গ্রামের নাম ইছাপুর।সবুজ শ্যমলী প্রান্তর।গ্রামের রাস্তার পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে নদী।স্নীগ্ধ সুন্দর পরিবেশ।
কিন্তু গ্রামে এখনো লাগেনি উন্নতির ছোয়া।অনুন্নত ঘরবাড়ি কারও বেড়ার ঘর কারো বা মাটির দেয়াল।বেশী বৃষ্টি হলে ঘরে পানি পড়ে।
একটিমাত্র পুরোনো ইটের বাড়ি আছে গ্রামের পোষ্টমাস্টার এর।উনি রমিজউদ্দিন।আগেকার মানুষ হিসেবে তিনি দুই কলম পড়া শিক্ষিত মানুষ।
মানুষ হিসেবে খুব ভালো।অন্যের উপকার করার জন্য নিজের জীবন ও বাজী রাখতে পারে।সবার প্রয়োজনে সাহায্য করে।
তার স্ত্রী জামিলা বেগম,তিন ছেলে ও তিন মেয়ে সন্তান তাদের।রমিজউদ্দিন তার বাবার একমাত্র ছেলে ছিলো।
সেকালের ওলা রোগে বাবা মা দুজন কেই হারিয়েছিলেন।বাড়িতে পরিচারক এক কাকা ছিলো তার কাছেই মানুষ….,
সে বড় করে তোলে পড়ালেখা শেখায় শেষমেষ পোষ্টমাস্টার এর চাকরি পায়।তার পর বিয়ে।
সামান্য বেতন এ এত বড় সংসার চালানো গেলেও সন্তানদের স্কুলে পাঠানোর মতো যথেষ্ট ছিলো না।
তবুও নিজে যতটুকু সম্ভব শিখিয়েছে আর যাই হোক নিরক্ষর রাখিনি তাদের।সন্তানরা বিবাহউপযুক্ত হলে একে একে ছেলেদের ও দুই মেয়েকে বিবাহ দেয়।
এখন আছে ছোট মেয়েটি।নাম ঝুমু।বয়স ষোল গড়িয়ে সতেরো তে পড়েছে।চলাফেরা চালচলন বাচ্চাদের মতোন।
তাছাড়া যাদের সাথে মেশে তাদের বয়স বারো-তেরো এমন হবে।
খুব চঞ্চল মেয়ে।সারাদিন মায়ের সাথে কাজে সাহায্য করলেও বিকালে তাকে আর আটকে রাখা সম্ভব নয়।এখনো খেলা করে সাথীদের সাথে।
যদিও খুব বকা শোনে এ নিয়ে ডিঙি মেয়ে বাইরে ইচ্ছামতো ঘুরে বেড়ায়, কিন্তু কে শোনে কার কথা।ঝুমুর চেহারার মিষ্ট ভাব দিন দিন বেড়েই চলেছে।
অতি আদরের সেই ছোট মেয়েটি অনেক বড় হয়ে গেছে সকলের চোখে ডিঙি, তা বাবার কাছে একবার ও মনে হয় নি।
ইদানিং বিকালো নদীর পাড়ে একটা ছেলে বসে থাকে। প্রায়শই রমিজউদ্দিন এর সাথে দেখা হয় আর দেখা হওয়া মাত্রই সালাম দেয়।
পরিচিত নয় সালাম দেয় তবুও জানতে চায়নি তার পরিচয়।অথচ ছেলেটি ঝুমুকে দেখার জন্যই বসে থাকে অধীর আগ্রহে, কখন ঝুমু আসবে এ পথ দিয়ে।
কাউকে কিছু না বলেই আজ ঝুমু পাশের গ্রামের বান্ধবী সীমাদের বাড়ি যাবে।যাওয়ার সময় সেই ছেলেটি ডাকলো।
কোথায় যাচ্ছো ঝুমু?
সীমাদের বাড়ি।আপনাকে তো চিনলাম না।আপনি আমার নাম জানেন কিভাবে?
ওইতো সেদিন তোমার বন্ধুরা এ নামে ডাকছিলো তোমাকে।
এভাবে কথা বলতে বলতে গ্রামের রাস্তা ধরে হাটছে।মাঝে মাঝে কোন কথায় হেসে ফেলছে ঝুমু।
ছেলেটি বলেছে ঝুমু তোমার সাথে কিছু কথা আছে কিন্তু অন্য একদিন বলবো। গ্রামের লোকেদের চোখে যেটা বিষের মতো লাগছে।
কথা বলতে বলতে সীমাদের বাড়ি পৌছে গেছে।ছেলটি চলে গেলো।
হঠাৎ আকাশ মেঘে ঢেকে গেছে।সীমার সাথে গল্প করছে ঝুমু। মেঘের গর্জন দিয়ে উঠলো ঝড় সাথে প্রচুর বৃষ্টি।
সন্ধা হয়ে গেছে সীমার মা বলছে ঝুমু মা তুই এ অবস্থায় বাড়ি যাবি কিভাবে রাতটা থেকে সকালে চলে যাস।
সীমা তো সেই খুশি দুই বান্ধবী একসাথে গল্প করছে।ওদিকে সন্ধা হয়ে গেছে ঝুমু এখনো বাড়ি ফেরেনি চিন্তার অস্থির ঝুমুর মা।
এই ঝড়ের ভিতর ও পাড়ার সব বাড়ি খুজেছে ঝুমুকে।কেউ জানেনা ঝুমু কোথায়।
একজন বলেছে বিকালে দেখেছে একটা ছেলের সাথে হেসে কথা বলতে বলতে কোথায় যাচ্ছিলো।রাত দেড়টায় বৃষ্টি থামলো।
বাবার চোখে ঘুম নেই।ভোর না হতেই কানাকানি শুরু হয়ে গেলো, পুরো এলাকা জুড়ে পোষ্টমাস্টার এর মেয়েকে পাওয়া যাচ্ছে না।
সর্বশেষ একটা ছেলের সাথে রাস্তা দিয়ে হাটতে দেখেছে অনেকে।এতে ধারনা করে নিয়েছে ওই ছেলের সাথে পালিয়েছে।
সবাই কানাঘষি করছে, কেউ শুনিয়ে শুনিয়ে কটু কথা বলছে।
কেউ বলছে বাবার আস্কারা পেয়ে মাথায় উঠেছে দেখো অবস্থা এবার বংশের মুখে চুনকালি মাখালো।
কিন্তু এসব কথা রমিজউদ্দিন মানতে পারছে না আর এক মুহূর্ত ও দাড়াতে পারলো না ঘরে যেয়ে দরজার খিল দিলো।
শুধু ঠক করে একটু শব্দ হলো তারপর শুনশান ঘর।সকালে খেয়ে ঝুমু বাড়ি ফিরছে।
আসতে আসতে যাদের সাথে দেখা হলো সবাই মুখ ঘুরিয়ে চলে গেলো।ঝুমু ভাবলো এদের আবার কি হলো।
বাড়ি ফিরে দেখে অনেক মানুষের ঢল বাড়িতে।ঝুমুর মা ভাই দরজা ঘাপাচ্ছে আর কাঁদছে।
ঝুমুকে দেখেই দৌড় আসে ওর মা, চুলের মুঠি ধরে থাপ্পড় মারে পোড়ামুখী মরিস নি এখনো, সারারাত কোথায় ছিলি বলে কান্নায় ভেঙে পড়ে।
তোর জন্য তোর বাবা দরজা দিয়েছে ঘরে এখনো খু্লছে না বলেই আবার দৌড়ে দরজার কাছে যায়।
না পেরে সবাই মিলে দরজা ভেঙে ফেলে।দেখে শাড়ির পেচে ঝুলে আছে রমিজউদ্দিন।
গ্রামের মানুষের অযাচিত ব্যবহারের কাছে হেরে গেছে রমিজউদ্দিন।যে মানুষ টা সব সময় অন্যের বিপদে আপদে সাহায্য করেছে।
কোন দোষ না করে দোষী ঝুমু।ঝুপটি মেরে বসে আছে নির্বাক চোখে অঝরে ঝরছে জল।
যার যা ইচ্ছা কথা শুনাচ্ছে ঝুমুকে। চোখে ভাসছে বাবার কথা।