– এই শোনেন?
– হ্যা বলো।
– আমরা ঢাকায় চলে যাচ্ছি।
– হঠাৎ ঢাকায় কেন?
– আব্বুর ট্রান্সফার হয়ে গেছে। তাই পরিবারসহ সেটেল হচ্ছি।
– হঠাৎ এভাবে ট্রান্সফার হয়ে গেলো!
– হ্যা। আমরা এখানে থেকে যেতে চেয়েছিলাম। কিন্তু আব্বুর পক্ষে ঢাকায় একা একা থাকা কষ্টকর হয়ে যাবে, তাই চলে যাওয়া লাগতেছে।
– ওহ, তা কবে যাচ্ছো?
– আজকে রাতেই। ১০ টায় বাস।
– আজকেই!
– হ্যা, আপনি কি করতেছেন?
– আমি তো পড়াতে এসেছিলাম।
– শেষ হবে কখন?
– একটু পরই।
– ওহ। আচ্ছা, ভালো থাকবেন।
– তুমিও..
– একটু শোনেন?
– হ্যা বলো…
– আমাদের দেখাটা তো আর হলোই না।
– আমার সময় থাকলে তোমার থাকে না; তোমার সময় থাকলে আমার থাকে না। নিয়তিই বোধহয় চায় না।
– নিয়তিকে বদলাতে পারলে মন্দ হতো না।
– কারও সাধ্য নেই যে।
– মাঝে মাঝে মানুষ অসাধ্যকেও সাধন করে ফেলে।
– সবার বেলায় ঘটলে সেটা অসাধ্য কাজ হিসেবে গণ্যই হতো না।
– দেখেন, এতো বুদ্ধিজীবীদের মতো কথা বলবেন না।
– আচ্ছা। এদিকে কি একবারও ফিরবে না?
– না ফেরার সম্ভাবনাই প্রবল।
– তাহলে না হয় কল্পনাতেই দেখে নিবো।
– আপনি একটা পাগল।
– পাগল ছিলাম না কবে?
– জানি না।
– বদলে দিতে চাও?
– সে সাধ্যি নেই যে।
– কেউ চাইলে তাকে নিরাশ করতাম না।
– নিশ্চিত হয়ে বললেন, নাকি আবেগ?
– আবেগ থেকে কি নিশ্চয়তার গল্প আসে না?
– আসলেও সেটা হয়তো তাসেরঘর।
– আস্ত তাজমহলটা আজও দাঁড়িয়ে।
– আপনি যে শাহজাহান নন।
– রাজা না হলেও রাজকুমার তো।
– নামে কি আসে যায়?
– নামই ইতিহাস হয়ে থাকে।
– হেয়ালিপনা বাদ দিন।
– আচ্ছা, দিলাম বাদ।
– একটা কাজ করলে কেমন হয়?
– কি কাজ?
– আজকেই না হয় আমরা দেখা করি?
– এতো ব্যস্ততার মাঝে!
– জগত সংসারে কেউই ব্যস্ত নয়। পুরোটাই প্রাধান্যদানের ব্যাপার।
– দিলাম না হয়। কিন্তু কোথায়?
– বাসস্ট্যান্ডে, সোহাগ কাউন্টার।
– কিভাবে?
– আসলেই হলো…
– সবার সামনে ?
– সামনে, তবুও অগোচরে।
– পারবে তো?
– মুখটা বন্ধ থাকলেও চোখদুটো সজাগ যে। দূর থেকেই না হয় দেখলাম।
– তৃষ্ণা মিটবে তো?
– দেখার জন্য চোখ দুটোই যথেষ্ট যে।
– দূরে দূরে আর কতো?
– নিরুপায় যে…
– আচ্ছা আসবো।
– অপেক্ষায় থাকবো…
ডাটা অফ করে দিয়ে চুপচাপ বসে রইলাম। কিছুক্ষণ পরে ছাত্রীকে ছুটি দিয়ে বেরিয়ে আসলাম। ভিতরটা ফাঁকা ফাঁকা লাগছে, বুকটা ধরফর করছে। কিছু মানুষ হঠাৎ করে জীবনে আসে, মিশে যায় আত্মার সাথে। তার সাথে হাসি, কান্না, রাগ, অভিমান, অভিযোগ এসব নিয়েই বিভোর হয়ে থাকা। মানুষগুলো অনাকাঙ্খিত সুখে ভাষায়; আবার হঠাৎ হারিয়ে যায়।
কানে হেডফোন গুঁজে দিলাম। গান ছেড়ে দিয়ে নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করলাম। ফোন হাতে নিয়ে সময় দেখলাম। ৯.৪০ বাজে। হাতে বেশি সময় নেই, যেন আইসিইউতে ভর্তি মুমূর্ষু রোগী। রিকশা নিলাম। রিকশাচালক বৃদ্ধ। ধীরে ধীরে এগিয়ে চলেছে। প্রতিদিন ইঞ্জিনচালিত রিকশায় চলাফেরা করি। আজকে ওঠার সময় সেটাও খেয়াল করিনি। বাসস্ট্যান্ডে আসতে আসতে ৯.৫৫ বেজে গেলো।
দুটো বাস পরপর দাঁড়িয়ে আছে। আর পাঁচ মিনিট পরেই চলে যাবে হয়তো। ফোন দিলাম, কিন্তু তার নম্বর সুইচড অফ। কয়েকবার ট্রাই করেও সুইচড অফ পেলাম। অনলাইনে এসেও বালিকার কোনো চিহ্ন পেলাম না। টের পেলাম, কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে। এদিক ওদিকে ঘুরেফিরে দ্রুত খুঁজতে লাগলাম তাকে। কোথাও খুঁজে পেলাম না।
অবশেষে কাউন্টারের সামনে দাঁড় করানো বাসের দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। বুকে সাহস সঞ্চার করে ভিতরে উঠলাম। সামনের দিকটায় দাঁড়িয়ে খড়ের গাদায় সুঁই খোঁজার মতো দৃষ্টিতে পুরোপুরিভাবে একবার তাকালাম। এভাবে খুঁজে পাওয়াটা নিতান্তই কঠিন কাজ। এভাবে একটা মানুষ নিরাশ করতে পারে!
উপায় না পেয়ে মনস্থির করলাম, চলে আসবো। কদমপানে চেয়ে চুপচাপ নেমে এসে চলে আসছি এমন সময়ে পিছন থেকে “এই যে” ডাক দিলো কেউ। শুনেও না শোনার ভান করলাম। হয়তো কেউ অন্য কাউকে ডাকছে। পিছনে তাকিয়ে বোকা বনে যাওয়ার চাইতে না তাকানোই উত্তম যে। আবারও “এ হ্যালো! কোথায় যাচ্ছেন?” বললে ফিরে তাকালাম।
দরজায় দাঁড়িয়ে আছে সে। মুখে হাসির ফোয়ারা। কতোটা অবলীলায় হেসে চলেছে সে! যেন নবজাতকের আগমন ঘটেছে। যেন আমি নিজেই সেই নবজাতক। কেঁদে চলেছি অবিরত, অগোচরে; ভেতরে ভেতরে। তার মুখ থেকে “চলে যাচ্ছি কিন্তু। ভালো থাকবেন। কেমন?” কথার জবাবে জীবনের শুষ্কতম হাসিটা প্রদর্শনপূর্বক “হু, তুমিও ভালো থেকো” বলে ঠায় দাঁড়িয়ে আছি। হাত নেড়ে বিদায় জানিয়ে ঘুরে নিজের সিটে চলে গেলো। আজ বড্ড নিরুপায়, অসহায় লাগছে নিজেকে।
একটু পরই বাস চলতে শুরু করলো। সাথে ভিতরটা হুঁ হুঁ করে উঠলো। সবকিছু গুলিয়ে যাচ্ছে। প্রতিটা মুহূর্তে যাকে নিয়ে ভেবেছি, যার কল্পনাতে বিভোর হয়েছি, যাকে একান্ত আপনার মতো করে কাছে পেতে চেয়েছি প্রতিক্ষণে; সে-ই কি না দূরে চলে যাচ্ছে। জীবনের প্রথম দেখাটাই বোধহয় শেষ দেখা। বাকীটা জীবন না হয় দূর থেকেই দেখে নেবো; কল্পনাতে, নীরবে, অগোচরে।