কাটাতাঁরে দাঁড়কাক

কাটাতাঁরে দাঁড়কাক

গ্রামের শেষ মাথায় যে বাড়িটা ওটা মল্লিিক বাড়ি নামে পরিচিত। নীল রঙের টিনের ছাউনিতে তৈরি বাড়িটা।

বাড়ির চারপাশে কাটাতাঁরের বেড়া দিয়ে ঘেরা। উঠানের একপাশে ফুলের বাগান। মল্লিক বাড়ির ছোট মেয়ে কবিতা বাগান করতে ভালোবাসে।

বাগানটি সে নিজ হাতে পরিচর্যা করে।
.
.
একদিন কবিতা তার ফুলের বাগানে চারাগাছে পানি দিচ্ছিলো। হঠাৎ তার চোখ পড়লো

বাড়ির গেইটের পাশে বড় আমগাছ থেকে দুটি দাঁড়কাকের বাচ্চা পড়েছে। কবিতা দৌঁড়ে গেল গেইটের পাশে। সযত্নে তুলে নিলো কাকের বাচ্চা দুটিকে।

খুব মায়া হলো তার পাখি দুটোর উপর। তারপর নিজেই আমগাছে উঠে কাকের বাসায় বাচ্চা দুটিকে সাবধানে রাখলো সে।
.
.
এক সকালে কবিতা শুনলো কাকের বাসা থেকে বাচ্চা দুটো চিৎকার করতেছে।

সে গাছে উঠে যখন কাকের বাসায় হাত রাখলো, তখন বাচ্চা দুটো হা করে থাকলো। মনে মনে অনেক বকা দিলো বাচ্চা দুটোর মাকে।

এভাবে বাচ্চাদের অনাহারে রেখে কোনো মা চলে যায়?
.
.
কবিতা সাবধানে নেমে এলো গাছ থেকে। তারপর বাগানে ফড়িং খু্ঁজতে লাগলো বাচ্চা দুটোর জন্য।

তখন বাড়ির ভেতর থেকে তার মা বের হয়ে বললো:
–কি রে কবিতা, কি করছিস এখানে?
–ফড়িং খু্ঁজতেছি মা।
–স্কুল নেই তোর আজ? যা, স্কুলে যা….
–মা দাঁড়াও, কাকের বাচ্চাদুটোর খুব খিদে পেয়েছে। ওদেরকে ফড়িংগুলো দিয়ে আসি খেতে।
–আচ্ছা ঠিক আছে।”
.
.
কবিতা কয়েকটা ফড়িং নিয়ে আমগাছে উঠলো। তারপর কাকের বাচ্চা দুটোকে তা খেতে দিলো। খাওয়ার পর পাখিদুটোর চীৎকার থেমে গেলো।

হয়তো মনে মনে কৃতজ্ঞ হলো কবিতার উপর। পাখির বাচ্চাদুটোর অনাহার দূর করতে পেরে কবিতার মনেও একরাশ আনন্দ বয়ে গেলো।

কতোটুকুই আর বয়স হবে তার? ১২/১৩ বছরের মেয়ে। এই বয়সেই সে বুঝতে শিখেছে পাখিদের প্রতি ভালোবাসা।

যখন স্কুলে থাকে সে, পাখিদুটোর জন্য তার চিন্তা হয়। কেমন আছে? কিভাবে আছে?

স্কুল থেকে ফিরেই কবিতা স্কুল ব্যাগটা রেখে দৌঁড়ে যায় আমগাছের পাশে।

তারপর আমগাছে উঠে পাখিদুটেকে সযত্নে খাবার খেতে দেয়। পাখি দুটোর মা নেই। কোথায় গেছে তাও জানা নেই।

কবিতাই যেন পাখি দুটোর মা এখন।
.
.
কাকের বাচ্চাদুটো উড়তে শিখেছে। তা দেখে কবিতার সেই কি খুশি। ওরা আকাশে যখন উড়ে বেড়ায়, কবিতা হা করে চেয়ে থাকে সেদিকে।

আর নিচ থেকে হাততালি দেয়। খাবারের সময় হলে পাখিদুটো উড়ে এসে বসে কাঁটাতারের বেড়ার উপর।

কবিতা তখন ফড়িংসহ আরো নানাধরণের পোকামাকড় খেতে দেয় তাদের।
.
.
আরেকটু বড় হলে কবিতা পাখিদুটোকে ভাত খাওয়াতে শুরু করে।

বাসায় কোনো কিছু রান্না হলে নিজের ভাগ থেকে সে পাখিদুটোর জন্য কিছুটা সরিয়ে রাখতো, তারপর একসময় গিয়ে পাখি দুটোকে খাইয়ে আসতো।
.
.
কবিতাদের বাসায় বেড়াতে এসেছে তার মাসিমা। সাথে তার মাসীমার দুষ্ট ছেলে পিন্টু। পিন্টু সারাক্ষণ দুষ্টামি করে।

কাকের বাচ্চা দুটোকে দেখলেই ঢিল ছুড়ে। তার এই দুষ্টামির কারণে দুটো কাকের বাচ্চা থেকে একটা মারা গেল একদিন।

বাচ্চা দুটো সেদিন কাঁটাতারের উপর বসেছিল, আর অপেক্ষা করছিল কবিতা কবে তাদের জন্য খাবার নিয়ে আসবে।

সেই ফাকে পিন্টু গিয়ে বড় একটা ঢিল ছুড়ে ওদের দিকে। সাথে সাথে দুটো বাচ্চা থেকে একটা মারা গেল, আর অন্যটা উড়ে গেল।

কবিতা এসে যখন দেখলো একটা কাকের বাচ্চা মারা গেছে, তখন সে খুব কান্না করতে লাগলো, আর পিন্টুকে বকা দিতে লাগলো।

পিন্টু পুরো ব্যাপারটাকে আরো মজা হিসেবে নিয়ে হাসতে লাগলো।
.
.
সন্ধ্যাবেলায় কবিতা আমগাছে উঠে অন্য কাকের বাচ্চাটাকে খাবার খাওয়াতে লাগলো। তখন সে বাচ্চাটির বড় বড় ঠোটে হাত বুলাতে বুলাতে বললো:
–তুই আর কাটাতাঁরের উপর বসিসনা, আমি তোর জন্য এখানেই খাবার নিয়ে আসবো। যতদিন পিন্টুরা থাকবে, তুই একটু সাবধানে থাকবি।”
.
দাঁড়কাকের বাচ্চাটি যেন বুঝতে পেরেছে কবিতার কথা। ছোট ছোট চোখ দুটো তার জলে ভিজে উঠলো।

কবিতা তার গায়ে একবার হাত বুলিয়ে দিয়ে গাছ থেকে নেমে এলো খাবার খাইয়ে।
.
.
এরপর থেকে কবিতা রোজ দাঁড়কাকের বাচ্চাটির জন্য খাবার নিয়ে উঠতো গাছে……,

বাচ্চাটি কবিতার সব কথা বুঝে, তাই সেদিন থেকে আর বাচ্চাটি কাটাতাঁরে বসতোনা।

পিন্টুরা চলে যাওয়ার পরেও কবিতা গাছে উঠেই খাবার খাওয়াতো দাঁড়কাকের বাচ্চাটিকে।
.
.
ধীরে ধীরে বড় হয়ে উঠলো দাঁড়কাকের বাচ্চাটি। এখন বাচ্চাটিকে প্রাপ্তবয়স্ক দাঁড়কাক বলা যেতে পারে।

বড় বড় ঠোঁটে কা কা করে দাঁড়কাকটি এখন উড়ে বেড়ায় আকাশে। তবুও কিছু একটা যেন কষ্ট থেকে গেছে ওর মনে।

মাঝেমাঝে তাকিয়ে থাকে সে কাটাতাঁরের বেড়ার দিকে। এই কাটাতাঁরে সে একদিন হারিয়েছে তার সঙ্গীকে। সেই দুঃখ কি করে ভুলা যায়।

কাক বলে কি অনুভূতি নেই তাদের? তবুও কষ্টটা সে একটু একটু ভুলতে শিখেছে। সকাল বেলায় কা কা করে সবার ঘুম ভাঙায় দাড়ঁকাকটি।

তখন কবিতা তার জন্য খাবার নিয়ে উঠে গাছে। খাবার খেয়ে কাকটি উড়াল দেয় আকাশে। ঘুরেফিরে আবার আসে সন্ধ্যায়।

কবিতা আবার খাবার নিয়ে উঠে তখন গাছে, আদর করে খাওয়ায় দাঁড়কাকটিকে।

দাঁড়কাকটিও বুঝে, পৃথিবীতে তার সবচেয়ে আপন কেউ হলো কবিতা।

কিন্তু কাকটি বুঝে উঠতে পারেনি তার সেই আপনজনকে অল্পসময়ের মধ্যে হারাতে হবে।
.
.
বর্ষণমুখর কোনো এক বিকেলে, কবিতা দাঁড়কাকটির জন্য খাবার নিয়ে উঠে গাছে। বৃষ্টির জন্য কাকটি সারাদিন বের হতে পারেনি, খাবারও খাইনি।

আর এদিকে বৃষ্টির কারণে কবিতাও গাছে উঠে খাবার দেয়নি কাকটিকে। ভেবেছিল বৃষ্টি থামলে, একফাকে গাছে উঠে খাবার দিয়ে আসবে।

কিন্তু সে কি বৃষ্টি! থামার নাম নেই। বাসা থেকে কাকটি কা কা করে ডাকতে লাগলো বিকেলের দিকে। কবিতা বুঝলো কাকটির খুব খিদে পেয়েছে।

তাই সে বৃষ্টি উপেক্ষা করে দাঁড়কাকটির জন্য খাবার নিয়ে উঠলো গাছে। কবিতাকে দেখে কাকটি শান্ত হলো।

কা কা করা থামিয়ে দিয়ে বড় বড় ঠোঁটে হা করে থাকলো খাবারের জন্য। কবিতা আদর করে খাইয়ে দিলো তাকে। তারপর জিজ্ঞেস করলো:
–খুব কষ্ট হয়েছে নারে তোর?”
কাকটি কৃতজ্ঞ দৃষ্টিতে কবিতার দিকে তাকিয়ে ঠোঁট নাড়ালো। কবিতা হেসে দিয়ে বললো:
–তোর জন্য বেশি করে খাবার নিয়ে এসেছি, যখনই খিদে পাবে এখান থেকে খাবি।” বলেই কবিতা নামতে যাবে গাছ থেকে।

তখন সে স্লিপ খেয়ে পড়ে গেল কাটাতাঁরের উপর। কাটাতাঁরে তার ছোট্ট দেহটা কয়েকমুহূর্ত ছিন্নভিন্ন হয়ে মাটিতে পড়লো।

বৃষ্টিরজল লাল হয়ে বয়ে যেতে লাগলো কবিতার রক্তে। কিছুক্ষণ ছটফট করে মারা গেলো কবিতা। দাঁড়কাকটি নেমে এলো নিচে।

তারপর “কা কা” করে চিৎকার করতে লাগলো কবিতার লাশের পাশে। কাকটির চিৎকারে ভেতর থেকে লোকজন এসে দেখলো কবিতার লাশ।

তারা কবিতার লাশ জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগলো। কবিতার মৃত্যুর জন্য তারা দায়ী করলো কাকটিকে। তাই তারা কাকটিকে অভিশাপ দিতে লাগলো।

একদিন ভেঙে দেয়া হলো দাঁড়কাকের বাসাটি। কাকটিকে কেউ দেখলে ঢিল ছুড়তো। তখন কাকটি উড়ে যেতো। তবে আবার আসতো।

এসে বসতো কাটাতাঁরের উপর, যেখানে কবিতার দেহ গেঁথে গিয়েছিলো।
.
.
একসময় মল্লিক বাড়ির সবাই বিরক্ত করা ছেড়ে দেয় দাঁড়কাকটিকে। কাকটিকে নিজের মতো থাকতে দিয়েছে ওরা।

কাকটি সারাক্ষণ বসে থাকতো কাটাতাঁরের উপর। আর তাকিয়ে থাকতো মল্লিক বাড়ির দিকে।

এক সকালে মল্লিক বাড়ির সবাই দেখলো কাঁটাতারের বেড়ায় কাকটি গেথে আছে মৃত। সবাই তখন বুঝলো কাকটি নিজেই নিজেকে শেষ করে দিছে।

হয়তো এটাই ভালোবাসা। কাকটি বুঝেছে, যেখানে কবিতা নেই, সেখানে তারও থাকা উচিত না।

তাই সে নিজেকে কাটাতাঁরে শেষ করে দিয়ে, চলে গেছে কবিতার কাছে। মরার আগে কাকটি বুঝে গেছে কাটাতাঁরে বিদ্ধ হওয়ার কষ্টটা কিরকম!
.
.
আজ আর কবিতা নেই। নেই দাড়ঁকাকও। এখন আর মল্লিক বাড়িতে খুব সকালে কারো ঘুম ভাঙেনা কাকের ডাকে।

আমগাছটাও কেটে ফেলা হয়েছে, কোনো কাক আর বাসা বাঁধতে পারবেনা। একপাশে পড়ে আছে কবিতার সাজানো বাগানটা।

ওখানে কেউ আর সযত্নে পানি দেয়না। কাটাতাঁরের বেড়াটা এখনো আছে, কবিতা আর দাঁড়কাকের মৃত্যুর সাক্ষী হয়ে।

গল্পের বিষয়:
দু:খদায়ক
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত