ঘরটা ছিমছাম করে গোছানো। দেয়াল র্যাক ভরা শুধু বই। পুব দেয়ালে ফ্রেসকো করা বিখ্যাত একটা লাইন ‘ন হন্যতে হন্যমানে শরীরে। এই ঘরটা অনিন্দিতার। ঘরটা এখন চাঁদের আলোয় ভেসে যাচ্ছে। লাইট নিভিয়ে চাঁদের আলো গায়ে মাখছে ও। বিছানার উপর অহন শুয়ে আছে খালি গায়ে। সিগারেট খাচ্ছে। অনিন্দিতার ইচ্ছে করছে অহনকে জড়িয়ে ধরে। সিগারেটের গন্ধমাখা ঠোঁটে উষ্ণ চুম্বন রাখুক। সিগারেট এশট্রেতে গুঁজে রেখে অহন উঠে লাইট জ্বাললো। প্রায় ছয় ফিট লম্বা শরীর। মেদহীন পেশল।গায়ের রং ফর্সা।
শর্টসের বাইরে মেদহীন নাভিস্থল দেখা যাচ্ছে। ক্ষীন কটি, চওড়া বুক আর আজানুলম্বিত বাহু। লাইট নিভিয়ে এগিয়ে এলো অনির কাছে। ও দুহাত বাড়িয়ে কাছে টানলো অনিকে। অনিন্দিতাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে নিবিড় হলো আরো। ওর কপাল, চোখ, মুখে অজস্র চুমোয় ভরিয়ে তুললো অহন। ঠোঁট রাখলো অনির কম্পিত ঠোঁটে। অহনের গলা জড়িয়ে ধরে ও ডুবে গেল ভালোলাগায়। চাঁদের আলোয় ভিজে যাচ্ছে দুটো একাকার হওয়া শরীর। অনি বলে উঠলো ‘ভালবাসি অহন।তোকে বড্ড ভালবাসি।’
অহনের সাথে অনিন্দিতার পরিচয় সোশ্যাল মিডিয়ায়। অনিন্দিতারা বেড়াতে গিয়েছিল বড় খালার বাসায়। নিজের ফোনেই টাকা থাকে না অনির। এর মধ্যে ছোট খালু বললো,
-অনিরে
-কান খোলা খালু
-আমার টাকা লাগবে
-আমারে বিলিয়ন খানেক দাও। দিচ্ছি তোমারে ।
-তুই সুপার হিরোইন সোনা। দে না ফ্লেক্সি করে ।
-আহা!কি দরকার এত?
-আমার সাঁটুলির সাথে কথা বলবো।
-কবে যে ছোটখালার কাছে ধরা পড়বে।
-চুপ চুপ। দে প্লিজ।
-কমিশন দাও।
-পাঁচশো পাবি।
এই অজ পাড়াগাঁয়ে ফ্লেক্সি পাওয়া কঠিন।ভরসা বন্ধুরা। নেট অন করে দেখে অহন এক্টিভ। অহন নামে অনির এক শত্রু ছিল।নক করলো,
-ডিয়ার শত্রু বন্ধু অহন।একটা হেল্প করা যাবে?
-হা হা হা। কারো সম্ভাষণে এত মজা পাইনি।বলুন কি হেল্প?
-আমাকে পঞ্চাশ টাকা ফ্লেক্সি করতে পারবেন?আমি বুধবারে বাসায় ফেরার পথে পাঠিয়ে দিব।
-ওকে।নম্বর দিন।
খালু ফ্লেক্সি পেয়েছে জানাতেই আমি ওকে নক করলাম।
-ধন্যবাদ
-কেন?
-এম্পটি পকেট ছিলাম।খালুর পকেট খালি করে আমার পকেট ভরলাম। ইকুয়াল ইকুয়াল।
-হা হা। ভাল তো।
অহন-অনিন্দিতার লম্বা যাত্রার শুরুটা ছিল এরকমই সাদামাটা ভাবে।
অনিন্দিতা একটা পাগলামির নাম ছিল। আর অহন ছিল রাশভারী, গম্ভীর। অনিন্দিতা উত্তর মেরু হলে অহন ছিল দক্ষিন মেরু। অনিন্দিতার ছিল মানুষকে দুঃখ দেয়ার অসম্ভব ক্ষমতা। অহনের ছিল আনন্দ দেয়ার অপরিসীম ক্ষমতা। কিন্তু বিপরীত মেরুর মধ্যে যেমন আকর্ষণ থাকে, তেমনি এই দুই মেরুও একে অন্যের কাছে ঘুরে ফিরে চলে এসেছিল।
-অনি
বড় ভাইয়ের ডাকে বই থেকে মুখ তুললো।
-বলো
-কি করিস
-দেখতেই পাচ্ছ ভাইয়া।শুধু শুধু বিরক্ত করছো কেন?
-আহা! তোর সব ভালবাসা বই ঘিরে। যে তোকে বিয়ে করবে সে একটা বই মানবী ছাড়া কিচ্ছু পাবে না।
একটা লম্বা শ্বাস নিয়ে বই বন্ধ করলো অনিন্দিতা। ভারী গ্লাসের চশমা খুলতে খুলতে বললো,
-ভাইয়া, মানুষ নেশা ছাড়তে পারবে হয়তো চেষ্টা করলে। আমাকে যে ভালবাসবে সে ছাড়তে পারবে না। আমি যাকে ভালবাসবো তার সাথে আমি একজীবন পাগলামিতে কাটাবো।এই ধরো হয়তো কোনো জোৎস্নায় সারারাত পথে হাঁটলাম।ঝুম বৃষ্টিতে সংসদ ভবনের রোড ধরে হেঁটে গেলাম।বৃষ্টিতে ভিজে চা খাওয়া। ইত্যাদি ইত্যাদি।
অনির বড় ভাই হেসে ফেললো।বোনের কপালে আলতো চুমু দিয়ে বললো,
-তুই যে কবে কাউকে ভালবাসবি।
-আহ ভাইয়া। বাসবো বাসবো।দেখো একদিন টুপ করে কারো প্রেমে পড়ে যাব।তার কলার চেপে ধরে বলবো আমাকে ভাল বাসতেই হবে।
-আচ্ছা বোনসোনা।
টুকটাক কথাবার্তা হতো অনিন্দিতা আর অহনের। হয়তো অনিন্দিতা অহনকে কোনো টেক্সট করেছে।তিন দিন পর তার রিপ্লে এসেছে। এর মধ্যে অহনের কোনো খোঁজ নেই। পুরোই ডুব মেরে আছে। অনিন্দিতা নিজেও ব্যস্ত ক্লাস, বন্ধু, আড্ডা, গান নিয়ে। এর মধ্যে অনিন্দিতার খুব দরকার হলো চিটাগাং যাওয়ার। কারণটা বলছি। অনির বড় ভাই পালিয়ে বিয়ে করে ফেলেছে। কাজেই বাড়ির সবাই খুব ক্ষেপে আছে। ভাই ভয়ে বাসায় আসতে পারছে না বউ রেখে। কাজেই ম্যাচমেকার হিসেবে ডাক পড়েছে অনির। চিটাগাং যাবে। কিন্তু থাকবে কোথায়? ভাবতে ভাবতে অনির মনে পড়লো অহনের কথা।অহন চবি তে পড়ে। ওর বাড়িও ওখানেই।পাহাড়তলি। আবার নক করলো অহনকে।
-শুনছেন। একটা হেল্প করতে হবে।
-কি ব্যাপার! আজ শত্রুবন্ধু বললেন না যে?
-না, সবসময় বলতে বলতে যদি ক্ষেপে যান। তাই আরকি।
-অহ! কি বলবেন।
-বলছিলাম কি, আমি চিটাগাং আসবো।ভাইয়া বিয়ে করে ফেলেছে।আমার এক দুদিন থাকার ব্যবস্থা করতে পারবেন?
-কবে আসবেন?
-আমি বাসে।
-অহ! আচ্ছা। আপনি কোথায় নামবেন?
-অলংকার
-আচ্ছা। নেমে ফোন দেবেন।নম্বর দিয়েছিলাম তো।
-শুকরিয়া
পৌঁছতে সন্ধ্যা লেগে গেল অনিন্দিতার। অলংকার নেমে ফোন দিল অহনকে।
-কই আপনি?
-আপনি কই?
-সৌদিয়া কাউন্টারের সামনে।
বলতে বলতেই অহন সামনে এসে দাঁড়ালো।
-আসুন
কিছু না বলেই অহন হাঁটা ধরলো। পেছন পেছন অনিন্দিতা।আবাসিক এরিয়ার মধ্যে যাচ্ছে দেখে প্রশ্ন করলো অনি,
-আপনি কি আপনার বাসায় নিচ্ছেন?
-হ্যা। ভাবী নিয়ে যেতে বলেছে।
-অ
-সমস্যা?
-না। আপনাদের সমস্যা না হলে আমার আর কি।
অনিন্দিতার জায়গা হলো অহনের রুমে।ওর রুমটা ভীষণই পছন্দ হলো অনির।
-রুম অগোছালো ।
-ব্যাপার না।
-কোন কিছু দরকার হলে ফোন দিয়েন।
-আচ্ছা
-গুড নাইট
-গুড নাইট
অনিন্দিতা প্রায় চারদিন ছিল অহনদের বাসায়। এই চারদিনে অহন অনিকে ছায়ার মত সাহায্য করেছে। ভাইয়ের বিয়ে, বাসায় কি করে ম্যানেজ করবে সব বিষয়েই। মাঝখানে কখন দুজন আপনি থেকে তুইয়ে নেমে গেছে ।
-এই অনি
-বল
-ভাইয়ার শেরওয়ানী আমারে দিয়ে যা
-কেন?
-আমিও ভাবছি পালায়ে বিয়ে থা করবো।
-দূর হ।
হাসি – আনন্দেই চারটে দিন কেটে গেছে ওদের।
এরপরও যে অবস্থার খুব উন্নতি হয়েছিল তা নয়।অহন হয়তো সাত আটদিন পর একদিন নক দিত অনিন্দিতাকে।অনিন্দিতাও তাই। কিন্তু কোথায় যেন দুজনেরই দুজনকে ভাললেগেছিল। প্রায় বছর খানেক পর একদিন হুট করেই অনিন্দিতা ফোন দেয় অহনকে।
-কই তুই?
-সবে বাসায় আসলাম
-লেকে আয় তো।
-লেক!তুই চিটাগাং?
-হ্যা
-মাত্র আসলাম তো বাসায়
-দূর। আসবি?
-আচ্ছা আসছি।
প্রায় আধাঘন্টা পর অহন ফোন দিল।
-কই তুই?
-দ্যাখ রাইডের পাশেই।
-হু
অনিন্দিতা ফয়েস লেকের সৌন্দর্য দেখছিল তন্ময় হয়ে।আচমকা পাশে তাকিয়েই চমকে উঠলো। অহন বসে আছে ।
-কি অবস্থা?
-এইতো
-চল হাঁটি
-হাঁটতে পারবি?
-দেখা যাক
অহন অনিন্দিতার পাশাপাশি হাঁটছে। আচমকা প্রশ্ন করলো,
-হঠাৎ চিটাগাং কি মনে করে?
-এইতো। তোকে দেখতে।
-তাই!
-হু
-বেশি দেখাদেখি ভাল না।ডুব দিতে পারি।
-তোর আগে আমিও ডুব দিতে পারি।
-তুই কেন ডুব দিবি?
-তুই যে কারণ ভাবছিস।যে কোনো রকম বন্ডিং, কমিটমেন্ট থেকে আমি দূরে থাকতে চাই।
-কেন?
-কেন জানিনা। একা আছি মানে বেশ আছি। ভাল আছি।
-কোনো রিলেশনশিপ?
-রাখ তোর রিলেশনশিপ অহন। আমি কোনো রকম রিলেশনই বিশ্বাস করি না। আমার বাবা তো মাকে ভালবেসেই বিয়ে করেছিল। শেষ পর্যন্ত কি হয়েছে?কোর্টে যেয়ে কাঁদা ছোঁড়াছুড়ি। আই হেইট দিস। এরচেয়ে এমন কোনো রিলেশন শিপ ভাল যেখানে কমিটমেন্টের বালাই নাই। যার ইচ্ছে হবে সে ওয়াক আউট করবে।
-ভাল তো।আমার সাথে থাকবি?
-আছিই তো। এক বছর।
-ফাজলামি না।হঠাৎ চিটাগাং কেন বলতো?
-মন খারাপ। খাগড়াছড়ি যাব। ঘুরতে। তাই ভাবলাম দেখা করে যাই।
-অ। আমার জন্য আসিস নাই?
হেসে ফেললো অনিন্দিতা।অহন মুগ্ধ চোখে তাকালো। হাসলে মেয়েটিকে বেশ লাগে।
-রাত হয়ে যাচ্ছে। বাসে যাব।চল যাই।
-হু
অনিন্দিতাকে বাসে তুলে দেয়ার সময় কি হলো অহনের কে জানে। আচমকা অনিন্দিতার মুখ দুহাতে ধরে কপালে ছোট্ট করে চুমু দিল অহন। চমকে গেল অনি। কোথা থেকে যেন একরাশ ভালোলাগায় ডুবে গেল দুজনেই।
-পৌঁছে জানাস।
-হু
অহনের সাথে এরপর অনিন্দিতার দেখা প্রায় দুবছর পর। যদিও দুজনের যোগাযোগ থেকেছে। অহন ঢাকাতে এসেছিল স্কলারশিপের কাজে। অনিকে ফোন দিল।
-অনি
-বল
-আমি তো ঢাকাতে..
-কই আছিস বল পিক করে নিচ্ছি।
-হাতিরঝিল
-আচ্ছা আসছি। তোর কোনো কাজ আছে?
-আজ আর নেই। কাল..
-আচ্ছা পরে শুনবো।আসছি।
অনিন্দিতাকে দেখে ছোটখাটো একটা ধাক্কা খেল অহন।দুবছরে মেয়েটা যেন বড় হয়ে গেছে অনেকটা। সাদা খোলের বালুচরি শাড়ি, অবিন্যস্ত চুল, চোখে গাঁঢ় করে কাজল নেয়া, কপালে শান্তিনিকেতনী টিপ, পায়ে নুপুর,দু হাতে রঙ। খানিকটা মুখেও। মেয়েটিকে দেখে মনে হচ্ছিল ভুল করে পথ ভুলে পৃথিবীতে চলে এসেছে ভেনাস। অহনের খুব ইচ্ছে করলো অনিন্দিতাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে।
-তাড়াতাড়ি চল
-কেন?
-আমি একটা পটারি নিয়ে বসেছিলাম।তোর জন্য চলে এসেছি সব ফেলে।
-না আসলেও হতো
-হতো না।না আসলে যদি হতোই আমি আসতাম না।
অহন হাসলো।মেয়েটি পাগলিই রয়ে গেছে।
-একি! তুই তোর বাসায় নিয়ে এলি যে!
-চমকানোর কি আছে! আমি আমার সব ছেড়েই এই লাইফ বেছে নিয়েছি। একা আছি বেশ আছি।
-তাই বলে এখানে!
-আচ্ছা!মনে হচ্ছে ভয় পাচ্ছিস!
-ভয়!
বলেই অহন উঠে এসে এক টানে অনিন্দিতাকে বুকের সাথে জড়িয়ে ধরলো শক্ত করে।
-ভালবাসি
-কাকে?
-তোকে
-কেন?
-ভালবাসার জন্য।
অনিন্দিতা পরম নিশ্চিন্তে অহনের বুকে মাথা রাখলো।
-অহন
-বল
-গত তিন বছরেও আমাদের মধ্যে কোনো কমিটমেন্ট হয়নি। তাই না!
-হ্যা
-কেন বলতো?
-কেন?
-কারণ প্রত্যেকটা জিনিসই পূর্ব নির্ধারিত।আমরা এভাবে একসাথে থাকবো বলেই কমিটমেন্ট হয় নি।
-আচ্ছা!মিস ফিলোসফার।আপনি কি জানেন আজ পূর্ণিমা!
-তাই নাকি!
-হুম।তুই পূর্ণিমার হিসেব ছেড়ে দিয়েছিস?ইজ ইট বিলিভেবল?
অনিন্দিতা হাসলো।
-ফ্রেশ হয়ে আয়
অহন ফ্রেশ হয়ে এসে খাটে বসতেই অনিন্দিতা লাইট নিভিয়ে জানালা খুলে দিল।সারাঘর ভেসে গেল চাঁদের আলোয়। অহন উঠে এলো অনিন্দিতার কাছে।
বেশ কিছুদিন অনির কোনো খোঁজ নেই। সোশ্যাল মিডিয়া, ফোন..কিছুতেই না। অহনের খটকা লাগলো।আর যাই হোক।দুই একটা টেক্সট তো অনি করে রাখে ওকে।সব কাজ ফেলে অহন ঢাকায় এলো। ওর বাসায় মস্ত বড় তালা ঝুলছে । টু লেট টানানো। হাতিরঝিল অনির মেজ ভাইয়ের বাড়ি।সেখানে গেল। অহনকে আসিফ চিনতো।ভাইয়া বললো গত দেড় মাস অনির খোঁজ নেই।
অহন বজ্রাহত হয়ে গেল। অনিন্দিতা প্রায়ই বলতো “জানিস অহন।আমার ভালোলাগা গুলো আমাকে ছেড়ে এক আলোকবর্ষ দূরে সিগারেট ফুঁকছে। একদিন আমি আমার সব শেঁকড় তুলে নিয়ে একা হারিয়ে যাব।দেখিস তুই। ”
অহন ভাবতো এসবই পাগলামি।কিন্তু এতটা কষ্ট অনি ভেতরে রেখেছিল অহন বোঝেনি। বুঝলে কি পাশে দাঁড়াতো না অহন?অনিন্দিতাকে তো ও ভালবাসতো।ভীষণ ভালবাসতো।কেন এভাবে হারিয়ে গেল অনি?জানে না অহন।অনিন্দিতার জন্য ওর কষ্ট হচ্ছে। অহন বেঁচে তো থাকবে।কিন্তু অনিন্দিতাকে ছাড়া ভাল থাকবে না নিশ্চয়ই। আচ্ছা!অনিন্দিতা কি কোনো পথভ্রষ্ট উল্কা ছিল?একবার দেখা দিয়ে মিলিয়ে যাওয়ার অধিকার যে শুধু উল্কাদেরই থাকে।।