তিন বন্ধু। ফাহিম, আযলান আর রিহান ক্লাসমেট, হলে থাকে একরাতে পড়াশোনা করতে ভালো লাগছিল না, তাই তারা ছাদে গেল।
অন্য রুমগুলো থেকে বাকি দুজনকে ম্যানেজ করে ফাহিম। তারপর সবাই মিলে গেল ছাদে।
একটা ফাঁকা জায়গা দেখে বসল সবাই। তারপর শুরু হল আড্ডা।
আড্ডা মানেই যা হয়, প্রথমে আমরা ব্যাচের কয়েকটা মেয়েকে পচালাম। তারপর মেয়েভাবাপন্ন কয়েকটা ছেলেকে পচালাম।
তারপর আমাদের কয়েকজন বন্ধুকে পচালাম। পরস্পরকে পচালাম কিছুক্ষণ।
তারপর আবিষ্কার করলাম, আমরা কথা বলার নতুন কোন টপিক খুঁজে পাচ্ছি না।
হঠাৎ ফাহিম বলে উঠল, একটা গল্প হোক।
সবাই হই হই করে উঠল। হ্যাঁ হ্যাঁ, হোক গল্প।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, কে বলবে গল্প?
আমরা কেউ কথা বললাম না।
হঠাৎ আযলান বলে উঠল, দোস্তরা, আমি একটা গল্প বলতে চাই।
রিহান বলল, কি গল্প? অশ্লীল?
আযলান বলে উঠল, না ব্যাটা, ঐসব কিছু না। অন্য গল্প।
ফাহিমঃ বলল, কি গল্প?
আযলানঃ আগে শোনাই না। শুরু করব?
রিহানঃ বলল, করে দে।
আযলানঃ একটা গলা খাকারি দিয়ে তার গল্প শুরু করল।***
ধরি এক দেশে দুই ভাই ছিল। ধরি তাদের নাম রিফান ও আফসান
রিফান ছিল বড়। আর আফসান ছিল ছোট।
রিফানের রেজাল্ট ছিল অস্বাভাবিক ভালো। সে ফাইভে বৃত্তি পেল, এইটে বৃত্তি পেল। ম্যাট্রিকে স্ট্যান্ড, ইন্টারে স্ট্যান্ড।
তারপর সে বড় একটা ভার্সিটিতে খুব ভালো সাবজেক্টে চান্স পেয়ে গেল।
-আর আফসান রেজাল্ট ছিল খুবই খারাপ।
সে প্রতি ক্লাসেই ন্যূনতম পাস মার্কের কিছু বেশী পেয়ে কিভাবে কিভাবে পাশ করে যেতে লাগল।
আর ওদিকে ক্রিকেট আর ফুটবলে পাড়ায় সুনাম ছড়াতে থাকল তার।
-তাদের বাবা মা ছিলেন অশিক্ষিত। তারা বেশী কিছু বুঝতেন না, শুধু বুঝতেন, বড় ছেলে তাদের জন্য সুনাম বয়ে আনছে।
আর ছোট ছেলে বয়ে আনছে শুধু দুর্নাম আর অভিযোগ।
-বড় ছেলে পাস করে বিদেশ(নিয়র্ক) চলে গেল। ভালো চাকরি পেয়ে ওখানেই বসবাস করতে লাগল সে।
-আর এদিকে “ওর মত হ” আর “ওর পা ধুয়ে পানি খেলেও তুই কিছু হইতে পারতি” গালি শুনতে শুনতে এদিকে ইন্টার পাশ করল ছোট ছেলে।
পড়াশোনা তার জন্য নয়, এই বিশ্বাসে স্বল্পপুঁজির ব্যবসায় নেমে পড়ল সে।
-প্রতিমাসে বড় ছেলের চিঠি আসে, ছোট ছেলে সেগুলো বাবা মাকে পড়ে শুনায়।
বাবা মা শুনে মাথা নাড়েন আর বলেন, “গরু, ওর মত হতে পারলি না তুই”।
-বড় ছেলে ছয়মাস পর থেকে বাসায় নিয়মিত টাকা পাঠানো শুরু করে।
বাবা মা পুরনো গান নতুন সুরে গাওয়া শুরু করেন, ”গাধা, ওর মত হতে পারলি না তুই”।
-এটুকু গল্প বলে আযলান বলল, গল্প শেষ।
ফাহিম লাফিয়ে উঠল। গল্প শেষ মানে? ফিনিশিং কই?
রিহান ও তাল মিলালো, হ্যাঁ, গল্পের তো কোন ফিনিশিং হয় নি। ফিনিশিং কই?
কাহিনীটা শেষ কর হারামজাদা।
আযলান নাটকীয়ভাবে বলল, এই দায়িত্ব আমি তোদেরই দিলাম। দেখি, তোরা কেমন গল্প বানাতে পারিস।
ফাহিম বলল, আমাদের মানে? আমাদের গল্প বানাতে হবে?
আযলানঃ হ্যাঁ। এই গল্পটা শেষ করতে
হবে। যে সবচেয়ে সুন্দরভাবে গল্পটা শেষ করতে পারবে তাকে আমি নিজে চায়নিজ খাওয়াব।
চিন্তাভাবনা করতে লেগে গেলাম। হলাম একবার সাহিত্যিক, ফ্রি চায়নিজ তো আর ছাড়া যায় না।
দশ মিনিট পর ফাহিম বলে উঠল , বলব?
আযলানঃ বল।
ফাহিম বললঃ এর পর বড় ছেলে রিফান নিজেই একদিন দেশে ফিরে এল।
সে ছোট ভাই আফসানকে একটা দোকান করে দিল, আর বাবা মাকে বড় করে একটা বাড়ি করে দিল।
তারপর বিয়ে করে ওখানেই সুখে শান্তিতে সংসার করতে লাগল সে।
অন্যরা ভ্রূ কুঁচকে ফাহিমের দিকে তাকাল। কিছুক্ষণ কেউই কিছু বলল না।
তারপর রিহান বলে উঠল, এইটা হইল কিছু? এত সহজ?
ফাহিমঃ ব্যঙ্গ করে উঠল, ওরে আমার সাহিত্যিক আসছে রে! নে, এবার তুই শেষ কর তো দেখি!
রিহান আগুনে চোখে ফাহিমের দিকে তাকাল। ওরে বাবা, যেন ভস্ম করে দেবে এখনই।
রিহানঃ শুরু করল, বাবা মায়ের এই অনাদর আর সহ্য করতে পারল না “আফসান” সে বাসা ছেড়ে পালিয়ে গেল।
তারপর অক্লান্ত পরিশ্রম করে দশ বছরের চেষ্টায় প্রতিষ্ঠিত হল সে। অতঃপর বাসায় ফিরে সে দেখল, বাবা মা তার আগেই মারা গেছেন।
চুক চুক করে একটা সহানুভূতির শব্দ করল কেউ একজন।
ফাহিম মনে মনে ভাবছে, ব্যাটা রিহান হারামিই তাহলে চায়নিজ পাচ্ছে।
হঠাৎ ফাহিম বলে উঠল, তোর গল্প ঠিক আছে, তবে আমিও একটা ফিনিশিং ভেবেছি। বলব?
সবাই বললঃ বল।
ফাহিম শুরু করল, আফসান” তার অপমান আর সহ্য করতে পারল না। একদিন আত্মহত্যাই করে বসল সে।
আর তার মৃত্যুর পরপরই দেখা গেল, ভালো একটা ফ্যাক্টরিতে চাকরি পেয়েছে সে, বা ব্যবসায়ে খুবই ভালো একটা লাভ করেছে।
আবারও চুক চুক শব্দ করে উঠল কেউ একজন
এবার রিহান বলল তো আযলান, তুইই বল, কে তাহলে আজকে চায়নিজ পাচ্ছে?
আযলান বললঃ আমাকে তো চান্সই দিলি না।
ফাহিম হেসে বলল, তুইও কম্পিটিটর নাকি? জানতাম না তো!
রিহান বলে উঠল, হ, শালা নিজেই নিজের পকেটের টাকা দিয়ে চায়নিজ খাবে। আচ্ছা, বল তোর গল্প।
আযলান বলতে শুরু করল, আসলে বড় ছেলে “রিফান” বাবা মাকে কোন টাকাই পাঠায় নি।
এমনকি কোন চিঠিও সে লেখে নি। চিঠিগুলো আসলে “ছোট” ছেলে নিজেই লিখেছে।
আর যে মাসে মাসে টাকার কথা শুনলি, সেগুলোও সে নিজে ব্যবসা করে জমায় আর বিদেশের ঠিকানা লিখে নিজেই নিজের বাসায় পাঠায়।
আমরা চোখ বড় বড় করে ওর দিকে তাকিয়ে রইলাম। ফাহিম বলল কেন? আফসান এরকম করল কেন?
-আযলান বলল, সে চায় নি তার বড় ভাইয়ের প্রতি বাবা মায়ের এতদিনের ভালবাসা নষ্ট হয়ে যাক।
বাবা মা সারাজীবনই ভেবে এসেছে তাদের বড় ছেলেই সবসময় তাদের মুখ উজ্জ্বল করবে,
সেই বিশ্বাসটা কোনভাবেই ভাঙতে চায় নি ছোট ছেলে আফসান
-তারপর?
আযলানঃ তারপর, ঐ বিশ্বাস নিয়েই তাদের বাবা মা বাকি জীবন পার করে দিলেন।
জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্তও তাদের মুখে একটাই কথা ছিল, “তোর ভাইয়ের পায়ের যোগ্যও তুই হতে পারলি না”।
কেন? ফাহিম বলল, আফসান কি বাবা মাকে পুরো ঘটনাটা বলে দিতে পারত না? কি সমস্যা ছিল তাতে?
আযলানঃকোন সমস্যা ছিল না। আফসান শুধু চাইত, বাবা মায়ের এতদিনের বিশ্বাস যেন না ভাঙে।
সারা জীবন ধরে তারা বড় ছেলেকে নিয়ে যে গর্ববোধ করেছেন,
আশার যে পাহাড় গড়ে তুলেছেন, স্বর্গীয় স্নেহে বড় ছেলেকে যেভাবে আপ্লুত করেছেন,
রঙ্গিন যে পৃথিবী গড়ে তুলেছেন তা যেন এক নিমিষে ধোঁয়া হয়ে উড়ে না যায়।
বড় ছেলের মধ্যে যে নির্ভরতার প্রতিচ্ছবি,
যে স্বপ্নের হাতছানি তারা এতকাল ধরে মনের মধ্যে গড়ে নিয়েছেন, তা যেন হঠাৎ করে ধুলো হয়ে ঝরে না পড়ে।
একটা মানুষের সবচেয়ে বড় নির্ভরতা তার বিশ্বাস, সেই বিশ্বাসই যদি ভেঙ্গে যায়, তবে আর বেঁচে থাকার সার্থকতা কি?
বলতে পারিস, বাবা মায়ের বিশ্বাসকে শ্রদ্ধা করত আফসান।
এটা কোন গল্প হইল? হঠাৎ বলে ওঠে রিহান, হইল কোন গল্প? কি ভুয়া ফিনিশিং…আফসান চরিত্রটা তো পুরাই ফাউল লাগছে।
আযলান অবাক হয়ে তাকাল। কেন?
-ফাহিম বলল, আসলে রে আযলান,
আফসান চরিত্রটাকে তুই যেভাবে দেখালি…সেটা আসলেই অসম্ভব।
-আযলান আরও অবাক হয়ে ফাহিমের দিকে তাকাল। তুইও…?
রিহানঃ আফসান ” চরিত্রটা নিজে টাকা পাঠায় এটা নাহয় বুঝলাম,
কিন্তু বড় ভাইয়ের কথাটা সে ফাঁস করে দেবে না এটা তো আমার বিশ্বাস হয় না।
সারাজীবন তো সে বড় ভাইয়ের জন্য নিজে গালি গালাজ খেয়ে এসেছে,
এখন সেই বড় ভাইয়ের জন্য সে এত বড় স্যাক্রিফাইস করবে এটা আমার বিশ্বাস হয় না।
টাকা পাঠানো ঠিক আছে, কিন্তু আফসানেত বলা উচিৎ ছিল যে এটা সে-ই পাঠাচ্ছে।
তাহলে অন্তত বাবা মায়ের চটকা ভাঙত আর যে ভালোবাসা থেকে তারা আফসানকে এতদিন বঞ্চিত করে রেখেছিলেন সেটা আফসান পেয়ে যেত।
-আযলানের মুখে কেন যেন হাসি ফুটে উঠল। সে হাসিতে মাখানো ছিল বিষণ্ণতা।
আচ্ছা ধর, যদি আফসান নিজের সুখের চেয়ে বাবা মায়ের বিশ্বাস বড় হয়?
ফাহিম বলল, ওসব গল্প দিস না, ওইগুলা খালি বাংলা সিনেমাতেই পাওয়া যায়।
এই কাহিনী নিয়ে শাকিব খান আর অপু বিশ্বাস কত হিট সিনেমা বানাইতে পারবে জানিস? এই বলে হা হা করে হাসতে লাগল সে।
-আযলান বলল, তার মানে আমার গল্পটার মত কখনও বাস্তবে হতে পারে না?
সবাই একসাথে বলল, না।
-আযলানঃ তোরা শিওর?
সবাইঃ শিওর।
আযলান একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। তারপর বলল, যাহোক, গল্প প্রতিযোগিতায় তাহলে জয়ী হচ্ছে…
হঠাৎ আযলানের মুখ দেখে বুকের মধ্যে ধড়াস করে উঠল।
সেই মুখে কি যেন ছিল…
ফাহিম বলে উঠলঃ আযলান, এটা কি আসলেই গল্প, নাকি সত্যি?
আযলান হাসতে শুরু করল।
-ফাহিম আবার বলল, দোহাই তোর, আযলান, বল, এটা কি শুধুই একটা গল্প নাকি সত্যি?
-আযলানঃ তবুও হাসতেই থাকল।
পরিশিষ্টঃ
যার যার রুমে ফিরে গেল তিনজন কিছুক্ষণের মধ্যেই শুয়ে পড়ল তারা।
তিনজন ঘুমিয়ে গেল, কিন্তু একজনের ঘুম এল না। সেই একজনের নাম আযলান।
আযলানের রুমে কেউ যদি জেগে থাকত, তাহলে দেখতে পেত, আযলান আকাশের দিকে তাকিয়ে বলছে,
বাবা, তোমার কাহিনীটা আমার বন্ধুদের শুনিয়েছি। ওরা কেউ বিশ্বাস করে নি।
কেন করবে বল বাবা, এত স্যাক্রিফাইস কি কোন মর্ত্যের মানুষের পক্ষে করা সম্ভব?
কেমন করে পারলে বল তো বাবা? কেমন করে পারলে? তোমার কি বড় চাচার প্রতি একটুও ক্ষোভ ছিল না?
একটুও রাগ ছিল না তার উপর? তোমার কি কখনও একটুও ইচ্ছা করে নি সব বলে দিতে?
দাদাজান তোমাকে কখনও স্নেহ করে নি, প্রশংসা করে নি, মাথায় হাত বুলিয়ে ভাত খেতে পাশে বসায় নি…
সব বড় চাচার জন্য…তোমার কি একটুও রাগ হয়নি? একটুও না? বল বাবা, তুমি মানুষ না ফেরেশতা?
না না তুমি ফেরেশতা নও…তোমার মনে মায়াদয়া কিছুই নেই…
নাহলে কিভাবে পারলে আমাদের একা ফেলে এভাবে চলে যেতে…
আমাকে আর আম্মুকে একা ফেলে চলে যেতে…কিভাবে পারলে…বাবা!…বাবা!!
তখন হয়তো আযলানের কোন রুমমেট আযলানের কান্নার আওয়াজ পেয়ে ধড়ফড় করে জেগে উঠত।
তারপর হয়তো সে আস্তে করে আযলানের পাশে গিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে জিজ্ঞেস করত, কি হয়েছে তোর?,
তখন হয়তো বরাবরের মতই আযলান সুন্দরভাবে সামলে নিত এবং বলত, কিছু হয় নি।
চোখে পোকা ঢুকেছে। একটু পানি এনে দিবি?