রক্ত

রক্ত

এক্সিডেন্ট, প্রাইভেট কারটা ভেঙ্গে চুরমার হয়ে যায়। যে মেয়েটা ড্রাইভিং সিটে বসেছিল। সে ব্যথায় নীরব চিৎকার করছে। তার দেহ থেকে রক্ত ঝরছে। এক মুহূর্তে জায়গাটা রক্তে ভেসে যায়। উৎসুক জনতার অনেকে দৃশ্যটা উপভোগ করছে। আবার অনেকে মেয়েটাকে বাঁচাতে এগিয়ে আসছে। একটা ছেলে চিৎকার করে বলতে থাকে, ‘অ্যাম্বুলেন্স, অ্যাম্বুলেন্স, অ্যাম্বুলেন্স। কেউ হাসপাতালে অ্যাম্বুলেন্সের জন্য ফোন করেন। এই যে শুনছেন? আপনি আমার কথা শুনতে পারছেন? আপনি জ্ঞান হারাবেন না। আপনার কিছু হবে না। আপনাকে এখনেই হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।’ মাওয়া এক পলক তাকায়। তারপর ধীরে ধীরে জ্ঞান হারায়। অ্যাম্বুলেন্সের অপেক্ষা না করে মাইক্রো করে হাসপাতালে ছুটে চলে।

•দুইদিন পর।

•মাওয়া চোখ মেলে তাকায়। সে দেখে হাসপাতালের বেডে শুয়ে আছে। মাথায় যে চুট পেয়েছিল আর যে রক্ত জড়েছিল! তাতে বাঁচার আশংখা কমেই ছিল। সে ভাগ্য গুণে বেঁচে গেছে। নার্স আসছে, তার জ্ঞান ফিরেছে দেখে ডাক্তারকে ডাকতে চলে যায়। মাওয়ার চোখ দু’টো একজনকে খুঁজে বেড়াচ্ছে। কিন্তু তাকে পাচ্ছে না। বার বার জ্ঞান হারানোর আগের কথাগুলো কানে বাজছে।

ডাক্তার আসে মাওয়াকে কিছু প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করে চ্যাকআপ করে। তারপর নার্সকে কি যেন বুঝিয়ে মাওয়ার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে যায়। যে তার জীবন বাঁচিয়েছে। আবার মাওয়ার চোখ দু’টো তাকে খুঁজে বেড়াচ্ছে।

– ‘মিস মাওয়া আপনার জন্য একটা চিঠি।’
– ‘কে দিয়েছে?’
– ‘যিনি আপনাকে হাসপাতালে নিয়ে এসেছেন। এবং আপনার জন্য রক্তও দিয়েছেন তিনি।’
কথা শুনে মাওয়ার শরীরটা কেমন ঠান্ডা হয়ে যায়। মনে হচ্ছে সে বরফের মতো জমে গেছে। ধীরে ধীরে চিঠিটা হাতে নিয়ে বলে
– ‘ধন্যবাদ।’
চিঠিটা হাতে দিয়ে নার্স চলে যায়। মাওয়া চিঠিটার দিকে তাকিয়ে আছে।

•প্রিয় আপু,
আপু বলে ডাকার জন্য প্রথমে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি। আল্লাহ তায়ালার কাছে লাখো কুটি শুকরিয়া। আলাহ তায়ালা তোমাকে যে বাঁচিয়েছেন। আমি দেখতে ছিলাম একটা কার দ্রুত আসছে। কিন্তু কিছু বোঝার আগেই এক্সিডেন্ট। বুঝতে পেরেছিলাম ইচ্ছা করে করেছিলে। তোমারর এক্সিডেন্টের পিছনের গল্পটা আমি জানি না। কিন্তু একটা কথাই বলব। জীবনটাকে নিয়ে খেলবে না। তুমি জানো তোমাকে নিয়ে আমরা কত ভয় পেয়েছিলাম? তোমার গ্রুপের রক্ত পাওয়ায় যাচ্ছিল না। মনে হচ্ছিল তোমাকে বাঁচাতে আর পারলাম না। যখন আমার রক্তের সাথে মিলে গেল কতটুকু খুশি হয়েছিলাম বোঝাতে পারব না। কারণ আমার জীবনের তো দাম নেই। আমি বাঁচলেই কি মরলেই কি বরং মরলেই আরো ভালো। আমার জন্য কেউ কাঁদবে না। আমার রক্ত দিয়ে যদি তোমাকে বাঁচাতে পারি। তাতে আমি মরলেও শান্তি। আর কখনও এরকম করবে না। এই অভাগা ভায়ের কথাটা রেখো! ভালো থেকো।

•চিঠিটা পড়ে মাওয়া থমকে যায়। রক্তের বাহিরে কেউ কারো জন্য এতটুকু করে? এটাও সম্ভব? কিন্তু কিভাবে? যে ছেলেটা তাকে চিনে না জানে তবুও তার জন্য এতো কিছু করল? কিন্তু কেন? অজানা কারণে চোখে পানি চলে আসে।
– ‘মা, কেমন আছিস?’
তার বাবা রুমে ডুকতে ডুকতে কথাটা বলে। দু’চোখে মেয়ে হারানোর ভয়। আবার মেয়ে ফিরে পাওয়ার আনন্দ।
– ‘তোর মা চলে গেল। তুইও চলে যেতে চাইলি? কেন রে? এই বুড়ো মানুষটা একা একা কিভাবে বাঁচবে? মা, তুই চলে গেলে আমি কি নিয়ে বাঁচতাম?’
মেয়েকে বুকে জড়িয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলে
– মাওয়া কিছু বলে না চুপ করে আছে। তার চোখ দুটি জলে ভেজা।

•রাতের আঁধার কুয়াশারা খেলা করছে। তাওহীদ মাউথওরগান বাজাচ্ছে। যেদিন মনটা কষ্টে জর্জরিত থাকে, যেদিন মনটা আনন্দে থাকে, ঐ-দিন বাজাবে। আজ তার আনন্দের দিন। নার্সকে ফোন করেছিল। নার্স বলেছে, ‘মিস মাওয়া বাসায় ফিরেছেন।’ বোনের ঘুম জড়ানো মুখটা বার বার ভেসে উঠছে। তাওহীদের খুব ইচ্ছা করছে বোনের হাসি মাখা মুখটা দেখতে। কিন্তু সেটা কিভাবে সম্ভব? সেটা তো সম্ভব নয়। কারণ সব আশা পূরণ হয় না। সব কল্পনা বাস্তব হয় না। তার বুকের ভিতরটা নড়ে ওঠে।

মাওয়া রাতের আকাশে তাকিয়ে আছে। তার মনে হাজারো প্রশ্ন কিন্তু একটা প্রশ্ন তাকে কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে। কে ওই ছেলে কেন বাঁচাল কেন পরিচয় না দিয়ে পালাল? আজ যে তার ব্র্যাকআপ হয়েছে এটা মাথাতেই নেই। তাকে প্রশ্নটা বার বার যন্ত্রনা দিচ্ছে। এবং যতোক্ষন উত্তর পাচ্ছে না ততোক্ষন যন্ত্রনা দিয়ে যাবে। কিন্তু কোথায় পাবে কিভাবে পাবে? জ্ঞান হারানোর পূর্বে শুধু মুহূর্ত কাল দেখেছে। যদি অল্প দিনের মধ্যে না পায় তার চেহারাও ভুলে যেতে পারে? তখন কিভাবে তাকে পাবে? মাওয়া গভীর ভাবনায় ডুবে যায়।

– ‘মাওয়া মা, খেতে আয়।’
বাবার ডাকে বাস্তবে ফিরে।
– ‘জি বাবা আসছি।’
মাওয়া চুপ করে বসে আছে কিছু খাচ্ছে না।
– ‘কিরে মা কি হয়েছে খাচ্ছিস না কেন?’
– ‘বাবা ঐ ছেলেটা কে ছিল? তোমার সাথে তার দেখা হয়েছিল কথা হয়েছিল?’
– ‘না মা, সে আমার সাথেও দেখা করেনি কথাও বলেনি।’
বাবাকে আর কোনো প্রশ্ন করেনি। মাওয়া কিছুক্ষণ বসে থেকে ওঠে যায়।
– ‘কিরে মা না খেয়েই উঠে পরলি?’
– ‘ভালো লাগছে না।’
তার বাবা আর কথা বাড়ায়নি।

মাওয়ার মনে একটায় ভাবনা ওকে যেকোনো মূল্যে খুঁজে বের করতেই হবে। কিন্তু কেন খুঁজবে? কেন খুঁজে বের করবে? উত্তর জানে না। জানতেও চায় না।

•ভোরের আলোয় কুয়াশারা লুকিয়ে পরছে। তাওহীদ ঘুম ঘুম চোখে সকালটা দেখছে। সে এই বছর অনার্স প্রথম বর্ষে পা দিয়েছে। পড়াশুনার আরেকটা অধ্যায় শুরু করছে। তৈরি হয়ে ক্লাসে যায়। একটা ভয়ে ক্লাসরুমে একা একাই থাকে। ক্লাস শেষে একা একাই ঘুরে ফিরে, আবার দিন শেষে একা একা নীড়ে ফিরে। তার সঙ্গী কেউ নেই।

মাওয়া যে স্থানে এক্সিডেন্ট করেছিল। সে স্থানে অনেক বার এসেছে। এবং তার চারপাশে অনেক খুঁজেছে। কিন্তু তাওহীদের দেখা মিলেনি। এভাবে এক সপ্তাহ কেটে যায়। তবুও তাওহীদকে খুঁজে পাচ্ছে না। তার বাবা বার বার শাম্তনা দিয়ে যাচ্ছে। তবুও সে শান্তি পায় না। মায়ের মৃত্যুতে তার আর কোনো ভাই বা বোন দেখার ভাগ্য হয়নি। ছোটকাল থেকে তার এই একটা শূণ্যতা ছিল। অন্য ভাই বোনদের ভালোবাসা দেখে মনে মনে বলত, ‘যদি আমার একটা ভাই বা বোন থাকত!’ তখন একটা কষ্টের ঢেউ পুরো শরীরটা নাড়িয়ে দিত। মাওয়া কি এই ভাইটার সন্ধানও পাবে না? উত্তরটা জানে না। মাওয়ার খুব কান্না পাচ্ছে। সে ভাইটাকে একবার দেখতে চায়। ভাইয়া বলে ডাকতে চায়। আপু ডাকটা শুনতে চায়। মাওয়া সূর্যাস্ত দেখছে। বিষন্নতা চারপাশ থেকে তাকে ঘিরে ধরছে।

•কে তুমি? কি তোমার পরিচয়? কে তোমার বাবা? কে তোমার মা? বল, বল, বল আমাকে! হা হা হা বলতে পারছ না। বোকা ছেলে! না বলতে পারলে এভাবে কেউ কাঁদে? হা হা হা আমি তোমাকে বলে দিচ্ছি।

•স্বপ্নটা ভেঙ্গে যায়। এই একটা দুঃস্বপ্ন তাওহীদকে ঘুমাতে দেয় না। যখনেই ঘুমাতে যাবে তখনেই স্বপ্নে আসবে। তাকে কষ্ট দিবে, যন্ত্রনা দিবে, কুড়ে কুড়ে খাবে। ছোট সময় পরিচয় নিয়ে তাকে কেউ প্রশ্ন করলে সে উত্তর দিয়ে এতীমখানা। কেউ ঘৃণার চোখে তাকাত কেউ কষ্টের চোখে তাকাত। তাওহীদের বোঝার ক্ষমতা ছিল অবুঝ চোখে তাকিয়ে থাকত। রুম ছেড়ে ছাদে আসে। চারদিকে শুধু অন্ধকার আর অন্ধকার, নীরবতা আর নীরবতা। রাতের এই আঁধারে কেউ হাসে কেউ কাঁদে। কেউ ঘুমিয়ে কাটায়, কেউ নির্ঘুম কাটায়। কেউ রাতের ভ্রমর হয়, কেউ রাতের ফুল হয়। তাওহীদের ইচ্ছা করে অজানা কোনো ঠিকানায় হারিয়ে যেতে। যে ঠিকানায় তাকে কেউ চিনবে না, জানবে না, কোনো প্রশ্ন করবে না। রাতের নির্জনতায় নিজেকে হারাতে থাকে।

মাওয়ার ক্লাসে মন বসছে না। প্রিয় মানুষের মুখটা বার বার ভেসে উঠছে। পুরনো স্মৃতিগুলো যন্ত্রনা দিচ্ছে। কেন তাকে ভালোবাসলো? আবার কেন তাকে ফিরিয়ে দিল? সে তো নিজে থেকে ভালোবাসতে চাইনি। তার কোন অপরাধে তাকে ফিরিয়ে দিল? মাওয়ার উত্তর জানা নেই। ঐ-দিন তাকে ডেকে ব্র্যাকআপ করে। তারপর মাওয়া নিজেই এক্সিডেন্টটা করে। সে মরে যেতে চেয়েছিল।

হঠাৎ দেখে প্রিয় মানুষটা অন্য এক মেয়ের সাথে হাতে হাত রেখে ক্লাসে আসছে। দৃশ্যটা দেখে তার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে। চোখের পাতিগুলো ভিজে ওঠে। চুপ করে ক্লাস থেকে বের হয়ে আসে। মাওয়ার নিজেকে খুব একা লাগছে। খুব একা। পিছনে ফিরে প্রিয় মানুষটাকে আর একটিবার দেখে। এই তার হৃদয়ের মানুষ? এই সেই মানুষ যে তাকে রঙিন স্বপ্ন দেখিয়েছে। ঘর বাঁধার আশা জাগিয়েছে? মাওয়া কত বোকা? নিজে নিজে বলছে ভেজা চোখে হাসছে। কত বোকা, কত বোকা।

ক্যাম্পাসের এক পাশে এসে বসে। জোড়ায় জোড়ায় জুটি দেখে হাসে। মনে মনে বলে, ‘কেউ সত্যি কারের ভালোবাসবে। কেউ মিথ্যা অভিনয় করবে। দিন শেষে কেউ হাসবে, কেউ কাঁদবে।’ অবচেতন মনে দীর্ঘশ্বাস ফেলে। হঠাৎ চোখ আটকে যায়। সেকি ভুল দেখছে নাকি সত্য দেখছে? তাকে যে এভাবে পেয়ে যাবে ভাবতেও পারেনি। খুশিতে ভেজা চোখে এক টুকরো হাসি মুখে ফুটে।

তাওহীদ আপন মনে মাউথওরগান বাজিয়ে যাচ্ছে। মনের হৃদয়ে পৃথিবীর সকল বন্ধন ছেড়ে অন্য কোনো ঠিকানায় হারিয়ে গেছে। চোখে মুখে হাসি ভাব ফুটছে। আজ তার আপুকে দেখেছে। দেখা মাত্র তার মনটা কেমন শীতল হয়ে যায়। সে ভাবতেও পারেনি এই ভার্সিটিতে তার আপু পড়ে! কিন্তু তাকে পালাতে হবে অনেক দূরে পালাতে হবে। তা না হলে আবার প্রশ্নের সম্মক্ষিন হতে হবে। প্রশ্ন করলে তার পরিচয় কি দিবে? সে এক পরিচয়হীন ছেলে! পরিচয় জানার পর যদি রক্ত নিয়ে প্রশ্ন তুলে? কেন তাকে রক্ত দিয়েছে? যার কোন পরিচয় নেই সে কেন রক্ত দিতে গেল? এর চেয়ে সে মরে যেত। তখন সে কি উত্তর দিবে? তাওহীদের চোখ দু’টো ভিজে যায়। কয়েক ফোটা নোনাজল গড়িয়ে পড়ে।

মাওয়া তার পাশে বসে চুপ থেকে দেখছিল, মাউথওরগান বাজানো শুনছিল। তার মনটা শান্ত হয়ে যায়। চুপ হয়ে আছে। কারণ এই পরিবেশটাকে নষ্ট করতে চায় না। হঠাৎ দেখে তাওহীদের চোখে পানি! মাওয়া চমকে যায়। মনে অনেক প্রশ্ন ঘুরপাক খেতে থাকে। কিন্তু উত্তর পায় না। তাকে কি ডাকবে নাকি ডাকবে না? সে অসস্তিতে পরে যায়।

তাওহীদ চোখে মেলে তাকাতেই চমকে ওঠে। চোখের নোনাজল মুছে ফেলতে ভুলে যায়। সে স্থির হয়ে আছে। এটা সে আশা করেনি। পালানোর পূর্বেই ধরা খেতে হলো? কি করবে কি বলবে বুঝতে পারছে না। মাওয়া মুখে হাসি রেখে ভাইকে দেখছে। কথা বলার শক্তি হারিয়ে ফেলে। তাওহীদ ওঠে চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়ায়। মাওয়ার হৃদয়টা হুহু করে কেঁদে ওঠে। কেন সবাই তাকে দূরে ঠেলে দিতে চায়? কিন্তু কেন? অনেক কষ্টে মাওয়া বলে, ‘এই ভাইয়া একা ফেলে চলে যাবি?’

কথাটা শুনে আবার তাওহীদের চোখ ভিজে যায়। বোনের ডাক অপেক্ষা করে চলে যাওয়ার শক্তি তার নেই। মাওয়া তাওহীদের কাছে এসে চোখের পানি মুছে দিয়ে বলে, ‘আমি কেমন বোন হলাম ভায়ের নামটা পর্যন্ত জানি না। এমন ভাবে বলে যে তাওহীদ হেসে ফেলে। ছোট করে সে বলে, ‘আমার নাম তাওহীদ।’ মাওয়া বলে, ‘ভাইয়া আমাকে একবার আপু বলে ডাক না।’ তাওহীদ ছোট করে আপু ডাকে। মাওয়ার প্রাণটা জুড়িয়ে যায়। মনে হচ্ছে আপু ডাকটা শুনার জন্য কতকাল অপেক্ষা করে ছিল। তারপর ভাইকে বলে, ‘ভাই আমার সাথে চল।’ মাওয়া ভাইকে নিয়ে চলতে শুরু করে। তাওহীদ বাধ্য ছেলের মতো সাথে সাথে হাটছে।

‘বাবা দেখ কাকে নিয়ে এসেছি; তোমার এই সন্তানটা হারিয়ে গিয়েছিল। তাকে খুঁজে পেয়েছি।’ তাওহীদ মাওয়ার দিকে তাকিয়ে রয়েছে। মনে মনে নিজেকে প্রশ্ন করে, ‘আমি কী এই আদরের যোগ্য এই ভালোবাসার যোগ্য? সত্যটা জানলে আমাকে ভাইয়া বলে ডাকবে নাকি ছুড়ে ফেলে দিবে? তাওহীদকে এক মূহূর্ত দেখে বুকে টেনে নেয়। তাওহীদ অনুভব করে তার গাড়ে কয়েক ফোটা জল পড়েছে। এই কান্নাটা আবেগের নয়, মিথ্যা অভিনয়ের নয়, হৃদয় থেকে কান্না। যে কান্না সহ্য করা যায় না।

মাওয়া তার জীবনের গল্পটা শেষ করে বলে
– ‘এই হলো আমার গল্প। এখন তোর গল্প শুনবো বল কেন পালিয়েছিলি? কেন পালিয়ে বেড়াস?’ মুচকি হেসে তাওহীদ বলে
– ‘এমনেতেই।’
– ‘কিহ! এমনেতেই? সত্যটা বল।’
– ‘আমার যাওয়ার সময় হয়েছে।’
– ‘কী, ঠাসসসস।’ রাগে থাপ্পড় মারে। তোকে আটকিয়ে কে রাখছে তুই চলে যা।’
মাওয়া কাঁদছে। তাওহীদ বোনের চোখের পানি মুছে দিয়ে বলতে শুরু করে

ছোটকাল থেকে একটা প্রশ্ন শুনতে শুনতে আমি জ্বলে পুড়ে শেষ হয়ে যাচ্ছি। আমি জানি না কে আমি? কি আমার পরিচয়। আমি জানি না, কে আমার বাবা, কে আমার মা। আমাকে যখন রাস্তায় পেয়েছিল তার পর্বে কেন রাস্তার যন্তু জানোয়ারদের হাতে মারা যাইনি? মরলে ভালোই হতো। তাহলে সুন্দর এই পৃথিবীর নিষ্ঠুরতা দেখতে হতো না। ছোট সময় যখন কেউ প্রশ্ন করত তখন বোকা বোকা চোখে তাকিয়ে থাকতাম। তারপর উত্তর দিলে তারা কেমন চোখে তাকাত। আমি এই তাকানোর অর্থ বুঝতাম না। একটা সময় বড় হতে লাগলাম বুঝতে শিখলাম। অন্য ছেলে মেয়েরা বুঝতে শিকল। তারপর আমাকে ছেড়ে পালাতে লাগলো। একটাই কারণ ছিল আমি পরিচয়হীন। প্রথম প্রথম কষ্ট হত। ধীরে ধীরে সহ্য হয়ে গেল। মানুষদের অন্য চোখে দেখা, আমাকে ঘৃণা করা, দূরে ঠেলে দেওয়া এখন আর সহ্য হয় না।

হয়তো অতীমখানা আমার বাসস্থান না হলে অন্য যেকোন পরিচয় হতো। সেটাও ভালো হতো আমার গায়ে লাগত না। কিন্তু এখন লাগে। এই ভদ্র সমাজের ভদ্র ভাষাগুলো সহ্য হয় না। দোষ কি আমার? নাকি যারা জন্ম দিয়েছে তারার? উত্তরটা আমার জানা নেই। যেদিন তোমাকে রক্ত দিলাম সেদিন নিজের সাথে অনেক যুদ্ধ করলাম। রক্ত ম্যাচ হওয়ার পরও অনেক সময় নিয়েছিলাম। তারপর আমাকে রক্ত দিতেই হল। আমি চাইনি আমার শরীরের রক্ত তোমার শরীরে যাক। আর তুমি যেন আমার পরিচয় জানতে না পারো। এ জন্যই পালিয়েছিলাম। এবং আজকে এজন্যই পালাচ্ছিলাম। পরিচয় জানতে পারলে আমাকে ঘৃণা করবে। নিজে অনুশোচনায় ভুগবে, কষ্ট পাবে। আমি সেটা সহ্য করতে পারব না। এতোটুকু তাওহীদ থামে। মুচকি হেসে বলে, এই হলো আমার গল্প। এখন আমি আসি, ভালো থেকো।

“আমি আসি” কথাটা শুনে মাওয়া অনেক দুঃখ পায়, রাগে আবার গালে থাপ্পড় বসায়। ভায়ের চোখের পানি মুছে দিয়ে বলে, ‘বেশি বুঝনাদার ছেলে! দুনিয়ার প্রত্যেকটা মানুষেই খারাপ ভালো কেউ নেই? যদি পরেই ভাবিস তাহলে কেন আপু বলে ডাকলি আমাকে? তুই আমার ভাই আমি তোর বোন। এটাই তোর আমার পরিচয়। অন্য কোনো পরিচয়ের দরকার নেই।’ তাওহীদ বোনকে দেখছে। কথা বলার শক্তি হারিয়ে ফেলে। মনে মনে বলে, ‘ভায়ের কষ্ট বোন দেখতে পারে না। বোনের কষ্ট ভাই দেখতে পারে না। এটাকেই স্নেহ, আদর, ভালোবাসা বলে নাকি অন্য কিছু বলে?’ মাওয়া ভাইটাকে দেখছে মন ভরে দেখছে। আজ এই ভাইটার জন্যই সে বেঁচে আছে। রক্তের না হলেও আজ সে রক্তের। পর হয়েও আজ সে নিজের। অনেক দূরের হয়েও আজ সে কাছের। ভুলতে পারবে না, দূরে দিতে পারবে না, রক্তে যে আছে মিশে।

গল্পের বিষয়:
দু:খদায়ক
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত