হুইলচেয়ার

হুইলচেয়ার

আজ মৃদুলার বিয়ে। পাত্র আর পাত্রের পরিবার বেশ ভালো মানুষ স্বভাবের। তবুও মৃদুলার পরিবারের কারো মুখে এতটুকু হাসিও নেই। বিয়ের কেনাকাটা করতে গিয়ে সড়ক দূর্ঘটনায় মৃদুলার দুটো পা ই হারিয়েছে। ওর বাবা মা আর এই পঙ্গু মেয়েকে অন্যের ঘাড়ে চাপাতে চাইছেন না। কিন্তু মৃদুলার বর প্রয়াস কিছুতেই মৃদুলাকে ছাড়বে না। সবার সামনে জানিয়ে দিয়েছে,” পা নেই তাতে কি, ওর চোখ তো আছে। সেই চোখের দিকে তাকিয়ে একটা জীবন পার করে দেয়া যাবে।”

এরকম ভালোবাসা দেখে কেউ আর আপত্তি করেনি। প্রয়াসের বাবা মা ও ছেলের এমন মহান প্রেম দেখে মুগ্ধ! কবুল বলতে গিয়ে কেঁদেই গলা, বুক ভিজিয়ে ফেললো মৃদুলা। ওর প্রয়াসের জন্য বড্ড কষ্ট হচ্ছে। চার বছরের সম্পর্কের পর আজ বিয়েতে এসে তাদের ভালোবাসা পূর্ণতা পেতে চলেছে, অথচ মৃদুলার দুটো পা নেই। সারাটা জীবন প্রয়াস ই মৃদুলার সেবা করে যাবে, ছেলেটার বউয়ের পা নেই! এটা ভেবেই মৃদুলার কষ্ট হচ্ছে।

প্রয়াসের মামা ওকে ডেকে বলেছিলেন, “ভাগ্নে, জীবন টা আবেগ দিয়ে চলেনা। বউ হইলো গিয়া সেবা করার জন্য। এমন একটা মেয়েরে বিয়া করলে আজীবন তাকে টেনে নিয়া বেড়াইতে হবে বুঝলি? তোর কোনো কাজেও সে আসবে না, আর বাচ্চাকাচ্চা মানুষ করবে কিভাবে বল দেখি? বিয়াটা বরং করিস না।”মামার চোখের দিকে তাকিয়ে প্রয়াস বলেছে, “আমার পা দুটো কেটে ফেলা হলে মৃদুলা কখনোই আমাকে ছেড়ে যেতো না। তাহলে ওর বেলায় কেন এমন হবে?”

প্রয়াসের তীব্র জেদের উপর কারো কিছু বলার ছিলোনা। অনেকেই বলছেন নকল পা লাগানোর জন্য। কিন্তু প্রয়াস সে ব্যাপারে কোনো আগ্রহ দেখায় নি। বিয়ে পড়ানোর পর বিদায় দিয়ে দেয়া হলো। বাড়ির সকলে কান্নায় ভেঙে পড়েছেন। মৃদুলাকে গাড়িতে তুলে দিয়ে ওর হুইল চেয়ার টাকেও তুলে দেয়া হলো। প্রয়াস হাতের মুঠোয় মৃদুলার হাত ধরে রেখেছে। মেয়েটির চোখের জলে বুক ভিজে যাচ্ছে প্রয়াসের।

শ্বশুরবাড়ি পৌছে গাড়ি থেকে নামার সময় হুইল চেয়ার টেনে আনা হলো। সেটায় বসতে গিয়ে বুক ফেটে কান্না এলো মৃদুলার। আল্লাহ কেন এই পা দুটো এভাবে নিয়ে নিলেন? শ্বশুরবাড়ির মাটিতে পা দেয়ার সৌভাগ্য টাও ওর হলোনা।মৃদুলা হুইল চেয়ারে বসার আগেই আচমকা প্রয়াস এসে ওকে থামিয়ে দিলো। তারপর সবাইকে অবাক করে দিয়ে কোলে তুলে নিলো ওকে। মৃদুলা বিস্ময়ে কাঁদতেও ভূলে গেছে! বাড়ির সকলে মুগ্ধ হয়ে চেয়ে আছে ওদের দিকে।

প্রয়াস অনায়াসে নতুন বউকে কোলে নিয়ে হেঁটে হেঁটে ওর মায়ের কাছে গেলো। মায়ের সামনে দাঁড়িয়ে বললো,”নতুন বউকে বরণ করে নাও মা। তোমার মেয়ে তার পা দুটো হারিয়েছে, তাই বলে মা কি কখনো মেয়েকে পর করে দিতে পারে?”মৃদুলার চোখ বেয়ে টপটপ করে পানি পড়ছে। ও দুহাতে প্রয়াসের গলা ধরে আছে। চোখ মেলে থাকতেও লজ্জা করছিলো। একদিকে লজ্জা, অন্যদিকে স্বামীর মহানুভবতায় নিজেকে বড্ড ভাগ্যবতী মনে হচ্ছিলো ওর। প্রয়াসের মা মৃদুলার মাথায় হাত রেখে বললেন, “সুখী হও তোমরা মা। দুয়া করি।”

বলতে বলতে উনিও কেঁদে ফেললেন। প্রয়াস আর কাউকে কিছু বলার প্রয়োজন মনে করলো না। সবাই শুধু অসহায় অবস্থা দেখে উপহাস করতেই পারে, কেউ এগিয়ে এসে একটু যত্নও নেবে না। মৃদুলার জন্য প্রয়াস একাই যথেষ্ট।মৃদুলাকে কোলে নিয়ে তরতর করে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে গেলো প্রয়াস। নিজের ঘরে নিয়ে গিয়ে বিছানায় বসিয়ে দিলো। চোখ মেলে তাকালো মৃদুলা। প্রয়াস এগিয়ে এসে মৃদুলার মাথার পিছন দিকটা চেপে ধরে ওর ভেজা চোখের উপর চুমু দিয়ে বললো, “ভালোবাসি রে পাগলি।”

মৃদুলা আর নিজেকে সামলাতে পারলো না। প্রয়াসকে জাপটে ধরে ডুকরে কেঁদে উঠলো। প্রয়াস মৃদুলার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলো। কয়েক মুহুর্ত নিরবে কেটে গেলো এভাবেই। কিছুক্ষণ পর মৃদুলা সোজা হয়ে বসতেই প্রয়াস উঠে গিয়ে একটা ছোট্ট বক্স হাতে করে নিয়ে আসলো।মৃদুলা অবাক চোখে তাকিয়ে আছে সেটার দিকে। প্রয়াস বক্সটা খুলতেই এক জোড়া রূপার নূপুর ঝিকমিক করে উঠলো। মৃদুলার কথা বলার শক্তি হারিয়ে গেছে। সে শুধু নির্বাক মুগ্ধ দৃষ্টিতে চেয়ে আছে।

প্রয়াস নূপুর জোড়া হাতে নিয়ে বলল, “আমার অনেক দিনের স্বপ্ন ছিলো এটা। বাসর রাতে বউকে এক জোড়া নূপুর দিতে না পারলে বিয়েটা অসম্পূর্ণ মনে হতো। অনেক যত্নে নূপুর জোড়া বানিয়েছিলাম তোমায় উপহার দিবো বলে। আগে বলিনি, চেয়েছিলাম এটা নাহয় সারপ্রাইজ হয়েই থাক।”মৃদুলার মুখে কোনো আওয়াজ আসছে না। কথা বলার শক্তিটাও বোধহয় হারিয়ে গেছে। প্রয়াসের ভেজা চোখের দিকে তাকিয়ে ওর ইচ্ছে করছিল নিজের কলিজাটা বের করে প্রয়াসের হাতে তুলে দিতে। ছেলেটা ওকে এত ভালোবাসে, তার ভাগ্যটা কেন এমন হলো?

প্রয়াস নূপুর জোড়া মৃদুলার হাতে তুলে দিয়ে বলল,”এটা রেখে দাও। আমাদের ছেলের বউকে দিবো।”হুম আচ্ছা। “বলে সায় দিলো মৃদুলা।মৃদুলার আর চোখে জল আসছে না। নূপুর জোড়া নিয়ে পাশে রেখে দিলো। আলতো করে মুছে দিলো প্রয়াসের চোখ। প্রয়াস হঠাৎ মৃদুলার শাড়ি উপরে তুললো। চোখ বুজে ফেললো মৃদুলা। প্রয়াস নিচু হয়ে মৃদুলার অর্ধেক কাটা পায়ে হাঁটুর উপরে চুমু এঁকে দিলো।মৃদুলা কাঁপছে, শক্ত করে প্রয়াসের হাত চেপে ধরলো।

“ঐ হুইলচেয়ারটা শুধু আক্ষরিক। তুমি আমার পায়ে পায়ে হাঁটবে মৃদুলা। আমার প্রত্যেকটা কদমের সাথে তুমি থাকবে।প্রত্যেকটা মুহূর্তে তুমি আমার সাথে থাকবে।কখনো ঐসব ভেবে নিজের মনকে কষ্ট দিও না।”প্রয়াস কান্না করছে মৃদুলার কোলে মাথা গুঁজে।মৃদুলার চোখের জল,সুখের জল,আনন্দের কান্না, তৃপ্তির কান্না।

গল্পের বিষয়:
দু:খদায়ক
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত