বাপি আমার মা কোথায়? রাইয়ানের প্রশ্ন একটুও অবাক হয়নি আদনান। একঘন্টা পরপর একই প্রশ্ন করে রাইয়ান হয়তো মনে করে এক প্রশ্ন বারবার করলে উত্তর বদলে যাবে আদনানের। প্রতিবারের মতো এবারও একই উত্তর দিল আদনান, তোমার মা হারিয়ে গেছে বাবা। কোথায় হারিয়ে গেছে?
প্রতিবারের মতো এবারও চুপ করে রইলো আদনান। কি জবাব দেবে ও রাইয়ানকে। ও নিজেও কি জানে কোথায় হারিয়ে গেছে রাই। কত খুজেছে কিন্তু মেয়েটা একরাতে উধাও না কোনো চিঠি না কোনো ফোন কিছুই না। পরিচিত সব জায়গায় খুজে দেখেছে ও না ওকে না ওর চাচাকে কাউকে পাইনি ও। পুলিশ এক দুদিন খুজে বলেছিল দেখুন কার না কার সাথে পালিয়ে গেছে। বলেই কেইস ফাইল বন্ধ। কিন্তু ও তো ওর রাই কে চেনে কিছুতেই ওর রাই এমন করবেনা। আজও খুজে যাচ্ছে ও ওর রাই কে। রাইয়ানের ডাকে সম্বিৎ পেয়ে ওর দিকে তাকালো আদনান।
রাইয়ান বলছে, তুমি কেদোঁনা বাপি আমি আর মার কথা জানতে চাইবো না। এতক্ষনে ওর খেয়াল হলো চোখ থেকে অনবরত পানি পরছে ওর। রাইয়ের কথা ভাবলেই নিজের অজান্তে চোখে পানি চলে আসে আদনানের। রাইয়ান কে কোলে নিয়ে ওর কপালে একটি ভালোবাসার পরশ এঁকে দিয়ে ওকে ঘুম পাড়াতে থাকে আদনান। আর ভাবতে থাকে ওর আর রাইয়ের কথা। এইতো সেদিন কলেজ মাঠে রাইয়ের কোলে মাথা রেখে ভবিষ্যৎের সপ্নে বিভোর ছিল ও। আর আজ কোনো এক অজানা ঝড়ের কবলে পরে ওর সব সপ্ন ধুলিস্যাৎ হয়ে গেছে। কলেজ জীবনের স্মৃতি গুলো ওর জীবনের একটা রঙিন অধ্যায়। ও আর রাই এতুটুকুই ছিলো ওদের পৃথিবী।
রাই ছিল বেশ গরীব পরিবারের মেয়ে। শুধু মা আর চাচার সাথে থাকে ও। এটুকুই জানতো আদনান রাইয়ের সম্পর্কে। আর আদনান বাবা মায়ের একমাত্র সন্তান। বাবার বিশাল ব্যাবসা আর সম্পত্তির একমাত্র উত্তরসুরি। কেনো ও রাইকে ভালোবেসেছিল তা ও আজও জানেনা। জানার চেষ্টাও করেনা। ভালোবাসতে তো কোনো কারণ লাগেনা। অসম্ভব সুন্দরী ছিল তার রাই। কলেজের সব ছেলেরাই রাই বলতে পাগল।কিন্তু ও তো রাইয়ের সৌন্দর্যের পুজারি কোনো কালেই ছিলনা। রাইয়ের চোখের সরল চাহনি মুখের মিষ্টি হাসিই তো বেশি নজর কেড়েছিল ওর। রাইয়ের যে ওকে ভালো লাগতো না তা নয়। কিন্তু নিজেকে সবসময় গুটিয়ে রখতো ও। তারপর একদিন রাতের আধাঁরের মতো নেমে এসেছিল ওর জীবনে রাইয়ের অজানা রহস্য।
কিন্তু সেদিন ও রাইকে ছেড়ে দেয়নি বরং আরো শক্ত করে জড়িয়ে নিয়েছিল। হ্যা রাই ছিল এক নিসিদ্ধ নগরির বাসিন্দা। যদিও সেই পাপ ওকে কোনোদিন স্পর্শ করতে পারেনি ওর মায়ের কারণে। ওর মা নিজেকে ধ্বংস করে রাইকে বাচিঁয়ে রেখেছিল শকুনিদের হাত থেকে কিন্তু আর কত মেয়ের চাহিদা ছিল মায়ের থেকে বেশি। তারপর আর কি রাইকে সেই অন্ধকার থেকে নিজের আলোর জগতে আনতে পেরেছিল আদনান যদিও আদনানের পরিবার সমাজ এর বিরুদ্ধে ছিল। তাতে আদনানের কি রাইকে নিয়ে নিজের আলাদা সুখের জগতের সৃষ্টি করেছিল ও। প্রথম দিকে একটু কষ্ট হলেও ফ্যামিলি ব্যাগরাউন্ড আর বাবার দেওয়া ওর সম্পত্তির ভাগ হিসাবে বেশ কিছু টাকা দিয়ে মাত্র দুবছরেই নিজের ব্যাবসা দাড় করাতে পেরেছিল আদনান। খুব সুখের ছোট্ট সংসার ছিল ওদের। সেই সংসারটা পরিপূর্ণ করতেই ওদের কোলে এসেছিল রাইয়ান। কিন্তু ওদের সুখে আবার কালো আধাঁর নামতে দেরি করেনি। একদিন অফিস থেকে ফিরে আদনান আর খুজে পাইনি রাইকে। আজ চার বছর ধরে রাইয়ের সন্ধানেই কাটছে ওর। না ফিরে যায়নি ও বাবা মায়ের কাছে কোনোদিন যাবেও না। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত সন্ধান চালিয়ে যাবে ও রাইয়ের।
আপা তুই এইটা কি করলি?
যা করেছি ভালো করেছি এখন মরতেও আমার আপত্তি নেই। এতদিন শুধু সুযোগ খুজেছি কাজটি করার। আজ ফাইনালি করতে পেরেছি। শান্তি লাগছে খুব।
এখন কি করবা এই লাশ তো পইচা গইলা গন্ধ ছড়াইবো। তহন তো সবাই জাইনা যাইবো।
তোরা সময় থাকতে বেরিয়ে পর। এই নিসিদ্ধ কারাগারে থেকে আর নিজেদের নষ্ট করিস না। জানি বাইরের জগৎটা সহজ হবেনা। লোকজন কথায় কথায় আঙুল তুলবে। কিন্তু কয়েকদিন টিকে থাকতে পারলেই সবাই সব ভুলে যাবে।
আর তুমি কি করবা আপা?
আমি? আমার এ জীবনের এখন আর কোনো মুল্য নেই। আমার দেহ নষ্ট হয়ে গেছে। যে দেহ বাচাঁতে আম্মা নিজেকে শেষ করেছিল। যে দেহ বাচাঁতে একজন সব ছেড়েছিল। সে দেহ আর বেচেঁ নেই। নষ্ট হয়ে গেছে। এই নষ্ট দেহ নিয়ে বেচেঁ থাকার অধিকারও নেই আমার আর।
বলেই হাতের ছুরিটা মাটিতে ফেলে গায়ের ওপর বোরকা জড়িয়ে বেরিয়ে গেল রাই। এখন ও আর রাই নেই রাধিকা হয়ে গেছে। নিসিদ্ধ নগরির সবথেকে এক্সপেনসিভ মেয়ে। ওর চলার পথে তাকিয়ে আছে ওর মতই কিছু হতভাগিনীরা।
রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়াচ্ছে রাই। মরার আগে একবার অন্তত স্বামী সন্তানের মুখ দেখতে চায় ও। কিন্তু বহুদিন যাবত চারদেয়ালে বন্দি থাকায় বাইরের জগতে অনেক কিছুই ভুলে গেছে ও। সেদিন আদনান অফিসে বেরিয়ে গেলে ওর চাচা এসেছিল বাড়িতে সাথে কয়েকজন লোক ওকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে ওকে বেহুশ করে ফেলেছিল ওর চাচা। হুশ ফিরলে নিজেকে একটা নোংরা ঘরে বন্দি অবস্থায় আবিষ্কার করল রাই। প্রতিদিন ওর ওপরে চলত অমানবিক অত্যাচার। চেতনা নাশক ইনজেকশন দিয়ে কত শত পুরুষ ওর ওপর হামলে পড়েছে হিসাব নেই। মা মারা যাওয়াতে চাচার নাকি অনেক লস হয়েছিল সেটা পোশাতেই ওর চাচার এই সুক্ষ ব্যাবস্থা। এইতো কিছুদিন আগে সব মেনে নেয়ার নাটক করে চাচাকে হাত করে ঘরের বাইরে যাতায়াত হয়ে ছিল ওর। আর কাল সেই চাচাকে ছুরি দিয়ে ইচ্ছামতো কুপিয়ে বেরিয়ে এসেছে ঐ নিসিদ্ধ নগরি থেকে। হঠাৎ অতি পরিচিত গলা আর নিজের ছেলের নাম শুনে ফিরে তাকালো রাই। রাস্তার মাঝ বরাবর একটা বাচ্চা দাড়ানো উল্টো পাশ থেকে একটা গাড়ি সজোরে এগিয়ে আসছে। আর কিছু ভাবতে পারলো না রাই ছুটে গিয়ে জরিয়ে ধরলো ও বাচ্চাটিকে।
আদনান রাইয়ান কে নিয়ে বেরিয়েছিল শপিংয়ে। আইসক্রিম কিনে রাইয়ানের হাতে ধরিয়ে টাকা দেওয়ায় ব্যাস্ত ছিল আদনান সেই ফাকেঁ রাইয়ান হাটতে হাটতে রাস্তার মাঝে এসে গেছিলো। যখন আদনানের খেয়াল হলো অনেক দেরি হয়ে গেছে ততক্ষনে। নিজের জীবনের দ্বিতীয় আলোকে হারানোর ভয়ে যখন কুকড়ে গেছিলো তখনই কোথা থেকে বোরকা পরা এক মহিলা বাচিঁয়ে নিল ওর দ্বিতীয় আলোকে। এগিয়ে গিয়ে রাইয়ানকে কোলে নিয়ে মহিলার দিকে তাকালো আদনান। এটা কি করে সম্ভব এত বছর ধরে যাকে খুজছে অবিকল সেই রাইয়ের চোখ না ওর ভুল হবার নয়। এ যে ওর রাই। রাইকে দেখে অটোমেটিকলি ওর মুখ দিয়ে বেরিয়ে এলো, রাই তুমি?
রাই আদনানের কথা শুনে চলে যেতে নিলেই খপ করে ওর হাত ধরে বসল আদনান। ওকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে টানতে টানতে গাড়িতে নিয়ে বসালো ওকে। সবাই নিজেদের নিয়েই ব্যাস্ত ওদের দেখার মতো ইচ্ছা বা সময় কারোই নেই। বাড়িতে এসে দুজনেই চুপ করে বসে আছে। হঠাৎ রাইয়ান বাবাকে প্রশ্ন করলো, এটা কে বাপি? ছেলের দিকে তাকিয়ে আদনান বলল, ও তোমার মা। মায়ের কথা শুনেই দৌড়ে গিয়ে জড়িয়ে ধরল রাইয়ান রাই কে। এতদিন পরে ছেলেকে বুকের মাঝে পেয়ে এক মুহুর্তের জন্য সব ভুলে গিয়েছিল রাই। রাইয়ান টেনে মায়ের মুখের নেকাবটা খুলে দিল। মুখে ছোপ ছোপ রক্ত দেখে রাইয়ান বলল, মা তোমার কি কেটে গেছে রক্ত কেনো? অমনি সব মনে পড়ে গেলো রাইয়ের।
হঠাৎ খুব বিব্রত হয়ে গেলো ও। আদনান বুঝতে পারল বড় কিছু ঘটেছে। তাই বলল, ও কিছু না বাবা লাল রং লেগেছে বোধহয়। তুমি এসো ঘুমাবে মা অনেক দুর থেকে এসেছে তো মা ও ঘুমাবে। বলেই রাইয়ান কে কোলে নিয়ে অন্য রুমে গিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিয়ে আবার রাইয়ের কাছে ফিরে এলো আদনান। রাইয়ের পরনে এখনো বোরকার বাকি অংশ রয়েছে। দৃষ্টি শুন্য। ওর পাশে বসতে বসতে আদনান বলল, আমি জানিনা এত বছর কই ছিলা জানতে চাইও না। কিন্তু একবার যখন পেয়েছি আর হারাতে দেবোনা তোমাকে। আমি যে আর আগের রাই নেই আদনান রাই মরে গিয়ে রাধিকায় পরিণত হয়েছে। নষ্ট হয়ে গেছে তোমার রাই। মানে?একে একে সব খুলে বলল রাই আদনানকে। সব শুনে আদনান বলল, দেখো রাই তোমার সব সত্যি যেনেই ঐ অন্ধকার জগৎ থেকে তোমাকে নিয়ে এসেছিলাম। ভালোবাসি তোমাকে সে তুমি যা ই হয়। নিজের উপর রাগ হচ্ছে ভালোবাসার মানুষটাকে আগলে রাখতে পারিনি আমি। কিন্তু আর না এবার আবার নতুন করে শুরু করব আমরা।
শুরু করবো বললেই তো আর শুরু করা যায়না আদনান। তুমি আমাকে মেনে নিয়েছো বলে তো আর তোমার সোসাইটি মেনে নেবেনা এর আগেও কম কথা শোনাইনি তোমার সোসাইটি। কিন্তু এবারের অপরাধ গুরুতর। আমরা নাহয় সব সহ্য করে থাকতে পারবো কিন্তু রাইয়ান ওরই সামনে যখন ওর মায়ের সত্যতা নিয়ে সবাই কথা শুনাবে ওর ওপর দিয়ে কি যাবে ভেবে দেখেছো। চিন্তা করো না এই সমাজ এই সোসাইটি ছেড়ে অনেক দুরে কোথাও চলে যাবো আমরা। থাকবো না আর এখানে। আমার কাউকে লাগবেনা শুধু একটু আলো লাগবে। যেটা তুমি আর রাইয়ান।
যতই পালাই আমরা অতীত কি আমাদের পিছু ছাড়বে।
অতীতকে আমরা এই দেশে এইখানে ফেলে রেখে ভিনদেশে পাড়ি জমাবো। যেখানে সবাই নিজেদের লাইফ নিয়েই ব্যাস্ত। যেখানে এখানকার মতো সোসাইটির বেড়াজাল নেই। সত্যি যেতে পারবে সব ছেড়ে। জানো যখন ওখান থেকে বেড়িয়ে এসেছিলাম বাচাঁর বিন্দুমাত্র ইচ্ছা ছিল না কিন্তু তোমাকে আর রাইয়ান কে দেখার পর তোমাদের নিয়ে বাচঁতে খুব ইচ্ছা করছে।আমার আধাঁর জীবনে আলো তোমরা। আমি আর অন্ধকারে থাকতে পারবোনা আদনান। বলেই আদনানকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল রাই।বন্দি জীবন থেকে বেড়িয়ে এসে যে আলো ও পাইনি এখন সে আলোর দেখা পেয়েছে ও। কিছুতেই হারাতে দেবেনা এ আলোকে ও।