অসমাপ্ত গল্প

অসমাপ্ত গল্প

আপনার জন্য খাবার পাঠিয়েছে মা ” অবাক হয়ে গেলাম খানিক!! নিহিন কখনো আমার জন্য কিছু নিয়ে আসে না। মানে সব সময় ওর ছোট ভাইটা নয়ত ওদের কাজের বুয়া এসে দিয়ে যায় যখন আন্টি আমার জন্য কিছু পাঠায়। তবে আজ ও!

” জ্বি আমি তো বাইরে থেকে খেয়ে এসেছি, থাক রেখে দিন সকালে খেয়ে নিবো ”
” সকালে খাবেন! কিন্তু সকালে তো এটা বাসি পচাঁ হয়ে যাবে ”
” আমার ওসব খাওয়ার অভ্যাস আছে ”
” ভালো অভ্যাস নয়, আপনার পেট ভরা থাকলেও খাবেন ”
” আচ্ছা রেখে দিন খেয়ে নিবো ”

মেয়েটাকে মিথ্যে বললাম। যদিও আমি বাইরে থেকে শুধু এক কাপ চা আর একটা রুটি খেয়েছিলাম। তবুও ভাত খাবার ক্ষুধা টা রয়েই গিয়েছিলো।

” আমি সকালে এসে আপনাকে ব্রেকফাষ্ট দিয়ে যাবো ”
” আমি বাইরে থেকে করে নেবো ”
” আমি দিয়ে যাবো ”

আর কিছু বললাম না। মেয়েটা অামার ঘর থেকে বেড়িয়ে গেলো। কিন্তু দড়জার সামনে গিয়ে কিছু সময় দাড়িয়ে থাকলো। আমি তাকিয়ে বললাম ” আচ্ছা সময় মত খেয়ে নেবো “। তবুও মেয়েটা দাড়িয়ে থেকে, হুট করে দৌড় দিলো! মেয়েটার কান্ডে আমি মাঝে মাঝে অবাকই হয়ে যাই। প্রথম দু বছরে তো আমার সাথে কথাই বলেনি, কিন্তু একদিন যখন ভাড়া দিতে গেলাম সেদিন বাসায় কেউ ছিলো না শুধু ও ছাড়া। তাই নিজেই কথা বলে ভাড়া টা দিয়ে এসে ছিলাম। এরপর প্রায়ই দেখতাম যখনই অফিসে যাবো মেয়েটা তাদের ফ্লাটের দড়জাটা’র আড়ালে দাড়িয়ে থাকত। আর ইদানিং দেখি সেই একই তবে খুক খুক কাশি দেয় আর তাকিয়ে থাকে। মেয়েটির এমন কাজে একটু অস্বস্তি হত আমার তাই জিগ্গাসা করতাম কিছু বলবে কিনা। তবে ব্যাপার টা একটু বেশিই মনে হচ্ছিলো আমার।

সেদিন ওরা ফ্রেন্ডস’রা মিলে ছাদে আড্ডা দিচ্ছে তখন তার এক বান্ধবী আমার দিকে তাকিয়ে বলে উঠলো “ওভাবে একপাশে দাড়িয়ে থেকে লাভ কি যদিনা পাশে তার ভালবাসার মানুষটা না থাকে”। আমি কিছুই বললাম না। অন্য এক বন্ধু বলে উঠলো “দোস্ত তোর প্রেমিক টা বোধ হয় গাধা, সব কিছু বুঝেও কেমন যেন বোঝেনা, এর থেকে তো তানভীর অনেক ভালো”।নিহিন ওর ফ্রেন্ডসদের চুপ করতে বলে। আমি আমার নিজের মত থাকতে চেষ্টা করি। এক সময় আমারও এমন অনেক বন্ধু ছিলো। নতুন নতুন কলেজে উঠে অনেক বন্ধু বান্ধবী বানিয়েছিলাম। আমার আড্ডা, দুষ্টুমি, আর একটু অতিরিক্তের কারনেই আজ আমার জীবনটা এমন হয়েছে। ” এই যে শুনুন না? ” নিহিন আমার পেছন থেকে বলে কথাটা। অন্যদিকে ওর ফ্রেন্ডরা চিৎকার দিয়ে বলে ” আহা জুলিয়েট রোমিওর সামনে গিয়ে আহা কি লাজুক ভাবে কথা বলছে রে।

” আসলে ওরা না খুব দুষ্টু আপনি কিছু মনে করবেন না।
” আমি কিছু মনে করিনি ”
” আচ্ছা আপনি কি কিছুই বোঝেন না? ”
” তানভীর টা কে আপনার বয়ফ্রেন্ড? ”
” ছিলো এক সময়, এখন হয়ত আমি পুরোনো হয়ে গেছি, তাই চলে গেছে ”
” ওহ ”

মনটা খারাপ করে বন্ধুদের দিকে চলে যায় নিহিন। আমি ফোনটা বের করে ফেসবুকে লগইন করি। আমার সাধারনত মেসেজিং করতে ভালো লাগেনা। তবে অবসরে আমি গল্প লেখি, দুঃখের গল্প, কষ্টের গল্প কারন এগুলোই আমার জীবন। রোজের মত আজও নিহিন দড়জার আড়ালেই দাড়িয়ে আছে। আমি ওর দিকে না তাকিয়ে সোজা নেমে গেলাম। ছাদের এক কোনের ঘরটায় আমি থাকি সবার থেকে আলাদা একটা স্থানে যেখানে কেউ আমাকে বিরক্ত করেনা। আর আমি নিজেও বিরক্ত হতে চাইনা…রাত আট টা বাজে। বাইরে খুব ঠান্ডা। একটা পুরোনো চাদর জড়িয়ে বসে টিভি দেখছি। এমন সময় দড়জটায় টোকা দেয়ার শব্দ শুনে খুলে দিলাম। দেখি নিহিন দাড়িয়ে আছে।

” কিছু বলবেন? ”
” আদা দিয়ে চা খাবেন আমি খুব ভাল বানাতে পারি? ”
” ঠিক আছে ”

হুট করে দৌড়ে সিড়ি বেয়ে নিচে নেমে গেলো নিহিন। আমি দড়জাটা লাগিয়ে দিলাম। খুব শীত শীত লাগছে এমনি তেই। টিভি তে একটা সুন্দর সিনেমা দেখছিলাম সেই পুরোনো আমলের। আমার এখনো মনে পড়ে যখন আমি ক্লাস ২ এ পড়ি তখন এই সিনেমা টা প্রতি শুক্রবারে বিটিভি তে দিতো। বাবা যত সময় না অফিস থেকে ফিরতো ততো সময় দেখতাম। কিন্তু শুক্রবার বাবা খুব তাড়া তাড়ি আসতো তাই টিভি বন্ধ করে দৌড়ে গিয়ে বই নিয়ে বসতাম।
” দড়জাটা খুলুন, আমি চা নিয়ে দাড়িয়ে আছি ” নিহিনের গলা শুনে, দড়জাটা খুলে তার দিকে তাকাতেই লাজুক হাসি মুখে চায়ের কাপ টা এগিয়ে দিয়ে বলল “এই শীতে ছাদের ওপরে চাদর গিয়ে চা খাওয়ার মজাই অন্যরকম, আসবেন নাকি একবার ছাদে? ”

” খুব ঠান্ডা,,,তো ”
” কিচ্ছু হবেনা আসুন ”
” আসলে আমার ঠান্ডায় সমস্যা হয় ”

মেয়েটা মন খারাপ করে বলল “থাক আসতে হবেনা”। ধীরে ধীরে হেটে ছাদের এক কোনে দাড়ালো। আমি চায়ের কাপে চুমুক না দিয়ে, আগে টিভি টা বন্ধ করে দড়জাটা বাইরে থেকে চাপিয়ে, চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে তার পাশে দাড়ালাম।

” খুব মজা হয়েছে চা ”
” সত্যিই? ”
” হ্যা ”

চা শেষ করে কাপ টা হাতে ধরে রাখলাম। কিন্তু সে কাপটা আমার হাত থেকে নিয়ে তার হাতে রাখলো। আমি আমার চাদরটা আরো ঠিকভাবো জড়িয়ে নিলাম। হাত দুটো একেবারে বরফ হয়ে যাচ্ছে মনে হচ্ছে। চাদর টার কয়েক জায়গায় ছিঁড়ে গিয়েছিলো কিন্তু সিলিয়ে নিয়েছি, অনেক পুরোনো চাদর এটা, আমার মা দিয়েছিল। তাই আজও এটার মায়া ছাড়তে পারিনা। ওয়ারড্রবে এখনো এক জোড়া নতুন চাদর পড়ে আছে কিন্তু এটাই আমার প্রিয়। নিহিন আজ আবার সেরকম ভাবে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। মেয়েটির এভাবে তাকিয়ে থাকা টা আমার কেমন যেন লাগে। আমার খুব অস্বস্তি লাগে।
.
” আমি যদি আপনাকে একটা কথা বলি, কিছু মনে করবেন? ”
” মনে করার মত হলে করতেও পারি ”
” অনেক দিন ধরেই চেষ্টা করছি বলবো বলবো কিন্তু বলা হয়ে ওঠেনা,

কেনো যেন আপনার সামনে আসলে আমার হৃদয়ের কম্পন টা খুব জোরে ধাক্কা দেয়, পৃথিবীর সবার জন্য আমি খুব দুরন্ত হলেও আপনি সেই মানুষ যার সামনে আমি কখনো দুরন্ত হয়ে থাকতে পারিনা ” আমি খানিক কাশি দিয়ে বললাম ” আসলে আমি হয়তবা খুব অদ্ভুত প্রানী তাই আপনার এমন মনে হয় ” “না নাহ তা নয়, আসলে আপনাকে আমার কেমন যেন লাগে, মানে আমি নিজেও বুঝিনা, কেন যেন আপনার প্রতি আমার অন্যরকমের এক ধরনের আকর্ষন, মানে অন্যরকম। আমি সেটা বলতে পারিনা, আর বুঝাতেও পারবোনা ”

ব্যাপার টা অন্যদিকে এগোচ্ছে ভেবে আমি বললাম ” আপনার এখন নিচে যাওয়া উচিত হয়ত “। মেয়েটা থেমে গেলো। চুপ হয়ে গেলো সে। ছাদের ছোট দেয়াল টায় হেলান দিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে বলল “জানেন, একটা মানুষকে আমি ভিষন ভাবে ভালবেসে ফেলেছি, তাকে ছাড়া একটা মুহুর্তও কাটছেনা আমার। সারাদিন শুধু কাদতেই ইচ্ছে করে, অকারনেই কাদি আমি তখন মা জানতে চায় আমি কেন কাদছি, আগে বাবা অফিস থেকে ফিরলে একসাথে ডিনার করতাম ডাইনিং টেবিলে বসে, আর এখন সবার শেষে, সবার থেকে আলাদা ভাবে থাকি আমি। আমার নিজের কাছেই কেন যেন মনে হচ্ছে আমি সবার থেকে খুব দুরে হারিয়ে যাচ্ছি। আমার হাসি, সেই দুরন্ত জীবন, সব কিছু কার মাঝে যেন রয়েছে। আমি ফিল করি কাউকে আমার জীবনে খুব প্রয়োজন আমি কি পাবো সেই মানুষ টা কে কখনো? ”

উদাস হয়ে কথা গুলো বলে নিহিন। আমার কাছে শুধু তাকে শান্তনা দেযা ছাড়া আর কিছু বলার ছিলোনা। তবুও বললাম “আপনি চিন্তা করবেন না। আমি আপনার তানভীরের সাথে কথা বলবো, তাকে বোঝাবো আমি”।

” ওর সাথে কেন কথা বলবেন? ”
” আমি বোঝাবো যে আপনি তাকে খুব বেশি ভালবাসেন অন্য সবার থেকে ”
” আমি ওর কথা বলিনি ”
” তাহলে? ”
” আমি আপনার কথা বলেছি, আমি আপনাকে ভালবাসি, আপনাকে আমার চাই চাই ”
” এটা কখনো সম্ভব না ”

অবাক হয়ে বলে নিহিন ” কেন সম্ভব না। কেন পারবেন না, কি দোষ আমার। কি করেছি আমি যে আমাকে আপনি মেনে নিতে পারছেন না ” আমি স্বাভাবিক ভাবেই বলি “আমি আপনার মত এবং আরও আট দশটা মানুষের থেকে খুব আলাদা ভাবে জীবন যাপন করি। একটা সময় ছিল এই আপনার মতই একটা রঙিন জীবনের অধিকারী ছিলাম আমি। কিন্তু আজ আমার কাছে সে সব কিছুই নেই। সব হারিয়ে নিস্ব আমি। জীবনে অনেক কিছু দেখেছি, অনেক কিছু শিখেছি, শুরুতে সব ঠিক, শেষে সব কেমন সব ফিকে মনে হয়, তাই আমি এসব নিয়ে ভাবতে চাইনা, আমাকে এসবের থেকে রেহাই দিন, আমি আমার মত থাকতে চাই,নিজের মত করেই বাচতে চাই। তবুও যদি সেভাবে থাকতে না দেন তাহলে আমি আপনাদের বাসা টা ছেড়ে দেবো”

মাথা ঝাকিয়ে নিহিন বলে “না নাহ প্লিজ আপনি যাবেন না। আমি আর কিছু বলবো না, ভাল না বাসতে পারি, পাশে না পাই তবুও তো আপনাকে রোজ দেখতে পাই এটাই অনেক, আমি আর কখনো এসব বলবো না” কাদতে কাদতে দৌড়ে নিচে নেমে চলে যায় মেয়েটা। আমি একটা সিগারেট জ্বালিয়ে ধুয়ো গুলো আকাশে উড়িয়ে দেই। মাঝে মাঝে খুব ইচ্ছে হয় এই ধুয়ো গুলোর মত কষ্ট গুলোকেও বুক থেকে বের করে উড়িয়ে দেই যাতে আর কখনোই ফিরে না আসে, তবে কষ্ট গুলো কষ্টই হাজার দুরে সরাতে চাইনা কেনো? বুকের মাঝে সে বাসা বেধে থাকতেই ভালবাসে

গল্পের বিষয়:
দু:খদায়ক
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত