ভাল থাকিস দোস্ত

ভাল থাকিস দোস্ত

মাঠে একাকী বসে আছি । মেজাজ প্রচন্ড খারাপ ।

ইরার সাথে ব্রেক আপ হয়ে গেছে। কিছুই ভালো লাগছে না। বাস্কেটবল খেলার মুড নেই । তারপরও বন্ধুরা চাপাচাপি করতে লাগলো । উঠে দাড়ালাম। প্রচন্ড রাগে গা কাঁপছে। আমার উচ্চতা ৬ ফুট ২ ইন্চি। আর শরীর দশাসই।

প্রচন্ড আক্রমনাত্মক খেলতে লাগলাম। আমার সাথে ধাক্কা খেয়ে কয়েকজন ছিটকে পরলো। সবাই অবাক ! হটাত্‍ রাজীব এগিয়ে এসে বলল , “কি ব্যাপার শাহরিয়ার কোন সমস্যা ?”

রাজীব কয়েকদিন আগেই এসেছে। এসেই সবাইকে আপন করে নেওয়ার বাহানায় মত্ত।
এই ব্যাটার সব জায়গায় নাক গলানো চাই। রুক্ষ স্বরে জবাব দিলাম “না কোন সমস্যা নাই।” সে তারপরও চাপাচাপি করতে লাগলো । দিলাম একটা ঘুষি ! ব্যাটার নাক ফেটে গেলো । রাজীব ঘাষের উপর বসে গেলো। আর আমি দৌড়ে চলে এলাম।

বেডরুমে শুয়ে আছি। হটাত্‍ আম্মু এসে বলল আমার নাকি কোন বন্ধু আসছে। পাঠিয়ে দিতে বললাম। একটু পর ঘরে ঢুকলো রাজীব। আমি চমকে গেলাম। রাজীবের নাক বেন্ডেজ করা। অদ্ভুত আর হাস্যকর লাগছে তাকে।

খারাপ লাগলো, তার সাথে এভাবে ব্যাবহার করাটা উচিত হয় নি। তাকে কিছু বলার আগেই সে বলল “শাহরিয়ার তোর সাথে আমি কিছু কথা বলতে চাই । কথাগুলো বলেই চলে যাব ।”

আমি মাথা নেড়ে সায় দিলাম ।

রাজীব বলতে শুরু করলো

“এমন একটা পরিবারে আমার জন্ম যেখানে কষ্ট, দারিদ্র্য আর হাহাকারের নিত্য বসবাস। আমার দাদা যখন মারা যান, তখন আমার বাবা মাত্রই অনার্স ফার্স্ট ইয়ারে পড়ে। দাদা মারা যাওয়ার পর বাবারা অনেক গরিব হয়ে যায়। ৭ ভাই বোন আর দাদীকে সামলাতে গিয়ে প্রচন্ড করেন বাবা।

এরই মধ্যে আমার মা কে ঘরের বউ করে আনেন। arrange marrige . . . মা অনেক বড় ঘরের মেয়ে ছিলেন। অথচ এতো কষ্ট দেখে , নিজের সব শখ আহ্লাদ বিসর্জন দিয়ে বাবার সাথে সংসারের হাল ধরেন।”

এতটুকু বলে একটু থামলো রাজীব তারপর আবার বলতে লাগলো ”
অবিশ্বাস্য হলেও সত্য যে আমার দাদী ফুফুরা আম্মার উপর অমানুষিক নির্যাতন করতো ।
এর মধ্যে আমার জন্ম । ছোট থেকেই প্রচন্ড কষ্টে বড় হয়েছি। কি যে কষ্ট। কি যে হাহাকার !

মা প্রতিদিন কাদঁতেন আমার সামনে। প্রতিদিন। আমার বন্ধুবান্ধব কতো কিছু কিনতো , কতো ইচ্ছা করতো। কিন্তু বলতাম না। কারন বললে মা কে দাদী অনেক কথা শোনাবে। ১৬ বছর টানা মা কষ্ট করে গেছেন ।

আর আমি ? আমার শৈশব ধ্বংস হয়ে গেছে। মা এখন প্রচন্ড অসুস্থ। আর বাবাও আর আগের মতো পরিশ্রম করতে পারেন না। এখন চাচা ফুফুরা সবাই যোগ্য। কেউ বাবাকে পাত্তা দেয় না। মায়ের উপর দাদী হাত পর্যন্ত তুলছে। কিন্তু বাবা দাদীকে অনেক সম্মান করতেন। তাই মা মুখ বুজে সব সহ্য করে গেছেন।

কিন্তু আমি অনেক ছোট। আমি এসব সহ্য করতে পারলামনা। আমার মাইগেন এর সমস্যা দেখা দিলো। যখন প্রচন্ড মাথা ব্যাথা করতো তখন নাক মুখ দিয়ে পানির মতো রক্ত পড়তো ।”

এতোটুক শোনার পর খুব অবাক হলাম। নতুন দৃষ্টিতে রাজীবকে দেখলাম। আজকের রাজীব অন্যান্য দিনের চেয়ে সম্পর্ন আলাদা। রাজীবকে সবসময় হাসি ঠাট্টায় মেতে থাকতে দেখি। তার এরকম কিছু থাকতে পারে চিন্তাই করিনি।

আমি বললাম “তারপর ?”

রাজীব আবার বলতে শুরু করলো “আস্তে আস্তে বড় হই। বিখ্যাত একটা স্কুলে এবং তারপর কলেজে ভর্তি হই। কলেজে পড়া অবস্থাতেই আমার সাথে একটা মেয়ের পরিচয় হয়। প্রথমে বন্ধুত্ব তার পর আস্তে আস্তে দেখলাম আমি তার প্রতি অনেক দুর্বল হয়ে গেছি।

কিন্তু তখনই জানতে পারলাম আমার শরীরে একটা কঠিন রোগ বাসা বেধেছে। যেটা অপারেশন করতে হবে । এবং অপারেশন দেশে সম্ভব নয়। অপারেশন এর টাইম লাইন ২ বছর অন্যথায় নিশ্চিত মৃত্যু।

বাবা , মা কে এই কথা জানাইনি। যদি জানাতাম তাহলে তারা মরেই যতো ।

মেয়েটার কাছ থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখলাম। মেয়েটাকে নিয়ে অনিচ্ছা সত্তেও অনেক অপ্রিতিকর কাহিনি ঘটে। সে অনেক কষ্ট পায় ।

একটা সময় আমাকে ঘৃণা করা শুরু করে। যাই হোক। যখন একটা মানুষ জানতে পারে যে তার সামনে মৃত্যু অবধারিত। যখন ঐ মানুষটা তার ভালবাসার মানুষটাকে কাছে পেয়েও ইচ্ছা করে দূরে সরিয়ে দেয়। যখন ঐ মানুষটা প্রচন্ড কষ্ট স্বত্তেও মা বাবাকে কিছু বলতে পারে না।

তখন যে কি পরিমান হতাশা, কি পরিমান কষ্ট হয় তা আমি হাড়ে হাড়ে টের পাইছি। আমার মেজাজ প্রচন্ড খিটখিটে। রাগ উঠলে আমি মানুষ পর্যন্ত খুন করতে পারবো।

অস্টেলিয়া থেকে এক ডাক্তার এসে কিছু ঔষধ আর ইনজেকশন দেয়। প্রচুর দাম। ডাক্তার সাহেব ইউনিসেফের দাতব্য হসপিটাল থেকে সেগুলো ফ্রি দেওয়ার ব্যাবস্থা করেন ।”

আমি স্তব্ধ হয়ে গেছি । রাজীবের মধ্যে এই প্রথম কোন শূন্যতা খুঁজে পেলাম।

রাজীব বলেই চলেছে ”
বাবা মাকে আমি কিছুই দিতে পারিনি। তাদের জন্য কিছু একটা করে যেতে চাই। তারা যেনো আমাকে নিয়ে গর্ব না হোক অন্তত লজ্জ্বা না পান। সবসময় হাসিখুশি থাকার চেষ্টা করি। আমার মতো হতাশাগ্রস্থ ব্যাক্তি দুনিয়াতে অনেক কম। তারপরও যতদিন বেঁচে থাকবো একটু হাসতে চাই ।”

আমার চোখ ছলছল করছে । আর রাজীব শূন্য দৃষ্টিতে চেয়ে আছে দেয়ালের দিকে ।

আমার দিকে ফিরে বলল “আজকে আমরা ঢাকা থেকে চলে যাব। কোথায় যাব এখনো জানি না। বাবা যেখানে নিয়ে যায়, সেখানেই যাব।

তোকে একটা কথা বলি দোস্ত। জীবনটা অনেক সুন্দর রে। অনেক সুন্দর। কখনো এমন কিছু করবি না। যাতে সুন্দর জীবনটা নষ্ট হয়ে যায়। হতাশ হবি না কখনো। মনে রাখবি যাদের কেউ নাই, তাদের আল্লাহ আছেন। ভাল থাকিস।”

কথাটা বলেই উঠে দাড়িয়ে হাটা শুরু করলো রাজীব। বাসা থেকে বের হয়ে গেলো সে। আমি এতোক্ষন রাজীবের কথার ঘোরের মধ্যে ছিলাম। হুশ ফিরতেই আমি দৌড়ে পিছনে গেলাম। কিন্তু ততক্ষনে রাজীব বাসে উঠে গেছে।

আমি অশ্রুসিক্ত চোখে তার গমন পথে চেয়ে আছি । রাজীব বাসের দরজায় দাড়িয়ে আছে । আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসছে । তার ঐ হাসির ছায়ায় লুকিয়ে আছে অনেক বেদনা ।

আস্তে করে জড়ানো কন্ঠে বিড়বিড় শুধু বলতে পারলাম “তুইও ভাল থাকিস দোস্ত ।”

গল্পের বিষয়:
দু:খদায়ক
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত