ময়নার কোনো রাগ অভিমান কিছুই নেই, প্রতিদিন মায়ের বকাবকি/রাগারাগি এগুলো শুনতে অভ্যস্ত হয়ে গেছে।
মায়ের চোখে ময়না এক বড় অপরাধী। ময়নারই বা কি দোষ ছিল বলুন?
গভির রাতে ঘড়ের দরজার নক করার আওয়াজ পেলাম, আমি দরজা খুলতে সংকোচ করলাম, কারন মা বাড়িতে নেই,
যাওয়ার সময় বলে গেছে রাতে কেউ ডাকলে দরজা খুলবি না, অন্তত তিন ডাকের অপেক্ষা করবি। কারন গ্রামে অনেক ভুতের আনাগেনা থাকে!
শুধু নকের আওয়াজ পেয়ে দরজা খুললাম না, কিছুক্ষন পরে আওয়াজ শুনলাম আপু আমি ময়না বলছি দরজাটা একটু খোলো।
আমি সাথে সাথে দরজা টা খুলে দিলাম! ময়না ভিতরে এসে জোরে চিৎকার দিয়ে বলল, আপু মা কেমন যেনো করছে,
দাত লেগে গেছে, মনে হয় প্রেসার উঠছে।
আমাকে ছুতে ও দিচ্ছে না, বলছে তুই ছুইলে আমার মরা মুখ দেখবি! আপু তুমি একটু চলোনা কিছু একটা কর মায়ের জন্য!
আমি সাথে সাথে দরজা লক করে ওর সাথে চললাম! গিয়ে দেখি বেহাল অবস্থা!
আমি মাথায় পানি দিলাম, ময়নার দিক ও তাকানো যাচ্ছে না, চোখের সামনে মায়ের এমন অবস্থা, নিজে কিছু করতে পারছে না!
কিছুক্ষন পর একটু সুস্থ হলো! আমি চলে আসলাম।ময়নার ব্যাপারে কিছু বললাম না, কারন বহুবার বুঝিয়েছি ওর মাকে,
সে কারো কথায় কান দেয় না, তাই নতুন করে কিছু বলি নাই!
ময়না খাওয়া দাওয়া, ঘুম, গোসল কিছুই ঠিক মতো করে না, ওর মনে শান্তি নেই মা থাকতে ও মা বলে ডাকতে পারছে না।
ময়নার চেহারা দিন দিন ভেঙে যাচ্ছে, শুকিয়ে যাচ্ছে, মুখে কোনো হাসি নেই,
আমি ময়নার মুখে কখনো হাসি দেখি নাই, ১৬ বছরের একটি মেয়ে যে নাকি সবসময় থাকবে হাসিখুশি,
পৃথিবীর রং দেখে সৃষ্টিকর্তার গুনগান গাইবে, কিন্তু ময়না আছে বেঁচে থেকে ও মৃত্যুর মতো!
ময়নার ধীরে ধীরে স্বাস্থের করুন পরিনতি হচ্ছে, মনে হচ্ছে ও মনে হয় কোনো কঠিন রোগের রুগী!
ময়নার এতো কষ্ট আমি আর দেখতে পারছি না, তাই সিদ্ধান্ত নিলাম, ওর মাকে আমি বলবোই আপনি পৃথিবীর সবচেয়ে খারাপ মা!
ময়নাদের ঘরে গেলাম, গিয়ে ওর মাকে বললাম, আন্টি, মানুষ মরনশীল, একদিন তাকে মরতে হবেই, আঙ্কেলের মৃত্যুর পিছনে ময়নার কি হাত?
ওর মা বলল, ও একটা অলক্ষী, ওর জন্মের দিন, আমার বাবা মারা গেছে, আবার ওর জন্যই ওর বাবা মারা গেছে!
আমি বললাম ওর দিক তাকিয়ে দেখছেন, ওর কি হাল হয়েছে?
এর ভিতরেই অন্য রুম থেকে কিছু পড়ার শব্দ আসল, আমি দৌড়ে ওই রুমে গেলাম, গিয়ে দেখি ময়না ফ্লোরে অচেতন অবস্থায় পড়া,
আন্টিকে ২-৩ ডাক দেয়ার পর আসল, একা আমি উঠাতে পারছিলাম না, তাই আন্টিকে বললাম আপনি একটু ধরুন?
অনেকবার বলার পর ধরল, দুজন ধরে খাটে উঠালাম!ডাক্তারকে খবর দিলাম, ডাক্তার এসে জ্ঞান ফিরাতে পারল না,
বলল, হসপিটালে নিয়ে যেতে, আমি আর ওর মা অপেক্ষা না করে নিয়ে গেলাম, ডাক্তার বলল, আপনার মেয়ের পাকিস্থলী শুকিয়ে গেছে,
আরো বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত, মনে হয় তাঁর হাতে সময় নেই, ময়নার মা ময়নাকে ধরে চিংকার করে কান্নাকাটি করতেছে,
আর বলতেছে আমি পৃথিবীর সবচেয়ে খারাপ মা, তোকে মায়ের ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত করেছি, কিছুক্ষন পরে ময়নার জ্ঞান ফিরে বলে,
মা তুমি একটু আমার নাম ধরে ডাক দাও, এ বলেই শেষ নিঃস্বাস ত্যাগ করল….!!
কিছুদিন পর ময়নার মা বালিশের নিচে একটি চিঠি পেল, সেখানে লেখা ছিল, মা ৯বছর বয়সের সময় বাবার কাছে আবদার করেছিলাম।
জন্মদিনের কেক আনতে, সেদিন বৃষ্টির রাত ছিল, তুমি বাবাকে যেতে নিষেধ করছিলে,
কিন্তু আমার কান্নার জন্য বাবা গিয়েছিল, কেক নিয়ে বাবা আর বাড়ি ফিরে আসেনি, আসছিলো বাবার ক্ষত-বিক্ষত লাশ।
আমার জন্মের দিন তোমার বাবা মারা যায়, আমার জন্য তোমার জিবন থেকে দুজন পুরুষ হারিয়ে গেছে,
তোমার কষ্ট আমি সহ্য করতে পারতাম না, তাই প্রভূর কাছে প্রতিনিয়ত দোয়া করতাম আমার যেনো খুব তাড়াতাড়ি তাঁর হাতে মৃত্যু হয়।
বাবার মৃত্যুর পর থেকে তুমি আমার সাথে কথা বলো না, কারন আমি না বললে বাবা যেত না।
মা! বাবাকে হারিয়ে কি আমি কষ্ট পাই নি?
আমি কি নিজেকে দোষী ভাবিনি? তুমি হারিয়েছো তোমার স্বামীকে, আর আমি তো সেদিন থেকে আমার মা- বাবা দুজন কেই হারিয়েছি!
প্রতিটি রাতে ভাবছি, তুমি এসে ঘুম পাড়িয়ে দিবে, আমি না খেয়ে থাকলে, তুমি বলবে, ময়না!
তুই না খাওয়া পর্যন্ত আমি খাব না।ময়না আজ তুই আমার কাছে ঘুমাতে আস!
হয়ত সে আশা পূর্ণ হবেনা। তবুও তুমিই আমার মা, সেরা মা।
আ’ম স্যরি মা, এই পৃথিবীর ভালোবাসা আমার জন্য নয়।
তোমার কাছে আমার শেষ অনুরোধ আমার মৃত্যুর পর তুমি কাঁদবা না!