অনুভূতি

অনুভূতি

সকাল সকাল উঠে এক বস্ত্রে বের হয়েছি।
কোথায় যাবো,কি করবো জানি না।
দু’দিন কিছু খাওয়া হয়নি।
মাথায় যন্ত্রনা হচ্ছে।
বেশ কিছু দিন হলো ঘুম হয় না রাতে।
হাটতে পারছি না। টলমল করছি রাস্তার মাঝে।
প্রচন্ড রোদ,গা ঘামাচ্ছে।
যেটুকু শক্তি অবশিষ্ট ছিলো তাও বের হয়ে যাচ্ছে।
একটু দূরে একটা বট গাছ দেখতে পাচ্ছি।
ধীর পায়ে হেটে গিয়ে বট গাছের ছায়ায় নিজেকে একটু আরাম দিলাম।
প্রখর রোদ। ঠিক মত তাকানো যাচ্ছে না। তাকালে মনে হচ্ছে চোখ জ্বলসে উঠছে।
যেটুকু জায়গা অবশিষ্ট ছিলো আজ সেটুকুও হারিয়েছি।
গতকাল রাতে আমার স্বামী আমায় ডিভোর্স দিয়েছে।
তাই সকাল সকাল বাড়ি থেকে বের হয়ে যেতে বলেছে।
এক বস্ত্রে বের হয়ে এসেছি।।
নিজের বাবা-মার কাছে যাওয়ার জায়গা নেই।
কারন আমি জানি না কে আমার বাবা-মা।
ছোটবেলা থেকেই আমি আমার স্বামীর ঘরে বড় হয়েছি।
সবার মুখে শুনেছি আমি এই বাড়ির কাজের লোক।
নিজেও বুঝতে পারতাম আমি কাজের লোক।

আমার আম্মার(শ্বাশড়ি) মুখে শুনেছি , আমি তাদের বাসার সামনে বসে কাঁদছিলাম।
তখন আমার বয়স তিন কি সাড়ে তিন বৎসর হবে।
আমার মরহুম বাবা(শ্বশুড়)আমায় থায় দিয়েছিলেন তাদের বাসায়।
সময়ের পরিবর্তনে আমার থায় হলেও পরিচয় হয় কাজের লোকের।
আমার স্বামী ছিলেন পরিবারের বড় সন্তান।
তার ছোট দু’ট ভাই-বোন ছিলো।
তারা সবাই উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত।
বাবা যখন বেঁচে ছিলেন তখন আমায় দু’এক অক্ষর শিখাতেন, বাবা গত হওয়ার পর থেকে আর কেউ আমায় পড়াতে বসতেন না।
কোন রকম নিজের নাম লিখতে পারতাম।
আম্মা সর্বত্র স্নেহ করতেন।
বাবা কে হারিয়ে আম্মা কে পেয়েছি।
আম্মার ভালোবাসায় আমি পরিপূর্ণ ছিলাম।
আমার স্বামী বিদেশ থেকে লেখাপড়া শেষ করে দেশে ফিরেছেন।
খুব ভাল চারকী করেন তিনি।
বাবার মৃত্যুর আগে শেষ ইচ্ছে ছিলো তার বড় সন্তান অভীর সাথে আমার বিয়ে হবে।
ছোট দেবর এবং আম্মা বাবার শেষ ইচ্ছে পূরণ করতে চাইতেন।
অভী দেশে ফেরার পর পর আম্মা এবং ছোট ভাইয়ার জোরাজোরি তে অভীর সাথে আমার বিয়ে হয়।
বিয়েতে কখনই অভীর মত ছিলো না।
এক প্রকার বাধ্য করা হয়েছিলো তাকে।
বাবা কে খুব ভালোবাসতাম তাই বাবার শেষ ইচ্ছে পূরণ করতে চেয়েছিলাম।
ফুলশয্যায় ফুল ছড়ানো বিছানায় আমার পাশে বসে অভী পরিস্কার করে জানিয়ে দেয় সে আমার সাথে কখন সংসার করতে পারবে না।
তার জীবনে অন্য কোন মেয়ে আছে।
যাকে নিয়ে সে সংসার করতে চায়।
হাসি মুখে মেনে নিয়েছিলাম তার কথা।
জোর করে যে কিছুই হয় না।
আমার বিশ্বাস ছিলো সে একদিন আমায় ভালোবাসবে।।
আমার সেই বিশ্বাস ভুল ছিলো।
সে কখন আমায় ভালবাসতে পারেনি।

বট তলায় বসে আছি।
সূর্যের তেজ কিছুটা কমেছে। বিকাল গড়াচ্ছে।
মাথার উপর ছাদ নেই।
কোথায় থাকবো, কি করবো!!
সন্ধ্যা হলেই যে খারাপ লোকের আনাগোনা বেশি হবে।
কখন ভাবিনি এই দিন দেখতে হবে।
অভীর প্রতি আমার ভালবাসা, বিশ্বাস সব কিছুই মিথ্যে হয়ে যাচ্ছে।
ভেবেছিলাম হয়তো আমায় ফিরিয়ে নিতে আসবে।
কিন্তু অপেক্ষার প্রহর আজ চোরাগলিতে হারিয়ে যাচ্ছে।
এক বছর ছিলাম তার সঙ্গে।
এক বছরে কি এইটুকু ভালোবাসা জম্মেনি তার মনে?????
এই ভাবে ভালোবাসা ফাঁকি দিলো আমায়!!!
আর ভাবতে পারছি না।
যে করেই হোক আজ রাতটা এই গট গাছ তলায় কাটিয়ে দিবো।
কোন রকম গুটিশুটি মেরে শুয়ে পড়লাম বট গাছের নিচে।।
চোখ বন্ধ করতেই এক বছরের পুরোন স্মৃতি ভেসে উঠলো প্রতিচ্ছবিতে।
এক বছরে অনেক কিছু হারিয়েছি।
তবু্ও অভী কে ছাড়ার কথা ভাবতে পারিনি।

আমার আর অভীর বিয়ের পর পরই অভী তার চাকরীর অযুহাতে আমায় নিয়ে অন্য শহরে থাকা শুরু করে।
আমাদের বিয়ের বয়স তিন মাস চলাকালীন আম্মা গত হন।
আম্মা কে হারিয়ে খুব কষ্ট পেয়েছিলাম।
আম্মার ভালবাসা অনুভব করতাম।
খুব ভালবাসতেন আম্মা আমায়।
ছোট ভাইয়া লেখাপড়ার জন্য দেশের বাহিরে চলে যান।
ছোট আপুর বিয়ে দেন অভী।
চাকরীর টান্সপার করিয়ে অভী চেনা শহরে থাকা শুধু করে।
অভী অফিস করতো, আমি সংসার সামলাতাম।
আমাদের সম্পর্ক একটা সুতয় বাঁধা ছিলো।
সে কখন আমাকে স্ত্রীর মর্যাদা দেয়নি।
ভালোবেসে তার মন জয় করতে চেয়েছিলাম।
আমি ব্যর্থ ছিলাম।
আমি কখনই তাকে আপন করতে পারিনি। কারন সে ভালোবাসে অন্য কাওকে।

সকাল হলো…
চারপাশে পাখিদের কিচিরমিচির শব্দ।
চোখ খুলে চমকে উঠলাম।
আমার পাশে একটা কুকুর বসে আছে….
আমার চোখের দিকে এক পলকে চেয়ে আছে।
দেখেই মনে হচ্ছে কারোর পোষা কুকুর।
কেন যেনো মনে হচ্ছে এই কুকুরের সঙ্গে আমি সময় কাটিয়েছি।
কিছুক্ষণ পর একজন ভদ্র লোক ‘ টমি টমি ‘ করতে করতে আমার কাছে এগিয়ে এলো।
আমার ধারনা ভুল ছিলো।
সে আমার কাছে নয় কুকুরটার কাছে এগিয়ে এলো।
লোকটা কুকুরের উদ্দশ্যে বলে উঠলো-
– টমি কোথায় গিয়েছিলি তুই..
– ঘেউ ঘেউ..
– কিরে কি বলছিস…
– ঘেউ ঘেউ ঘেউ. (আমার জামা কামড়ে ধরে বসে রইলো)
কুকুরটার এমন আচারন দেখে লোকটা আমার দিকে তাকালো।
নিমিষেই লোকটার চোখে পানি টলটল করছে।
লোকটা বলে উঠলো–
– রোদ..
– রোদ!! রোদ কে?
– তুমি কে মা?
– আমি কেয়া..
– আমার মেয়ের নাম রোদ..
কুকুরটা তখন খুব জোরে জোরে ঘেউ ঘেউ করতে লাগলো।
ভদ্র লোক এবং আমি কুকুরের এমন আচারনে বিস্মিত।
কুকুর যেনো কিছু বলতে চাচ্ছে।
কিন্তু কি বলতে চাচ্ছে??
কুকুর আমার জামা ছেড়ে এক দৌড়ে পাশের গলি পার হয়ে গেলো।
ভদ্র লোক আমার পাশেই বসে রইলেন।
কিছুক্ষণ পর কুকুরটা মুখে একটা কাগজ নিয়ে দৌড়েতে লাগলো।
কাছে আসতেই বুঝতে পারলাম তা কোন কাগজ নয়।
সেটা ছোট একটা বাচ্ছার ছবি।
কুকুরটা ছবি মুখে নিয়ে সোজা এসে আমার পাশে ছবিটি রেখে ঘেউ ঘেউ করতে লাগলো।
পাশের ভদ্র লোক কাঁদতে শুরু করলেন।
– ওরে টমি তুই কি বুঝাতে চাচ্ছিস..(ভদ্র লোক)
– ঘেউ ঘেউ ঘেউ..
(বাচ্চাটার ছবিতে একটা পা রাখছে আবার আমার কাছে একটা পা রাখছে)
ঝাপসা কিছু স্মৃতি আমার চোখে ভাসছে।
কিন্তু কিছুই মনে করতে পারছি না।
নিমিষেই লোকটা আমায় বুকে টেনে নিয়ে কাঁদতে থাকলেন ‘ রোদ মা ‘ বলে।।
তবে কি আমি তার হারিয়ে যাওয়া সন্তান???
ভদ্র লোকের সাথে আমি তাদের বাসায় গেলাম।
একজন বয়স্ক মহিলা বিছানায় শুয়ে আছে।
হঠাৎ কেন যেনো আমার মন চটপট করতে লাগালো।
ভদ্র মহিলা কে দেখে আমি স্থির হয়ে দাড়াতে পারলাম না।
অজান্তেই দৌড়ে গিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরলাম।
তার ছোঁয়া কেমন যেনো আম্মার ছোঁয়ার মত।
মা মা গন্ধ তার গায়ে।
পাশে এসে ভদ্র লোক আমার পাশে বসলেন।
দুজনের প্রতি মায়া অনূভব করছি।।
টমির চোখ বেয়ে পানি পড়ছে।
তাদের পুরো বাড়ি জুড়ে আমার ছোটবেলার ছবি।
মনের টান এবং মায়ায় আমি আকড়ে ধরলাম আমার বাবা-মা কে।
এত বছর পর বাবা-মার স্পর্শ পেয়েছি।
কিন্তু অভী???
সে কি ভালো আছে??

প্রায় বছর কেটে গেলো।
টমি কে নিয়ে বসে আছি বারান্দায়।
মনে পড়ছে অভীর কথা।
শুনেছি সে তার পছন্দের মেয়েকে বিয়ে করছে।
আচ্ছা সত্যি কি অভীর মনে আমার জন্য কোন ভালোবাসা ছিলো না??
তোমায় নিয়ে কতকিছু আমি করে যাই।
হাজার রঙ্গে হাজার ডঙ্গে তাকেই সাজাই।।
হয়তো তার মনে আমায় নিয়ে কোন অনুভুতি ছিলো না।
তাই কখন আমাকে সে ভালোবাসতে পারেনি।
কিন্তু আমি তাকে মন থেকে ডিভোর্স করতে পারিনি।
আদৌ সে আমার স্বামী।
আমার অনূভুতি জুড়ে শুধু একজনই।
আমার জীবনের প্রথম এবং শেষ পুরুষ সে।

গল্পের বিষয়:
দু:খদায়ক
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত