একই বেঞ্চের দুই প্রান্তে দুইজন চুপচাপ বসে আছে। মনে হচ্ছে এখানে ওরা নিরবতাপালন করতেই এসেছে। কিছুক্ষণ পরে মিতু বলে উঠলো,
– আচ্ছা রফিক, তুই কি আমায় সত্যিই ভালোবাসিস?
— হুম, ক্যানো তাতে কোনো সন্দেহ আছে তোর?
— আছেই তো, আমি দেখা করার কথা বললে কোনদিন তুই সময় মতো এসেছিস বলতো, কমপক্ষে আধা ঘন্টা দেরি হবেই হবে তোর, কিন্তু কেন ?
— হা,হা,হা” এই কথা?
— হাসছিস না, মিথ্যুক, ভন্ড, পাজি!
–হুম, মিথ্যুক, ভন্ড আর পাজি হলেও, প্রত্যেকবারই ঠিক সময় এসে আড়ালে দাড়িয়ে, ঐ সময়টুকু তোকে দুচোখ ভরে দেখি।
— ক্যানো, লুকিয়ে দেখতে হবে ক্যানো?
— লুকিয়ে লুকিয়ে যখন দেখি তুই আমার অপেক্ষায় পথ চেয়ে আছিস, তখন মনে হয় আমি কতো ভাগ্যবান, আমার পথ চেয়েও কেউ বসে থাকে, মনে হয় জীবন আমার ধন্য, তোর ভালোবাসা পেয়ে।
— হইছে হইছে, এবার থাম।
— বিশ্বাস কর মিতু, ধীরে ধীরে আমি তোর প্রেমের নেশায় এতটাই আসক্ত হয়ে গেছি যে, তোকে হারালে হয়তো পাগল হয়ে যাবো, নয়তো পৃথিবী ছেড়ে চলে যাবো।
— এবার তুই থামবি রফিক, একটা কথা জেনে রাখ, তোকে হারালে আমি নিজেই পৃথিবীথেকে চিরতরে হারিয়ে যাবো।এবার দুজনেই এগিয়ে এসে একেবারে গায়েগায়ে মিশে বসলো। মিতু শপিং ব্যাগথেকে একটা শার্ট বের করে রফিকের হাতে দিয়ে বললো,
– দ্যাখ তো, তোর পছন্দ হয় কিনা। রফিক বললো,
– শোন, এভাবে তুই আর আমাকে ছোটো করিস না প্লিজ, তোকে কোনোকিছু দেবার ইচ্ছে থাকলেও উপায় নেই আমার, তাই তোর কাছ থেকে কিছু নিতে ভিসন খারাপ লাগে আমার।
– মিতু বললো,
– আমি জানি তো, টিউশনি করে যা পাও, তাতে নিজের খরচাই হয়না। রফিক বললো,
– তবুও তুই ক্যানো টাকা খরচা করে আমাকে এ সব দিস।
— এগুলো আমি তোকে দেইনা, এগুলো দিয়ে আমি আমার স্বপ্নটাকে সাজাই, আর তোকে ঘিরেই আমার সেই স্বপ্নের পৃথিবী।
— আর তুইজে আমার পৃথিবীতে সূর্য, তোকে ছাড়া আমার জীবনটাও যে মূল্যহীন, সেটাকে বলবে।
— ক্যানো, তুই নিজের মুখেই বলবি, তোর মুখে ঐ কথাগুলো শুনতে আমার খুবই ভালোলাগে। এভাবেই দিন যায়, দুজনার ভালোবাসা অতলগভীরতার সিমাও ছাড়িয়ে যায়। প্রায়দুবছর পরে, একদিন আবারও দুজন পার্কেদেখা করতে আসে। মিতুর মুখে দুঃখ, কষ্ট,বিষণ্ণতা, আর হতাশার ছায়া স্পষ্ট। মাথা নিচু করে বসে আছে মিতু। রফিক আলতো করে মিতুর মাথায় হাত বুলিয়ে বললো,
– কিরে কি হয়েছে তোর, শরীর খারাপ ?। মিতু মাথা তুলে রফিকের দিকে তাকালো, দুচোখে জল টলমল করছে, ভাঙা ভাঙা গলায় রফিকের হাত শক্ত করে ধরে মিতু বললো,
– এখন থেকে আমার স্বপ্নটা মনে হয় আমার আরসাজিয়ে রাখার সৌভাগ্য নেই রে, তুই আমায় কথা দে, আমার স্বপ্নটা তুই সুন্দর ভাবে এই পৃথিবীতে বাচিয়ে রাখবি!। এই বলে উঠে দাড়িয়ে, রফিকের কপালে একটা চুমু দিয়ে কাদতে কাদতে চলে গেল মিতু। রফিককিছুই বুঝতে পারলোনা, হঠাৎ মিতুর মুখে এই কথা শুনে যেন বাকশক্তি হারিয়ে নির্বাক রফিক। কিছু বলতে চেয়েও বলতে পারছেনা, তবে মিতুর চোখে জল দেখে, নিজের চোখের জল আর আটকে রাখতে পারলোনা রফিক।
–পরে খোজ নিয়ে জানতে পারে, মিতুরর দুটো কিডনি-ই নষ্ট হয়েগেছে, এখন সে হাসপাতালে।
— এদিকে আজ অনেকদিন ধরে হাসপাতালের বেডে শুয়ে ক্রমে ক্রমে মৃত্যুর পথে এগিয়ে যাচ্ছে মিতু। বেচে থাকতে হলে অন্তত একটা কিডনি প্রয়োজন। অনেক চেষ্টা করেও মিতুর আত্মীয় স্বজন একটা কিডনির ব্যাবস্থা ও করতে পারেনি। মিতু বিছানায় সুয়ে সুয়ে রফিকের কথাই ভাবছে,- আজ এতদিন হয়ে গ্যালো, রফিকের একটি বারের জন্যও আমাকে দেখতে এলোনা, এই কি আমার প্রতি ওর ভালোবাসা, নাকি স্বপ্নটা শুধু আমিই দেখতাম, ওর কোনো ইচ্ছেই ছিলনা।
–এসব ভেবে ভেবে মিতু ফুপিয়ে কাদতে কাদতে নিজের বুকের ভেতর দুঃখের নদীতে কষ্টের বন্যা বইয়ে দিলো। ভাগ্য ভালো বিধায় কয়েকদিনের মধ্যেই একটা কিডনি পাওয়া গেল। অপারেশন হলো, মিতু এখন সুস্থ প্রায়। কিন্তু রফিকের কোনো খবর নেই। রফিকেরপ্রতি মিতুর ভালোবাসা এতদিনে ঘৃণা আর অভিমানে পরিণত হয়েছে।
–কয়েকদিন বাদে মিতু সেই পার্কে আসলো, যেখানে রফিক আর মিতু দেখা করতো। আশ্চর্যের বিষয়, ওরা যেবেঞ্চে বসে কথা বলতো, সেই বেঞ্চের কাছে আসতেই মিতু দেখলো, রফিক বসে আছে, হয়তো কারো অপেক্ষায়।
–মিতু রফিকের সামনে এসে দাড়ালো। মিতুকে দেখে রফিকফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলো মিতুর দিকে।
— মিতু বললো,- কি, খুব অবাক হয়ে যাচ্ছো তাইনা, আমি এখনও বেচে আছি তাই দেখে!
— আমি তোমাকে সত্যিই ভালোবাসি মিতু !
— চুপ করো, তোমার মতো বেইমান বিশ্বাস ঘাতকের মুখে ভালোবাসি শব্দটা শোভা পায়না।
–তুমি আমাকে ভুল বুঝনা বলে রফিক মিতুর হাত ধরতেই, মিতু রফিকের গালে একটা থাপ্পর মেরে বললো,
– কোন অধিকারে তুমি আমার হাত ধরো?।
— রফিকের চোখের জল উপছে পড়তে চাইছে। হাত দিয়ে চোখের জলমুছলো রফিক।
–নিজেকে সামলে নিয়ে রফিক বললো,
— তোমার সেই সুখের স্বপ্নটা এখন তোমার কাছে খুব বিরক্তিকর তাইনা?।
–প্রচণ্ড কাশি শুরু হলো রফিকের।
–পেটে হাত দিয়ে কাশতে কাশতে নুয়ে পড়লো রফিক।
–কোমরের দিকের শার্টের কিছু অংশ রক্তে লাল হয়ে গেল।
–মিতু ধরতে চাইলে রফিক বললো,
— আমি ঠিক আছি, আমাকে ধরলে তোমার হাতে এই বেইমানবিশ্বাস ঘাতকের রক্ত লাগতে পারে।
–রফিকের এই অবস্থা দেখে মিতুর হৃদয়টাহাহাকার করে উঠলো।
–রফিকের জামা উল্টে রক্ত বের হবার কারণ খুজতে চাইল মিতু।
–রফিক বাধা দিলো।
— কিন্তু মিতু জোর করে রফিকের শার্টটা তুলে ধরতেই দেখলো, রফিকের কোমরের কাছাকাছি ডান পাশে একটি অপারেশনের দাগ।
–মিতু এবার জ্ঞান হারিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়লো। মিতুর আর বুঝতে বাকি ছিলনা, যে কিডনিটার জন্য মিতু বেচে আছে, সেটা আর কারো নয়, রফিকের-ই।
–জ্ঞান ফিরতেই মিতু রফিকের পা জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেদে উঠলো-”
–আমাকে তুমি ক্ষমা করে দাও রফিক, আমি তোমাকে ভুল বুঝেছি, অনেক বড় অন্যায় করেছি”।
–মিতুকে তুলে বুকে জড়িয়ে ধরে রফিক বললো,
–অপারেশনের পড়ে ঘা শুকানোর জন্যে ডাক্তার কিছু ওষুধ লিখে দিয়েছিলো, টাকা ছিলনা তাই খেতে পারিনি, তবে এই যন্ত্রণা আমার কাছে মধুর। এই যন্ত্রণার কারণেই আমার ভালোবাসা বেচে আছে।
— আর তুমিই তো বলেছিলে আমি তোমার স্বপ্নে, তাই তুমি বেচে না থাকলে তোমার স্বপ্নটা বেচে থাকবে কার চোখে।।।
সমাপ্ত