আজ অনেকদিন পর বিকেল বেলা বাসা থেকে বের হলাম। সারাদিন বাসায় শুয়ে-বসে থেকে দম বন্ধ হবার উপক্রম হচ্ছিল। বাহিরে যে সৌন্দর্যময় একটা পরিবেশ আছে সেটা প্রায় ভুলতেই বসেছিলাম। কি মনে করে বের হলাম জানিনা। তবে সকাল থেকেই কেমন মনে হচ্ছিল আমাকে বের হতে হবে। বাহিরে কিছুএকটা অপেক্ষা করছে। বাসা থেকে একটু দূরেই পাবলিক পার্কটা। ধীরে ধীরে গেটের কাছে আসতেই হারিয়ে যাওয়া স্মৃতিগুলি চোখের সামনে ভেসে উঠল। মুহুর্তেই চোখটা ঝাপসা হয়ে এল। চশমাটা খোলে পানিটুকু মুছে নিলাম। একটা সময় প্রতিদিন রিয়ার সাথেএই পার্কে দেখা না করলে রাতে ঘুমই আসত না। এইত সেই জারুল গাছ, তার নিচে পাতানো বেঞ্চটা। যেখানে পরে আছে আমাদের কত স্মৃতি। লক্ষ্য করলাম সেই বেঞ্চটাতে আমার বয়সী এমজন মেয়ে মানুষ বসে আছে। মনে হচ্ছে কারো জন্য অপেক্ষা করছে। কাউকে যেন খুজছে। হঠাৎ করে গল্প করতে ইচ্ছে হল। ধীরে ধীরে এগুতে লাগলাম।
যত এগুচ্ছিলাম ততই বুকের ভেতর অদ্ভুত অনুভুতি হচ্ছিল। খুব অবাক হলাম। কারণ এমনটা যে হবার কথা না! আমি পাশে গিয়ে বসলাম আর সে যখন আমার দিকে তাকাল তখন দুজনেই বড় ধরনের ঝাকি খেলাম। হঠাৎ বুকের ভেতর ধক করে উঠল। এটা যে রিয়া! এতটা বছর পর ওকে চিনতে একটু সময় লাগল না। যার মুখটা মনের মাঝে এখনো ঝুলন্তু ছবির মত রয়ে গেছে।রিয়ার মুখ দেখে বুঝা যাচ্ছে ততক্ষনে সেও আমাকে চিনে ফেলেছে। দুজন চুপচাপ কতক্ষণ তাকিয়ে ছিলাম ঠিক বলতে পারব না। একটা সময় রিয়াই নিরবতা ভেঙ্গে বলল রাফাত, কি দেখছ এমন করে? এখন আমাকে দেখার মত কিছুই নেই। তোমার রিয়া অনেক আগেই হারিয়ে গেছে। আমি একটু লজ্জা পেয়ে ওর দিক থেকে চোখ সরিয়ে নিলাম। আসলেই ত! রিয়া এখন আর আমার নেই। তাহলে আমি এভাবে তাকিয়ে আছি কেন? আমি বললাম। ভালবাসার মানুষগুলোর দিকে তাকাতে হয় না রিয়া। কখন যে নিজের অজান্তেই চোখ চলে যায় সেটা টের পাওয়া যায় না।
তোমাকে কতদিন পর হঠাৎ দেখলাম তাই চোখ সরাতে পারছিলাম না। কেমন আছ রাফাত? যেমনটা রেখে গেছ তেমনই। তুমি কেমন আছ? রিয়া প্রশ্নের উত্তরটা চর করে দিল না। চুপ করে রইল। তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল! আছি না মরে বেচে থাকার মত। আচ্ছা রাফাত, আজ কতবছর পর তোমার সাথে দেখা হল বলত? শেষ দেখাটা কবে হয়েছিল তোমার মনে অাছে? থাকবে না কেন? পচিশবছর আগের সে দিনটি কি ভুলা যায়? কখনোই না! সেদিন তুমি আমাকে এখানেই একা ফেলে চলে গেছিলে। তোমাকে আমি ফেলে যেততে চাই নি, পরিস্থিতিই আমাকে চলে যেতে বাধ্য করেছে। জান রাফাত, আমার যখন তোমার কথা মনে পড়ত তখন সময় পেলেই এখানে আসতাম। অনুভব করতাম তুমি আমার পাশেই বসে আছ। আমার সাথে সেই আগের মতই কথা বলছ। একটা সময় যখন কল্পনার ঘোর কাটত আর দেখতাম তুমি নেই তখন খুব খারাপ লাগত। তবে আমার সবসময়ই মনে হত তোমার সাথে আবার দেখা হবে। একদিন তুমি নিশ্চই আসবে। সত্যি করে বল তোমারও কি এমনটা ফিল হত?
রিয়ার কথাগুলো শুনে অামি অবাক না হয়ে পারলাম না। এই জিনিসটা আমিও ঠিকই ফিল করতাম। একদিন আমাদের দেখা হবে। নিশ্চই হবে! হতে হবেই। তাহলে রিয়ারও এমনটা ফিল হত! সত্যি বলতে কি আমারও এমন মনে হত তুমি এখানে আসবে। হয়ত আমাদের দেখা হবে। তবেএকটা কথা কি রিয়া, তুমি যদি সেদিন তোমার বাবার কাছে আমাদের রিলেশনের কথাটা বলতে তাহলে হয়ত এই সময়টুকু আমরা অন্য কোন ভাবে পার করতে পারতাম। বিশ্বাস কর, সেদিন পরিস্থিতি এতটাই কঠিন ছিল আমি এই বিষয়টা কারো কাছে বলতে পারি নি। শুধু বাবার সম্মানের কথা ভেবে আর ওনার মুখের দিকে তাকিয়ে নিরবে সবকিছু মেনে নিয়েছি। ধরে নিয়েছিলাম কপালে এটাই লেখা আছে। তবে হ্যা জীবনের এই প্রান্তে এসেও আমি তোমার শুণ্যতাটা অনুভব করি। এখনো তোমার স্মৃতি মনে পড়লে আমার সবকিছু ঝাপসা হয়ে যায়। মনে হয় কি যেন নেই আমার হারিয়ে গেছে অনেক দূরে।
রিয়া কথাগুলো খুব ধীরগতিতে বলল। আমি যখন ওর দিকে তাকালাম দেখলাম ওর চোখ থেকে টুপ করে কয়েক ফোটা জল গড়িয়ে পড়ল। চশমাটা খুলে পানিটুকু মুছে নিল। আর নিজেকে সামলে নিয়ে বলল তারপর তোমার কি খবর? এই সময়টা কিভাবে কাটালে? বিয়ে করেছ কি? সেদিন তুমি চলে যাবার পর একা একা এখানে বসে অনেক কেদেছিলাম। প্রতিজ্ঞা করেছিলাম তোমাকে যখন পাই নি জীবনে আর বিয়েই করব না। কিন্তু একটা সময় দেখলাম আম্মু খুব অসুস্থ হয়ে পড়ল। তাকে দেখাশুনা করার মত কেউ নেই। তখন মায়ের পছন্দ করা একটা মেয়েকে বিয়ে করলাম। বিন্দু মেয়েটা খুব সহজ সরল প্রকৃতির ছিল।
আমাকে খুব ভালবাসত। ওর এমন ভালবাসায় আমি আবার ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হয়ে উঠতে লাগলাম। কিন্তু ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস দেখ ছোঁয়াকে জন্ম দিয়ে বিন্দুও আমাকে কাদিয়ে পৃথিবী থেকে বিদায় নিল। তারপর থেকে একাই আছি। তবে মৃত্যুর পূর্বে ও বলে গেছে ছোঁয়াকে বড় ডাক্তার বানাতে। ওর কথামতই আজ আমার মেয়েটা ডাক্তার হয়ে বেড়ুল। এখন ভাল একটা ছেলে দেখে ওকে বিয়ে দিতে পারলে মরেও শান্তি পাব। সেদিন ছোঁয়ার এক বান্ধবী বলল ছোঁয়া নাকি একটা ছেলেকে পছন্দ করে। ভাবছি আমার জীবনে যেটা ঘটেছে সেটা আমার মেয়ের ক্ষেত্রে হতে দেব না। ও যদি রাজি থাকে তাহলে ঐ ছেলের সাথেই বিয়ে হবে। ছোঁয়া কি দেখতে ওর আম্মুর মতই হয়েছে? একদম ঠিক ধরেছ! আমি যখন বিন্দুকে মিস করতাম তখন ছোঁয়ার সাথে গল্প করতাম। তখন কিছুটা হলেও ভাল লাগত। আচ্ছা আমার কথা সবই শুনলে এবার তোমার কথা বল? কিভাবে কাটালে এই সময়টুকু?
প্রশ্নটা শুনে রিয়ার মুখটা একদম মলিন হয়ে গেল। কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। যেন ভাষা হারিয়ে ফেলেছে। একটা সময় বলতে শুরু করল বাবা ভেবেছিল ওনার পছন্দের ছেলেটা ভালই হবে। শশুরেরও টাকা-পয়সার কোন অভাব ছিল না। কিন্তু বিয়ের কিছুদিন পর লক্ষ্য করলাম লোকটা ব্যবহার দিনদিন কেমন কঠিন হয়ে আসছে। নেশা করে অনেক রাতে বাসায় ফিরত। আমি কিছু জিজ্ঞেস করলে আমাকে খুব মারধর করত এইটুক বলে রিয়া নিজেকে ধরে রাখতে পারল না। অঝোর ধারায় কাদতে লাগল। হয়ত অনেক দিনের জমানো কষ্ট করো কাছে প্রকাশ করছে। তাই বুক ফেটে কান্না আসছে। ওর কান্না আমি কখনোই সহ্য করতে পারতাম না। এজন্য ওকে কখনো কাদতে দিতাম না। অনুভব করলাম আমারও কান্না আসছে। আমিও কাদছি। রিয়া আবার বলতে লাগল বিয়ের দুবছর পর আমাদের মেয়ে (অরি) জন্ম নিল। ভেবেছিলাম সবকিছু নতুন করে শুরু করব। কিন্তু দিন দিন লোকটার অত্যাচার বাড়তে লাগল। দিনরাত কেবল নেশা নিয়ে পড়ে থাকত। কিছুদিন পর ওর ক্যান্সার ধরা পরে।
একটা সময় আমাদের একা করে পৃথিবী ছেড়ে চলে যায়। তারপর থেকে আমি মেয়েটাকে নিয়ে বাবার কাছেই থাকি। আর মেয়েটাকে আকরে ধরেই বেচে আছি। অরির বিয়ে হয়ে যাবার পর ওর স্বামী ওকে অস্ট্রেলিয়া নিয়ে যায়। আমাকে একা ফেলে অরি যেতে না করেছিল। পরে আমিই ওকে বুঝিয়ে পাঠিয়েছি। গতমাসে ওরা দেশে এসেছে কিছুদিন পর আবার চলে যাবে। আমি আবার একা হয়ে যাব। রিয়া কাদতে কাদতে কথাগুলো বলল। সবকিছু শুনে ওর প্রতি আমার কেমন মায়া অনুভব হল। ও সুখে ছিল না কথাটা ভাবতে আমার খুব কষ্ট হচ্ছিল। বেশি ভালবাসতাম এইজন্যই বোধ হয়। আমি বললাম। একটা কথা বলতাম রিয়া। রাখবে? বল কি বলবে। জীবনের এই বাকি সময়টুকু কি আমরা একসাথে কাটাতে পারি না? গল্পগুজব করে একসাথে নাহয় কাটিয়ে দিলাম। অন্তত বলতে পারতাম দুজন সুখী না হয় হইনি কিন্তু একসাথে মরতে পেরেছি। এ হয় না রাফাত। সমাজ কি ভাববে? আর মেয়েটা চাচ্ছে ওদের সাথে আমাকে নিয়ে যেতে। সবকিছু ঠিক করা আছে। এখন শুধু আমার হ্যা বলার অপেক্ষা। ভাবছি জীবনের বাকি সময়টুকু একা না থেকে ওদের সাথে কাটিয়ে দেব।
তাই আজ শেষবারের মত এখানে এসেছিলাম। হয়ত আর কোন দিন এখানে আসা হবে না। তোমার সাথেও আর দেখা হবে না। খুব মিস করব তোমায়। রিয়ার মুখ থেকে কথাগুলো শুনে আমি আর কিছু বলতে পারলাম না। তবে লক্ষ্য করলাম বুকের ভেতর পচিশবছর বছর আগের সেই পুরোনো ব্যাথাটা আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। যেটা এতটা বছর আমাকে নিরব যন্ত্রনা দিয়ে আসছে। কোন কিছুতেই যেন থামছে না। রিয়াকে আবারও হারিয়ে ফেলছি কথাটা ভাবতে বুকের ভেতরটা হাহাকার করে উঠল। রাফাত, সন্ধ্যা হয়ে আসছে। আমাকে যেতে হবে। ড্রাইভার আমার জন্য অপেক্ষা করছে। আর মেয়েটাকে না জানিয়ে এসেছি। বাসায় খুজে না পেলে ও চিন্তা করবে। ছোঁয়াকে খুব দেখার ইচ্ছে ছিল কিন্তু সে সময় বোধহয় পাব না। শেষবেলা শুধু এটুকুই বলতে চাই, তুমি ভাল থেক। নিজের খেয়াল রেখ। এই কামনাই রইল। আর যদি পার তোমার রিয়াকে ক্ষমা করে দিও।
বাই কথাটা বলে রিয়া আর দাড়াল না। সামনে অপেক্ষারত গাড়িটার দিকে এগুতে লাগল। আমি পেছন থেকে ওর চলে যাওয়া দেখছি। মাঝে মাঝে ও পিছনে ফিরে তাকাচ্ছিল। আমি শেষবারের মত রিয়ার অশ্রুঝরা চোখদুটি দেখতে পেলাম। আমি জানি এটাই শেষ দেখা! আর কোনদিন এই চোখ দেখতে পাব না। গাড়িতে বসে রিয়া আমাকে হাত নেড়ে বিদায় জানাল। আমিও সংক্ষেপে হাত তুললাম। মুহুর্তের মধ্যেই রিয়াকে নিয়ে গাড়িটা চোখের আড়ালে চলে গেল। আমার কেবলই মনে হচ্ছিল খুব কাছের কিছু একটা আমি চিরতরে হারিয়ে ফেলছি। কিছুতেই আটকাতে পারছি না। বুকের ভেতর চিনচিন করা ব্যাথার পরিমানটা বেড়ে যেতে লাগল। তবে আমার কোন কষ্ট অনুভব হচ্ছিল না। এই ভেবে যে মৃত্যুর আগে শেষবারের মত রিয়াকে দেখতে ত পেলাম। এতেই চলবে! সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে, বাসায় যেতে হবে। মেয়েটা আবার বাসায় ফিরে না দেখলে খুজতে বেরুবে।
শেষ বিকেলের সূর্যটা রক্তবর্ণ ধারন করে অস্ত যাচ্ছে। যেকোন একদিন আমার জীবন থেকেও শেষবারের মত বিদায় নিবে। সেদিনটা খুব বেশি দূরে নয়। খুব নিকটেই! কিছুদিন থেকে বিন্দুকেও স্বপ্নে দেখছি। ও এসে দূর থেকে মায়াবী হাসি দিয়ে অন্ধকারে হারিয়ে যায়। হয়ত ওর কাছে চলে যাবার দিন ঘনিয়ে আসছে তাই স্বপ্নে দেখা দিচ্ছে। এখন আর কোন আফসোস নেই। নেই কোন চাওয়া। তবে সৃষ্টিকর্তার কাছে চিৎকার করে এটুকু বলতে ইচ্ছে করছে! ভালবেসে কি খুব অপরাধ করেছিলাম? নাহলে কেন আমরা সুখী হলাম না? কেন সারাটা জীবন কষ্ট নিয়ে বেচে থাকলাম? জানি এর কোন উত্তর নেই। নেই কোন সমাধান! তবুও উত্তরটা খুব জানতে ইচ্ছে করছে। হয়ত কোন দিন পাব না। কোন দিন না।?
(সমাপ্ত)