এই নীল শোন, পিছনে তাকিয়ে দেখি মারিয়া ডাকছে।
আস্তে আস্তে ওর কাছে গেলাম।
ইদানিং দেখা হলেই অপমান করে।
আর একি কলেজে পড়াতে অপমানের ধাপটা আরও এগিয়ে।
তবুও গেলাম……!
আজকে মারিয়া একা না সাথে আরও বান্ধবীরা আছে।
বোঝাই যাচ্ছে আজকে অপমানের পরিমান বেশি ছাড়া কম নয়।
আজকাল অপমান কে আর অপমান মনেই হয় না।
– বল কি বলবি (আমি)
কাছে যেতেই প্রশ্ন করলাম।।
– কেন খুব তাড়া আছে নাকি? (মারিয়া)
– তাড়া হবে না দেখ হয় তো কোন মেয়ের সাথে বা লাভারের সাথে দেখা করতে যাবে। (মিতু)
– আরে আরে কি বলিস? ওর হবে জিএফ? ওকে দেখলেই তো মেয়েরা ভয় পায়। (নিতু)
কথাগুলো বলেই সবাই একসাথে হেসে উঠলো।
মাথা নিচু করে দাড়িয়ে আছি।
মুখে কোন কথা নেই কথা বললেই হিতে-বিপরীত হবে।
তাই চুপ থাকাই শ্রেয়।
– এই শোন তুই আমাদের সামনে আর আসিস না। (মারিয়া)
– কেন?
– আরে বুঝিস না কেন তোরে দেখলেই তো আত্তা উড়ে যায় ভয়ে। হু হি হু হু……..
কোন কথা না বলেই হাটা শুরু করলাম। যতই থাকবো ততই বললে।।
– এই যে রাজকুমার খুব তাড়া আছে নাকি?
পিছন থেকে ডাক দিলো। কিন্তু তাকালাম না সোজা মেসের উদ্দেশ্য রওনা দিলাম। মেসে আসছি কয়েক দিন হলো !
আজকাল মেসেও আমি হাসির পাএ ! আগে নানুর বাসায় থাকতাম কিন্তু একটু দুর হওয়াতে মেসে পাঠালো নানু।
মাস পুরলে আর থাকা যাবে না।
আচ্ছা কালোরা কি মানুষ না?
আমি না হয় একটৃ কালো।
না। ভুল বললাম একটু না অনেকটাই কালো।
নিজে যখন আয়নার সামনে দাড়াই তখন বুঝি কত টা কালো!
সবাই বলে, আমি নাকি মায়ের হাত পেয়েছি সাথে চেহারাটাও।
আমার বাবা যখন মারা যায় তখন নানুরা সবাই মিলে আবার মাকে বিয়ে দেয়।
তখন আমার বয়স সবে ৭।
একটু বুঝতে শিখেছি মাএ।
আমার সৎ বাবা মাকে বিয়ে করেছিলো রুপের জন্য না কারন আমার মায়ের সেটা ছিলো না,
টাকার জন্য করেছিলো কিন্তু সেটাই যখন পাচ্ছে না তখন মাকে বালিশ চাপা দিয়ে মেরে দিলো।
মায়ের গলায় একটা হাতের দাগ ছিলো। অনেকক্ষণ তাকিয়ে ছিলাম মায়ের দিকে। মায়ের কালো মুখটা আরও কালো আকার ধারন করেছিলো।
মা মারা যাওয়ার কয়েকদিন পরই বাবা ঘরে নতুন বউ আনে।
দেখতে অনেক সুন্দর। কিন্তু আমাকে দেখতে পারে না। একটা কালো ছেলেকে কেন ভালোবাসবে? সেটাও আবার সৎ মা নিজের মা হলে না হয় হতো।
নানু আমাকে নিয়ে গেলো।
নানু বাড়িতে্র সবাই নানান কথা শুনাতো।
সব সহ্য করতাম। দৌড়ে যেতাম পার্লারে ফর্সা হওয়ার জন্য।
কিন্তু তারা হেসে হেসে বলে, আমাকে নাকি এসিড মেরে ফর্সা করতে হবে।
সেটাই করতে খুব ইচ্ছা ছিলো। কিন্তু নানু একদিন মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলেছিলো, “নানু ভাই, কালো মানুষের মনটা অনেক ভালো হয় ”
কথাটা বিশ্বাম করেছিলাম।
কখনো কোন বন্ধু পাই নি কেউ বন্ধুত্ব করতো না।
আসলেই তো একটা কালো ছেলের সাথে কেনোই বা করবে?
একবার ছোট খালামুনির জন্য মামা বিদেশ থেকে ক্রিম পাঠাইছিলো।
আমি আড়াল থেকে শুনেছিলাম এটা নাকি ফর্সা হওয়ার জন্য।
মাঝে মাঝে লুকিয়ে মুখে দিতাম।কিন্তু ফর্সা হতে পারলাম না তবুও চেষ্টা করতাম!
একদিন ধরা পড়ে গেছিলাম খালামুনির কাছে।
খালামুনি মুখে কয়লার গুড়ো দিয়ে বলেছিলো, এইটা মাখ ফর্সা হবি।
পুকুর পাড়ের কদম গাছের গোড়াই বসে খুব কেদেঁছিলাম সেইদিন।
পিছন থেকে কাধে হাত দিয়ে নানু বলেছিলো, “নানু ভাই, তোকে বাজারের সবচেয়ে দামি ক্রিম এনে দিবো, তুই ঠিক একদিন ফর্সা হবি “।
এর পর থেকে সবার নজর এড়িয়ে আমাকে ক্রীম এনে দিতো।
অনেক রাতে ববহার করতাম কেউ যেন না দেখে তাই। হতে পারলাম না।
একবার পাশের বাসার একটা মেয়েকে খুব ভালো লাগলো, প্রতিদিন তাকিয়ে থাকতাম।
একদিন মেয়েটা হাতের ইশারা তে ডাকলো।
খুব খুশি হলাম সাথে সাথে দৌড়ে গেলাম ওর কাছে।
তার কাছে যেতেই মুখে হাত দিয়ে হাসতে লাগলো।
কিছুক্ষণ পর বললো,
– আয়নাতে নিজের চেহারা দেখছিস?
কথাটা শুনেই মাথা নিচু করে নিলাম। উওরের ভাষা তো আমার জানা নেই কি উওর দিবো?
নানান কথা শুনিয়ে দিলো।
বাসায় এসে অনেক কাদলাম। মেয়েটা অনেক সুন্দর ছিলো তাতে কি? আমি না হয় কালো তাই বলে কি আমার ভালোবাসার অধিকার নেই?
সেই দিনের পর থেকে আর কোন মেয়ের দিকে তাকাই না।
কারও সাথে মিশি না!
স্কুলে একা যাই আবার বাসায় এসেই রুমে বসে থাকি সব সময়।
স্কুলেও কেউ আমার সাথে বসতো না।
পিছনের একটা টুলে বসতাম।
সবাই হাসাহাসি করতো সুযোগ পেলেই।
তাই চোখ মুখে প্রচুর পাউডার মাখতাম। যেন একটু হলেও ফর্সা দেখায়।
কিন্তু ফর্সা দেখানোর বদলে সার্কাসের জোকারের মত লাগে। এতে আর বেশি হাসা হাসি করতো।
নিজেকে বন্ধি করে নিই চার দেওয়ালে।
কারও সাথে কথা বলতাম না।
নানু যখন বাইরে থেকে আসতো আমার ঘরে এসে গল্প করতো অনেক। অনেক মজা করতাম।
নানু আমার রুমে আসার আগে মুখে কালি মেখে আসতো।
এসেই বলতো, “নানু ভাই, এই দেখ তুই আর আমি এক ” নানুর কথা শুনে লুকিয়ে কাদতাম।
কেউ আমাকে বোঝে না শুধু নানু ছাড়া।
আগে মা অনেক ভালোবাসতো।
১৮ বছর বয়সে বুঝে গেলাম কালো মানুষের দাম নেই এই সমাজে।
বয়স যখন ২১ তখনি আমার বিয়ের জন্য মেয়ে দেখা শুরু করলো নানু।
অনেক মেয়ের বাড়িতে নিয়েও যায় আমাকে। কিন্তু মেয়ের বাবা মা মুখের উপরই না করে দিলো। আমাদের সামনেও আনলো না মেয়েকে।
একবার মেয়ে দেখতে গিয়ে বসে আছি।
অনেক গুলো হাসির শব্দ পেয়ে পিছনের জানালার দিকে তাকাতেই দেখলাম অনেক মেয়ে হাসাহাসি করছে তাদের মধ্যে একজন বেশি হাসছে।
এবারও মা বাবা মুখের উপর না করে দিলো যে মেয়ে বিয়ে দিবে নি।
নানু অনেক বার বলার পরও মেয়েকে সামনে আনলো না।
বাসায় এসে ঠিক করলাম আর বিয়েই করবো না।
নানু খুব অসুস্থ হয়ে পড়লো। আমাকে কাছে ডেকে বললো,,,, “শোন নানু ভাই, একাই বেচে থাক, যে যাই বলুক ”
এই কথাটাকেই হাতিয়ার হিসাবে নিলাম। একাই বেচে আছি কিন্তু নানু নেই। আমার কোলে মাথা রেখেই সেই দিন শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেছিলো।
পরে জানতে পারি আমার নামে মোটা অংকের টাকা উইল করে গেছে।
নতুন ব্যবসা শুরু করলাম। দেশে বিদেশে কয়েকটা ছোট বড় কোম্পানিও আছে নিজের।
দিন কাটছে সাথে কমছে বয়সের খাতা থেকে আয়ু।
নানুর শেষ কথাটা সব সময় কানে বাজে, “শোন নানু ভাই, একাই বেচে থাক, যে যাই বলুক ”
বয়স ৪০ ছাড়িয়ে।
শুনলাম একটা মেয়ের মা আর বাবা এসেছে বিয়ের বিয়ের জন্য।
তাদের কাছে যেতেই মেয়ের মাকে চিনে ফেললাম, অনেক আগে একবার ফিরিয়ে দিয়েছিলো আমাকে আর নানুকে।
সরাসরি না করে দিলাম। মেয়েটার ছবি দেখালো।
বড়ই সুন্দরী।
আমাকে না আমার সম্পদ কে বিয়ে করতে চায় ওরা।
কিন্তু তারা জানে না, আমার মৃত্যুর পর সব কিছু, বিভিন্ন আশ্রম,এতিমখানা, বিদ্ধাশ্রম ইত্যাদিতে উইল করা আছে।
একাই তো কাটলো এতোটা বছর।
বাকি দিন গুলো না হয় একাই কেটে গেলো।
তাতে দোষের কি?
নানুর কথাটা আজকে খুব বেশিই মনে পড়ছে, “শোন নানু ভাই, একাই বেচে থাক, যে যাই বলুক “