অলিখিত পতিতা

অলিখিত পতিতা

ঘর থেকে পালিয়ে আসা নিকিতার মনে হচ্ছে কে যেন তার পেছন পেছন হাঁটছে কিন্তু পেছনে তাকাতেই কাউকেই দেখতে পারছে না,

আবার পায়ের শব্দ তার কানে প্রতিধ্বনি হচ্ছে । রাত্রে হলে ভৌতিকতায় কিছুটা বিশ্বাস থাকতো কিন্তু দিন দুপুরে এমন হচ্ছে কেন ?

নাকি সবটাই তার অবচেতন মনের অনুভূতি !
.
হঠাৎ সামনে নিকিতা তার বাবাকে দেখে থমকে দাঁড়িয়েছে ।
.
– নিকিতা কোথায় যাচ্ছি মা, আর তোর হাতে ব্যাগ কিসের ।
.
– জি বাবা বান্ধবীর বাসায় যাচ্ছি ।
.
– দে ব্যাগটা আমার হাতে দে আমি এগিয়ে দিয়ে আসি…
.
– না বাবা তোমার যাওয়া লাগবে না আমি একাই যেতে পারবো ।
.
– আমি জানি মা তুই মিথ্যা বলছিস, তুই বান্ধবীর বাসায় যাচ্ছিস না, যাচ্ছিস কাজী অফিসে, রিহাবকে বিয়ে করার জন্য ।

….বাড়ি থেকে পালিয়েছিস তাই না ?
.
– না বাবা বাড়ি থেকে পালাব কেন ? আর বিয়ে করার প্রশ্নই আসে না ।
.
– আমি সব জানি মা, এই যে আমার মুখে চুনকালি দিয়ে সমাজের চোখে আমাকে ছোট করে পালিয়ে বিয়ে করছিস এটা কি ঠিক হচ্ছে ।

আচ্ছা আমি কি তোকে খুব যত্নে আদর করে ভালোবাসা দিয়ে মানুষ করিনি । আমার কষ্টার্জিত উপার্জন দিয়ে তোকে লেখা পড়া শিখাইনি ।

তোর কি মনে আছে মা, একবার তোর নিউমনিয়া হয়েছিলো খুব সিরিয়াস অবস্থা তোকে বাঁচানোটাই কষ্ট সাধ্য হয়ে দাঁড়িয়েছিল ।

সেসময় হাসপাতালে আমি তোর বিছানায় পাশে তিন রাত নির্ঘুমে কাটিয়েছিলাম আর জায়নামাজে মোনাজাতে বসে পার্থনা করেছিলাম,

হে আল্লাহ আমার সোনা মানিকটাকে তুমি ভালো করে দেও আমার জীবনের বিনিময়ে ওর জীবন ফিরিয়ে দেও । মনে আছে তোর ?
.
– না বাবা মনে নেই
.
– মনে থাকবেই বা কেন দুই দিনের ভালোবাসার জন্য মায়ের অকৃত্রিম ভালোবাসা আর আমার স্নেহ মমতাকে পায়ে ঠেলে দিয়ে বাড়ি থেকে পালিয়ে যাচ্ছিস ?

….এই কি তোর পুথিগত বিদ্যার বিবেক বোধ ! এই সব দেখার আগে আমার মরণ হলো না কেন ?
.
– না বাবা আমি এমনটা করতে চাইনি, আমি যাকে ভালোবাসি তাকে তো তোমরা মেনে নিবেনা বাবা ।
.
– কেনই বা মেনে নিব বল । যে ছেলে মাঝ পথে লেখা পড়া থামিয়ে এলাকায় মাস্তানি করে বেড়ায়…,

….চার পাঁচটা মেয়ের সাথে সম্পর্ক রাখে সে ছেলেকে কেনই বা মেনে নিব বল ?
.
– না বাবা ও ছেলেটা খুব ভালো তুমি যা শুনেছ সব মিথ্যা এবং ভুল ।
.
– আমি কারো কাছ থেকে কিছু শুনিনি সব আমার নিজের চোখে দেখা ।
.
– না বাবা তোমার দেখায় ভুল আছে । তুমি যাই বলনা কেন আমি ঐ ছেলেকেই বিয়ে করবো ।

একবার যখন বাড়ি থেকে বেরিয়েছি আর ফিরবো না ।
.
– এখন হয়তো ফিরবিনা যখন নিজের সবকিছু শেষ করে নিজের ভুলটা বুঝতে পারবি তখন হয়তো ফিরবি কিন্তু তখন অনেক দেরি হয়ে যাবে মা ।

আবেগ আর মোহ দিয়ে জীবন চলে না । জীবন বড় কঠিন । এখানে বাস্তবতা মেনে জীবন কে পরিচালনা করতে হয় তা না হলে যে পস্তাতে হয় ।
.
– আমার যথেষ্ট জ্ঞান হয়েছে বাবা । আমার ভালো আমি বুঝতে পারি । তুমি আমার পথ থেকে সরে দাঁড়ালেই খুশি হবো বাবা ।
.
– আমি তো তোর পথ আগলে দাঁড়াইনি, যে তোর সামনে দাঁড়িয়ে আছে সেটা তোর মস্তিষ্কের নিউরোন থেকে তৈরি কল্পিত বাবা ।

…তোর বিবেক ও বলতে পারিস ।
.
– মস্তিষ্ক , কল্পনা , বিবেক এতো কিছু বুঝি না বাবা আমি ঐ ছেলেকে বিয়ে করবো এটাই ফাইনাল, এছাড়া আমার কোন গতি নেই ।
.
– গতি নেই কেন ?
.
– সব কথা তোমাকে বলতে পারবো না বাবা ।
,,,,,,
ঐ তো কাজী অফিস দেখা যাচ্ছে এখানেই তো রিহাবের আসার কথা কিন্তু কাজী অফিসে একা একা প্রবেশ করতে কেন যেন লজ্জা লাগছে নিকিতার,

তার চেয়ে বরং রিহাব কে একটা ফোন করা যাক ।
….
একবার, দুইবার , তিনবার কল করার পরেও রিহাব কে পাওয়া যাচ্ছে না । কি ব্যাপার রিহাবের ফোন বন্ধ কেন ? ফোন বন্ধ থাকার কথা তো নয় ।

রিহাব বলেছিল পাঁচটার আগেই কাজী অফিসের সামনে এসে দাঁড়িয়ে থাকবে এখন তো সারে পাঁচটা বাজে তবে আসলো না কেন আর ফোনটাই বা বন্ধ কেন ?

কোন বিপদ হলো না তো ! কাজী অফিসের ভেতরে গিয়ে কি দেখবে রিহাব তার জন্য অপেক্ষা করছে কিনা ?
,
মাথায় টুপি আর মোটা কাঁচের চশমা পরে বসে আছেন কাজী সাহেব । চোখ গুলোকে তীর্যক ভাবে কেন যেন বড় বড় লাগছে ।

হয়তো মোটা কাঁচের জন্য এমন দেখাচ্ছে । তার সামনে এককী একটি মেয়েকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে কিছুটা অপ্রস্তুত ।
.
– কিছু বলবে মা ?
.
– জি আঙ্কেল, রিহাব নামের একটি ছেলে এখানে আসার কথা ছিল, সেকি এসেছে ?
.
– না মা কোন ছেলে তো আসেনি । কিন্তু সে এখানে কেন আসবে ?
.
– না মানে,, আজ আমাদের বিয়ে হওয়ার কথা ছিল ।
.
– ও,,,, বুঝতে পেরেছি কিন্তু মা আমার মনে হয় না ছেলেটা এখানে আসবে তুমি বরং বাড়ি ফিরে যাও । এই জীবনে অনেক তো দেখলাম ।

কেউ কথা রাখে না । সবাই শুধু আশার বাণী শুনিয়ে যায় । ।
,
কাজী অফিসের সামনে আরো ঘন্টা খানেক দাঁড়িয়ে ছিল নিকিতা….,

কিন্তু রিহাব আসেনি ফোনটাও বন্ধ এছাড়া ক্লান্ত পায়ে রিহাবের বাসায় পর্যন্ত গিয়েছিলো নিকিতা, সেখানেও নেই বাসাতেও তালা মারা ।
.
কেন এমন করলো রিহাব । রিহাবের প্রতি তার ভালোবাসার কমতি তো ছিল না । যা চেয়েছিল সবকিছু উজার করে দিয়েছে ।

নিজের দেহটা পর্যন্ত বিলিয়ে দিয়েছে ভালোবাসার তরে । তবে কেন এমন বিশ্বাস ঘাতকতা করলো ?

কেন তার পবিত্র ভালোবাসাকে অপবিত্র করে পালিয়ে গেল কাপুরুষের মতো ? কেন এমনটা করলো কেন ??
.
পার্কের বেঞ্চিতে বসে খুব কান্না করছে নিকিতা সেই কষ্টের কান্নার শব্দ গাছের প্রতিটি ডালে ডালে প্রতিধ্বনি হচ্ছে ।

পাখিরাও যেন তার কান্নার শব্দে স্তব্ধ হয়ে গেছে ।
.
সন্ধ্যা ঘনিয়ে রাতের আঁধার পার্কের পরিবেশটাকে গুমোট করে তুলেছে কিন্তু নিকিতার কোন ভয় করছে না ।

কিসের ভয়, সম্ভ্রমের ? সেতো একজনের হাতে লুন্ঠিত হয়েছে অনেক আগেই তবে ভয় করে লাভ কি !
.
– এই ছেমড়ি তোর রেট কতরে ?
.
আচমকা এমন কথা শুনে পেছনে তাকিয়েছে নিকিতা । কিসের রেট জিজ্ঞেস করলো লোকটা বুঝতে সময় লাগলো তার,

হ্যা তাই তো তার এখন নিলামে উঠার সময়, সময় নিজেকে বিলিয়ে দেওয়ার ।

যেখানে ভালোবাসা মানুষ তাকে চিনেনি সেখানে রাস্তার মানুষ তাকে চিনবে কি করে ।
.
– আমাকে কি আপনার সেই রকম মনে হয় ? মনে হয় ভ্রাম্যমান কোন পতিতা । বলুন, মনে হয় ?
.
লোকটা ভরকে গেছে, রাগ নিয়েই কথা গুলো বলেছিল নিকিতা তাই হয়তো লোকটি চলে গেছে,

কিন্তু এই জায়গাটি যে তার জন্য নিরাপদ নয় সেটা সে বুঝে গেছে ।

এখন তার কি করা উচিত বা কোথায় যাওয়া উচিত কিছুই বুঝতে পারছে না সে । মৃত্যুই কি তার জন্য একমাত্র মুক্তির পথ ?
.
– মৃত্যু কেন তোর মুক্তির পথ হবে মা । তোর জন্য আমাদের ভালোবাসা দরজা সবসময় খোলা যে ।
.
– কিন্তু বাবা,,,
.
আমি জানি মা তুই প্রচণ্ড একটা ভুল করেছিস যে ভুলের মাশুল তোর পক্ষে হয়তো দেওয়া সম্ভব না, কিন্তু মা, জীবন তো কারো জন্য থেমে থাকে না ।

তোকে যে আবার নতুন করে পথ চলতে হবে । আবার নতুন করে বাঁচাতে হবে । তুই বাড়ি ফিরে যা আমরা যে তোর জন্য বড় উদগ্রীব হয়ে বসে আছি ।
,,,,
দুই পাশে গাছের সারি তার ফাঁকে ফাঁকে ল্যাম্প পোস্ট । সেই ল্যাম্প পোস্টের আলোয় নিকিতার অশ্রু ভেজা অবয়ব কে অদ্ভুত দেখাচ্ছে ।

নিশি রাতের হুতুম পেঁচা গুলো বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে আছে অচেনা একটি মেয়ের দিকে ।

মেয়েটি জানেনা তার পরিবার এবং সমাজ তাকে মনে নিবে কিনা । মেনে নিবে কিনা এই অলিখিত পতিতাকে ।

গল্পের বিষয়:
দু:খদায়ক
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত