আমার ছোটবেলার বন্ধু নিতাই। নিতাই মোহন গোস্বামী। একসাথে একই স্কুলে পড়াশুনা। এসএসসি পাশ করার পর নিতাইয়ের বাবা মারা গেলে কলেজে ভর্তি হয়েও সে আর পড়াশুনা করতে পারেনি। সংসারের হাল ধরার জন্য অতটুকু বয়সেই সে তার বাবার ব্যবসার বোঝা কাঁধে তুলে নেয়। পোর্সেলিন সামগ্রীর দোকান। পরের দিকে মেলামাইন ও প্লাস্টিক পণ্যও যুক্ত হয় ওর ব্যবসায়। তবে আইটেম গুলোর নাম দেখে এটা ভাবা ঠিক হবে না যে, অনেক টাকার ব্যবসা। মহাজনের কাছে কিছু টাকা জমা দিয়ে বাঁকিতে মাল নিত সে। বেচাকেনা করে আগের টাকা শোধ করার পর আবার নতুন মাল তুলতো দোকানে। নিতাইয়ের বাবাও এভাবে ব্যবসা করে গেছেন। ব্যবসার আয় থেকে সংসার চালাতে কষ্ট হতো নিতাইয়ের। মা ও আরও তিন ভাইবোনের সাথে এক সন্তানসহ বিধবা পিসীমাকে নিয়ে ভারি সংসার। পুরনো আমলের তীর বর্গার ছাদওয়ালা নোনা ধরা দুই কামরার বাসায় ঠাসাঠাসি করে থাকা। খাওয়া থাকার কষ্ট ওদের চিরসঙ্গী।
শহরের অন্য প্রান্তে হওয়ায় ওদের বাসায় আমার খুব একটা যাওয়া হতো না। কিন্তু নিতাইয়ের খোঁজে কখনো গেলে ওর মা খুব লজ্জায় পড়ে যেতেন। কোথায় বসতে দেবেন বা কোথায় দাঁড়িয়ে কথা বলবেন বুঝতে পারতেন না। হয়তো দেখা যেত নিতাইয়ের কোন বোন সে সময় কুয়া থেকে জল তুলে স্নান করছে। আমাকে দেখে সে ঐ অবস্থায় দৌড়ে পালিয়ে যেত ঘরে। নিতাইয়ের মা না পারতেন আমাকে বাইরে দাঁড় করিয়ে রেখে কথা বলতে, না পারতেন বাড়ির ভেতরে নিয়ে যেতে। বিব্রতকর অবস্থা।
সময়টা ছিল ১৯৭০ সালের মাঝামাঝি। নিতাইয়ের বাবা সবে মারা গেছেন। নিতাই আমার সাথে কলেজে ভর্তি হয়েও ক্লাসে আসছে না। ব্যাপার কী জানার জন্য আমি সন্ধ্যের দিকে গেছি ওদের বাসায়। বাইরে থেকে ‘নিতাই’ ‘নিতাই’ বলে ডাক দিতেই ওর মা দরজা খুলে বেরিয়ে এসে বললেন, ‘ও হেনা! তুমি এসেছ বাবা! নিতাই তো দোকানে। বাসায় ফিরতে ওর অনেক রাত হবে যে!’
বাসার ভেতর থেকে ধূপ ধুনার গন্ধ আসছে। কাকীমা সম্ভবতঃ ঠাকুরের পুজা দিয়ে এসেছেন। তিনি দরজার এক পাশে সরে গিয়ে বললেন, ‘ভেতরে এসো বাবা।’
আমি বললাম, ‘না কাকীমা। ভেতরে আর যাবো না। আমি তাহলে দোকানেই যাই।’
দোকানে গিয়ে দেখলাম, নিতাই মাথা ন্যাড়া করে ধূতি পরে বসে আছে। ধূতির একটা অংশ ওর গায়ের ওপর। আমি বললাম, ‘কী রে, কলেজে আসিস না কেন?’
নিতাই একটু সরে গিয়ে আমাকে ওর পাশে বসতে দিয়ে বললো, ‘ভগবানের সাথে আমার ভাগাভাগি হয়ে গেছে রে!’
‘কী রকম?’
‘ভগবান বাবাকে তুলে নিয়ে আমাকে এই দোকানটা দিয়ে দিয়েছেন। কলেজে যাবো কীভাবে? আমার আর পড়াশুনা হবে না রে হেনা।’
আমার মন খুব খারাপ হয়ে গেল। নিতাই অসম্ভব মেধাবী ছাত্র। আমাদের স্কুল থেকে এসএসসিতে দু’জন ছাত্র ফার্স্ট ডিভিশন পেয়েছিল। এই দু’জনের একজন ছিল নিতাই। তার আর পড়াশুনা হবেনা শুনে সত্যিই খুব কষ্ট পেলাম। কিন্তু কীই বা করার ছিল ওর? ছোট তিন ভাইবোনের মধ্যে দুটিই বোন, আর ভাইটা মাত্র ক্লাস ফোরে পড়ে। নিতাই ছাড়া দোকান চালাবে কে? এই দোকান ছাড়া ওদের আয়-উপার্জনের আর কোন পথ নেই। নিতাইয়ের পড়াশুনা আর হলো না।
এর কিছুদিন পর মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে বাড়িঘর দোকানপাট সব ফেলে রেখে সপরিবারে ভারতে পালিয়ে গেল নিতাই। সেখানে মুর্শিদাবাদের জলঙ্গী শরণার্থী শিবিরে কলেরায় আক্রান্ত হয়ে নিতাইয়ের মা আর এক বোন মারা গেল। একাত্তরের ডিসেম্বরে দেশ শত্রুমুক্ত হলে সন্তানসহ পিসীমা ও নিজের নাবালক দুটো ভাই বোন নিয়ে স্বাধীন দেশে ফিরে এলো নিতাই। মুক্তিযুদ্ধের সময় এক বিহারী পরিবার ওদের বাড়িঘর দখল করে রেখেছিল। যুদ্ধের শেষের দিকে তারা পালিয়ে যাওয়ায় বাড়ি ফিরে পেতে নিতাইয়ের কষ্ট হলো না। কিন্তু দোকানের মালপত্র সব লুট হয়ে যাওয়ায় ভীষণ বিপদে পড়লো সে। আগের মহাজন মারা যাওয়ায় তার ছেলে বাঁকিতে মাল দিতে চায় না। তখন এমন একটা সময় যে কার কান্না কে শোনে? কম বেশি সকলেই নিঃস্ব।
বাহাত্তরের জানুয়ারি মাসের প্রথম দিকে নিতাইয়ের সাথে আমার দেখা হলো। ওর শরীর ও পোশাকের দিকে তাকিয়ে আমার বুকের ভেতরটা হু হু করে উঠলো। বললাম, ‘তোর বাড়ি যাবো।’
নিতাই তীক্ষ্ণ গলায় চিৎকার করে বললো, ‘তুই বড়লোকের ছেলে। আমার মতো গরীবের বাড়িতে গিয়ে কী দেখতে চাস? ক’টা অনাহারী মুখ ধুঁকে ধুঁকে এখনো বেঁচে আছে, তাই দেখবি?’
আমি ওকে অনেক বুঝিয়ে সুঝিয়ে শান্ত করার চেষ্টা করলাম। বার বার অনুরোধ করে ওকে সাথে নিয়ে পদ্মার বাঁধের ওপর গিয়ে বসলাম। সেখানে বসে যুদ্ধের সময় শরণার্থী শিবিরে ওর মা ও বোনের মৃত্যুর কথা শুনলাম। দোকানে মালপত্র না থাকায় ব্যবসাপাতি বন্ধ, সে কথাও জানলাম। ‘তাহলে এখন কী করছিস’ জিজ্ঞেস করায় নিতাই সোজা সাপটা জবাব দিল, ‘খোয়া ভাংছি।’
‘মানে?’
‘ইট ভেঙ্গে খোয়া বানাচ্ছি। এই সহজ কথাটাও বুঝতে পারছিস না?’
‘নিতাই!’ অশ্রুসজল চোখে ওকে বুকে জড়িয়ে ধরে আমি বললাম, ‘না না, এ কাজ তুই করতে পারিস না ভাই। আমি আজই তোকে কিছু টাকা দিচ্ছি। মহাজনের কাছ থেকে কিছু মাল তুলে আবার ব্যবসা শুরু কর ভাই।’
নিতাই আমার আলিঙ্গন থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে বললো, ‘আমাকে তুই দয়া দেখাচ্ছিস? আমি কারো দয়া ভিক্ষা নেই না।’
নিতাইয়ের আত্মসম্মানবোধ খুব প্রখর। স্কুল জীবন থেকেই সেটা জানতাম। তবু ওর এই করুণ অবস্থা দেখে মুখ ফসকে টাকা দেবার কথা বলে ফেলেছি। ও রেগে যাচ্ছে দেখে সামাল দেবার জন্য বললাম, ‘না না, ঐ টাকা তুই পরে আমাকে শোধ করে দিবি। এখন জাস্ট ধার হিসাবে নে।’
নিতাই কিছুক্ষণ আমার মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে শান্ত গলায় বললো, ‘জীবনে বহুদিন আমরা না খেয়ে থেকেছি। কিন্তু কোনদিন কারো কাছে আমাকে হাত পাততে দেখেছিস? তুই আমার দু’তিনজন ঘনিষ্ঠ বন্ধুর মধ্যে একজন। তোর টাকা ধার হিসাবে নিতে পারলে আমি খুশি হতাম। কিন্তু ঐ যে ওপরে একজন ভগবান আছেন না! তিনি তো আমার জন্মের সময় থেকে সব কিছু ভাগাভাগি করে রেখেছেন। আমার ভাগে দিয়েছেন লজ্জা আর আত্মসম্মানবোধ, আর তার নিজের ভাগে রেখেছেন আমার মুখের আহার।’
একবার মনে হলো ওকে বলি, তুই ফার্স্ট ডিভিশনে এসএসসি পাশ করা ছাত্র। খোয়া ভেঙ্গে পেট চালাচ্ছিস। এতে তোর লজ্জা আর আত্মসম্মানবোধ কোথায় থাকে? কিন্তু বললাম না। কারণ আমি জানি, সে বলবে সে চুরি চামারি করছে না, ভিক্ষা করছে না, কারো কাছে হাতও পাতছে না। দেহের ঘাম ঝরিয়ে খেটে খাচ্ছে।
আমার সাথে আর কোন কথা না বলে বাঁধের ওপর দিয়ে সোজা হাঁটা ধরলো নিতাই। আমি ওর পিছে পিছে হেঁটে কিছুদূর গেলাম। কিন্তু কিছুতেই ওকে ডাকতে আর সাহস পেলাম না। দারিদ্র্য, অনাহার, দুশ্চিন্তা সব এক জায়গায় হয়ে নিতাইকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরেছে। এ অবস্থায় একজন মানুষ স্বাভাবিক আচরণ করেনা।
এরপর আমার নিজের জীবনেই ঘটলো এক বিপর্যয়। এক ফৌজদারি মামলায় জড়িয়ে গ্রেপ্তার হয়ে জেলে গেলাম। ছয় মাস জেল খেটে জামিন পেলাম ঠিকই, কিন্তু পুনরায় গ্রেপ্তারের ভয়ে রাজশাহী ছেড়ে এদিক ওদিক পালিয়ে বেড়াতে হলো আমাকে। লেখাপড়ায় চরম ব্যাঘাত ঘটলো। কয়েক বছর পর মামলায় জিতে আমি যখন একটু স্থির হয়েছি, তখন একদিন নিতাইয়ের কথা মনে পড়লো। জেদি বন্ধুটা এতদিন পর কেমন আছে কে জানে?
নিতাইয়ের খোঁজে একদিন ওদের বাড়িতে গিয়ে দেখি, পুরাতন বাড়ি ভেঙ্গে ফেলে ঝকঝকে নতুন দোতলা বাড়ি উঠেছে। কিন্তু নিতাইরা কেউ নেই। আশে পাশের লোকজনকে জিজ্ঞেস করে জানতে পারলাম, নিতাই যক্ষ্মা রোগে ভুগে দু’বছর আগে মারা গেছে। ওর ভাইবোন ও পিসীমারা বাড়ি বিক্রি করে দিয়ে চলে গেছে ভারতে। মহল্লার এক হিন্দু গোয়ালার কাছে জানতে পারলাম, টাকার অভাবে নিতাইয়ের লাশ দাহ করা সম্ভব হয়নি। পঞ্চবটি শ্মশান ঘাটের পতিত জমিতে তার লাশ মাটি চাপা কবর দেওয়া হয়েছে।
‘জায়গাটা কী একবার চিনিয়ে দিতে পারবেন?’
দুধ বিক্রেতা লোকটি বললো, ‘ওখানে তো দাহ টাহ হয়না। জংলা জায়গা। লোকজনের যাতায়াত নেই।’
‘কবর দেবার সময় আপনি কী ছিলেন ওখানে?’
‘হাঁ ছিলাম বাবু। মড়া তো আমরাই ক’জন নিয়ে গিয়েছিলাম বটে। চলুন দেখি খুঁজে পাওয়া যায় কী না। রাম নাম সাত্তা হায়।’
বন্ধুর কবরের পাশে অনেকক্ষণ চুপচাপ বসে থেকে বাড়ি ফেরার জন্য উঠে দাঁড়ালাম আমি। পদ্মা নদীর তীর ঘেঁষে পঞ্চবটি শ্মশান ঘাট। পশ্চিম আকাশে হেলে পড়েছে সূর্য। পদ্মার ঘোলা পানি অস্তায়মান সূর্যের আলোয় লালচে হয়ে উঠেছে। জামার আস্তিনে চোখ মুছে বাড়ি ফেরার জন্য পা বাড়াতেই কেন জানিনা নিতাইয়ের সেই কষ্ট কাতর মুখটা ভেসে উঠলো আমার চোখের সামনে। মনে হলো সে আগের মতোই অভিযোগ করে বলছে, ‘ভগবান শেষ ভাগাভাগিটা করে নিয়েছে বন্ধু। বাবার মতো আমাকেও তার নিজের ভাগে নিয়ে নিয়েছে। আমার ভাগে আর কিছু নেই।’
( সত্য ঘটনা অবলম্বনে )