নীলু কে যখন শেষ বার দেখেছিলাম তখন ওর পরনে ছিলো সাদা শাড়ি। ২৮ বছর বয়সী কোন মেয়ের গায়ে এমন পোশাক কখনোই আশা করা যায় নাহ্। আসলে বিষয় টা দেখতেও কেমন যেন বেমানান লাগে। আমাকে দেখে হেসে হেসে বললো,
কি রে নীল কবে দেশে ফিরলি?? আমাদের তো খোজই নিস নাহ্ আর। তা সব ভালোই ভালোই যাচ্ছে তো? আন্টি ভালো আছে? দেখ এতোটাই ব্যস্ত থাকি যে তোদের বাসায় গিয়ে আন্টির সাথে দুই এক টা ভালো মন্দ কথা বলবো সেই সময় টুকুও হাতে নেই। তা এবার কী এক বারেই আসলি নাকি আবার যাবি?? বাসায় আন্টি একা থাকে একটা বিয়ে তো কর।
ঠোটে হাসি থাকলেও কথা গুলো বলতে
নীলুর গলা বেশ কয়েকবার আটকে আটকে যাচ্ছিলো, চোখের পলক পড়লো অগনিত।
কথা গুলো বলার শেষে বিশেষ কায়দায় সাদা শাড়ির এক পাশটা টেনে মাথাটা ডাকলো। চেহারায় ক্লান্তি যেন কত রাত নির্ঘম কেটেছে। চোখের নিচের কালো দাগটা সেটাই জানান দিচ্ছে। অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলাম ওর দিকে। বার বার আমার চোখ থেকে নিজের চোখটা আড়াল করার চেষ্টা করছে।
-বিয়ে করবি আমাকে?
হঠাৎই আমার মুখে এমন একটা কথা শুনে বেশ অবাকই হয়ে গেলো নীলু। আমার দিকে তাকিয়ে থাকলো অনেকক্ষন যেমনটা আগে তাকাতো। তারপর ঠোটে একটা হাসি এনে বললো,,
তুই কোন দিন বদলাবি না বলেই কি ঠিক করেছিস?
– আমি সত্যি বলছি করবি বিয়ে আমাকে?? দেখ এমন তো কতই হয় তাছাড়া আমার তো কোন সমস্যা নেই, কি রে করবি বিয়ে আমাকে? আবার সব নতুন করে শুরু করি? করবি বিয়ে আমাকে?
আমার হাতটা ওর হাত থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে বললো,,
পাগলি করিস নাহ্ তো, যাহ্ বাসায় যাহ্। দেখিস ফুটফুটে একটা বউ আসবে। ভালো থাকিস রে দেখছিস নাহ্ আমার হাতে বাজারের ব্যাগ? বাসায় গিয়ে আবার রান্না চড়াতে হবে।
বলেই উল্টো দিকে হাটার জন্য অগ্রসর হতেই হাতটা টেনে ধরলাম। বেশ খানিকটা চমকে উঠলো। তারপর আমার দিকে ভারী কণ্ঠে বললো,
নীল আমি আমার ভাগ্য কে মেনে নিয়েছি রে, আমি চাই তুইও তাই করবি।
আর বাধা দিই নি। চোখের আড়ালে চলে গেলেও মনের আড়াল হলো নাহ্।
তখন সবে উচ্চ মাধ্যমিক পরিক্ষা শেষ হয়েছে। সবাই ব্যস্ত এডমিশন টেষ্টের জন্য। কিন্তু হঠাৎই সবাই মত দিলো তিন দিনের একটা ট্যুরে গেলে কেমন হয়?? আর এডমিশনের পর তো সবাই সবার মত হয়ে পড়বে সময় হবে নাহ্। তাই সবাই একসাথে একটা ট্যুর করলে ব্যপারটা খারাপ হয় নাহ্।
ব্যাস্ সবাই হ্যাঁ হ্যাঁ ধ্বনিতে মাতুম হলেও একজন চুপচাপ বসে থাকলো।
চশমার ফাক দিয়ে আমাদের দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে। দেখে মনে হলো কিছু একটা বলবে বলবে করেও বলতে পারছে নাহ্। তাই নিজেই এগিয়ে গিয়ে বললাম,,, কোচিংয়ে নতুন বুঝি???
মুখে কোন কথা নাহ্ বলে মাথা নেড়ে হ্যাঁ সম্মতি দিলো।
” তোমাকে দেখে মনে হলো তুমি কিছু বলবে কিন্তু বলতে পারছো নাহ্, আমি কি ঠিক বলছি?
আবারও মাথা নেড়ে হ্যাঁ সূচক উওর দিলো।
-আচ্ছা ঠিক আছে বলো কি বলবে???
– নাহ্ আসলে আপনারা সবাই তো ট্যুরের বিষয়ে কথা বলছেন তাই…
– যাবে তুমি??? আর কি আপনি আপনি বলছো?? তুমি বলো তুমি আর তুমি চাইলে আমরা তুই করেও বলতে পারি।
আমার কথা শুনে হঠাৎই মেয়েটা লাফ দিয়ে বললো,, আসলে আমিও সেটাই ভাবছি, কিন্তু তোরা কি মনে করবি তাই বলতে চেয়েও বলা হচ্ছে নাহ্। আসলে তোরা তো সবাই ট্যুরে যাবি তাই আমি ভাবছি তোদের সাথে যাবো। কিন্তু তোরা তো আমাকে চিনিস না তাই মনে করলাম আমাকে যদি না নিস তাই চুপ করে বসে ছিলাম। আসলে হয়েছে কী, আমার না ঘুরতে খুব ভালো লাগে। মন চায় সব সময় ঘুরে ঘৃরে কাটিয়ে দিই এই জীবন টা। আর একবার হয়েছিলো কী বাবার সাথে কক্সবাজার যেয়ে সে কি কান্ড। আমি তো আসবোই নাহ্ কিন্তু বাবার অফিস তাই ফিরত হলো কিন্তু তিন দিন পর। পরে শুনেছি বাবা নাকি বকাও শুনেছে এই সব। আর তাছাড়া আমি তোদের সাথে যাবো কি নিবি তো আমাকে??
সবাই হা করে তাকিয়ে আছে মেয়েটার দিকে। ওর ঠোটে একটা মিষ্টি হাসি। সবাইকে চুপ করে থাকতে দেখে একটু নরম কণ্ঠে বললো,
আমি কি একটু বেশিই কথা বলে ফেললাম??? আসলে আমি এমনি কথা বলতে আমার খুব ভালো লাগে। তাছাড়া…..
-হইছে বুঝছি তো, নীল শোন..
মেয়েটাকে কথা বলার মাঝে আটকিয়ে নিতু আমাকে ইশারাই ডাকলো।
দেখলাম হঠাৎই তাকে বাধা দেওয়াই চোখে একটা রাগ ফুটে উঠেছে। মনে হচ্ছে এখনি ঝলসে দিবে সব কিছু।
-নীল আমার মনে হয় মেয়েটার মাথা কোন সমস্যা আছে। মানুষ এতো দূত আর এতো কথা বলতে পারে???
-ধুর কি বলিস, এমনিতে কিন্তু মেয়েটা ভালোই মনে হলো।
আমার কথা শুনে নিতু একটা ভেংচি কেটে বললো,,,,
ও তাই নাহ্ সাদা চামড়া দেখে গলে গেলি ? আর আমাকে চোখে পড়ে না তোর তাই নাহ্???
– তুই মেয়ে নাকি যে তোর সাথে প্রেম করবো?
– কি আমি মেয়ে নাহ্?
– কই নাহ্ তো তুই তো…
– কি হলো থামলি কেন বল বল আমি কি..
– মেয়ে হতে শিখ বুঝলি?
-ধুর হ শয়তান।
বলেই একটা ধাক্কা মারলো।
– এই শোন এই দিকে আয়..
মেয়েটার ডাকে কাছে গেলাম।
– আমাকে নিয়ে কিছু বলছিলো তাই নাহ্?
– না তো কই আপনাকে নিয়ে তো বলে নি।
– ওমা তুই আবার আমাকে আপনি করে বলছিস কেন?
– নাহ্ মানে মুখ ফসকে বের হয়ে গেছে?আর ঠিক আছে আমরা সব ঠিক করে জানাবো, এখন যাই?
– তোরা সব ঠিক করবি মানে কি? তোরা তো জানিসই নাহ্ কোথায় কি আছে, আমার থেকে শোন আমরা রাঙ্গামাটি যাচ্ছি, আর হ্যাঁ সবাই শোন কালকে সকাল সকাল সবাই চলে আসবি যে দেরি করবে তাকে রেখে চলে যাবো।
সবাই রাঙ্গামাটি যেতে রাজি হলেও ওর এমন ব্যবহার সবাইকে অবাক করে দিলো। সবার সাথে এতো সহজেই মিশে যেতে পারে ওকে না দেখলে বোঝাই হতো নাহ্। পরদিন ঘটলো আরেক কাহিনি, সবাই ঠিক মত আসলেও নিতুর একটু দেরি হয়ে গেলো। সেইটা নিয়ে বাধলো তমুল ঝগড়া শেষ মেষ সব ঠিক ঠাক করার পর গাড়ি ছাড়তে ছাড়তে প্রায় দুপুর হই হই অবস্থা।
গাড়ি চলছে আপন গতিতে। এই সব বাইরের দৃশ্যটা সত্যিই দেখার মত।
গাছগুলো ছুটার পাল্লায় মেতেছে নাকি গাড়ি?
এই হিসাব যখন সবাই মিলাচ্ছি ঠিক তখনি একটা অবাক করা প্রশ্ন কানে আসলো।
– এই সবাই একে একে নাম বল তো।
-নীল
-সামী
-শুভ
-কি হলো মুখে কথা নেই?
নিতু তখনো চুপ করে আছে দেখেই কড়া স্বরে কথাটা বললো মেয়েটা। মেয়েটার কড়া স্বর শুনে ভয়েই মুখ থেকে বেরিয়ে আসলো,
-নিতু।
– ওকে আমার নাম অধরা। সবাই নীলু বলেই ডাকে।ঐ তুই এই দিকে আয়।
নীলু নিতুকে হাতের ইশারাতে ডাকলো।
নিতু যে ভয়ে ভয়ে এগিয়ে আসলো সেটা সবার বুঝতে বাকি রইলো নাহ্।
নিতু আসার সাথে সাথে যা করলো তাতে সবাই আর এক বার অবাক নাহ্ হয়ে পারলামম নাহ্।
নীলু নিতুকে ঝাপটে ধরলো। তারপর বললো,
কি রে আমার উপর রেগে আসিস? দেখ আমরা আমরাই তো রাগ করিস নাহ্ জানুটা।
তারপর থেকে সব কিছু ঠিক ঠাক চলতে লাগলো। তিন দিন পর আবার সেই ব্যস্ত শহরে কিন্তু সব থেকেও কেন জানি কিছু একটা নেই নেই ভাব।
পরে আবিষ্কার করলাম নীলুর প্রতি ভালোবাসা। সবাই ভালো ভালো কলেজে শিফট হলেও নিতু টার গতি হলো নাহ্। পরিক্ষার আগেই বাবা মারা যাওয়াতে সব কিছুই এলোমেলো হয়ে গেলো।
যেইদিন বিদায় নিবো সবাই সবার কাছ থেকে মনে মনে ঠিক করেছিলাম সেইদিন নীলুকে সব কথা বলবো।
নিতু এসে হাউ মাউ করে কাদতে লাগলো। নীলু সবার হাতে ধরিয়ে দিলো বিয়ের কার্ড। আমার কাছে এসে কার্ডটা দেওয়ার সময় ওর হাতটা কাপছি সে আমি ঠিকই টের পেলাম।
বলতে গিয়েও বলা হলো নাহ্ অনেক কথা। সেইদিন প্রথম কান্না করেছিলাম কারো জন্য। সে কি জন্মের কান্নাই নাহ্ কেদেছিলাম।
গভীর রাতে ফোন করে বলেছিলাম,
– নীলু চল পালিয়ে যাই আমরা।
নীলু আমার কথায় সম্মতি নাহ্ দিলেও ফোনের এপার থেকে ওর ফুপিয়ে ফুপিয়ে কান্নার শব্দটা কানে আমার ঠিকই এসেছিলো।
মাস ছয় পর বিদেশে পাড়ি জমায়।
সেখান থেকে শুনলাম নিতুর নাকি কোথায় বিয়ে হয়ে গেছে। সামী নিজের সংসার সামলাতেই ব্যস্ত। আমার পুরো ব্যাচের মধ্যে কারই স্বপ্ন পূরণ হলো নাহ্। নিতু খুব ভালো গিটার বাজাতো খুব শখ ছিলো মিউজিক করবে। বছর দুই পর খবর পেলাম ওর সংসারটা ঠিকে নি। সৎ বাবার অত্যাচার সহ্য করতে নাহ্ পেরে আত্মহত্যা করেছে।
দেশি ফিরলাম বছর সাত পর আর এসেই নীলুকে এই বেশে দেখলাম। বেশ বড় একটা ধাক্কা খেলাম।
আগের সেই নীলু ছিটাফোটাও নেই বর্তমানের নীলুর মাঝে কেমন যেন ছন্নছাড়া, বাধন হারা অবস্থা।
গভীর রাতে যখন সবাই ঘুমে তখনই ফোনটা বেজে উঠলো,
স্কিনে কোন নাম নেই।
-নীল ঘুমিয়ে পড়েছিলি নাকি?
ফোনটা ধরতেই ওপাশ থেকে কন্ঠটা ভেসে আসলো।
– নাহ্।
-ও, হ্যা রে বিদেশে গিয়ে সাদা সাদা মেম সাহেবেরা পিছু নেয় নি বুঝি?
– বিয়ে করবি আমাকে?
আমার কথা শুনে চুপ হয়ে গেলো নীলু। সেইদিনের মত ফুপিয়ে কান্নার শব্দটা কানকে ধোকা দিতে পারলো নাহ্। দুই জনের নিরবতায় ফোনটা কেটে গেলো।
দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে আসলো। জানি ওপারেে মানুষটা কাদছে আচলে মুখ লুকিয়ে।
সমাপ্ত