ঝুম বৃষ্টি নেমেছে চারদিকে বৃষ্টির টুপটাপ শব্দ ছাড়া কিছু শোনা যাচ্ছে না । দূর আকাশ থেকে একটা মিষ্টি কন্ঠে আযানের ধ্বনি ভেষে আসছে ।
বৃষ্টির জল বারান্দা ছুয়ে দিতে চাচ্ছে দমকা বাতাসে কয়েক ফোটা বৃষ্টি আমার মুখের একপাশে পড়েছে ।
অপারেশন থিয়েটারের লাল বাতিটা জ্বলছে , ভিতরে অবনীর অপারেশন চলছে ।
লাল আলো আমার বরাবর অপ্রিয় ছিল কেমন যেন কটকটে একটা রং যার মধ্যে কোন টান নেই কোন মায়া নেই কোন কোমলতা নেই ।
সূর্যের রক্তিম আভা আমাকে মোহিত করত না । বিকেলের গোধুলী আমার মন প্রেম জাগাত না ।
অবনী গোধুলী ভালোবাসতো যখন সুর্য সারাদিন তার আভা ছড়িয়ে অন্ধকার দূর করে বাড়ী ফেরার তোড়ঝোড় শুরু করত,
অবনী ছাদের পশ্চিম পাশটায় গিয়ে দু হাত প্রশারিত করে বলত,
‘তপু শুনতে পাচ্ছে ? গোধুলী আমাকে তার শেষটুকু দিয়ে বলছে আমার ধ্বংসের তুমি শুরু ।
ছড়িয়ে দাও আমার আভা আলোকিত কর অন্ধকারে নিমজ্জিত মানুষ গুলোকে ।’’
আমি অবাক চোখে তাকিয়ে দেখতাম কখনো বা মুচকি হাসতাম । আজ গোধুলী নেই তবে প্রকৃতি অপর মহিমায় বর্ষে যাচ্ছে ।
ডাক্তার রহমান অপারেশন করছেন নামকরা গাইনোলজিস্ট। সবাই বলে ওনার হাতে নাকি যাদু আছে , অবনীর সিজার হচ্ছে ঝুকিপুর্ন অবস্থা ।
যে কোন একজন বাচতে পারে আমি সিদ্ধান্থীনতায় ভুগছি ।
ভিশন কষ্ট হচ্ছে হ্রদস্পন্দন থেমে যেতে চাচ্ছে।
সুমন্ত কে দেখলাম কাক ভেজা হয়ে এসেছে সুমন্ত আমার সহকারী বেশিদুর পড়াশুনা করতে পারেনি ।
তারপর হঠাৎ এক অজানা রোগে আক্রান্ত হয় যার ফলে দৈর্ঘে না বেড়ে প্রস্থে বেড়েছে ।
এই মানুষগুলো সমাজে বড্ড অবহেলিত সবাই কেমন বাকা চোখে দেখে এরা কাজ করতে পারেনা, পড়তে পারেন, স্বাধীনভাবে চলতে পারেনা ।
শুধু এরাই না সমাজে কয়েক শ্রেনীর মানুষ আছে যারা সমাজের ময়লা বলে অভিহিত উচুশ্রেনী এদের মানুষ বলে মানেনা তার মধ্যে রিক্সাওয়ালা,
গায়ের রঙ বিশ্রি, ভিখারি , কাজের লোক , বেটে লোক ।
আমি হাপিয়ে যাই ভাবতে গেলে যখন দেখি এক সৃষ্টিকর্তার সৃষ্টি হয়ে নিজদের মধ্যে ভিন্নতার দেয়াল তুলে দেয় ।
অথচ চাইলে এরাও স্বপ্ন দেখতে পারত ।
এই মানুষগুলো কাজে বড্ড মনযোগী আমার এক ভয়ংকর অতীত আছে তাই এই মানুষ গুলোকে আমি অবহেলা করিনা বড্ড ভালোবাসি।
এদের আগলে রাখার চেষ্টা করি ঠিক যেমন একটা মা মুরগী তাদের ছানাদের ঢেকে রাখে ।
সুমন্ত একটা সার্কাসে কাজ করত মাসে যা পেত তা দিয়ে পেট ভরত না..,
তারউপর সার্কাসে যদি কোন ভুল করে ওস্তাদ নামক ব্যাক্তিটার বিদঘুটে সব শাস্তি আছে ।
সার্কাস দেখা শেষে যখন বেরিয়ে আসছিলাম তখন প্রথম সুমন্ত কে দেখি কিছু টাকা বেশি চাওয়ায় ওস্তাদ লাথি মারছে আর সেখান থেকে বেরিয়ে যেতে বলছে কাছে ডেকে নিয়ে যখন জিজ্ঞাসা করলাম কত সুন্দর বচনভঙ্গী ।
অথচ এই মানুষটাই একটু আগে ওস্তাদ নামক ব্যাক্তিটার লাথি খাচ্ছিল ।
সুমন্তের কেউ নেই এক বন্যায় নাকি সব ভেসে গেছে । সেদিন যখন বলেছিলাম আমার বাড়ি যাবি?
বেশিকিছু দিতে পারব না তোকে একটা বোন, তিনবেলা খাবার আর একটু সুখের দিশা বিনিময়ে শুধু তোর বোনের ভাই হয়ে যাবি পারবি না?
– পারব স্যার ।
সেদিন বেশ খানিক টা অবাক হয়েছিলাম , আসলে এই মানুষগুলো বেশিকিছু চায়না শ বিন্দু পরিমান ভালোবাসা আর মাথাগোজার আশ্রয়টুকু ।
সুমন্ত অবনীকে বোন বলে ডাকে ঠিক নিজের বোন যেমন হয় তেমন ।
সন্ধ্যে হলেই লাঠি হাতে সুমন্তকে পড়াতে বসে যায় অবনী । অ তে অজগর ; আ তে আম ; সুমন্ত সব শিখে গেছে ।
মাঝে মাঝে দু একটা ইংরেজি বলে ।
সুমন্ত কে কখনো বলতে শুনিনি যে আমার এটা লাগবে ওটা চাই উল্টো সব সময় আমাদের কিভাবে খেয়াল রাখা যায় তা নিয়ে ভেবেছে ।
*
অবনী ঘুমিয়ে আছে বড্ড পবিত্র লাগছে । বিন্দু বিন্দু ঘামের রেখা ফুটে উঠেছে তার মুখে হয়ত কিছুটা শংকা নয়ত অজানা কোন ভয় ।
পাশে সদ্য ভুমিষ্ঠ হওয়া এক বাচ্চাকে শুইয়ে রেখেছে, অপার শান্তিতে ঘুমিয়ে আছে। অবনীর বড্ড শখ ছিল মেয়ে বাচ্চার তার শখ পুরন হয়েছে।
সুমন্ত মুখ চেপে নিশব্দে কাদছে নোনা জলের ফোয়ারা বইছে তার চোখে থেকে ।
মেয়েটা তার মায়ের মত হয়েছে চোখ গুলো বন্ধ করে আছে হয়ত বড্ড অভিমান করেছ্ হৃদস্পন্দন থেমে গেছে ।
অপারেশন থিয়েটার থেকে ডাক্তার মলিন মুখে বলল
-দুঃখিত মিঃ তপু , আপনার মেয়েকে বাচাতে পারলামনা ।
মনে হল আমার কলিজাতে একটা তির বিধলো যেটা এফোঁড় ওফোঁড় করে দিয়ে চলে গেছে ।
আমি রক্তাক্ত কিন্তু কেউ দেখছেনা আমার আত্মচিৎকার কেউ শুনছে না।
আমি কাদতেছি কিন্তু চোখ থেকে জ্বল গড়াচ্ছে না । অবনীকে কি জবাব দিবো? যে আমাকে বিশ্বাস করে এতটা পথ এসেছে ।
যে আমার উপর ভরসা রেখেছে । চোখ খুলে যদি দেখে আমি তার বিশ্বাসের যোগ্য না । তার ভরসার মুল্য দিতে পারিনি । কি জবাব দিবো?
সুমন্ত পাশে দাঁড়িয়েছে খেয়াল করিনি বেচারা কাদতে কাদতে চোখ লাল করে ফেলেছে ।
-ভাই আশ্রমে আজকে একটা একদিন বয়সের বাচ্চা এসেছে পাড়ার গলির মোড়ের ডাস্টবিনটায় ফেলে দিয়ে গিয়েছিল কে জানি ।
ভাই ঐ বাচ্চাটাও মেয়ে । ঐ মেয়টাকে আপার মেয়ে বানিয়ে দেন না ভাই । জানেন মেয়েটা অনেক সুন্দর ফুটফুটে ।
*
অবনী মেয়েকে পেয়ে বড্ড খুশি চুমোয় চুমোয় ভরিয়ে দিচ্ছে এ অবস্থায় যে কতবার উঠে বসতে চেয়েছে । নাম ও ঠিক করে ফেলেছে “প্রাপ্তি” ।
সুমন্ত আর কাদছে না হয়ত তার বোনের হাসি বিলিন হওয়ার ভয়ে । সুমন্তের চোখে অজানা ভয় হয়ত বেঈমানি ।
এটাকে কি আদৌ বেঈমানি বলে? আমরা কি স্বার্থপরের মত কাজ করলাম?
অনেক প্রশ্ন আমাকে থামিয়ে দিচ্ছে, বলছে ‘ ঠিক করেছিস তুই তোর সত্তাকে বাচিয়ে রেখেছিস একজন মায়ের মুখে হাসি ফুটিয়েছিস তুই নির্দোষ ’’
আমরা ভাবনা থেমে গেছে, সুমন্ত আর অবনী প্রাপ্তি কে সামলাতে ব্যাস্ত ।
প্রাপ্তি আমাকে আমার অতীতের সামনে দাড় করিয়েছে।
আমার ঘৃনিত সেই অতীত যাকে আমি তালাবন্দী করে রেখেছিলাম যার ভয়ে আমি মুখ লুকিয়ে রেখেছিলাম ।
যে অতীত আমাকে সমাজে স্বীকৃতি পেতে দেয়নি । যে আমার পিতা হিসেবে নাম না লেখানোর জন্য আমাকে ফেলে দিয়েছছিল ।
আমিও কারো কয়েক মিনিটের সুখের পরিনতি ছিলাম । কারো অবৈধ একখন্ড ভালোবাসার ফল ছিলাম যাকে সুশীল সমাজ জারজ বলে জানে ।
যার কোন পরিচয় থাকেনা যার মা নিজের সন্তান কে সবার সামনে তুলে ধরতে ভয় পায় আমি ছিলাম সে মায়ের সন্তান ।
হয়ত কোন কাল রাত্রিতে আমার মা আমাকে পৃথিবীতে এনেছিল আবার রাতের আধারেই আমাকে তার জীবন থেকে মুছে দিয়েছে ।
হয়ত ভয় পেয়েছিল যদি তার জীবনে অন্ধকার করে দিতাম বলে ।
অথবা কোন কাল সন্ধ্যে ,সারা পৃথিবী যখন নিকশ কালো অন্ধকারে ঢাকতে শুরু করেছে আমি আমার জন্মদাত্রীর কোল আলো করতে পারিনি বলে ।
আমাকে শক্ত একটা পলিথিনে মুড়ে পচা বাসি নোংরার সাথে ফেলে দিয়েছে অথচ আমি ছিলাম তাজা পবিত্র যার শরীর পবিত্রতা দিয়ে ঘেরা ছিল ।
পলিথিনে মোড়ানো অবস্থায় পেটের খিদায় যখন কান্না জুড়ে দিয়েছিলাম সুশীল সমাজ,
তখন আমাকে দেখে একদলা থুথু ফেলে মুখ ঢেকে পাশ কাটিয়ে চলে গেছিল ।
কেউ হয়ত বলেছে , ‘কে ফেলল এই নোংরাটা ’ ।
অথচ আজ তারা জনদরদী সমাজের মাথা , সমাজের উন্নয়নকারী ।
এরা বস্ত্রহীন দের বস্ত্রদান করে শীত শেষে দেড়শত টাকার কম্বল দিয়ে দেড়কোটি টাকার জনপ্রিয়তা পায় ।
যারা নির্বাচনের ভাষনে শুরু করেন , ‘ভাইয়েরা আমি এত কোটি টাকার শীতবস্ত্র দান করেছি’’। তবুও দিনশেষে এরাই সমাজের সেবক ।
সুশীল সমাজ যাকে নিচু শ্রেনী যাদের মানুষ বলে মানেনা দশ টাকা বেশি চাইলে যাদের গায়ে হাত উঠায়।
যাকে দশ কিলো টানানে বলেন দেড় কিলো আসলি মাত্র ,
সেই অমানুষ টার মনে কেন জানি আমাকে দেখে মায়া হয়েছিল তিনি আমাকে কোলে তুলে নিয়ে চুমোয় ভরে দিয়েছিল ।
হয়ত সেই মানুষটার কাছে আমি পবিত্র ছিলাম তাই হয়তো আমাকে নোংরা ভাবেনি ।
আমাকে দেখে যেন তার অন্ধকার আকাশে আলো এসেছিল নিকশ কালো আধার ভোরের মৃদ্যু আলোয় কেটে গেছিলো ।
আমার মুখের কাছে এনে বলেছিল ‘আমার বাপ হবি’
তিনি আমাকে ফুটপাত থেকে কেনা প্রিন্টের কমদামি একটা শাড়ী পরা মহিলার হাতে তুলে দিয়েছিল ।
– জমিলা নে আইজ থাইকা এইটা তোর ছাওয়াল ।
-হ এইটা আমার ছাওয়াল আমি কাউরে ছুইতে দিমুনা ।
দিনশেষে যখন সেই নিচু শ্রেনীর মানুষটা রিক্সা চালিয়ে শরীরে নোনতা একটা বিদ্ঘুটে গন্ধ নিয়ে বাড়িতে আসে কমদামী নোংরা কাপড় পরিহিতা মহিলা টা আমাকে বড্ড যত্ন করে মানুষটার হাতে তুলে দেয় আমাকে দেখে তার সারাদিনের ক্লান্তি গ্লানি কষ্ট যেন ধুলিষ্যাৎ হয় ।
আমাকে কোলে নিয়ে বলে
– আমার বাপ একদিন মেলা বড় হইবে মেলা নাম ডাক হবে তুই দেখে নিস জমিলা ।
– হ এইডা তো খালি আম্নের একার বাপ আমার আর বাপ আছে ?
– আহা! জমিলা মন খারাপ করস ক্যা? এইডা তোর আর আমার দুইজনাগো পোলা বুঝছস?
– হয় বুঝছি অহন যান হাত মুখ ধুইয়া আহেন ভাত বাড়ি আমি
।
সৃষ্টীকর্তা হয়ত সবার কপালে সব রাখেনা । প্রিন্টের শাড়ি পরা মহিলাটার একদিন রক্তবমি শুরু হয় দলা দলা রক্ত মুখ থেকে বেরিয়ে আসছিলো ।
গলা কাটা মুরগিদের মত হাত ছুড়ছিল ঠিক যেন কেউ তার কলিজাটা টেনে বের করছিল ।
শেষ নিশ্বাঃস ত্যাগ করার পুর্বেও আমার কাছে আসার জন্য হাতড়াচ্ছিল তবুও আমাকে শেষবার ছুয়ে দেখতে পারেনি ।
সারাদিনের ক্লান্তি শেষে যখন গামছাটা দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে জমিলা বলে ডাকছিল সাড়া না পেয়ে ঘরে ঢুকে যখন রক্তের ছড়াছড়ি দেখে লোকটা সেদিন অনেক কেদেছিল হাত দুটো শুন্যে তুলে আছড়ে আছড়ে কেদেছিলো । পাগলের মত বিলাপ করছিল কেউ শোনার ছিলনা সেই প্রলাপ ।
কেউ দেখেনি আমাকে জড়িয়ে তার কান্না ।
আমার জায়গা আর হয়নি সেখানে । একটা অনাথ আশ্রমে রেখে এসেছিল ।
এরপর ওনাকে আর দেখা যায়নি । প্রথম প্রথম দু একদিন দেখতে আসলেও পরে আর আসেনি উনি । আশ্রমের ম্যানেজার কিছু জানেনা ।
লোকটার ঠিকানায় গিয়ে একটা পলিথিনে মোড়ানো শুন্য ঘর ছাড়া কিচ্ছু পাওয়া যায়নি ।
আশেপাশের লোক বলছিল তিনি হঠাৎ একদিন রাতে উধাও হয়েছিলেন সব পড়েছিল ঘরে একটু বদলায়নি একটা পুরোন আমলের ট্রাংক দুটো থালা একটা সিলভারের জগ আর একটা পানি খাওয়ার মগ । হাতল ছাড়া চেয়ার, চৌকির এক পাশ ভেংগে গিয়েছিল ঠেস দিয়ে রেখেছিল ।
ধুধু করছে চারপাশে , মাকড়শার ঝাল জড়িয়ে গেছে ।
শুধু সেই নিচু শ্রেনীর মানুষটার অভাব ।
ময়লা কাপড় পরিহিত মহিলাটার বড্ড অভাব যে আমাকে পরম মমতায় জড়িয়ে রাখতো যার কাছে আমি ছিলাম পবিত্র ।
*
দিন যাচ্ছে প্রাপ্তি বড় হচ্ছে ধীরে ধীরে হাটতেও শিখে যাচ্ছে কখনো বা পড়ে গিয়ে কান্না জুড়ে দিচ্ছে।
আর অবনী রান্নাঘর থেকে খুন্তি হাতে চলে আসছে মেয়েকে তুলতে এ যেন সৃষ্টিকর্তার এক অপর মহিমা ।
যেখানে মেয়ের একটু আঘাতে মায়ের সারা শরীরে ব্যাথার সৃষ্টী হয় । একটু আড়াল হলেই মেয়েকে খুজতে শুরু করে দেয় ।
যে ভালোবাসার তুলনা শুধু মায়ের সাথেই যায় অন্য কারো সাথে না ।
অবনী আজো সত্যটা জানেনা আশ্রমের ম্যানেজার , আমি সুমন্ত আর অপারেশন থিয়টারে থাকা কয়েকজন ব্যাক্তি গুলোর মাঝে বিদ্যমান ।
আমি জানি এই সত্যটা কখনো বের হবেনা দরকার কি? যে সত্য আরেকজনের চোখে জল আনবে।
অবনীর পুরো নাম ‘‘অবনীতা চৌধুরী’’ অবনীর সাথে পরিচয় কাকতালীয় ভাবে ।
ভার্সিটির ৩য় বর্ষে থাকাকালিন আমরা কয়েকজন মিলে একটা পথশিশুদের সংগঠন চালাতাম ।
ক্যাম্পাস থেকে চাঁদা তুলে সেই টাকা দিয়ে তাদের জন্য খাবার আর বই কিনতাম ।
অবনীর কাছে যখন টাকা চাইতে গেছিলাম অবনী বলেছিল , “সব খরচ যদি একাই দেই আমাকে আপনাদের সাথে নিবেন ?’’
আমি বেশখানিকটা অবাক হয়ে গেছিলাম ।ঠিক যেমন কারো সামনে সোনার কলস উন্মুক্ত কর ধরলে অবাক হয় সেরকম ।
আমি ঢোক গিলে বলেছিলাম ‘হ্যা নিব’ এরপর থেকে রোজ ক্লাস শেষে আমাদের সাথে আসতো পড়াতো খেলতো কখনো বা চকলেট এনে দিত ।
এটা যেন রোজকার রুটিন হয়ে দাড়িয়েছিল ।
আমি অবনী সম্পর্কে খুব একটা জানতাম না শুধু জানতাম মেয়েটার বাবা অনেক বিত্তশালী ।
মেয়েটা অনেক কথা বলত , আমাকে আমার এক শিক্ষক বলেছিল শোন তপু যাদের বেশি কথা বলতে দেখবা তাদের বাচাল বলবে না কারন জানো ?
আমি মাথা এপাশ ওপাশ করে না বলেছিলাম ।
-এই মানুষ গুলো অনেক দুঃখী হয় আর সেটা তাদের কথার মাধ্যমে লুকাতে চায় দেখোনা ?
যার জীবনে দুঃখ ছাড়া কিছু পায়নি সে সবচেয়ে বড় কমেডিয়ান হয় ।
– জি স্যার ।
অবনী হাটতে বেশ ভালোবাসতো ক্লাস শেষ করে রেললাইন ধরে হাটতাম । মাঝপথেন কোন এক টং দোকানে থেমে চা খেয়ে আবার হাটতে থাকতাম ।
অবনী মাঝে মাঝে কিছু অদ্ভুদ কথা বলত ।
– তপু? রেললাইন কেন সোজা? ইশ! মানুষের জীবন টা যদি এরকম সোজা আর সরল হতো প্রত্যেক টা মানুষ যদি রেললাইনের মত সোজা আর সমান্তরাল হতো ।
তাহলে সমাজে আজ কোন ভেদাভেদ থাকতো না বল?
-হুম ঠিক বলেছিস ।
-আচ্ছা তোর কখনো দিগন্ত ছুতে ইচ্ছে করে?
বৃষ্টিতে খালি পায়ে হাটতে কিংবা জোৎস্না রাতে শুন্য শহরের একলা পথিক হতে ? আমার না বড্ড ইচ্ছে করে ।
ডানপিঠে শহর টাও যেন আমাদের সে সুযোগ করে দিয়েছিল ।
হঠাৎ রিমঝিমিয়ে বৃষ্টি নামতো অবনী আমার হাত টেনে রাস্তায় নেমে পড়ত তকাকভেজা হয়ে যখন ঠান্ডায় কাপতাম ,
অবনী পরম মমতা নিয়ে ওড়না দিয়ে আমার মাথা মুছে দিত ।
কিংবা মাঝরাতে ফোন দিয়ে বলত চল চা খেতে যাই ।
প্রত্যেকটা পথশিশু আজ নতুন ভাবে সেজেছে অবনী নিজ হাতে সাজিয়েছে সবাইকে । নোংরা শরীরে একেকজন যেন ঠিক রাজকন্যা ।
দিনশেষে যখন অবনী আর আমি ফিরছিলাম হাসিমাখা মুখটাতে হঠাৎ যেন শ্রাবনের মেঘ জমা হয়েছিল ।
– আচ্ছা তপু মায়েদের কোন শ্রেনী বিভাগ হয়? মা তো শুধুই মা হয় না ? বল । তাহলে সমাজ কেন আলাদা করে মায়েদের ।
আমি তো আমার মাকে কখনো সৎ মা ডাকিনি । তাহলে সমাজ কেন বলে ওটা তোর সৎ মা ? মা কেন আমাকে বলে তুই ফকিন্নির মেয়ে ।
জানিস? মা আমাকে কখনো তার হাতে খাইয়ে দেয়নি । মা সবসময় অফিস পার্টি নিয়ে ব্যাস্ত থাকে ,
আমি কিছু বলতে গেলেই বলে তোমার একাউন্টে টাকা ট্রান্সফার করে দিয়েছি যা লাগবে নিয়ে নিও ।
আচ্ছা তুই বল টাকা দিয়ে কি মায়ের আদর কেনা যায়? আমি চলে এসেছি আর বাড়ি ফিরবো না । আমাকে তোর কাছে রেখে দিবি?
আমি সব বলে দিয়েছিলাম । তারপরো মেয়েটা সেদিন আমার বারণ শোনেনি । উল্টো আমাকে বলেছিল!
– বাড়ী গাড়ী সম্পত্তি এসব থেকে কি হবে বল? যদি ভালোবাসাটাই না থাকে ।
মাছ মাংস থাকার চেয়ে যদি ভালোবেসে তুই আমাকে ডালভাত মেখে খাইয়ে দিস তা আমার কাছে অমৃত্যর স্বাদ যোগাবে ।
আচ্ছা মধ্যবিত্তদের কখনো ছাড়াছাড়ি হতে দেখেছিস?
তারা জানে কিভাবে ভালোবাসতে হয় কিভাবে একটা পরিবার এর মানুষগুলোকে ভালোবাসতে হয় ।
মায়ের ছোট্ট এক টুকরো জমি আছে ছোট বেলায় নাকি মা আমাকে ওটা দিয়ে গিয়েছিল শহর থেকে একটূ দূরে ছোট্ট একটা টিনশেড বাড়ী আছে ।
আমার একাউন্টে কিছু টাকা আছে ততদিনে তুই ছোট খাট জব পেয়ে যাবি ।
আমরা ভালো থাকব আর আমার পরিবার আমাকে কখনো খুজবে না ।
কারন তারা আমাকে উটকো ঝামেলা ভাবতো সেটা চলে যাওয়াতে তারা খুশিই হবে । তুই যদি আমাকে ফিরিয়ে দিস ।
আমাকে আর কখনো দেখতে পাবিনা আমি বিলিন হবো, হারিয়ে যাবো অজানায়, নিশ্চিন্ন হবো ।
বেশি ভাবিনি ওর কথায় সায় দিয়েছিলাম ছোট্ট একটা সংসার বেধেছিলাম । বাড়ির সামনে একটা ফুলেরবাগান করেছিলাম।
রাতে পুরো বাড়ি সুবাসিত করে দিত, ফুলের গন্ধে ম ম করত চারপাশ । কখনো বা বেলির মালা দেখতাম অবনীর খোপায় ।
আমরা সুখেই ছিলাম ঠিক যেন রাজ্যবিহিন রাজকুমার আর রাজকন্যা ।
রাজ্যহীন হলেও আমাদের একটা রাজপ্রাসাদ ছিল , যার ভিত্তি দেয়া সুখ নামক বস্তু দিয়ে ।
আমরা সুখী ছিলাম যোগ্যতা অনুযায়ী একটা চাকুরি পেয়ে যাই বিনিময়ে আমাকে কোন মুল্য দিতে হয়নি হয়ত আজো কোন ভালো মানুষ আছে তাই ।
আমার অফিসের বস বেশ রসিক কিন্তু বেচারা বাড়িতে একটুও সুখ পেত না বউ নামক প্রানীটার জন্য ।
উনি প্রায় দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলত বুঝলা তপু?
-বউ হচ্ছে এমন একটা প্রানী যার সামনে গেলে গুতো আর পিছনে গেলে লাথি খেতে হয় ।
-কেন স্যার?
-তোমাকে কতবার বলব? যে আমাকে স্যার না ভাই বলে ডাকবা । কেন বলছ? তুমি বিয়ে করোনি? ধরো অফিসে ব্যাস্ত আছ ।
বউ বলবে মেয়ে কলিগ নিয়ে ব্যাস্ত না?
তারপর কেনাকাটা করতে যাবা বাহাত্তুর হাজার দোকান ঘুরিয়ে প্রথম দোকান থেকে কাপড় কিনে বলবে হয়ে গেছে ।
তার আগে বাথরুমে ঢুকতে পারবা না , তাকে সবকিছু আগে দিতে হবে তোমার জামা নষ্ট হলেও সমস্যা নাই ।
জীবন ত্যানা ত্যানা রে ভাই । তোমার কি অবস্থা?
– স্যার বেশ ভালোই চলছে ।
-ধুর মিয়া যাও তো ।
*
দ্বিতল একটা ভবন বট গাছের শীতল হাওয়া বইছে , বৃষ্টির ছোয়া রেখে দিয়েছে দেয়ালগুলো কেমন যেন শ্যাতশ্যতে হয়ে গেছে ।
সাইনবোর্ডটাও নুইয়ে পড়েছে কিন্তু নাম টা আজো জ্বল জ্বল করছে , ‘‘মা অনাথ আশ্রম” বারান্দার রশিতে কাপড় ঝুলছে ।
কয়েকটা বাচ্চা ফুটবল নিয়ে মেতেছে । রফিক চাচা-করিম চাচা দাবা খেলছে ।
রফিক চাচা অংকে বেশ ভালোছিল । সেখান থেকেই তার দাবাতে আগ্রহ । তিনি বেশ কয়েকবার চ্যাম্পিয়ন ও হয়েছেন ।
করিম চাচা বেশি পড়াশুনো করেনি একটা দারোয়ান এর চাকুরি করত রাতে নাকি কোন আমলারা জিনিস সরাচ্ছিল তাতে বাধা দেয়াতে চাচাকে চাকুরিচ্যুত করেছে ,
আমাকে দেখে বলেছিল
– বাবা কিছু খেতে দিবি? কয়েকদিন খাইনি ।
– হ্যা চাচা চলেন আমার বাসায় ।
চাচা সেদিন অবাক হয়েছিল যখন শুনেছিল তাকে বাসায় নিয়ে যাবো কারন আমার পোশাক দেখে ভেবেছিল আমি কোন উচু শ্রেনীর মুখোশধারী মানুষ ।
অবনী সব সময় এগুলোর আশায় বসে থাকতো ।
কাউকে খাওয়াতে পারলে সে যেন অনেক সুখী হত ঠিক হারিয়ে ফেলা বাচ্চাকে তার মায়ের কাছে ফিরিয়ে দিলে মা যতটা খুশি হয় ।
যে গুটি কয়েকজন মানুষ আছে এদের প্রত্যেকের এরকম একটা গল্প আছে কেউ বা কাগজ কুড়িয়ে একটা পাউরুটি কলা আর ট্যাপের পানি খেয়ে সারাদিন পার করে দিত ।
যে আশ্রমে আমি একদিন মানুষ হয়েছি , যে আশ্রম এর জন্য আমি আজ এ জায়গায় ,সেখান থেকে ঘুরে আজ আমি সেই আশ্রমের পরিচালক ।
আমার বেতন আর অবনীর কিছু টাকা দিয়ে সমাজের নিচু শ্রেনীর নোংরা আর অবহেলিত মানুষগুলোর দিন চলে যায় ।
মানুষগুলোর বেশি চাওয়া থাকেনা দুবেলা পেঠ পুরে খাওয়া আর থাকার জন্য একটা নিরাপদ আশ্রয় ।
আমার আর অবনীর এই মানুষগুলো ছাড়া কোন পিছুটান নেই যে মানুষটা আমাকে জন্মের পর লোকলজ্জার ভয়ে পলিথিনে মুড়ে আমাকে ফেলে দিয়েছিল আজ তাকে ধন্যবাদ দিতে ইচ্ছে করছে । তার জন্য হয়ত আজ একটা বাবা-মা না আমাদের অনেকগুলো বাবা-মা ।
যাদের ছুড়ে ফেলা হয়েছিল রাস্তায় ঠিক যখন তারা ঝামেলা হয়ে দাড়িয়েছিল ।
আমি এদের তুলে এনেছি এরা আমার কাছে অমুল্য এরা আমার বাবা-মা ।
অবনীও যেন তার মা কি ফিরে পেয়েছে মাঝে মাঝে রান্না করে নিয়ে চলে আসে খাইয়ে দাইয়ে সারাদিন কাটিয়ে বাসায় ফেরে ।
*
প্রাপ্তি বড় হয় স্কুল কলেজের গন্ডি পেরিয়ে মেডিকেলে সুযোগ পেয়ে নাম করা ডাক্তারদের মধ্যে একজন ।
প্রাপ্তি তার মায়ের মত হয়েছে দায়িত্বশীল বুদ্ধিমতী আর শান্ত ।
ও নিজস্ব একটা হাসপাতাল খুলেছে যেখানে শুধু সমাজের সুবিধাবঞ্চিত লোকগুলোর চিকিৎসা হয় ।
যাদের চিকিৎসা করা পয়সা নেই যাদের শরীরে পচন ধরলেও ফিরে তাকায় না তাদের চিকিৎসা করে থাকে আমার মেয়ে ।
ঘাড়ে একটা টেথোস্কোপ, আর শরীরে সেই পবিত্র পোশাক যাকে সৃষ্টিকর্তার পরে বিবেচনা করা হয় ।
আজও বৃষ্টি নেমেছে অঝোর ধারায় সাতাশ সমান এক যুবক হাত মুখে গুজে বসে আছে,
অপারেশন থিয়েটারের লাল কটকটে লাইটটা বেশ উজ্জল লাগছে ।
অপারেশন হচ্ছে একটা নতুন মুখকে পৃথিবীতে আনার যুদ্ধ ।
লাইট নিভে যায় প্রাপ্তি হাসিমুখে বেরহয় “ অভিন্দন আপনার মেয়ে হয়েছে”
প্রাপ্তির কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম আমার দিকে তাকিয়ে হাসিটা প্রসারিত করে বলল….
-বাবা আপনি বসেন আমি আসছি ।
রাতে যখন প্রাপ্তির ডিউটি থাকে আমাকে আসতে হয় তাকে নেওয়ার জন্য । একহাতে ছাতা একপাশে আমার মেয়ে আর তার পাশে আমি ।
-বাবা আপনার কষ্ট হয়না আসতে ?
– মায়ের জন্য আবার ছেলের কিসের কষ্ট বলেন?
-ওহ তাই না?
ছাতা টা প্রাপ্তি মুড়িয়ে নিয়েছে বাব-মেয়ে ভিজছি ।
রাস্তার ল্যাম্পপোষ্ট গুলো দাড়িয়ে দেখছে ডানপিঠে শহর টা হয়ত বাকা একটা হাসি দিয়ে বলছে যাদের জন্মের ঠিক নেই তাদের আবার এত আদিখ্যেতা যত ঢং ।
বৃষ্টি আমাদের গ্লানি মুছে দিচ্ছে ।
কে বলেছে আমরা জারজ?
আমাদের বাবা-মা আছে একটা না কয়েকটা ।
প্রাপ্তি ডানা মেলা পাখিদের মত হাত প্রসারিত করে বলছে, ”আমি সমাজের ধার ধারিনা আমার বাবা আমার সমাজ আমার পৃথিবী আমার কল্যান”
হলদেটে আলোয় আমাদের অস্তিত্ব এক সময় হয়ত মিলিয়ে যাবে, বাকা সমাজ পিছনে মুখ ঘুরিয়ে বলবে “জারজ”