রক্তাক্ত অবস্থায় মেঝেতে পড়ে আছি ১০মিনিট ধরে।বুঝতে পারছি চোখটা ফুলে গেছে।চোখ মেলে তাকাতে পারছি না।এক বছরের ছেলেটা অনেক্ষন ধরে কাঁদছে।আর আমার শরীরের উপর দিয়ে হামাগুরি দিয়ে এপাশ ওপাশ করছে।নড়তেও পারছি না আমি।
এখন ছেলেটা আমার মুখে আলতো করে অর ছোট ছোট হাত দিয়ে ছুয়ে দিচ্ছে আর আম্মু আম্মু করে ডাকছে কিন্তু হতভাগী আমি কিছুই করতে পারছি না।অনেকক্ষন ধরে কিছু খায়নি ছেলেটা আমার।আমার উপর করা এই অত্যাচার হয়তো এই এক বছরের বাচ্চাটার মনেও দাগ কাটে।কিন্তু অই নরপিশাচটার এতে কিচ্ছু আসে যায় না।নিজের দোষে আজ আমার এই অবস্থা।
৩বছর আগে বাবা-মার অমতে ভালবেসে বিয়ে করেছিলাম তপুকে।৬বছরের রিলেশন ছিল আমাদের।বিয়ের আগে কত কিছুই বলতো।কত প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল।সব আজ নাটক মনে হয়।ফ্রেন্ডরা সবাই বলেছিল তপন ছেলেটা ভাল না।আমি কাউকে বিশ্বাস করিনি।তপুকে ভালবেসে অন্ধ হয়ে গিয়েছিলাম।সকলের কথার অবাধ্য হয়ে পালিয়ে এসেছিলাম তপন আহমেদ অর্থাৎ তপুর কাছে।
আমাদের যখন বিয়ে হয়েছিল তপুও তখন স্টুডেন্ট। আত্নীয় সজন বলতে কেউ ছিলনা তপুর।বিয়ের জন্য সামান্য কিছু পয়সা দরকার ছিল তাও ছিল না তার কাছে
কোনোরকম টিউশনি করে দিন কাটাতো।কিন্তু তার চলা ফেরা দেখে তেমন মনে হত না।চলাফেরা ছিল প্রভাবশালীদের মত।বিয়ের সময় সব কিছুর ব্যবস্থা আমাকেই করতে হয়েছিল।আসার সময় মায়ের গয়না নিয়ে পালিয়ে এসেছিলাম যা দিয়ে মোটামুটি চার লাখ টাকা হয়েছিল আর ঘরে থাকা ২৭ হাজার টাকা নিয়ে চলে এসেছিলাম। বাবা-মাকে তপুর ব্যপারে বলেছিলাম।বেকার ছেলের কাছে বিয়ে দিতে কোনো বাবা-মা ই রাজি হয় না।
আমার বাবা-মাও হয়নি।তাই এই কাজ করেছিলাম।তপু ভাল মানের একটা বাসা ভাড়া করেছিল আমাদের থাকার জন্য।বিয়ের ২মাস ভালই গিয়েছিল।পরে জানতে পারলাম তপুর বাবা-মা সবাই আছে।তারা কুয়েত থাকেন।এরপর ধীরে ধীরে বিয়ের ৬মাসের মধ্যে তপুর অনেক গোপন তথ্য আমার সামনে আসতে থাকে।তপু প্রচুর পরিমানে জুয়া খেলতো।জুয়া খেলে খেলে আমার মায়ের গয়নার সব টাকা শেষ করে দিয়েছে।বড়লোকের ছেলে তার তো আর টাকার অভাব নাই।
তখন বুঝতে পারতাম কতটা ভুল করেছি একটা ভুল মানুষকে ভালোবেসে।আমি সকলের বিরুদ্ধে গিয়েছিলাম তাদের ভুল ভেবে।কিন্তু এখন বুঝতে পারি কে আসলে ভুল ছিল।বিয়ের দেড় বছর পর আমি কন্সিভ করলাম।ভেবে ছিলাম এখন সব ঠিক হয়ে যাবে।কিন্তু তখন থেকে তপু আমার গায়ে হাত উঠানো শুরু করে।দাঁতে দাঁত কামড়ে এই সংসারে পড়ে ছিলাম।আমার যাবার মত কোনো জায়গাও ছিল না।একদিন রাতে ড্রিংক করে এসে প্রচুর মারধর করে আমাকে।
কয়েকদিন পর্যন্ত অজ্ঞান ছিলাম।জ্ঞান ফিরে নিজেকে হাসপাতালের বেডে আবিষ্কার করি।পড়ে জানতে পারলাম আমার বাবুটা মারা গেছে।যা শোনার জন্য আমি মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না।এরপর তপু পুরিপুরি পাল্টে গেল।তার এই ব্যবহারের জন্য সে আমার কাছে অনেক করে ক্ষমাও চাইলো।অনেক কান্নাকাটি করে বললো সে বুঝতে পারে নি এমন কিছু হবে।বাচ্চা হারানোর শোকে আমি সারাদিন ঘরের কোনে পড়ে থাকতাম।আর তখন তপুও আমার খুব যত্ন নিত।নিজে তুলে খাইয়ে দিত।নানান জায়গায় ঘুরতে নিয়ে যেত।
অনেক কেয়ার করতো আমার।আমিও তখন তার ব্যবহারে ভেবে নিয়েছিলাম সে ভাল হয়ে গেছে।তার ৭মাসের মধ্যে আমি আবার কন্সিভ করলাম।আগের সব কথা ভুলে গিয়েছিলাম।স্বপ্নীল এর জন্ম হলো।স্বপ্লীলের মধ্যে আমি আমার সকল সুখ খুঁজে পেলাম। কিন্তু কথায় বলে না কুকুরের লেজ সোজা হয় না।যার যেটা স্বভাব সেটা থেকেই যায়। আগের সবটা ছিল তার অভিনয়।
আমাকে শারীরিক নির্যাতন আর আমার সন্তান হত্যার অপরাধে আমি যদি তার নামে মামলা করে বসি সেই ভয়ে এত আদর যত্ন ছিল আমার।স্বপ্নীলের জন্মের কিছুদিন পর থেকে আবার সে তার আসল রুপ দেখাতে শুরু করে।তপু যখন আমাকে মারধোর করে স্বপ্নীল তখন ভয়ে চুপটি মেরে থাকে। কলিং বেলের শব্দে ঘোর কাটলো আমার।ছেলেটা আমার ক্ষুদা নিয়ে কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে গেছে।খুব অসহায় লাগছে নিজেকে।অনেক কষ্টে উঠলাম।দেয়াল ধরে ধরে কোনো মতে দরজা খুললাম।পাশের বাসার ভাবি এসেছে।
-তোমার এই অবস্থা কেন স্বর্ণা?
-কিছুনা ভাবি বাথরুমে পড়ে গিয়েছিলাম।
-সত্যি করে বলতো কি হয়েছে?
-কিছু হয়নি ভাবি।হটাৎ কি দরকারে?
তোমার ভাই বললো আজ সারাদিন পানি থাকবে না।কিছু একটা প্রব্লেম আছে হয়তো।পর্যাপ্ত পানি তুলে রেখ কিন্তু।তাই বলতে আসলাম। বলেই ভাবি চলে গেল।হয়তো অনেক কিছুই বুঝতে পারলো আমার এই অবস্থা দেখে।কিন্তু দেখা পর্যন্তই। এই শহরে কেউ কারো নয়। আবার দেয়াল ধরে ধরে গিয়ে গোসলটা সেরে নিলাম।সারা শরীর ব্যাথা করছে।তাই কিছু ওষুধ ও খেয়ে নিলাম।বাবু ঘুম থেকে উঠলে কান্না করবে।অর জন্য হলেও কিছু রান্না করতে হবে।তাই ভাত আর ডাল বসালাম।
স্বপ্নীল ঘুম থেকে উঠার পর ওকে খাওয়ালাম নিজেও কিছু খেয়ে বারান্দায় ছেলেকে নিয়ে বসে আছি।আজ খুব মনে পড়ছে বাবা-মার কথা।তাদের কথা মত তপুকে বিয়ে না করলে হয়তো আজকে এই দিন দেখতে হতো না।ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে আজও এই সংসারে খেয়ে না খেয়ে পড়ে আছি।যেন ছেলেটা ভবিষ্যৎ এ মানুষ হতে পারে।
তপু অনেক রাতে বাড়ি ফিরলো।এখন এটা রোজকার ঘটনা।এসেই মাতলামি শুরু করে দিল।অশ্রাব্য ভাষায় গালাগালি শুরু করলো।তার চিল্লানোর কারনে স্বপ্নীল ঘুম থেকে উঠে কান্না শুরু করলো।স্বপ্নীলের কান্নার কারনে তপু বিরক্ত হয়ে স্বপ্নীলকেও গালাগালি শুরু করলো।স্বপ্নীল ভয়ে আরো কাঁদতে শুরু করলো।তপু বিরক্ত হয়ে স্বপ্নীল কে লাথি দিয়ে বিছানা থেকে ফেলে দিল।পড়ে গিয়ে জ্ঞান হারালো স্বপ্নীল। আমি এই ঘটনায় আমি চিৎকার করে কান্না করতে করতে স্বপ্নীলকে কোলে তুলে নিয়ে কিছু টাকা ব্যাগে ঢুকিয়ে হাসপাতালের দিকে রওনা হলাম।
হাসপাতালে ছেলের পাশেই বসে আছি।ডাক্তার কিছু ইঞ্জেকশন দিয়ে গেল।স্বপ্নীল এখন ঘুমাচ্ছে।পাশেই আমি বসে ভাবনায় বিভোর হয়ে গেলাম।কেমন ছিল তপু আর কেমন হয়ে গেল।৬বছরের রিলেশন এর সময় একটা বার বুঝতে পারলাম না ছেলেটাকে।কত নিখুঁত অভিনয় ছিল তার।কতটা ভাল অভিনয় জানলে এভাবে ঠকানো যায় মানুষকে।অনেক হয়েছে,,আর নাহ!এই অমানুষ টার সাথে থাকলে আমার ছেলেটাও শেষ হয়ে যাবে।আমার তো জীবনটাই শেষ। আজ আমার ছেলের গায়েও হাত তুলেছে।কাল যদি আমি মারা যাই আমার ছেলেটাও না খেতে পেয়ে আর নয়তো মার খেয়ে মারা যাবে।
এসব নয়ছয় ভাবতে ভাবতে ফজরের আযান দিয়ে দিল।ফ্রেশ হয়ে অযু করে নামাজটা পড়ে নিলাম।নামাজ পড়ে সবে মাত্র ছেলেটার পাশে গিয়ে বসেছি এমন সময় ডাঃ সাফায়েত এর আগমন। কেমন আছেন মিসেস? মিস বলুন।মিস স্বর্ণা। ওকে,কেমন আছেন মিস স্বর্ণা।আর বাবুটির কি হয়েছিল? হটাৎ অজ্ঞান হলো কিভাবে? মাথাতেও অনেকটা আঘাত দেখছি।খাট থেকে পড়ে গিয়েছিল?
ছেলের এই অবস্থা হলে কোন মা ভালো থাকে বলতে পারবেন? আমার তো জানা নেই।আর বাবু খাট থেকে পড়ে যায় নি।ফেলে দেওয়া হয়েছে আমার সোনাটাকে।কতটা খারাপ হলে একজন মানুষ একটা বাচ্চার এমন হাল করতে পারে বলতে পারেন?(বলতে বলতে চোখের পানি অঝরে ঝরতে থাকলো) মানে কি,কি বলছেন এসব? কে করেছে এমনটা?
অই জানোয়ারটার পরিচয় দিতেও ঘেন্না করে আমার। ও,,বুঝেছি।আপনার ও তো কপালে গায়ে অনেক কাটা দাগ রয়েছে।আমি কিছু ওষুধ দিচ্ছি খেয়ে নিন। আমার কিছু লাগবে না। আমার ছেলেটাকে তাড়াতাড়ি সুস্থ করে দিন। কথা না বলে ওষুধ গুলো খেয়ে নিন। লাগবে না বললাম তো।
একজন ডাক্তার নয় একজন বড় ভাই হিসেবে বলছি। আর আপনি যদি সুস্থ না থাকেন তাহলে তো আপনার ছেলের ভালোমতো দেখাশোনা করতে পারবেন না।আপনি কি চান না আপনার ছেলে তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে উঠুক?
-হ্যাঁ চাই।(নরম সুরে) তাহলে জেদ না করে তাড়াতাড়ি খেয়ে নিন।আর কাটা জায়গায় মলম লাগিয়ে নিন। কথা বলতে বলতে স্বপ্নীল ঘুম থেকে উঠে গেল।ছেলেটার শুকনো মুখটা দেখতেই আবার কান্না চলে এল। চোখে পানি নিয়েই ডাক্তার সাফায়েত এর দিকে তাকিয়ে বড় ভাইয়ের মত যখন বলেছেন তখন একটা উপকার করবেন প্লিজ?
-বলুন কি করতে পারি?
-একটা কাজের খুব দরকার।ওই অমানুষটার কাছে আর যেতে চাই না।নিজের জন্য না হলেও ছেলেটার জন্য আমাকে বাঁচতে হবে।
-দেখেন, এভাবে তো হটাৎ করে কোনো কাজ জোগার করা সম্ভব না।