সপ্না

সপ্না

আলিশা তোর ভাবি এসেছে বাসায়??
ফোনের ওপাশ থেকে আলিশা জাহিদ কে বললো,নাতো ভাইয়া, ভাবিতো এখনো বাসায় আসে নি,
জাহিদ চিন্তায় পরে গেলো। এই মেয়ে কি আমাকে কখনো শান্তিতে থাকতে দিবে নাহ,
ভাইয়া, মা কিন্তু খুব রেগে আছে তুই তাড়াতাড়ি ভাবিকে নিয়ে চলে আয়। আজ কিছু একটা আবার হবে আমার মন বলছে।

ধুর, আমার আর ভাল্লাগে না এগুলো,
এক প্রকার রাগে জাহিদ ফোন টা রেখে দিলো।
জাহিদ আর সপ্নার বিয়ে হয়েছিলো পারিবারিক ভাবে,

জাহিদের বাবা আর সপ্নার বাবা ছিলো ক্লোজ বন্ধু, অনেক দিন পরে জাহিদের বাবার সাথে সপ্নার বাবার দেখা হই, ওইদিন জাহিদ ওর বাবার সাথেই ছিলো, সপ্নার বাবার জাহিদ কে অনেক পছন্দ হই আর ওর পরিপেক্ষিতেই ২ জনের ৪ হাত এক হয়ে যায়।

বাসর রাতে জাহিদ সপ্নাকে বলে, তুমি কখনো আমার বাবা মা কে নিয়ে কোন অভিযোগ আনবা না, কারন আমি তাদের কে অনেক ভালোবাসি। আর আমি মনে করি আমার বাবা মা কখনো ভুল করবে না।
সপ্না ওইদিন ঈ বুঝে গেছিলো জাহিদের বাবা মায়ের প্রতি প্রচন্ড ভালোবাসা আছে।

দিনগুলো অনেক ভালোই যেতে লাগলো, সপ্না বড় লোক বাবার একমাত্র মেয়ে হলে কি হবে, বাসার যাবতীয় কাজ ও করতো, সারাদিন একটা সেকেন্ড সময় ও পেতো না বসে থাকার। এর জন্য সপ্নার কখনো খারাপ লাগতো না, কিন্তু খারাপ লাগতো একটা কারনে, কারন টা ছিলো সারাদিন গাধার মতো খেটেও নিজের শাশুড়ির কাছে মন পেতো না। সপ্না আড়ালে দাড়িয়ে ওর নামে অভিযোগ গুলা শুনতো যা ওর শাশুড়ি ওর শ্বশুড় কে বলতো।
সপ্না মনে মনে অনেক কষ্ট পেতো, আর ভাবতো আর কি করলে আমি আমার শাশুড়ির মন পাবো??

৩ বছর পরে;

সপ্না রান্না ঘরে রান্না করছিলো, মেয়েটার শরীর দুর্বল হয়ে পড়েছে, এই ৩ টা বছরে এক টা দিনো সে তার বাবার মুখ টা দেখতে পারে নি। রাত্রে বেলকুনি তে গিয়ে মুখ বুজে কান্না করে, মাঝে মাঝে বাবা ফোন করলে,হাসিখুশি ভাবে কথা বলে বাবাকে আতস্থ করে,

মা সপ্না, তুই আসবি না মা?
হ্যা বাবা, এইতো সামনে ঈদে তোমার জামাই এর সাথেই যাবো,
মারে, ৩ বছর ত একি কথা বললি, আর তোর শরীরের অবস্থা কেমন এখন?
হ্যা বাবা ভালো আছি,
আমার মন বলছে তুই ভালো নেই মা,

বাবার এমন কথাতে নিজের ভেতরে থাকা কষ্ট টা আর চেপে রাখতে পারে না, কান্না করে দেই তবে সেই কান্নার শব্দ হই না কারন নিজের মুখ ধরে রেখেছে সপ্না।

কিরে মা, বল না, আমি তোকে নিয়ে আসবো?
না, বাবা, বললাম ত আমি আসবো। আচ্ছা এখন রাখি পরে কথা বলবো,

আর একটু বলি মা,অনেকদিন পরে তুই ফোন রিসিভ করলি, আমার ফোন টাও ত রিসিভ করিস না। বিয়ে হলে সব মেয়েই পর হয়ে যায়,

শেষ কথাটা বলতে গিয়ে বাবার গলাটা ধরে এলো।

সপ্না আর কিছু বলতে পারলো না, ফোন কেটে দিলো আর জোরে জোরে কান্না করতে লাগলো

বাবা আমি তোমাকে অনেক ভালোবাসি গো বাবা। মিস করি অনেক। কিন্তু আমার হাত পা বেধে দিয়েছে সাথে মন টাকেও বেধে দিয়েছে বাবা,

রান্না ঘর থেকে সপ্না আলিশা কে বললো মায়ের কাছ থেকে শুনে আসতে, কি রান্না করবে,
ভাবি আমার না কাল এক্সাম আমি পড়তে বসছি তুমি একটু যেনে আসো প্লিজ,
এই বাড়ির ২ টা মানুষ ই শুধু সপ্নাকে ভালোবাসে, আর তারা হলো আলিশা, সপ্নার ননদ আর সপ্নার শশুর।
আচ্ছা ননদিনী, তুমি পড়ো বলেই হালকা হেসে সিড়ি বেয়ে উপরে উঠে গেলো,
রুমের পাশে গিয়ে দাড়াতেই ভেতরে বলা কথাগুলো শুনতেই সপ্নার পা আটকে গেলো,
কি বউ মা আনছিলা যে এখন অবধি একটা বাচ্চা দিবার পারলো না,(মা)
কি বলছো কি তুমি??( বাবা)
শুনতে পারো নি??( মা)
হ্যা শুনেছি, কিন্তু মাত্র ত,

মাত্র, কিসের মাত্র? ৩, ৪ টা বছর হলো, এখন পর্যন্ত একটা দাদু ডাক শুনতে পেলাম না, আহা বলি, বউ কি বাড়িতে পুজা করার লাইগা আনছি নাকি?

আহা, জয়া কি বলছো এগুলো, চুপ করো, বউ মা শুনতে পাবে,
শুনুক, তাতে আমার কি?? আমি কি ভুল কিছু বলছি নাকি, আরো জোরে জোরেই বললো কথাগুলো,
একটা কথা কান খুলে শুনে নাও,

এই বছরে যদি আমার ঘরে নাতনি না আসে, ত ওই বউ রে আমি ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বাড়ি থেকে বের করে দিবো, এই আমি বলে দিলুম,

আহা চুপ করো ত

সপ্না বসে পড়লো, ওর চোখ থেকে অঝড়ে পানি পড়ছে, ওর কানে শুধু কথাগুলো বার বার ভেসে আসছে।
ওইদিনের পর থেকে প্রায় প্রতিটাদিন সপ্না একবার হলেও শাশুড়ির মুখের অকথ্য কথাগুলো শুনতো,
আর রাতে নিজের একমাত্র অবলম্বন যাকে মনে করতো সেই স্বামীও তাকে ওই কথাগুলো বলা থেকে বাদ রাখতো না।
আর সহ্য করতে না পেরে সপ্না ডাক্তারের কাছে গেলো, ডাক্তার কিছু টেষ্ট করলো আর রিপোর্ট পড়ের দিন গিয়ে নিয়ে আসতে বললো।

কিন্তু পড়ের দিন অনেক কাজ থাকায় সপ্না ডাক্তারের কাছে যেতে পারলো না, তার ২ দিন পরে গেলে
ডাক্তার অনেকগুলো ফাইল থেকে একটা রিপোর্ট বের করে দেখে বললো,
সরি আপনি কোনদিন ও মা হতে পারবেন না,
ডাক্তার যেটা সহজ ভাবে বলে দিলো, সপ্নার কাছে সেটা মেনে নেউয়া ততটা সহজ ছিলো না।
সারা রাস্তা সপ্না কান্না করতে করতে এসেছিলো, বাসায় এসে রুমে গিয়ে রুম বন্ধ করে কান্না করে,
আলিশা সপ্নার এমন ভাবে আসা এবং ঘর আটকানো দেখে অবাক হয়ে যায়, ভাবি এমন করলো কেনো??
আলিশা ঘরে গিয়ে অনেক্ষন ডাকার পরে সপ্না রুম খুলে দেয়।
ভাবি তোমার কিছু হয়েছে?? আর তোমার চোখে পানি, কি হয়েছে ভাবি??

সপ্না আর নিজেকে ধরে রাখতে পারলো না, আলিশা কে জরায়ে ধরে কান্না করে দিলো, আর আলিশা কে সব বলে দিলো,

আলিশা সব শুনে সপ্নাকে শান্তনা দিতে লাগলো তবে সেই শান্তনার বীপরিতে ওর জন্য আরো বড় কিছু অপেক্ষা করছিলো যা ওর পেছনেই দাড়িয়ে ছিলো,

আলিশা কে বলা সব কথাই সপ্নার শাশুড়ির শুনে ফেলে, ওনার চোখ দেখেই বোঝা যাচ্ছিলো উনি ঠিক কি পরিমানে রেগে আছে,

সারাদিন সপ্নাকে একটা কথাও বলেনি ওর শাশুড়ি, সপ্না ত অবাক এমন ত হবার কথা না, সাথে ভয় ও পাচ্ছে,
হ্যা সপ্নার ভয় টাই সত্য হলো,

রাত্রে জাহিদ বাসায় এলে জাহিদের মা সব কিছু বলে দেয় জাহিদ কে আর সাথে মায়াকান্না শুরু করে,
জাহিদ আগে থেকেই মা ভক্ত ছিলো তাই সপ্নার কোন কথা না শুনেই সপ্নাকে অনেক খারাপ খারাপ কথা বলে ইভেন সপ্নার গায়ে হাত অবধি তুলে,

ওইদিনের পর থেকে সপ্নাকে প্রায় প্রতিদিন এগুলো শুনতে হতো,

হ্যাগো মানুষ ত গলায় দরি দিয়ে মরে গো, এই মাইয়ার মাথায় কি সেই বুদ্ধিটুকুও নাই?? মরলেও ত বাঁচতাম, আমার পোলাডারে আর একটা বিয়া দিয়া নাতনির মুখ দেখতাম, এই অলক্ষির জন্য কি সেই সুখ আছে নি আমাদের কপালে,
কথাগুলো সপ্না শুনতো তবে কিছু বলতো না আর কান্নাও করতো না, হইতো চোখের জল সব শুকিয়ে গেছিলো,
অনেক রাত পর্যন্ত জাহিদ খুজলো সপ্নাকে, আত্মীয়স্বজন, রাস্তা সব জায়গায়, কিন্তু কোথাও না পেয়ে বাসায় গেলো।
পরের দিনঃ

সকালের ব্রেকিং নিউজে চোখ পড়তেই আলিশার চোখ থেকে পানি গড়িয়ে পড়লো,
ভাইয়া বলে জোরে চিৎকার দিলো,
ব্রেকিং নিউজে লেখা ছিলো,
গতরাতে বাসের ধাক্কায় অজ্ঞ্যাত্নামা মহিলাটির মৃত্যু হই,
আলিশা নিজের ভাবিকে চিনতে একটুও ভুল করে নি।
জাহিদ নিউজ টা দেখে চুপ হয়ে যায়।
জাহিদের মা কিছুসময় পরে,
ভাল হইছে আপদ বিদেয় হইছে,
আলিশা আর আলিশার বাবা জয়া বেগমের দিকে তাকিয়ে রইলো,
সপ্নার মৃত্যুর কয়েকদিন পরে হাসপাতাল থেকে কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে একটা রিপোর্ট আসে
রিপোর্ট টা দেখে জাহিদ চমকে যায়,
কারন রিপোর্ট টা সপ্নার মেডিকেল টেষ্টের ছিলো, আর সেখানে সব কিছু পজিটিভ ছিলো,
রিপোর্টের সাথে একটা চিঠিও ছিলো যাতে লেখা ছিলো,

সরি, অত্যন্ত দুঃখের সাথে জানাচ্ছি যে আমাদের রিপোর্ট টা দিতে ভুল হয়েছিলো, আপনার রিপোর্ট টার সাথে অন্যজনের রিপোর্ট মিশে গেছিলো, ওনার নাম টাও সপ্না খান ছিলো, আর আপনার টা চৌধুরী ছিলো যা আমাদের অলক্ষে ছিলো, ক্ষমা করবেন।

ডা. তায়ামুন খানম

আলিশা চিঠি টা পরেই চুপ হয়ে গেলো, আর মনে মনে বললো,

ভাবি, তোমার সোনার হরিণ টা দেখো আমাদের কাছে যেই রিপোর্টের পজিটিভ রেজাল্ট শোনার জন্য তুমি অনেক উৎসুক ছিলা, দেখ সেইটা এখন আমাদের কাছে।

সপ্নার মৃত্যুর ৬ মাস পরেই জাহিদের মা জাহিদ কে আবার বিয়ে দেয়। তবে আনিকা সপ্নার মতো এতটা বোকা ছিলো না, বাসার কাজের জন্য জোর করে কাজের মেয়ে রাখে, ১ বছর যেতে জয়া বেগম আনিকা কে নাতনির ব্যাপারে কথা বললে, আনিকা জাহিদ কে নিয়ে ডাক্টারের কাছে যায়। কারন ও সপ্নার মৃত্যুর কথা জানতো এবং সপ্নার ব্যাপারে যাবতীয় কিছু আলিশার কাছ থেকে শুনেছিলো, তাই ও একা না জাহিদ কেও ওর সাথে নিয়ে যায়। আনিকা আগে থেকেই ডাক্তার কে বলে রেখেছিলো, তাই ওরা ২ জন যখন হাসপাতালে যায়, ডাক্তার ২ জনেরি কিছু টেষ্ট করতে বলে। জাহিদ ত অবাক হয়ে যায় আনিকার কাজগুলো দেখে, তবে কিছু বলে না।

টেষ্ট শেষে, ডাক্তার যখন রিপোর্ট দিলো জাহিদ তখন থমকে গেলো আর আনিকার মুখে হাসি ফুটে উঠলো।
রিপোর্টে আনিকার রেজাল্ট পজিটিভ ছিলো, তবে জাহিদের রেজাল্ট পজিটিভ ছিলো না, যার জন্য সপ্নার রেজাল্ট পজিটিভ হউয়া সত্তেও সপ্নার কোন বেবি হয়েছিলো না।
গাড়ির মধ্যেঃ

আপনি সপ্নাকে অনেক কথা শুনিয়েছিলেন তাই না?? এখন কি বলবেন??
জাহিদের চোখ থেকে পানি গড়িয়ে পড়লো, অনুশোচনার।

আমি আপনার সাথে থাকতে পারবো না, মেয়েদের কাছে সব চেয়ে মুল্যবান মাতৃত্ব নামক শব্দ ধারন করা, যার জন্য সপ্নার মতো হাজার মেয়েকে নিজের জীবন বিসর্জন দিতে হয়।
আমায় ক্ষমা করবেন।

জাহিদ আনিকার কথাগুলো শুধু শুনলো তবে কিছু বললো না, কিছু বলার ছিলোও না। শুধু অনুশোচনা আর ঘৃনা হচ্ছিলো ওর নিজের প্রতি…

সপ্নার বাবা মেয়ের ছবি বুকে নিয়ে কান্না করে আর বলে, মারে তুই আমার কাছে কেনো এলি না, আমার কি তোকে আগলে রাখার সম্বল ছিলো না??

একমাত্র সপ্নাই জানে ওকে কেনো এমন কাজ করতে হলো। হ্যা, সপ্না পারতো নিজের বাবার কাছে ফিরে যেতে, নতুন করে জীবন গড়তে কিন্তু একটা কথা যা ওকে কুড়ে কুড়ে খেতো, প্রতিবেশিদের মুখ থেকে বন্ধা নামক শব্দটা শোনা।

জীবনে এমন কিছু পরিস্থিতি আসে যখন মৃত্যুকেই বেশি আপন মনে হই..

গল্পের বিষয়:
দু:খদায়ক
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত