শেষ স্মৃতি

শেষ স্মৃতি

বারান্দায় বসে আছি আকাশের দিকে তাকিয়ে। আজ নীলকে খুব মনে পড়ছে। আরুশার ক্লাসের এক মেয়েকে তার বাবা আদর করতে দেখে সে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে বললো ,,,

— আরুশাঃ মা বাবা কি আর আসবেনা আমাকে আদর করতে?

মেয়ের কথা শুনে মন খারাপ হয়ে গেলো। খুব একা অনুভব করছি। যদিও আজ চার বছর জীবন সংগ্রামে একাই চলছি। তারপরও আজ মনে হচ্ছে আমি খুবই একা। নীলের সাথে আমার পরিচয় হয় আমার এক কাজিনের বিয়েতে। অনুষ্ঠান চলছে, বরের বাড়ি থেকে লোকজন এসেছে কনেকে হলুদ পড়াতে। আমি কাজিনদের সাথে বসে আছি হঠাৎ এক ছেলে এসে আমাকে বললো ,,,

— ছেলেটিঃ হাই, আপু আপনি কি কনেপক্ষ?
— আফরিনঃ কেনো কি মনে হয় আপনার?
— ছেলেটিঃ আপনি বললে কি সমস্যা আছে?
— আফরিনঃ আরে আজবতো, বরপক্ষের সাথে যাতে আসিনি তাহলেতো কনেপক্ষই তাইনা?
— ছেলেটিঃ আচ্ছা তাইতো। আমি নীল। আপনি?
— আফরিনঃ নীল মানে? কোথায় নীল? আমিতো দেখছি আপনি লাল পরে আছেন।
— ছেলেটিঃ হা হা হা আরে আমার নাম নীল। আপনার নামটা কি?
— আফরিনঃ ও আচ্ছা এটা বলবেনতো। আমি আফরিন।
— নীলঃ বাহ্ খুব সুন্দর নামতো। কিন্তু আপনি অনেকটা ফাস্ট মনে হয়।
— আফরিনঃ তাই নাকি? কি করে বুঝলেন?
— নীলঃ আপনার কথা শুনেই বুঝেছি।
— আফরিনঃ আমি কি এমন বলছি বুঝার মতো?
— নীলঃ যতটুকু বললেন ততটুকুতেই বুঝেছি। আচ্ছা আপনি কনের কি হোন?
— আফরিনঃ আমি খালাতো বোন।
— নীলঃ তাহলেতো ভালোই। আমিও সম্পর্কে বরের কাজিন।
— আফরিনঃ তোহ আমি কি করবো?
— নীলঃ না কিছুনা এমনি বলছি। আচ্ছা আপনি কি পড়াশুনা করেন?
— আফরিনঃ হুম, অনার্স ২য় বর্ষ।
— নীলঃ আমি মাস্টার্স শেষ করে একটা এনজিওতে জব করি।
— আফরিনঃ ভালো।
— নীলঃ আচ্ছা আবার দেখা হবে। আসি তাহলে।
— আফরিনঃ না হওয়াই ভালো।
— নীলঃ কিছু বললেন নাকি?
— আফরিনঃ না কিছু বলিনি।
— নীলঃ আচ্ছা আসি।

এই নীল লোকটার সাথে বিয়ের দিনও দেখা হয়েছে। কিন্তু আমি এড়িয়ে চলাতে কথা বলতে পারেনি।
একদিন কলেজ থেকে এসে দেখি আমার খালাতো বোন এসেছে আমাদের বাসায়। আমিতো অনেক খুশি, অনেকদিন পর আপুকে দেখলাম। ওনার সাথে একটা মহিলাও ছিলো। ওরা আমাদের বাসায় বিকেল পর্যন্ত ছিলো। অনেক বলেছি আপুকে থাকার জন্য কিন্তু থাকেনি মহিলাটার জন্য। মহিলাটা নাকি বাসায় চলে যাবে।

এর এক সপ্তাহ পর আমাকে দেখতে আসে। যদিও আব্বু, আম্মুর পছন্দমত আমি বিয়ে করবো তারপরও কেনো জানি খারাপ লাগছিলো। আমাকে নিয়ে যাওয়া হলো তাদের সামনে ছেলেকে দেখেতো, আমি যেনো আকাশ থেকে পড়লাম। এই যে সেই নীল রং। ওই দিনই ওরা আমাকে আংটি পড়িয়ে যায়।

আমি ভাবতাম যার সাথে বিয়ে ঠিক হবে তার সাথে এক/দুইমাস প্রেম করবো। কিন্তু কপাল যে খারাপ। দেখে যাওয়ার এজ সপ্তাহ পর আমাদের বিয়ে হয়ে গেলো।

বিয়ের দিন রাত ,,,

— নীলঃ কি হলো এভাবে লম্বা ঘোমটা দিয়ে বসে আছো কেনো?
— আফরিনঃ কি করবো তাহলে?
— নীলঃ ঘোমটা ফেলো একটু দেখি।
— আফরিনঃ কি দেখবেন? আচ্ছা আপনার মনে মনে কি এটাই ভেবে রেখেছিলেন?
— নীলঃ কি?
— আফরিনঃ এই যে আমাকে বিয়ে করাটা।
— নীলঃ হুম। আল্লাহরও ইচ্ছা ছিলো মনে হয়। এই শুনো আমাকে কিন্তু আপনি বলবানা।
— আফরিনঃ কি বলবো তাহলে? আর প্রথম প্রথম আপনি বলাটা আমার অভ্যাস।
— নীলঃ এতো কিছু জানিনা তুমি করে বলবা। তোমার কি পড়ার ইচ্ছা আছে?
— আফরিনঃ ছিলো। কিন্তু এখন কি সম্ভব?
— নীলঃ কেনো সম্ভবনা। আমি পড়াবো যতকুটু ইচ্ছা তোমার কিন্তু কোনো জব করা যাবেনা।
— আফরিনঃ আচ্ছা ঠিক আছে।(খুশি হয়ে)
— নীলঃ তাহলে কি বেবিটা ২বছর পরই আসবে।
— আফরিনঃ যাহ্। তুমিনা খুব দুষ্টু।

সে আমাকে ঠিিক পড়িয়ে ছিলো। আমার অনার্স শেষ হওয়ার পর আমাদের কোল জুড়ে একটা ছোট্ট পরীর আগমন ঘটে। নীলতো অনেক খুশি। আসলে বাবারা মেয়ে বেবিটাই বেশি পছন্দ করে মনে হয়। আমাদের পরীটার নাম রাখা হয় আরুশা। পরীটাকে নিয়ে তার বাবার অনেক স্বপ্ন। সে পরীটাকে ডাক্তার বানাবে। কিন্তু তা আর হলোনা। আরুশার যখন ২বছর আধো আধো ভাষায় আব্বু, আম্মু বলতে শিখেছে তখন নীল একটা এক্সিডেন্টে মারা যায়। আমার জীবনে নেমে আসে ভয়াভহ অন্ধকার। এইটুকু মেয়েকে নিয়ে কি করবো আমি! তা দেখে আমার মা, বাবা আমাকে আবার বিয়ে দিতে চেয়েছিলো। কিন্তু আমি পারিনি নীলের শেষ চিহ্ন আর তার স্মৃতিগুলোকে আড়াল করতে। তাই আর বিয়ে করিনি।

ভাগ্যক্রমে নীলের এক কলিগের মাধ্যমে নীলের চাকরিটাই আমি পেয়ে যাই। আর বেছে নিই এই সংগ্রামী জীবন। নীলের ছোট্ট পরীটাকে যে অনেক বড় করতে হবে তার স্বপ্নটা যে পূরণ করতে হবে। নীলের অস্তিত্ব নেই কিন্তু তার স্মৃতিগুলোতো আছে ওটাই আমার প্রেরণা। এসব ভাবতে ভাবতে কখন যে চোখ থেকে অঝোরে বৃষ্টি নামে বুঝতে পারিনি। হঠাৎ একটা ছোট্ট হাতের স্পর্শ অনুভব করি ,,,

— আরুশাঃ মা তুমি কাঁদছো কেনো? (চোখের পানি মুছে দিেত দিতে)
— আফরিনঃ কই মা নাতো কাঁদছিনা।
— আরুশাঃ মিথ্যে বলোনা মা। আমি দেখেছি কিন্তু। তুমি কি বাবার জন্য কাঁদছো?
— আফরিনঃ না মা এমনি। চোখে কি যেনো পড়েছে।
— আরুশাঃ আমি জানি মা। তুমি কেঁদোনা। তুমি কাঁদলে যে আমারও কান্না পায়। বাবা নেইতো কি হয়েছে আমিতো আছি, তোমার সব কষ্ট মুছে দেবো।

আমার কান্নাটা যেনো আরো বেড়ে গেলো। মেয়েকে জড়িয়ে ধরলাম। ঠিকিতো নীল নেই কিন্তু ওর পরীটাতো আছে। আরুশা এখন ক্লাস টুতে পড়ে। ওর সামনে আরো লম্বা পথ পাড়ি দিতে হবে। তার জন্য আমাকে ভেঙ্গে পরলে চলবেনা। আরো শক্ত হতে হবে। কারণ এটাই যে নীলের রেখে যাওয়া শেষ চিহ্ন আর আমার বেঁচে থাকার একমাত্র অবলম্বন।

গল্পের বিষয়:
দু:খদায়ক
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত