রেডিওর অনুষ্ঠানে গেলাম অাজ প্রধান অতিথি হয়ে।জীবনে কোনদিন গুছিয়ে কথা বলতে পারি নি।
তবে অাজ বেশ খানিকটা গুছিয়েই বললাম।অনুষ্ঠানটা রেকর্ডও করে রাখা অাছে।অামি নিয়ে অাসলাম সাথে করে রেকর্ডিংটা।বারবার শুনছি অার ভাবছি এতো বড় একটা লাইভ অনুষ্ঠানে কীভাবে এতক্ষণ কথা বললাম।
অামার পরিচয়টা একটু পর দিব।
ওহ হ্যাঁ অনুষ্ঠানটা ছিলো জীবনের গল্প নিয়ে।এই ধরণের অনুষ্ঠানগুলো রেডিওতে ভীষণ জনপ্রিয় হয়।শ্রোতাও হয় অনেক বেশি।অনুষ্ঠানে শুধুমাত্র অামার নাম বলা হয়েছে।অার তেমন কোন তথ্য অামার সম্পর্কে দেয়া হয় নি।যেদিন অামি নিজে এই গল্পটা শুনি সেদিন থেকেই ইচ্ছে ছিলো গল্পটা সবার কাছে পৌঁছে দেয়ার।সেই ইচ্ছেরই প্রতিফলন ঘটলো অাজ।
২ দিন পর ফেসবুক অাইডিতে একটা মেসেজ অাসলো।খুব অনুনয় বিনয় করে মেসেজের রিপ্লে চাওয়া হচ্ছে অামার কাছে।বিষয়টা অামার কাছে খুব একটা বোধগম্য হলো না।তাছাড়া আইডিটা ছিলো একটা মেয়ের।
মানুষের মন স্বভাবতই কিছুটা কৌতুহূলী।অাপনাদেরও হয়তো জানতে ইচ্ছে করছে রেডিওতে বলা সেই গল্পটা।
চিন্তা করবেন না।
অাপনাদের কৌতুহল এখনই দূর করে দিচ্ছি।
অাজ থেকে প্রায় ২ মাস অাগে……
অামি ষ্টেশনে বসে অাছি।তখন রাত প্রায় ১১ টা বাজে।
সাধারণত বছরের এই সময়টাতে ট্রেনে তেমন ভীঁড় থাকে না।তবে ষ্টেশনে এসে জানতে পারি ট্রেন অাসবে অারও দেরীতে।
ষ্টেশনে লোকজন প্রায় হাতেগোনা।যারা অাছে তারা সবাই মোটামুটি পরিবারের সাথে বা অন্য কারো সাথে।
অামিই একমাত্র একা। একাকিত্ব দূর করার জন্য মোবাইলটা হাতে নিলাম অার পাশের টংয়ে একচাপ চা অর্ডার করলাম।
কিছুক্ষণ বাদে একটা ছেলে অাসলো।বয়স বোধহয় অামার থেকে একটু কম হবে।দেখতে কিছুটা অদ্ভূত।
অামার প্রথমে সন্দেহ হলো হয়তো কোন ছিনতাইকারী বা নেশাখোর টাইপের ছেলে।
–অামি কি বসতে পারি স্যার??(ছেলে)
–হুম পারো।কিন্তু কে তুমি তোমাকে তো অামি চিনি না।(অামি)
–অামাকে অাপনি চিনবেন না স্যার।অামি নিজেই তো অনেক সময় নিজেকে চিনি না।(ছেলে)
–তোমার কথাগুলো একটু কঠিন।(অামি)
— ভয় পাবেন না স্যার।অামি অাপনার কোন ক্ষতি করতে অাসি নি।অামাকে এক কাপ চা খাওয়াবেন স্যার??(ছেলে)
–অাচ্ছা তোমাকে এক কাপ চা খাওয়াচ্ছি।তুমি চা খেয়ে চলে যাও।(অামি)
–থাক স্যার।অাপনি অামাকে বিশ্বাস করতে পারেন নি।অামি জানি স্যার কেউ অামাকে বিশ্বাস করে না।
–তুমি তো দেখছি তোমার চেহারার মতোই অদ্ভূত টাইপের।অাচ্ছা তুমি কোথায় যাবে??
–অামি ষ্টেশনেই থাকি।সবাই চলে যায় স্যার।অামি যাই না।যেতে পারি না।
–এটা অাবার কেমন কথা??
–থাক স্যার বাদ দেন অামার কথা।একটা গল্প শুনবেন স্যার??
–ছোট হলে শোনা যায়।ট্রেন এসে পড়বে তো।
–সত্যি শুনবেন স্যার!!অামার গল্প তো কেউ শুনতে চায় না স্যার।
–চলো চা খেতে খেতে গল্প শুনবো তোমার।
— স্যার অামার কাপে চিনি একটু বেশি দিতে বলবেন।
–অাচ্ছা ঠিক অাছে।তোমার গল্প শুরু করো।
–অামার গল্পটা স্যার একটু অন্যরকম।জানেন স্যার অামার একটা পরিবার ছিলো।অামি পরিবারের বড় ছেলে ছিলাম স্যার।স্যার জানেন অামার বাবা-মা অামাকে নিয়ে অনেক বড় স্বপ্ন দেখতো।
তারা ভাবতো অামি হয়তো অনেক বড় ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ার হবো।কিন্তু জানেন স্যার অামি কখনোই সে স্বপ্ন
দেখতাম না।লেখাপড়া অামাকে কোনদিনও টানতো না স্যার।বাবা মায়ের জোড়াজোড়িতে পড়তাম স্যার।এসএসসি পাশ করলাম।রেজাল্ট হলো মোটামুটি।মন থেকে না পড়লে যেরকম রেজাল্ট হয় ঠিক সেরকমই হলো।
জানেন স্যার অামি না খুব ভালো ফুটবল খেলতাম।এসএসসি পরীক্ষার অাগে অনুর্ধ্ব-১৯ দলে সুযোগ পেয়েছিলাম।ভেবেছ
িলাম হয়তো ফুটবলার হতে পারবো।কিন্তু স্যার এটা ছিলো অামার বাবা-মায়ের স্বপ্নের সাথে সাংঘর্ষিক।রেজাল্ট তেমন ভালো না হওয়ায় অামি অার পড়ার ইচ্ছা হারিয়ে ফেলি।যদিও তেমন পড়ার ইচ্ছা অামার কখনোই ছিলো না।
–এইতো নাও চা চলে এসেছে।তোমারটায় চিনি একটু বেশিই দেয়া হয়েছে।
–অাপনি অনেক ভালো স্যার।জানেন কেউ অামাকে চা খাওয়ায় না।যাই হোক স্যার অামার গল্পটা শুরু করি।
অামার গল্পে একটা রাজকন্যার অাগমন ঘটে স্যার।
রাজকন্যার মনটা অনেক ভালো ছিলো।অামার অনেক কেয়ার করতো স্যার।তার জন্যই অামি অাবার লেখাপড়াতে মনোযোগ দেই স্যার।সে অামাকে অামার বাবা-মায়ের স্বপ্নের কথা বুঝায়।অামি সেই রাজকন্যার কোন কথা ফেলতাম না।অামি চাইলেও ফেলতে পারতাম না।একদিন রাজকন্যার সাথে খুব ঝগড়া হল স্যার।অামার তখন টেস্ট পরীক্ষা চলছিলো।অামি তারপর অনুর্ধ্ব-২৩ দলের ক্যাম্পে ডাক পেলাম।ক্যাম্পটা পরীক্ষার মধ্যেই পড়লো।ক্যাম্পে গেলে শেষের কয়েকটা পরীক্ষা বাদ দিতে হবে।অন্যদিকে কলেজ থেকে কড়া নির্দেশ টেস্ট পরীক্ষা না দিলে বোর্ড পরীক্ষা দিতে দিবে না।অামার তখন সেই ফুটবলের ভূত মাথায় চাপলো।চিন্তা করলাম বাসায় না জানিয়ে ক্যাম্পে চলে যাবো।কিন্তু খবরটা রাজকন্যার কান অবধি পৌঁছে গেলো।সে অামাকে ক্যাম্পে যেতে নিষেধ করলো।এই নিয়ে অনেকক্ষণ কথা কাটাকাটি হলো অামাদের।
তাকে স্পষ্ট বলে দিলাম অামি ক্যাম্পে যাচ্ছি।কিন্তু স্যার অামি কিছুক্ষণ পর সিদ্ধান্ত নেই ক্যাম্পে যাবো না।
এইদিকে রাজকন্যা যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়েছে অামার সাথে।অামি সিদ্ধান্ত নিলাম রাজকন্যার সাথে দেখা করে অাসবো।সামনাসামনি গিয়ে তার রাগ ভাঙাবো।অামি যে ক্যাম্পে যাচ্ছি না এটা শুনলে হয়তো খুব খুশি হবে অামার রাজকন্যা।
কিন্তু স্যার অামি অামার রাজকন্যাকে হারিয়ে ফেলেছি।ওরা অামার রাজকন্যার কাছে অামাকে যেতে দেয় নি।
গল্পটা এরকম অসম্পূর্ণ রেখেই ছেলেটা চলে গেলো।
চা টাও পুরোটা শেষ করে নি।অামি পেছন থেকে ডাকছি কিন্তু সে শুনছে না।চায়ের দোকানের মামাটা এসে বলছে…
–মামা অাফনে হেরে ডাইকেন না।হের মাথায় সমস্যা অাছে।
–কিন্তু অামার তো ভালোই মনে হলো।
–১ মাস অাগে কারা যেনো হেরে মাইরা ষ্টেশনে ফালায় রাইখা গেছিলো।নাম ঠিকানা কিছু বলতে পারে না।খালি সবাইরে গল্প শুনাইতে চায়।অার সারাক্ষণ রাজকন্যা রাজকন্যা করে।
–অাপনারা কেউ তার গল্প শুনেছেন অাগে??
–কি যে কন মামা পাগলের গল্প কেডায় শুনবো।মাইনষের তো সময়ের দাম অাছে নাকি??
ট্রেন চলে এসেছে।অামি ট্রেনে উঠে পড়লাম।সারা রাস্তা কেবল ছেলেটির কথা ভাবলাম।তখন থেকেই ইচ্ছে ছিলো ছেলেটির গল্প সবাইকে শোনানোর। ভাগ্যক্ রমে সুযোগটাও হয়ে গেলো।
অামি হঠাৎ করে খেয়াল করলাম যে অাইডি থেকে মেসেজ এসেছে সেই অাইডিটার নাম “দুঃখী রাজকন্যা”।
অাপনারা হয়তো অনুমান করছেন এটাই ছেলেটার সেই রাজকন্যা কিনা??
অাসলে অাপনাদের অনুমানের প্রশংসা করতেই হয়।ঠিকই ধরেছেন এটাই সেই রাজকন্যা।
অামি কথা বলে জানতে পারলাম ছেলেটা ৩ মাস যাবৎ নিখোঁজ।ছেলেটির পরিবার অার ছেলেটির রাজকন্যা তন্ন তন্ন করে খুঁজেছে ছেলেটিকে।পায় নি তারা।
রাজকন্যা অামার কাছে ষ্টেশনের নাম জানতে চাইলো।
অামি পরেরদিন রাজকন্যা অার ছেলেটির মা-বাবা কে নিয়ে সেই ষ্টেশনে গেলাম।
খুব করে প্রার্থনা করছিলাম যেনো ছেলেটিকে পেয়ে যাই।২ মাস অাগে দেখা ছেলেটিকে দেখলে হয়তো অামিও চিনতে পারবো।
ষ্টেশনে নামলাম।অনেক খোঁজাখুঁজি করলাম।শুধু ষ্টেশনই না, ষ্টেশন সংলগ্ন সব এলাকায় খুঁজলাম।কিন্তু ছেলেটিকে পেলাম না।হঠাৎ করে সেই চায়ের টংয়ের মামার কাছে ফিরে গেলাম।
উনি বললেন কিছুদিন অাগে লোকজন মিলে ছেলেটিকে পাগলাগারদে দিয়ে এসেছে।
ষ্টেশন ফেলে অামরা ছুটলাম পাগলাগারদে।পেয়ে গেলাম সেখানে ছেলেটিকে।ছেলেটি বাবা-মা কে চিনতে পারলো না।তার রাজকন্যাকেও চিনতে পারলো না।
ছেলেটি অাবার তার রাজকন্যার কাছেই গল্প বলা শুরু করলো।
ছেলেটির নামে থানায় অাগেই নিঁখোজের জিডি করা ছিলো।সেই কাগজপত্র দেখিয়ে বাবা-মা তাকে বাড়িতে নিয়ে গেলো।ছেলেটি যেতে চাইছিলো না।কিন্তু তার রাজকন্যাই তাকে অাশ্বাস দিলো যে তাকে রাজকন্যার কাছে নিয়ে যাবে।ছেলেটি ফিরে যাচ্ছে বাড়িতে।রাজকন্যা অঝোর ধারায় কাঁদছে।ছেলেটি ফুটবলার হতে পারবে না।পারবে না তার বাবা-মায়ের স্বপ্নের মতো ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ার হতে।
রাজকন্যা ভাবছে একদিন ছেলেটি সুস্থ হয়ে যাবে।তার রাজকন্যাকে চিনতে পারবে।
অামিও এই প্রত্যাশায় রয়েছি।মাঝে মাঝেই খোঁজ নেই ছেলেটির।ওহ্ হ্যাঁ….অামার পরিচয়টা তো দেয়া বাকি ছিলো।
থাক।সেটা নাহয় ছেলেটি সুস্থ হয়ে গেলে তখনই দিবো।