ঘৃণার ভালোবাসা

ঘৃণার ভালোবাসা

ডিভোর্স কবে দিচ্ছেন??? বাসর রাতে রাত্রীর মুখে কথাটা শুনে সুইট ব্যর্থ একটা মুচকী হাসি দিয়ে বললো বিয়ের ছয় মাস না হওয়া পর্যন্ত তো ডিভোর্স দেয়া যায় না,ছয় মাস পূরণ হলেই দিয়ে দিবো। কথাটা বলেই সুইট বালিশ নিয়ে মেঝেতে শুয়ে পড়লো। বাসর রাত নিয়ে প্রতিটা ছেলে মেয়ের মাঝেই হাজার স্বপ্ন থাকে। হয়তো সুইটের মনেও তেমন হাজারো স্বপ্ন ছিলো। নতুন বউয়ের সাথে সারা রাত গল্প করবে তার ভালো লাগা, না ভালো লাগা সব কিছু জানবে। কিন্তু সব স্বপ্ন তার স্বপ্নই রয়ে গেলো। চাকচিক্যে পুরা রুম ভরিয়ে গেলেও দুটি মনে রয়ে গেলো কালো অন্ধকার। এটা হয়তো হওয়ারি ছিলো।

কি ব্যাপার আর কতোদিন লাগবে আপনার এই প্রজেক্টটা তৈরী করতে, আর যেগুলা করছেন সেগুলাও তো ভুলে ভরা কাজ করার ইচ্ছা না থাকলে চলে যান। রাত্রীর ঝাড়ি খেয়ে তার রুম থেকে বের হয়ে আসে সুইট। এই মেয়েটাকে কিছুতেই বুঝতে পারে না সুইট,খালি সারাদিন তার পিছেই লেগে থাকে। সুইট মনে মনে বলতে থাকে অফিসের ডিরেক্টর হইছে তো কি হইছে এর পর থেকে বেশী কিছু বললে সেও ছেড়ে কথা বলবে না। চাকরি গেলে যাক।

সুইট ঘুম থেকে উঠে দেখে রাত্রীর চুল গুলা তার নাকের উপরে পড়েছে এবং বাতাসে উড়ছে। রাত্রী এমনিতেই দেখতে পরীর মতো সুন্দর তার উপর দুধে আলতা গায়ে নতুন বধুর সাজে এমন দৃশ্য সুইটকে এতোতাই মুগ্ধ করেছে যে সুইট রাত্রীর দিকে একটানা কতোক্ষণ যে তাকিয়েছিলো বুঝতেই পারেনি। রাত্রীর নড়াচড়ার শব্দে সুইটের ঘোর কাটে, রাত্রী উঠার আগেই সুইট বাথরুমে যায় ফ্রেশ হতে। তারপর নাস্তা বানিয়ে রাত্রীর জন্য রেখে অফিসে যায়। এইভাবেই চলতে থাকে সুইট এবং রাত্রীর দিনগুলি, কেউ কারো সাথে খুব প্রয়োজন ছাড়া কথা বলে না। দুজনই শুধু অপেক্ষায় আছে ডিভোর্সের জন্য।

এম.এস.সি পাশ করেও কোনো সরকারী চাকরি না পাওয়ায় রাত্রীর বাবার কোম্পানিতে সুইট জয়েন্ট করে। রাত্রীর বাবা অনেক ভালো মানুষ কিন্তু রাত্রী সব স্ট্যাফদের সাথেই কেমন জানি আচারণ করে,সব স্ট্যাফ বললে ভুল হবে সব ছেলে স্ট্যাফদের সাথে খারাপ আচারণ করে,যেন ছেলেদের সে সহ্য করতেই পারে না। এইটা নিয়ে অফিসে কম কথাও হয়নি কিন্তু কিছু করার নেই সবাই পেটের দায়ে সব সহ্য করে নেয় কিন্তু সুইট এইসব ধরে দেখেই রাত্রী সুইটের সাথে আরো বেশী করে খারাপ আচারণ করে,,একগাদা করে কাজ দেয় আর সেগুলা শেষ করতে না পারলেই বকা দেয় ইচ্ছামতো। রাত্রীর বাবা অবশ্য সুইটকে অনেক ভালোবাসে এবং তার কাজের অনেক প্রশাংসা করে কিন্তু মেয়ের ভয়ে রাত্রীর সামনে কিছু বলতে পারে না।

আজ সুইটের সাথে রাত্রীর সাথে বিয়ে। বিয়ে বলাটা ভুল হবে বলা চলে এটা এক ধরনের চুক্তি। রাত্রী বিয়ের জন্য প্রায় অর্ধশত ছেলেকে রিজেক্ট করেছে এবং তার বাবাকে বলেছে সে জীবনে বিয়ে করবে না। সুইটের সাথে রাত্রীর সারাদিন রাগারাগি দেখে রাত্রীর বাবা নতুন আশা খুজে পান কারণ রাত্রী ছেলেদের সাথে কথা বলেনা বললেই চলে। সুইটকে রাত্রী বাবার পছন্দ হলে রাত্রীকে সুইটকে বিয়ে করার প্রস্তাব দেয়। রাত্রী ফিরিয়ে দিলে রাত্রীর বাবা অসুস্থ হয়ে পড়ে এবং ডাক্তার তাকে সকল ধরনের চিন্তা থেকে মুক্ত থাকতে বলে। যার ফলে বাধ্য হয়েই রাত্রী সুইটকে বিয়ে করতে রাজী হয়ে যায়। তবে শর্ত দেয়া থাকে বিয়ের পরেই ডিভোর্স দিতে হবে, শুধুমাত্র লোক দেখানো বিয়ে হবে এটা। এর বিনিময়ে তাকে বিপুল পরিমানে টাকা দেয়া হবে। সুইটও তার বাসার আর্থিক অবস্থা বিবেচনা করে বিয়ে নামক এই চুক্তিতে রাজি হয়ে যায়।

তাদের বিয়ের পর এবং বিয়ের আগের জীবনে কোনো পার্থক্য খুজে পাওয়া যায় না। রাত্রীর বাবার দেয়া একটা ফ্লাটে তারা দুজন থাকে। রাত্রীকে বিয়ে করার কারনে সুইটকে অফিসের সহকারী ডিরেক্টরের পদ দিলেও সুইট তা গ্রহণ করতে রাজি হয়নি।

বিয়ের পরেও সুইট রাত্রীর চোখে তার প্রতি সেই আগের ঘৃণাই দেখতো। কিন্তু কি সেই কারণ তা আজো সুইট বুঝতে পারে না। শুধু সুইট না সব ছেলের প্রতিই তার তীব্র ঘৃণা। বিয়ের এতোদিনেও তার মধ্যে কোনো পরিবর্তন লক্ষ্য করেনি সুইট। এর রহস্য খুজতেই আজ অফিস শেষে রাত্রীর বাসায় যায় সুইট।

সুইটকে দেখেই রাত্রীর বাবা বলতে থাকে আমি জানি বাবা তুমি এখানে কেনো এসেছো। তোমাকে একটা কথা জানানোই হয়নি।রাত্রী ছোট থেকেই বিভিন্ন নিউজের বই বা ম্যাগাজিন পড়তো তাই ধর্ষন বিষয়ে কিছুটা হলেও তার ধারণা ছিলো। আর এইসব বিষয়ে ও অনেক সেন্সিটিভ ছিলো। রাত্রীর বয়স যখন ৬ বছর ছিলো তখন আমার এক বন্ধু তাকে কোলে নেয়ার ছলে তাকে বিভিন্ন ভাবে যৌন হয়রানি করে যেটা রাত্রী কিছুতেই সহ্য করতে পারেনি। তারপর আরো অনেক রিলেটিভদের এমন আচারণ দেখে এবং প্রতিদিন মেয়েদের জোর করে ধর্ষন এবং স্বামী দ্বারা স্ত্রীদের নির্যাতন এইসব দেখে ও ছেলেদের আর সহ্যই করতে পারেনা। ও ভাবে হয়তো সব ছেলেই এক রকম তাই ছেলে দেখলেই ওর মাথা গরম হয়ে যায়। আসলে ওর মা নেই তো, আমার সাথে হয়তো সেইভাবে মনের কথা বলতে পারে না,মা থাকলে মনের কথা গুলা বলতো, মনের কথা মনেই জমে রাখে যার ফলে এমন হয়ে গেছে।

রাত্রীর বাবার কথা গুলা শুনার পর সুইট সেখান থেকে চলে আসে। রাত্রীর প্রতি তার যে রাগ/অভিমান ছিলো তা সব এক নিমিষে উধাও হয়ে গেলো। সুইট এখন নিজ থেকেই রাত্রীর সাথে কথা বলে যাতে রাত্রী স্বাভাবিক হয়। রাত্রীও সুইটের আচারণে মুগ্ধ হয়েছে তাই সেও সুইটের সাথে টুকিটাকি কথা বলে। সুইটের মূল লক্ষ্যই ছিল রাত্রীর ভুল ভাঙ্গানো যে সব ছেলে এক না। তাই সুইট রাত্রীর ভালো লাগা জিনিস গুলা আনতো, তার ভালো লাগা কাজ গুলা করতো,আর সব অপছন্দের জিনিস গুলা পরিহার করার চেষ্টা করতো। একদিন রাত্রী পা মচকে মেঝেতে পড়ে যায়,সুইট কি করবে না করবে ভেবে পাচ্ছিলো না, হঠাৎ সে রাত্রীকে কোলে তুলে নিয়ে বিছানায় দিয়ে আসে,,রাত্রী এতে অবাক হলেও কিছু বলে না। আস্তে আস্তে সুইট রাত্রীর ভুল ভাঙ্গাতে সক্ষম হয়। রাত্রীও এখন বিঃশ্বাস করে যে সব ছেলে এক না। এই দিকে চুক্তির সময় সীমাও শেষ হতে চলেছে। ঈদের পরেই হয়তো তাদের ডিভোর্স হয়ে যাবে।

রোজা শুরু হওয়ায় সুইট রাত্রীকে তাদের বাসায় দিয়ে আসে। রাত্রীর বাবা সুইটকে অনুরোধ করেছিলো তারা যেনো পুরা রমযান মাসটা তাদের বাসায় থাকে। সুইট থাকতে রাজি না হলেও রাত্রীকে দিয়ে আসে।

পুরা রমজান মাসে সুইট রাত্রীর সাথে আর কোনো যোগাযোগ করেনি, বিসিএস পরীক্ষায় টিকে যাওয়ার কারণে তার সরকারি চাকরি হয়ে যায় যার ফলে অফিসের চাকরিটা ছেড়ে দেয়। এদিকে সুইটের অনুপস্থিতি রাত্রী হারে হারে বুঝতে পারে। সারাদিন শুধু সুইটের কথাই তার মনে হয়। এমনকি রাতে ঘুমাতেও পারে না। তাহলে কি রাত্রী সুইটের মায়া জালে ফেসে গেলো,হ্যাঁ রাত্রী সুইটকে ভালোবেসে ফেলেছে।

প্রায় ১ মাস পর সুইটকে দেখে রাত্রী অনেকটা উত্তেজিত হয়ে উঠে। সুইট আজ রাত্রীর বাসায় এসেছে রাত্রীর সাথে দেখা করতে। রাত্রী সুইটের হাত ধরে সোজা ছাদে নিয়ে গেলো।

রাত্রীঃ কি ব্যাপার,,, এতো দিন কোথায় ছিলা?? আমি কতো ফোন দিছি তোমাকে,তোমার ফোন বন্ধ, অফিসে আসো না,আবার ফ্লাটেও তালা দেয়া মানেটা কি???

সুইটঃ চিন্তার কিছু নেই,আমি তো বলছিই সময় মতোই ডিভোর্স দিয়ে দিবো,এই নাও ডিভোর্স পেপার,আমি সাইন করে দিছি।

রাত্রী ডিভোর্স পেপাটা কেড়ে নিয়ে একটানে ছিড়ে ফেলে দেয়। আর সুইটের কলার্ট টেনে ধরে বলে,আর যদি একবার ডিভোর্স এর কথা বলো তাইলে খুন করে ফেলবো,বুঝোনা কেনো আমি তোমায় ভালোবেসে ফেলেছি। এত্ত কিছু বুঝো আর এইটা বুঝো না,গাধা কোথাকার।

সুইটঃ মাথা খারাপ, আমি তোমাকে ডিভোর্স দিবো!!! আমিও যে তোমায় ভালোবাসি। সেই প্রথম অফিসের দিন থেকেই তোমার প্রতি আমার ভালোলাগা,তাইতো তোমার সব রাগ,বকা হাসি মুখে গ্রহণ করেছি। আর আমি এই জন্যই এতো দিন যোগাযোগ করিনি যাতে তুমি আমাকে অনুভব করো,কারণ অনুভব না করলে কখনো ভালোবাসতে পারবে না। আর সেইটা আমার কাছে থাকলে কখনোই সম্ভব ছিলো না।

রাত্রীঃ কচু বাসো তুমি,তাহলে ডিভোর্স পেপার সাইন করে নিয়ে আসতে না।

সুইটঃ কে বলেছে,আমি ডিভোর্স পেপার সাইন করে নিয়ে এসেছি,,তুমি পেপারটা পড়ছো??

রাত্রী সাথে সাথে ছেড়া পেপার গুলা জড়ো করে পেপারটা পড়ে, সেখানে লেখা আছে——-
প্রিয় ম্যাডাম,
আপনি আমাকে যতোই বকা দিন,যতোই আমার সাথে খারাপ ব্যাবহার করেন না কেনো, আমি তাও আপনাকে ছাড়বো না। আর ছাড়বোই বা কি করে আপনি যে আমার অর্ধাঙ্গিনী। আল্লাহ যে আমার বুকের বাম পাঁজরের হাড় দিয়েই আপনাকে তৈরী করেছে,,,তাই ছাড়ার কোনো প্রশ্নই উঠেনা। এতে যদি বলেন আমার লজ্জা নেই তাহলে বলবো হ্যাঁ আপনার ভালোবাসার জন্য আমার লজ্জায় পিজারভেটিভ দেয়া আছে।

আমি আপনার অতীত সম্পর্কে সব কিছু জানি,,আর এটাও জানি আপনি আর আমি পুরাই আলাদা,আপনি যেমন আমি ঠিক তার উল্টা। কিন্তু আপনি কি এটা জানেন পৃথিবীতে সব চেয়ে মজবুত বন্ধন হচ্ছে পজিটিভ -নেগেটিভ বন্ধন। তাই আপনাকেই আমার চাই সবচেয়ে মজবুত বন্ধনে আবদ্ধ হতে।

দেখেন কাল ঈদ, আর আমি একজন বিবাহিত ছেলে,,একজন বিবাহিত ছেলের কাছে বউ ছাড়া ঈদ করা যে কতোটা কষ্টের তা বউ ছাড়া বিবাহিত ছেলেরাই বুঝে। তাই কাল যাতে আমার নজর অন্যের বউয়ের দিকে না যায় তাই আপনাকে আমার পাশে লাগবে। সবকিছু শেষে একটাই কথা,,,,ভালোবাসি অনেক অনেক বেশী আপনাকে।

চিঠিটা পড়া শেষ হলে রাত্রী সোজা সুইটের বুকে ঝাপিয়ে পড়ে। প্রপোজটা সুন্দর হইছে কিন্তু আপনি করে বলে কেউ প্রপোজ করে নাকি??

সুইটঃ চিঠির শুরুতেই ম্যাডাম বলছি তো,তাই পুরা চিঠিতেই ভদ্রতা বজায় রাখছি।

রাত্রীঃ হাহাহা,তুমি আসলেই একটা পাঁজি,শুধু পাঁজি না বজ্জাত কোথাকার,এতো দিন আমায় শুধু শুধু কষ্ট দিছো।

সুইটঃ কষ্ট না করলে কি কেষ্ট মেলে নাকি আফামনি??

রাত্রীঃ এই আফামনি মানে??

সুইটঃ হাহাহা,ম্যাডামের বাংলা ভার্ষন আফামনি,,কথাটা বলেই সুইট রাত্রীকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে। আর ধরবেই না কেনো,পবিত্র দিনের আগমনে মনের সকল অপবিত্রতা দূর করে তারা যে পবিত্র ভালোবাসার বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছে। ভালোবাসা সত্যিই অনেক অদ্ভুত, কখন, কোথায়,কার মাঝে এই অনুভুতি তৈরী হয় কেউ বুঝতেই পারে না।

গল্পের বিষয়:
দু:খদায়ক
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত