খেলার মাঠের ঠিক মাঝখানে বসে আছি আমি আর রাফসান। রাফসানকে দেখে বোঝা যাচ্ছে ওর মন খারাপ। মুখটা কেমন যেন গোল আলুর মত করে রেখেছে সে। এমনিতেই ওর গালদুটো গোলআলুর মতই লাগে সবসময়।
— কিরে রাফু, এমনে হাবলুর মত বইসা কি ভাবিস?
হয়তো অন্যকিছু নিয়ে এতক্ষন ভাবনায় ব্যস্ত ছিল রাফসান। তাই হঠাৎ আমার কথা শুনে ঘোরলাগা চোখে তাকালো আমার দিকে। দেখে মনে হচ্ছে মাত্রই বুঝি ঘুম থেকে উঠলো রাফসান।
— দোস্ত আমি হয়তো বেশিদিন বাঁচবো না। হতে পারে আজকেই আমি মারা যাবো।
রাফসানের মুখে এই কথা শুনে হঠাৎ আমার কেমন যেন খারাপ লাগতে শুরু করলো। বেচারা নাহয় প্রেম করে ছ্যাঁকা খেয়েছে, তাই বলে সেই শোকে মারা যেতে হবে? কেন যে মানুষ প্রেম করে বুঝিনা।
— দোস্ত নিজেকে শক্ত কর। তোর মৃত্যুর কথা এভাবে বললে আমার খারাপ লাগে। দোস্ত বুঝতে পারলাম তোর মন খারাপ। আমি ফোন দিয়ে রাজীব, ফারহান আর উম্মে হানীকে নিয়ে আসছি। ওরা আসলেই দেখবি তোর মন ভাল হয়ে যাবে।
— দোস্ত যাই করিস, আজ কেন যেন মনে হচ্ছে আমি মারা যাবো। আমাকে তোরা ক্ষমা করে দিস।
— ধূর ব্যাটা কথা কম বল।
বেচারা সত্যিই মনে অনেক আঘাত পেয়েছে। তাই সেই আঘাত সহ্য করতে না পেরে আত্মহত্যার কথা চিন্তা করছে। আমি একে একে রাজীব, ফারহান আর হানীকারক উম্মে হানীকে ফোন দিয়ে মাঠে আসতে বললাম। রাফসানের মনটা যেভাবেই হোক ভাল করতে হবে।
ফোন দেয়ার কিছুক্ষন পর একে একে সবাই চলে আসলো। তারপর সবাই গোল হয়ে বসে কথা বলতে শুরু করলাম। সবার প্রথম হানী বললো,
— আজকে কোন মাসের কত তারিখ বলতে পারিস রাফু?
— আজকে অক্টোবরের দশ তারিখ।
— তারমানে নভেম্বরের বিশ তারিখ পর্যন্ত আমাদেরকে অপেক্ষায় থাকতে হচ্ছে।
— কিসের অপেক্ষার কথা বলছিস হানী?
এই প্রশ্নের উত্তরে হানীকারক হানী কিছুই বললো না। সে এখন মৌনব্রত পালনে ব্যস্ত আর মাঝে মাঝে মুচকি হাসিতে ব্যস্ত।
হানী চুপ করার পর রাজীব কথা বলতে শুরু করলো।
— দোস্ত আমার কাছে এক বাবুর্চির নাম্বার আছে। সেইরকম বিরিয়ানি বানায়। একবার খেলে বারবার খেতে ইচ্ছে করবে।
রাজীবের কথায় রাফসান চোখ বড়বড় করে তাকিয়ে রইলো আমাদের সবার দিকে। রাফুর মাথায় বোধহয় কিছুই ঢুকছে না। সে অবাক কন্ঠে বলে উঠলো,
— তোরা কি বলছিস আমার মাথায় কিছুই ঢুকছে না। কি সব বিরিয়ানি, নভেম্বরের বিশ তারিখের কথা বলছিস তোরা?
— দোস্ত এসব বুঝতে ঘিলু লাগে, তোর মাথায় তো ঘিলুর অভাব আছে। আমার কাছথেকে কিছু ঘিলু ধার নিস।
একথা বলে রাজীব হাসতে হাসতে মাঠের নরম সবুজ ঘাসের উপর গড়াগড়ি দিতে লাগলো। আমরাও রাজীবের সাথে হাসিতে যোগ দিলাম। হাসি থামার পর ফারহান বলতে শুরু করলো।
— দোস্ত মাংস যেনো বেশি থাকে। মাংস কম দিলে কিন্তু বিরিয়ানি খেতে একেবারেই ভাল লাগে না। আবার দেখিস মুরগি দিয়ে বিরিয়ানি করার চেষ্টা যাতে আঙ্কেল না করে। তাহলে কিন্তু আমরা খাবো না।
— তোরা কি পাগল হয়ে গেলি নাকি? কি বলছিস কিছুই তো মাথায় ঢুকছে না। প্লীজ একটু খুলে বল ব্যাপারটা। এমনিতেই আমার মন ভাল নেই। তার উপর তোরা এসে এসব কি উদ্ভট কথা বলছিস?
রাফু বেচারা কথা বলতে বলতে প্রায় কেঁদেই দিচ্ছিল। আরেকটু হলে হয়তো কেঁদেই দিতো। তার আগেই আমি রাফুর মাথায় চাটি মেরে বললাম,
— গাধা আমরা তো তোর চল্লিশা খাওয়ার প্ল্যান করছিলাম। অনেকদিন হলো বিরিয়ানি খাওয়া হয়না। পকেটের যা অবস্থা!
— আমার চল্লিশা মানে?
— ওমা! তুই তো একটু আগে বললি যে তুই মারা যাবি। তাই আগেভাগেই তোর চল্লিশা খাওয়ার প্ল্যান করে ফেললাম। বুঝতেই তো পারছিস আগেভাগে প্ল্যান করে রাখলে উপকারই হয়।
আমার কথা শেষ হওয়ার সাথে সাথেই একসাথে হানী, রাজীব আর ফারহান হেসে উঠলো। আমি তো রাফুর মুখ দেখে হাসি কিছুতেই থামাতে পারছিলাম না। বেচারা বুঝতেই পারেনি যে ওর মরে যাওয়ার মত সিরিয়াস ব্যাপারটাকে আমরা এভাবে ঠাট্টা করে উড়িয়ে দেব।
— দোস্ত তোরা এভাবে আমাকে নিয়ে ফান করতে পারলি? তোরা দোস্ত নাকি দুশমন?
— আমরা মোটেও তোর দোস্ত না, আমরা হচ্ছি বিরিয়ানিখোর। তাড়াতাড়ি মরে গিয়ে আমাদের বিরিয়ানি খাওয়ার ব্যবস্থা করে দিয়ে দোজাহানের অশেষ নেকি হাসিল কর।
রাজীব হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ছে আমার গায়ের উপর, ফারহান আর হানী পেটে হাত দিয়ে হাসছে। আমাদের হাসি দেখে রাফু নিজেও হেসে দিল। যাক বোকাটার মন তাহলে ভাল হয়েছে।
১০ই নভেম্বর, ২০১৮। আমি, উম্মে হানী, রাজীব আর ফারহান মাঠের মাঝখানে বসে আছি। ইদানিং বিকেলে আবহাওয়া ঠান্ডা থাকে, শীত আসি আসি করছে। আমরা সবাই একসাথে আছি, শুধু রাফু আসেনি।
আর রাফু কোনদিনই আসবে না আমাদের কাছে, বসবে না আমাদের পাশে। সেদিন আমাদের সাথে আড্ডা দেয়ার পর বাসায় গিয়ে কিছুক্ষন পড়ালেখা করার পর রাফসান ছাদে গিয়ে বসে ছিল কিছুক্ষন। তারপর ছাদ থেকে নিচে নামার সময় হঠাৎ করে পা ফসকে সিড়ি থেকে গড়িয়ে নিচে পড়ে যায়। উল্টো হয়ে পড়ার ফলে রাফসানের ঘাড় ভেঙ্গে যায়। হাসপাতালে নিতে নিতে মৃত্যু হয় রাফসানের।
আমরা আজ দুপুরেই রাফসানের চল্লিশা খেয়ে এসে এই মাঠে বসলাম।