সাহেব এগুলো নেবেন? নিন না, মেডামকে গিফট দিলে খুশি হবে। দেখলাম একটা আধময়লা ফ্রক পরে, ফুটপাতের ভিখারিদের মত দেখতেবাচ্চা মেয়ে আমার চোখের পানে করুণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। হাতে একগোছা গোলাপ। এরা খুব একটা বোকা হয়না। না হলে, এতো ছোট বয়সে গার্লফ্রেন্ডকেরপ্ত করার কৌশল, জানত না। কিন্তু গোলাপ কি শুধু গার্লফ্রেন্ডকে দিতে হয়?মাকে দেওয়া যায়না?
পকেট থেকে একশো টাকা বের করে বললাম, এই নাও। কতো দাম এগুলোর ?ও দাম হিসেব করতে যাবে, এমন সময় আকাশ ভেঙে বৃষ্টি এল।কাছাকাছি একটা ঝুপড়ি মতো জায়গায় দৌড়ে আশ্রয় নিলাম। দেখি ঐ মেয়েটাও, আমার পিছু পিছু এসে পাশে বসেছে। এদিকে মুশলধারে বৃষ্টি। এক কাপ চা হলে বেশ হতো। রাস্তার ওপাশে চায়ের দোকান। কিন্তু আনবে কে? নাম কি তোমার? ফুলি। আচ্ছা ফুলি, তোমাকে একটা কাজ দেব পারবে? বলুন সাহেব ।পকেট থেকে কুড়িটা টাকা বের করে বললাম, ঐ দোকান থেকে এককাপ চা আনতে পারবে? আর যদি তুমি কিছু খাও খেতে পার। অবশ্য ওখানে যেতে যদি তোমার কোন আপত্তি না থাকে।
দেখলাম নিঃশব্দে মেয়েটি আমার হাত থেকে টাকাটা নিয়ে, এক দৌড়ে চা নিয়ে এলো। ফুলি তুমি কিছু খেলেনা কেন? এমনি সাহেব। এই নিন বাকি টাকা। তুমি স্কুলে যাও? না। তবেখালার মেয়েরা পুরোনো বই ফেলে দিলে, সেগুলো নিয়ে মাঝে মাঝে পড়ি। ও! তুমি স্কুলে যাওনা, তোমার বাবা-মা বকেনা বুঝি? বাবা মা নেই সহেব। নেই মানে? আগে একটা মা ছিল। কিন্তু এখন তাকে দেখিনা। মানে? এখন দেখনা কেন? তোমার মা মারা গেছেন? না। আমার আসল বাবা-মা ঐযে ঐখানেযে ময়লা গুলো আছে, সেখানে ফেলে রেখে গেছিল ছোটবেলায়।তারপর একটা মা এসে আমায় বড় করেছে। তার নিজেরও তিনটে ছেলেমেয়ে। বাবা আমায় নিয়ে ঝগড়া করতো মায়ের সাথে। তাই ঐ মাটা আবার আমাকে ঠিক ঐখানেই রেখে কোথায় যেন চলে গেছে? আর দেখিনা। তাই তুমি ফুলগুলো বিক্রি করে বেঁচে থাক? না সহেব। এই ফুলগুলো তেমাথার খালার ফুল। সব বিক্রি করলে তিনি আমাকে দুপুরে খেতে দেন। দুপুরে খেতে দেন মানে? আর রাতে, সকালে কি খাও? খাইনা সাহেব। পানি খেয়ে থাকি। কখনো কখনো ডাস্টবিনে ভালো শুকনো খাবার খুঁজে পেলে, তাই খাই। চোখ ফেটে কান্না এল। ধরে রাখতে পারলাম না।
একি শুধুই ফুলির জন্য নাকি, সকালে শর্মীর হারিয়ে যাওয়া প্রেমের যন্ত্রনায়? বৃষ্টি এদিকে কমেছে। ওর নোংরা মাথায় হাত বুলিয়ে বললাম, দু’বেলা না খেয়ে থাকিস কি করে? চল সামনের রেস্তরাঁতে কিছু খাবি। দেখলাম ফুলির মুখে শহস্র শতাব্দীর লুকিয়ে থাকা হাসিটা ঠুকরে বেরোল। ফুলি! কি খাবি বল? সহেব অনেক দিন মুরগির মাংস খাইনি। যদি দিতেন আবারও চোখের বাঁধ ভাঙল। কত সীমিত চাহিদা এদের। অত কথা বলিস কেন? যা ইচ্ছে খা না। সেবার ফুলিকে খাইয়ে যে আনন্দ পেয়েছিলাম তার জুড়ি মেলা ভার। পরদিন বাইরে বেরিয়েছি, দেখি ও একটা নেসপাতি হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে। ফুল বিক্রি করে কিছু টাকা বাঁচিয়েছে। আর সেটা দিয়ে ও এটা কিনেছে। ফুলি। খবরদার, এসব আর কখনো করবি না। আমি এসব প্রচুর খেয়েছি। তোর খিদে পেয়েছে? নিন না সহেব। না হলে আমি কষ্ট পাব। ঠিক আছে। আজ নিলাম। কিন্তু আর কিনবি না, ঠিক আছে? তোর মুখ ভীষণ শুকনো দেখাচ্ছে। কিছু খাসনি সকাল থেকে, না !! চল, কিছু খাবি।
এরপর থেকে প্রতিদিনই ওকে খাওয়াতাম। সে তৃপ্তি ভাষায় বলা কঠিন। আর ও প্রতিদিনই বারণ করতো। শেষমেশ আমার চাপে পরে খেতে হত। দেখতাম ও আমার জন্যও, একটা কমলালেবু, কিম্বা পেয়ারা নিয়ে আসতো। বড্ডো ভালোবেসে ফেললাম ফুলিকে। মানুষের জীবনে কতরকম ভাবেই প্রেম আসে। মাঝে মাঝে ওকে নিয়ে স্বপ্ন দেখতাম। পুরোনো ছেড়া পোশাক বাদ দিয়ে, আমার দেওয়া হলুদ ফ্রকটা পরে একটা কাঁশ বনে ও খিলখিল করে হাসছে। চারপাশে আনন্দের লহর যেন ঝংকৃত হচ্ছে পবিত্র আযানের সুরের মতো। একসময় উপলব্ধি করলাম, ওকে না দেখতে পেলে আমার হৃদয় যেন ব্যাকুল হয়ে উঠছে। আমি যেন কোথাও একটা হারিয়ে যাচ্ছি। ১৮ই ফ্রেবুয়ারি। রাত তখন ন’টা বাজে। হঠাৎ মায়ের ফোন। -হ্যালো অনি। বিপদ হয়েছেরে বাবা। তোর বাবা অফিস থেকে বাড়ি ফিরছিল। একটা মারুতি এসে তোর বাবাকে ধাক্কা দিয়েছে। পায়ে ফ্যাকচার হয়েছে। এখন আমরা হসপিটালে। তুই শিগ্গিরি চলে আয়।
খবরটা শুনে খারাপ লাগলো। কিন্তু ফুলি? ওকে তবে দেখতে পাবোনা কিছুদিন ! যাবার আগে একবার দেখা হলে ভালো হত। কিন্তু খুঁজি কোথায়? জামা কাপড় কিছুটা গুছিয়ে রাস্তাতে উঠেছি। বাবা কতটা ভালো আছেন, কে জানে? বাসের অপেক্ষায় আছি। এমন সময়ে দেখি, ফুলি দূরে দাঁড়িয়ে। হাতে একটা চকোবার আইসক্রিম। আমার কাছে এসে, মায়াবী দৃষ্টিতে চোখের দিকে তাকিয়ে, আমায় নিতে বললো।-নাও দাদাবাবু। শুনলাম, আমারই মতো একজন পাগল ওকে এটা খেতে দিয়েছে। আর সেটা ও আমায় দিতে চায়। ফুলির ময়লা গালে একটা চুমু খেয়ে বললাম, পাগল কোথাকার। তোর মতো থাকতে আমি এসব প্রচুর খেয়েছি। তোকে ভালোবেসে উনি দিয়েছেন, তুই ই খা। কিন্তু শুনল না ফুলি। ওটার পাশ থেকে এক কামড় দিয়ে বললাম,-শোন ফুলি। আমার বাবার শরীর খারাপ বুঝলি তো।তাই পাঁচ-সাত দিন আসতে পারব না। তুই এই তিনশো-চারশো টাকা রাখ। এই ক’দিন কিছু কিনে খাস। ২৪ই ফ্রেবুয়ারি ফিরে এলাম ঢাকায়য়। কিন্তু চার-পাঁচ দিন হয়ে গেল, ফুলির দেখা নেই।
খোঁজ নিতে গেলাম তেমাথার ঐ খালার ফুলের দোকানে। খালা এখানে ফুলি নামে একটা মেয়ে থাকে না? খালা আমার দিকে বেদনাক্লিষ্ট দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো, -তুমি কি ফুলির অনি সাহেব? -হ্যাঁ। কোথায় ও? দেখলাম খালা হাও মাও করে কাঁদছে।-সহেব গো, ফুলি যে আর নেই। গত ১৯ তারিখ ও বাস এক্সিডেন্টে মারা গেছে। এবার আমার কান্না পেল না। বমি পেল। গলগল করে বমি করলাম রাস্তায়। মনে হচ্ছিল বুকের রক্তে তীব্র কোন বিষাক্ত বিষ কেউ ঢেলে দিয়েছে। চিৎকার করে পৃথিবী ফাটাতে ইচ্ছে করছিলো। কিন্তু পারিনি। -সাহেব একটু বসুন সুস্থ হয়ে। এই নিন। ফুলি বলেছিলো, ‘খালা আমি যদি কখনও হারিয়ে যাই তবে এটা সাহেবকে দিও।’ দেখলাম একটা লাল ডাইরি।
সেখানে এবড়োখেবড়ো ভাবে দিনলীপি লেখা। চোখ গিয়ে ১৮ই ফেব্রুয়ারিতে ঠেকলো, আজ সাহেব ভাইয়াটা চলে গেলেন। মনটা বড় খারাপ। যাওয়ার আগে উনি আমায় চারশো টাকা দিয়েছেন। ওপাশে দিনু কাকুর মা অনেক দিন ধরে ভালো-মন্দ খেতে চেয়েছেন। বুড়ি হয়েছেন বলে, ওনাকে এখন কেউ ভিক্ষা দেয়না।তাই এই টাকাটা তাকে দিয়ে এলাম। কাল থেকে আমি আবার ফুল বিক্রি করব। আর সহেব ভাইয়া এলে তাকে বলব, সাহেব ভাইয়া আমিও তোমার মতো ভালোবাসতে শিখেছি। এ যে তোমারই দান।