বিষণ্ণ বিকাল। জানালা দিয়ে বাহিরে তাকালে সবুজে ঘেরা মনোরম প্রকৃতি দেখা যাচ্ছে। আরেকটু উপরে তাকালে এক ফালি শুভ্র মেঘের বিচরণ দেখা যাচ্ছে নীলাকাশে। দুপুরে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। কবে থেকে যে এটা আমার প্রাত্যহিক জীবনের অভ্যাস হয়ে দাড়িয়েছে। নিজেই ঠিক বুঝে উঠতে পারিনি। আজ ঘুম থেকে উঠার পর থেকে কেমন যেন ফুরফুরে সতেজ ভাব অনুভব হচ্ছে। যা গত একুশ বছরে কখনো হয়নি। হঠাৎই কি মনে করে উঠে পড়লাম। কোনো দিকে না তাকিয়ে এক ঝটকায় দরজা খুলে বেরিয়ে এলাম বদ্ধ ঘর হতে। বাড়ির উঠানের একপাশ হতে আরেকপাশ পর্যন্ত শুধু ছুঁটেই বেড়ালাম বেশ কিছুক্ষণ। জন্মের পর আজ প্রথমবারের মতো হুইলচেয়ার নামক অসহ্যকর যন্ত্রটা ছাড়া নিজ পায়ে হেঁটে বেড়াতে পারছি আমি। পারছি ইচ্ছা মতো ছোটাছুটি করতে। এ যে কি আনন্দের মুহূর্ত। সেটা কখনো ভাষায় প্রকাশ করে বোঝানো সম্ভব নয়।
–
কতো বিনিদ্র রাত যে শুধু ঐ হুইলচেয়ারটির দিকে আক্রোশ ভরা দৃষ্টিতে তাকিয়ে পার করেছি। তার কোনো হিসেব নেই। পাশের বাড়ির ষোড়শী কন্যার প্রেমে পড়েছিলাম নিজের অজান্তেই। কিন্তু আমার অক্ষমতার জন্য তাকে বলা হয়ে উঠেনি। আদরের ছোটো বোনকে নিয়ে কতোবার মেলায় গিয়ে চুড়ি কিনে দিতে চেয়েছি। তাতেও বাঁধ সেজেছিল আমার অক্ষমতা। আর পাঁচটা সন্তানের মতো আমিও বাবা মায়ের মুখে হাসি ফোঁটাতে চেয়েছিলাম। কিন্তু সেই তৃপ্তির হাসি আর দেখা হয়নি। সবার মতো আমিও যে কতোবার নিজ পায়ে পাড়া-মহল্লা দাপিয়ে বেড়াতে চেয়েছি। তার কোনো ইয়ত্তা নেই। একলা ক্ষণে যখন আমি এসব সুপ্ত ইচ্ছা নিয়ে কল্পনা করতাম। সামনে থাকা হুইলচেয়ারটা যেন তখন আমায় বিদ্রুপের হাসি উপহার দিয়ে বলত, ‘এসব মিছেমিছি কল্পনা করে কোনো লাভ নেই রে। ঘুরে ফিরে সেই আমার কাছেই তোকে আসতে হবে।’
আমি অগ্নি দৃষ্টিতে শুধু মনে মনে বলে যেতাম, ‘একদিন নিজ হাতে তোকে আমি দুমড়ে মুচড়ে শহরের জঞ্জালে ছুঁড়ে ফেলে দিবো। সেদিন আমি হাসবো। খুব করে হাসবো। তুই অসহায় হয়ে শুধু দেখবি সেদিন।’
একসময় মনে হতে শুরু হলো, ‘এসব স্রেফ আমার নিছক কল্পনা। বাস্তবে তো অসম্ভব।’
কিন্তু আজ আমার ভুল ভেঙ্গেছে। অবশেষে ঈশ্বর আমার দিকে মুখ ফিরে তাকিয়েছে। আজ আমি আমার সুপ্ত ইচ্ছা নিজ হাতে পূরণ করব। যেভাবে ঘর হতে দৌড়ে বেড়িয়ে এসেছিলাম। ঠিক সেভাবেই দমকা হাওয়ার মতো এক দৌড়ে ঘরে প্রবেশ করলাম। কিন্তু হঠাৎ করেই আমার হাত পা ভারী হয়ে আসতে শুরু করল। সারা শরীর ক্রমশ অবশ হয়ে আসতে থাকল। আমি এখানে দাড়িয়ে থাকলে বিছানায় শুয়ে থাকা অবিকল আমার মতো দেখতে ছেলেটি তাহলে কে? এই মুহূর্তে আমার কি করা উচিৎ বুঝে উঠতে পারলাম না।
–
ঘড়ির কাটা ৫ টা ছুঁই ছুঁই করছে। এসময় মায়ের এ ঘরে আসার কথা। হাতে এক মগ পানি আর সাদা বর্ণের ট্যাবলেট নিয়ে আমার নামে ধরে ডাকতে ডাকতে প্রতিদিন আসে সে। আজও তার ব্যতিক্রম হলো না। এবার আমি একটু স্বস্তি পেলাম। নিশ্চয় আমার ভুল ভাঙ্গিয়ে দিবে মা। কিন্তু এ কি! আমার সামনে দিয়েই মা চলে যাচ্ছে। কিন্তু আমাকে যেন দেখতেই পাচ্ছেনা। কয়েকবার মা বলে ডেকে নিজেকে ক্ষান্ত দিলাম। বিছানায় চোখ বুজে থাকা ছেলেটির দিকে এগিয়ে গেলেন মা। আমার কাছে ব্যাপারটা এখন ভুতুড়ে ভুতুড়ে ঠেকছে। যেখানে স্বয়ং আমি এখানে উপস্থিত। তাহলে ঐ ছেলেটা কে? আর মা’ই বা কেনো আমাকে দেখতে পাচ্ছেনা? কোনো এক বই এ পড়েছিলাম কিসব কালো জাদু দিয়ে নাকি এমনটা করা সম্ভব। তবে এসব শুধু গল্পেই মানায়। বাস্তবে নয়। কিন্তু আমার সাথে এখন যা ঘটছে সেটাও বা কিভাবে অস্বীকার করি। আচ্ছা এমন ও তো হতে পারে আমার সাথে এসব যা ঘটছে সবই কোনো দুঃস্বপ্ন কিংবা আমার অবচেতন মনের নিছক কল্পনা।
মায়ের আর্তচিৎকারে আমি সম্বিত ফিরে পেলাম। আমার মতো দেখতে ছেলেটির বুকে মাথা রেখে অবিরত কেঁদেই যাচ্ছে মা। পাশের ঘর থেকে ছোটো বোনটা দৌড়ে আসল। কি বুঝল কে জানে। সে ও মা এর মতো কাঁদতে শুরু করল। বাবা দরজা পর্যন্ত এসেই কেমন যেন নিথর হয়ে গেল। ওখানেই মাথায় হাত দিয়ে ধুলোমাখা মেঝেতে বসে পড়ল। আমার সাথে এসব কি হচ্ছে বুঝে উঠতে পারলাম না। হঠাৎই আমার খুব কান্না পেলো কোনো এক অজানা কারণে। বুকের মাঝ হতে এক চাপা দীর্ঘশ্বাস যেন কানে এসে ফিসফিস করে বলে উঠল, ‘তুই আর নেই রে পাগল। অবশেষে তোর ও মিলল মুক্তি।’
গল্পের বিষয়:
দু:খদায়ক