হারানো

হারানো

– দেখ আমি চাইছি তোরা আর না হয় কয়েকদিন সময় নে। আগে দেখ কি হয় না হয়। (জোবায়ের)
– তুইতো সবটায় জানিস। তবুও এই কথা বলছিস? (আমি)
– দেখ তোকে আমি অনেক ভালো করে চিনি।
– তুই কি এটা করতে পারবি? না পারলে বল আমি অন্য কারো কাছে যাচ্ছি।
– আর কিছু বলবো না। ধর পেপার নে। সব রেডি আছে। আর তোদের সই করা হলে আমাকে দিয়ে যাস দুই তিন দিনের মধ্যে।

জোবায়েরর চেম্বার থেকে বের হয়ে আসলাম। কোন গন্তব্য নেই। তাই ক্ষানিক বাদে চির চেনা সেই গাছের নিচে বসে পরলাম। চোখের সামনে দিয়ে নদীর ঢেউগুলো বাতাসের তালে ছুটছে। শুধু সামনের দিকে এগুচ্ছে। মনে হচ্ছে তার থামার বিন্দু মাত্র ইচ্ছে নেই। জীবনটাও এমন। পকেটে থাকা মোবাইলটা ভাইব্রেট হচ্ছে। বের করে দেখি সেই চেনা মুখটা স্ক্রিনে ভেসে উঠেছে। ধরার বিন্দুমাত্র ইচ্ছা নেই। কয়েকবার রিং হয়ে কেটে যাওয়ার পর পঞ্চম বারে ধরলাম।

– বলুন। (আমি)
– কোথায় আপনি? (পৌষি)
– বসে আছি।
– যেখানেই থাকুন না কেন একটু তাড়াতাড়ি বাসায় আসবেন।

টুট টুট টুট। ফোনটা আমি কেটে দিলাম। বটগাছের নিচে বসে আছি তাই নির্জন জায়গা বলা যায়। তাই কেন জানি অতীতটাকে খুব মনে পড়ছে।  আমি হিমেল। সাধারন ঘরের ছেলে। মোটামুটি ভালো একটা জব করি। বাবা, মা ছোট বেলাতেই মারা গিয়েছে। নানুর কাছে মানুষ। তার জোরাজুরিতে বিয়ে করতে বাধ্য হয়েছি। অবশ্য ছোট থেকে যে যার বাধ্য ছিলাম তা নয়। বিয়ে করা দরকার তাছাড়া মেয়েটাকে দেখতে গিয়েই ভালোবেসে ফেলেছি তাই না করি নি। মেয়েটার নাম পৌষি। দেখতে খুব সুন্দরী সেটা বলবো না। তবে আমার কাছে সেই শ্রেষ্ঠ সুন্দরী। আজ আমাদের বিয়ের প্রথম রাত। নির্দিষ্ট সময়ে নিজের ঘরে গেলাম। মেয়েটা খাটের এককোনাতে বসে ছিল। সবাই বলে প্রথম রাতে মেয়েরা নাকি পা ছুয়ে সালাম করে। তাই আমিও বেশ ক্ষানিক দাড়িয়ে ছিলাম মনে হয়েছিল সালাম করবে না। তাই বিছানার পাশে গিয়ে বসতেই বলে উঠলো..

– আপনাকে কিছু বলার ছিল। (পৌষি)
– জ্বী বলুন। (আমি)
– দেখুন আমাদের বিয়েটা তো হুট করে হয়েছে।
– জ্বী।
– আমরা নিজেরা নিজেদের চিনিও না।
– জ্বী।
– তাছাড়া আমার আপনাকে পছন্দ হয় নি।
কথাটা শুনে আকাশ থেকে পড়লাম। তাও উত্তর দিলাম
– আমি বুঝতে পেরেছি আপনি কি বলতে চাইছেন। সমস্যা নেই ঘুমিয়ে পড়ুন।
– আপনি কি এখানে ঘুমোতে
– না না আপনি বিছানাতে শয়ে পড়ুন। আমি না হয় শোফাতে শুয়ে পড়বো।

পৌষি শুয়ে পড়েছে। আমি বারান্দাতে দাড়িয়ে আছি। হালকা হালকা বৃষ্টি পড়ছে। শুনেছিলাম এমন দিনে বৃষ্টি হওয়া নাকি ভালো। হয়তো কারো কারো কপালে এটা হয় না। আকাশে মেঘ থাকা সত্বেও ল্যাম্পপোস্টের আলো রুমে ঠিকই আসছে। আলোর ছটাতে মেয়েটার মায়া ভরা মুখটা দেখে কেন জানি আরো বেশি করে ভালোবাসতে ইচ্ছে করছে। দেয়ালের দিকে তাকিয়ে দেখি রাত ২:২৫ বাজে। বাহিরে আবারো ধীরে ধীরে বৃষ্টি শুরু হয়েছে। হয়তো পরে সব ঠিক ঠাক হয়ে যাবে। হয়তো আমাকে ভালোবাসবে। সকালে পৌষির ডাকে ঘুম ভাঙ্গলো। রাতে ছাদের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছি নিজেও জানি না। সকালে ঘুম থেকে উঠেই বললাম…

– আপনাকে একটা কথা বলার ছিল। (আমি)
– হুম বলেন। (পৌষি)
– আমাদের মাঝে যে কোন সম্পর্ক নেই সেটা এই চার দেয়ালের মাঝে রাখাই ভালো।
– হুম।

কি কপাল! বিয়ে করার আগে যদি জানতাম পছন্দ করে না তাহলে বিয়েই করতাম না। তবে এখন আর কিছু করার নেই। পৌষির ছোট ভাইয়ের কাছে থেকে শুনেছিলাম পৌষির কি কি পছন্দ। চকলেট আর নীল গোলাপ নাকি তার খুব পছন্দের। তাই মাঝে মাঝেই রাতে বাসাতে যাওয়ার সময় চকলেট নিয়ে যেতাম তার জন্য। কিন্তু কোনদিনই মনে হয় খেত না কারন পরেরদিনই সেটা ময়লার ঝুড়িতে দেখতে পেতাম। তবুও নিয়ে যেতাম। মাঝে মাঝে নীল গোলাপটাও পেলে নিয়ে যেতাম এটারও একি অবস্থা হয়।

– আজকে অফিস থেকে ছুটি নিয়েছি। (আমি)
– তো কি করবো? (পৌষি)
– বিকেলে কোথাও থেকে ঘুরে আসি যদি চান?
– সময় হবে না।
– কেন? কোথাও যাবেন?
– দুপুরে ভার্সিটিতে ক্লাস আছে আসতে বিকেল হয়ে পড়বে।
– আজকে ক্লাস না করলে হবে না?
– আপনার সাথে ঘুরার চেয়ে ক্লাসই আমার কাছে গুরুত্বপূর্ন।
– ওও আচ্ছা। সাবধানে যাবেন।
– আপনার না বললেও চলবে।

পৌষি চলে গেল। কেন জানি মেযেটা আমাকে দেখতেই পারে না। তবুও অপেক্ষাতে থাকি যদি ভালোবাসতে পারে। মাসখানেক পর নানু মারা যায়। পৃথিবীতে সেও আমাকে ছেড়ে চলে গেল। এখন আমি একা হয়ে পড়েছি। তখন আমার পাশে হয়তো পৌষির থাকাটা উচিত ছিল। কিন্তু সেও ছিল না। আজোও নেই। হয়তো থাকবেও না।
আযান দিচ্ছে। মোবাইলের দিকে তাকিয়ে দেখি ৬:৪৩ বাজে। এখন বাসায় যাওয়া উচিত। সাড়ে সাতটার নাগাদ বাসার দরজাতে নক করলাম। গেট খুলে দিল পৌষি।

– কাজ হয়েছে? (পৌষি)
– হুম। (আমি)
– পেপার কোথায়?
– নিন। আপনার সই হয়ে গেলে আমাকে দিয়ে যায়েন।
– কেন আপনি করেন এখনো?
– সময় হয় নি। রাত ১০ টার দিকে..
– টেবিলে আপনার খাবার দেয়া আছে খেয়ে নিয়েন। (পৌষি)
– আপনি খেয়েছেন? (আমি)
– হুম।

আমাদের বিয়ের প্রায় এক বছর দুই মাস হচ্ছে। কোনদিনই মেয়েটা আমার সাথে খেতে বসে নি। কোন কাজে আমি জোড় করি নি। কারন জোড় করে কারো কাছ থেকে সবকিছু পাওয়া গেলেও সবচেয়ে দামি যে জিনিস তার মন, তার ভালোবাসা পাওয়া যায় না। খাওয়া শেষে টেবিলে বসে আছি। পৌষি এসে বলতে লাগলো

– আমার সই হয়ে গেছে। এখন আপনারটা হলেই হবে।
– ঠিক আছে। কাল সকালের মাঝে হয়ে যাবে।

রাত ১১ টা বাজে ছাদে বসে আছি। হঠাৎ করেই বৃষ্টি নামলো। যদিও আকাশে সন্ধ্যার দিকে মেঘ জমেছিল। মনে হচ্ছে মেঘগুলো আমার জন্যেই। পেপারটা হাতেই ছিল। খুলে দেখি পৌষি চৌধুরী লেখে সুন্দর করেই সই করা। সইটা করতে এখনো হাত কাপছে, চোখের কোনা থেকে বৃষ্টির মতোই জল গড়িয়ে কাগজটাতে পড়ছে। তাও সই করেছি। সব শেষ, সব সম্পর্ক শেষ। আজ থেকে পৌষি মুক্ত। ছাদে বসার জন্য জায়গা ছিল। উপরে ছাউনিও ছিল। তাই বৃষ্টি গায়ে পড়ছে না। চেয়ার থেকে উঠে বৃষ্টিতে ভিজতে মন চাইছে। দেয়ালে হেলান দিয়ে আছি। এমন বৃষ্টি ভেজা দিনেই পৌষিকে বিয়ে করেছিলাম। আর এমন দিনেই তাকে মুক্ত করে দিলাম।  পৌষিকে ফোন দিলাম।

– আমি বাসাতে আসছি।
– তো কি করবো?
– আজ আমার জন্মদিন। তাই অফিসের বস ছুটি দিয়েছে। বিকেলে কি সময় দিতে পারবেন?
– ওও শুভ জন্মদিন। খুবি দুঃখিত বিকেলে বন্ধুদের সাথে বাহিরে যাবো তাই আজ হবে না।
– ঠিক আছে। সাবধানে থাকেন।
– অন্য একদিন যাবো।
– হুম।

খারাপ লাগে নি সেদিন। একটুও খারাপ লাগে নি। তবে ভীষন কষ্ট লাগছিল। যা বলার মতো না। দুপুরে নানুর কবর জিয়ারত করে এসে খাওয়া শেষ করে বিছানাতে শুয়ে পড়েছি। একটু পরেই পৌষির ফোন আসলো। রিসিভ করতেই.

– আপনি হিমেল?
– জ্বী। কিন্তু আপনি কে? আর এটাতো আমার স্ত্রীর ফোন।
– দেখুন আপনি এখনি একটু ওমুক হাসপাতালে চলে আসুন।
– কেন পৌষির কি হয়েছে?
– তেমন কিছু না। শুধু মাথাতে একটু আঘাত পেয়েছে আপনি এখন একটু আসুন তাহলেই হবে।

তখনি বেরিয়ে পড়েছিলাম। হাসপাতালে গিয়ে দেখলাম মেয়েটা ঘুমিয়ে আছে। ডাক্তারের সাথে কথা বলে শুনলাম তেমন কিছু হয় নি। শুধু মাথাতে একটু আঘাত পেয়েছে। জ্ঞান ফিরলেই বাসাতে নিয়ে যেতে পারবো। রাত ২ টা বাজে পৌষির প্রচন্ড জ্বর এসেছে। অবশ্য ডাক্তার বলেছিল জ্বর আসতে পারে। পরেরদিন আর অফিসে গেলাম না। দুপুরে এখনো জ্বর আছে। সকালে কিছু খায় নি।

– সকাল থেকে কিছু খান নি। (আমি)
– উঠুন কিছু খেয়ে নিন।
– হুম।

মনে হয় ওর শরীর খুব দূর্বল। তাই আমিই খেয়ে দিতে চাইলাম। কিন্তু আমার হাতে খাবে না। নিজেই খেতে পারবে নাকি। আমিও তেমন কিছু বললাম না।
কয়েকদিন পর..

– আপনার শরীর এখন কেমন? (আমি)
– ভালো। (পৌষি)
– ঔষুধগুলো ঠিক ভাবে খাচ্ছেন?
– হুম।
– কোথায় খাচ্ছেন? সবগুলোইতো ধরায় আছে।
– শুনুন আপনার এতো কেয়ারিং আমার ভালো লাগে না। বিরক্তধরে গেছে আপনাকে। এক কথায় আপনি যাস্ট একটা হেডেক।
– এমন করে বলছেন কেন?
– কারন আমি আপনার সাথে কোনদিনই থাকতে চাই নি। আর এখনো চাই না।
– কাওকে ভালোবাসেন?
– না।
– তাহলে?
– আমি নিজের পায়ে সবসময় দাড়াতে চেয়েছি। যেটা এই বিয়ে নামক সম্পর্কের জন্য পারি না।
– আমাকে কি ভালোবাসা যায় না?
– চেষ্টা করেছি। কিন্তু সম্ভব হয় নি।
– কি করতে চাইছেন এখন?
– ডিভোর্স চাই ডিভোর্স। এক সপ্তাহের মধ্যে ডিভোর্স দিবেন।

বলেই পৌষি চলে গেল। আর আমি হতবাকের মতো চেয়ে রয়েছি। কথাটা শুনে অবাক হয়েছি। ভীষন অবাক হয়েছি। মনে হচ্ছে কোন স্বপ্ন দেখছি। এখন রাত। পৃথিবীটাতে সঙ্গী বলতে এখন শুধুমাত্র এই রাতের আকাশটাই। কেন জানি নিজের কাছেই বড্ড অপরাধী মনে হচ্ছে। আসলেই তাকে মুক্ত করে দেয়া উচিত। মিথ্যা বন্ধনে তাকে আর আটকে লাভ নেই। যেটা কখনো শুরুই হয় নি, যেটা কখনো শুরুও হবে না সেটার মিথ্যা মায়া ত্যাগ করা ভালো। পরে পৌষির বাবা, মার সাথেও কথা বলেছি। তারা তাদের মেয়ের সাথে কথা বলতে চেয়েছিল। কিন্তু আমিই বারন করেছিলাম। যেটার শুরু হয় নি সেটাতে আর না আগানোই ভালো।

আকাশের গর্জন গুলো শুনে বাস্তবে ফিরলাম। বৃষ্টি আর নেই বললেই চলে। অনেক রাত হয়ে গেছে। আবার হালকা শীত শীত করছে। নিচে নেমে দেখি পৌষি ওর রুমেই আছে হয়তো ব্যাগ গোছাচ্ছে। কারেন্ট ছিল না। তাই মোমবাতি জ্বালিয়েছে। হয়তো চার্জার লাইটের চার্জ নেই। মোমবাতির হালকা আলোতে তাকে আরো মায়াবি করে তুলেছে। তাকে আরোও ভালবাসতে ইচ্ছে করছে। কিছুতেই তাকে ছাড়তে ইচ্ছে করছে না। আমাকে দেখে বলতে লাগলো..

– আপনার সই হয়ে গেছে? (পৌষি)
– হুম। (আমি)
– কোথায় দেখি।
– নিন।

ডিভোর্স পেপারটা পৌষির দিকে আগিয়ে দিলাম। পেপারটা দেখে খুব খুশি হয়েছে।

– আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ।
– ব্যাস এই রাতটুকুই শেষ হলেই হলো। তারপর আমি আমার দিকে আপনি আপনার দিকে।
নিজের অন্ধকার ঘরে এসে বসে পড়লাম। সবকিছু অপরিচিত লাগছে। সকালে এসে পৌষি বলতে লাগলো।
– আচ্ছা তাহলে ভালো থাকবেন। আমি তাহলে আসি।
– আরেকবার ভেবে দেখলে হয় না?
– না না। ভাবা ভাবি নেই। ভালো থাকবেন।

রাস্তাতে দাড়িয়ে শুধু যাওযার পথটাতে চাতকের মতো চেয়ে আছি। ভেবেছিলাম হয়তো একবার হলেও পেছনে ফিরে তাকাবে। কিন্তু না, সেই প্রথমদিনের মতোই ভুল ছিলাম আমি। সবসময় ভুল ছিলাম।

গল্পের বিষয়:
দু:খদায়ক
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত