কালো মেয়ে

কালো মেয়ে

মেয়েটা কালো তবুও হাসুম…!!

বিয়ের আগে ওকে দেখিনি। শুধু শুনেছি মেয়েটা শ্যামলা দেখতে। বাঙালী মেয়েদের রূপ অন্যান্য মেয়েদের তুলনায় আলাদা। তারা সুন্দর হলেও শ্যামলা, আবার কালো হলেও শ্যামলা। আমি জানি না আমার হবু স্ত্রী এ দুটার মধ্যে কোন পাল্লায় আছে।
..
যাইহোক, বাসর রাতে ওকে দেখলাম। প্রতিবেশিদের যত কানাঘুষা শুনেছি মেয়েটা দেখতে তত খারাপ না। ওদের কাজই এরকম। কারো ভালো কিছু সহ্য করতে পারে না। ওদের কোন কথায় কান দিলাম না।
..
বাসরের নিভু নিভু জোনাক আলোতে ওর মুখটা অনেক সুন্দর লাগছিল। ও খেয়াল করছিল আমি ওর দিকে অনেক্ষন তাকিয়ে আছি। সে একটু ভিত গলায় আমাকে জিজ্ঞেস করলো এভাবে কি দেখছেন! আমাকে ছবিতে দেখেন নি?
আমি জানতাম না কোন ছবির কথা। কেউ আমাকে বলেনি মেয়ের বাড়ি থেকে ছবি এসেছে। আমি ওকে বললাম আমি তোমাকে না দেখে বিয়ে করেছি। তোমাকে আমার বাবা পছন্দ করেছেন।
সে বললো বাবা যদি না করতেন তাহলে করতেন না? আমি না বললাম। মেয়েটা তখন আর কিছুই বললো না। চুপ-চাপ থেকে গেল। আমিও ওর সাড়া-শব্দ না শুনে ঘুমিয়ে পড়লাম।
..
সকালে ঘুম থেকে উঠে লঙ্কা-কান্ড হয়ে গেল। জীবনেও কল্পনা করিনি আমার সকালটা এরকম হবে। সোফায় বসে ছিল সে। মেয়েটা গতকাল রাতের অপ্সরী ছিল না বরং অপ্সরী ন্যায় কোন ভূত ছিল। আমি লাফ দিয়ে বিছানা থেকে উঠি। সে আমাকে সালাম দিল। আমি কোন জবাব না দিয়ে আম্মুর রুমে গেলাম। আম্মু আমাকে রাগান্বিত দেখে বললেন কি হয়েছে বাবা! এই সাতসকাল বেলায় এরকম মুখ বানিয়েছিস কেন?
আমি টাস করে দরজায় লাথি দিয়ে বললাম তোমরা আমার জীবনটাকে নিয়ে এভাবে খেলতে পারলে! আমি কি দোষ করেছি যে আমার এরকম মেয়ে জুটালে!! কেন!!???
..
আমার হাইস্পিড আর হাইলোডের কথায় রুমে প্রতিধ্বনি ভাসতে লাগলো। আম্মু কিছু বলছে না। আমি জোরে জোরে চেঁচাতে লাগলাম। আম্মু শুধু একটাই কথা বললেন, তোর বাবা সব জানে। এটা শুনে থমকে গেলাম। মনটা ভিষন খারাপ হয়ে গেল। মনে হচ্ছিল বাবা আমাকে ইচ্ছে করে তালাবে ফেলে দিয়েছেন।
..
বাবা তো অন্তত আমাকে মেয়েটার ছবির দেখাতে পারতেন। আর মেয়ে দেখতে যাওয়ার সময় কি টিনের চশমা লাগিয়ে গিয়েছেন যে কালো একটা মেয়েকে আমার জন্য পছন্দ করে আসছেন!
..
মেয়েটা কালো নাহ, অনেক কালো। ছোটবেলায় আমার নজর না লাগার জন্য মা কপালে যে টিপ লাগিয়ে দিত ওইটার মত দেখতে কুচকুচে কালো। একে নিয়ে কিভাবে থাকবো!
..
ভাবছি কোথাও বেরোলে পাচে কেউ জিজ্ঞেস করবে না তো এই জঙলিটাকে কোথা থেকে নিয়ে এসেছি! কেউ মজা করার জন্য বলবে না তো মেয়েটা বাড়ির বউ নাকি কাজের মেয়ে!
..
আব্বুর ভুল ডিসিশনের কথা আমি ভাবছি না, আমি ভাবছি এই কালো মেয়েটাকে নিয়ে কিভাবে সংসার করবো! ও কালো হয়েছে, কয়েকদিন দিন পর আমার সন্তানও কালো হবে। সব কালো হবে। উফফফফ!!! নাহ!! এটা আমি মেনে নিতে পারবো নাহ। যা বলার যা শুনার সব কোর্টে। আমি ডিভোর্স চাই।
..
মেয়েটা ততক্ষনে সব জেনে গেছে আমার রেগে যাওয়ার কারনটা কি। সে ফুঁপিয়ে কাঁদতে কাঁদতে রুমে চলে গেল। ওর চেহারাটা দূর আওয়াজটাও আমার কানে বিচ্ছিরি শুনাচ্ছিল।
..
আব্বু ঘরে হৈ চৈ শুনে ভিতরে এলেন। মনে হচ্ছিল বাইরে কোথাও ছিলেন। আমাকে বললেন কি হয়েছে এত আওয়াজ কিসের! আমার মুখ থেকে কোন কথা বের হচ্ছিল না। সারা দুনিয়ার সামনে আমি যা-তা করতে পারি কিন্তু বাবার সামনে কিছুই করতে পারিনা। মুখ ফুটে বলতেও পারছি না কথাটা। হাত মুষ্টিবদ্ধ ছিল। ওইগুলো খুলে একটা লম্বা দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বেরিয়ে গেলাম।
..
আমি ছাদে বসে ভাবছিলাম কেন আমার সাথে এরকমটা হল! আমি কি দেখতে খারাপ যে আমার বউও খারাপ হবে! নাকি আমার টাকা পয়সা কম! আমার তো সবই আছে তাহলে কেন এরকম মেয়ে আমার কপালে জুটলো! মাথা ফেটে বেরিয়ে যাচ্ছে কিন্তু কোন উত্তর পাচ্ছি না। ছাদের রেলিং এর রডে শক্ত করে ধরে আছি। হয়ত রাগ চেপে রাখছি। ইচ্ছে করছিল রডটা চ্যাপ্টা করে দিই। তখন হঠাৎ পিছন থেকে আব্বুর আওয়াজ শুনতে পেলাম। আব্বু ডাকছেন। হাত নরম হয়ে গেল। রড ছেড়ে দিলাম। তাকিয়ে দেখি রড যেভাবে ছিল সেভাবেই আছে। শুধু আমার হাত লাল হয়ে গেছে। আর প্রচন্ড রেগে যাওয়াতে মুখটা গরম লাগছিল।
..
আব্বুর আদেশ মেনে আব্বুর পিছন পিছন উনার রুমে গেলাম। আম্মুর চেহারা দেখে বুঝে গেলাম উনি সব আব্বুকে বলে দিয়েছেন। তারমানে এখন আর নাটক করা যাবে না। যা বলার ক্লিয়ারকাট বলবো। আব্বু নরম স্বরে বললেন,
..
-সকাল বেলা তোমার আচরনের কারনটা জানতে পেরেছি। কেন আমি ওই মেয়ের সাথে বিয়ে দিয়েছি এটাই জানতে চাচ্চো তো!
..
আমি মাথা নিচু করে হ্যাসূচক জবার দিলাম। আব্বু বললেন,
..
-তার আগে আমাকে একটা প্রশ্নের উত্তর দাও। কেন প্রিমাকে এক্সেপ্ট করতে পারছো না! সে কি বিবাহিতা! নাকি সে কি ধর্ষিতা! নাকি দেখতে কালো!!
..
আব্বুর প্রশ্ন শুনে চমকে গেলাম। এমনিতেই সহজ কিছুর উত্তর দিতে পারিনা আর এটা তো………..। আমি বরাবরের মত চুপ থেকে গেলাম। কিছুই বলতে পারলাম নাহ। উনি বললেন, “মেয়েটার গায়ের রঙ না দেখে মনটা দেখতে, মন কে ভালোবাসতে। গায়ের রঙ তো একদিন খসে পড়ে যাবে কিন্তু মন নাহ। তাই, আমি যা বলছি তাই করো। মেয়েটাকে নিয়ে সুখে থাকো। আর আমি তোমার বাবা। কোন বাবা তার ছেলের খারাপ চায় না। যেদিন বাবা হবে সেদিন টের পাবে”।
..
আব্বুর কথা শুনা ছাড়া আর কিছুই করার ছিল নাহ। সব বুঝেছি ভান করে রুমে চলে গেলাম। এসে দেখি সে কাঁদছে। আমার মনে ওর জন্য কোন দয়া জন্মালো নাহ। আর হবেই বা কেন! সে কে! কি হয় আমার! ধোকা খাইয়ে বিয়ে দেয়া হয়েছে!
..
এখন আর এসব বলে লাভ নেই। কয়েকটা দিনের তো ব্যাপার। একটু এডজাস্ট করে চলতে হবে। আমি তাকে বললাম,
..
-তুমি এই বিয়েতে খুশি?
-আপনার কেমন লাগছে?
-বুঝতে পারছো না কেমন লাগছে!
-বুঝি। তবে আপনি যা চাইবেন তা-ই হবে।
-তা তো হবেই। শুধু কয়েকটা দিনের ব্যাপার। এই কয়েকদিন স্বামী-স্ত্রীর মত থেকে যাই, পরে আলাদা হয়ে যাবো।
-আলাদা বলতে?
-ডিভোর্স!
..
কথাটা যেন ওর কানে তীরের মত বিধলো। এক কান দিয়ে ঢুকে অন্য কানে বের হল। যতক্ষন কথা বললাম এই এতটুকু সময় ছিলল যে তার চোখে জল ছিল না। এখন আমার কথা শুনে আবার! আমি ওসব সহ্য করতে পারিনা। প্রচন্ড রেগে যাই। মারা-মারিও তো করা সম্ভব নাহ। কোনরকম রাগ চেপে ধরলাম।
..
বিয়ের দু-মাস চলে গেল। আমি সোফায় ঘুমাই আর সে বিছানায়। সকালে ওর ঘুম ভাঙার পর আমি আবার বিছানায় চলে যাই। আব্বুর সামনে ওর সাথে ভালো ব্যবহার করছি। অনেক যত্ন নিচ্ছি। আমার রুমে আসলেই সব উল্টো হয়ে যায় যেন বাবার কাছে ধরা না খাই।
..
কোন দরকার ছাড়া ওর সাথে কথা বলিনা। রুমে যতক্ষন থাকে সবসময় বই একটা পড়ে। আর কাজ হাতে থাকলে কাজ। আমি অফিস শেষ করে বাসায় যখন ফিরি তখন অনেকের খাওয়া শেষ হয়ে যায়। রাত্র ১২টা পর্যন্ত আমার জন্য কে ওয়েট করবে! ঠিক তখন সে আমার সামনে হাজির। টেবিলে সবকিছু রেখে রুমে চলে যায়। আমার খাওয়া শেষ হলে আমি রুমে আসলে সে বেরিয়ে যায়। আড়চোখে তাকিয়ে দেখি সে খাচ্ছে। একটা মানুষ পেলাম যে আমার কথা ভাবে কিন্তু মানুষটা ভুল। ওর ভাবা না ভাবা নিয়ে আমার কিছু যায় আসে নাহ। কোর্টের আলোকে আমাদের কমপক্ষে ছয়-মাস একত্রে থাকতে হবে। একত্রে থাকা মানে এক ছাদের নিচে আলাদা হয়ে থাকা। তাই আমি ওকে নিয়ে বেশি মাথা ঘামাচ্ছি না।
..
একদিন রাতে হঠাৎ ঘুম ভেঙে যায়। চোখে অল্প জল জমে আছে। হয়ত কোন খারাপ স্বপ্ন দেখেছি। পানি এক গ্লাস খেয়ে ঘুমোতেই যাবো তখন দেখি বিছানায় প্রিমা নেই। ওয়াশরুমের লাইটও তো বন্ধ। বেলকোনির দরজাও ভিতর থেকে লাগানো। তাহলে সে গেল কোথায়! কেবল মাত্র সোফা থেকে নামলাম তখন দেখি বিছানার ওপাশে সে নামাজ পড়ছে। আমি স্বস্তির নিশ্বাস ফেললাম। সেকেন্ডের জন্য মাথায় আসছিল ও পালিয়ে গেল না তো! যাক! এখন একটু শান্তি পেলাম। চোখ বুজে ঘুমানোর চেষ্টা করলাম। তখন প্রিমা কি জানি বলছিল। স্পষ্ট শুনা যাচ্ছিল না। আমি আবার উঠলাম। আস্তে আস্তে ওর পিছনে গিয়ে দাড়ালাম যেন সে টের না পায় আমি জেগে আছি। তাহাজ্জুদের নামাজ শেষে সে মোনাজাত করছিল…
..
“হে আল্লাহ, তুমি কেন আমাকে কালো করে পৃথিবীতে পাঠিয়েছো! জন্মের পর মা-বাবার আদর পাইনি। পাড়া-প্রতিবেশির
খে বিয়ে করেছি। কারন বাবার পছন্দ করা ছিল। আর যাই অমান্য করিনা কেন বাবার কোন কথা ফেলতে পারিনা।
লোকেরা আমায় নিয়ে মা-বাবাকে কটাক্ষ করতে দ্বিধা করেনি।। ভাইবোনদের কে জিজ্ঞেস করত এই কালো প্যাচা কি তোর বোন! ওরা লজ্জায় মাথা নামিয়ে নিত। তাদের কাছে কোন উত্তর ছিল বলার।
..
স্কুলে সামনের ব্রেঞ্চে বসা আমার নিষেধ ছিল। একা পিছনের ব্রেঞ্চে বসতে হয় যেন আমার গায়ের রং অন্য কারোর গায়ে না লাগে। আচ্ছা, এটা কি কোন ছোঁয়াচে রোগ! না তো! তাহলে কেউ আমার সাথে মিশে না কেন! কথা বলতে চায় না কেন? এটা কি আমার দোষ ছিল যে আমি কালো! টিভিতে দেখায় ক্রিম মাখলেই মানুষ সাদা হয়ে যায়। তাহলে আমি কেন সাদা হই না! আমি কি এতটাই কালো!!!
..
বয়সের চেয়েও দ্বিগুন বার পাত্রপক্ষ দেখতে এসে একি কথা বলে যায় “কালা কাউয়াকে লাইটের নিচে বসালেও দেখা যাবে না আর বিয়ে করতে বসছে”! কালো বলে কেউ আমাকে নিতেও চাচ্ছে না আবার নিজের কেউ রাখতেও চাচ্ছে না। আমি কালো বলে কি আমার বেঁচে থাকাও দায় পড়বে!
..
শেষে কিভাবে জানি আমার বিয়েও ঠিক হয়ে গেল। বড় ঘরের ছেলে, শিক্ষিত সুন্দর ছেলের সাথে আমার বিয়ে ঠিক হল। মনে করেছিলাম হয়ত এখান থেকেই আমার নতুন জীবন শুরু হবে। কিন্তু তা আর হল না। ঘুটঘুটে কালো থাকার জন্যে বিয়ের পরের দিন-ই আমার স্বামী ডিভোর্স চায়। আমার সাথে নাকি উনাকে মানায় নাহ। উনার মত আমারো দুই-হাত, দুই-পা, দুই-কান, দুই-চোখ, এক মাথা আছে। সবই এক তবুও নাকি মানায় না। শুধু পার্থক্য হল উনি সুন্দর আর আমি কুৎসিত!
..
কেন তুমি আমাকে কালো রং দিয়ে বানিয়েছো! অন্য কোন রং দিলেই তো পারতে!
..
হয় তুমি আমাকে বদলিয়ে দাও নয় মৃত্যু দাও। এভাবে আমি আর বাঁচতে পারবো না। তোমার দরবারে কতবার হাত পেতেছি কিন্তু আমায় কিছইু দাওনি। শেষ বারের মত একটা জিনিস-ই চাইবো, আমার স্বামী যেন সুখে থাকেন। আমার কালো ছায়া যেন উনার ওপর না পড়ে”
আমিন।
..
আমি ওর মোনাজাত শুনে দু-পায়ে দাড়ানোর শক্তি হারিয়ে ফেলেছি। হাঁটু গেড়ে ঠাস করে নিচে পড়লাম। সে তার পিছনের আচমকা শব্দ শুনে আঁতকে যায়। সঙ্গে সঙ্গে পিছনে তাকায়। আমি ওর পিছনে এভাবে পড়ে থাকবো সেটা সে কল্পনা করে নি। ওসব কিছু না ভেবে সে আমাকে তুলে বিছানায় শুয়ালো। আমার সারা শরীর কাঁপছে। আমি স্থির হয়ে শুতে পারছিলাম না। আবার বসতেও পারছিলাম না। গায়ের লোম সব দাড়িয়ে গিয়েছে।
..
এত সবের পরেও আমি ওর দিকে তাকিয়ে আছি। সে ছুটা-ছুটি করছে এদিক থেকে ওদিক। পাগলের মত ওষুধ খুজছে। মনে হচ্ছে কয়েক সেকেন্ডের ভেতর আমাকে ওষুধ না দিলে আমি মারা যাবো আর তার আপ্রান চেষ্টা চলছে আমাকে বাঁচানোর। আমি ওকে বললাম আমাকে পানি দাও ভিষন তৃষ্ণা পেয়েছে। সে দৌড়ে এসে আমাকে পানি দিল। আমি কিছুক্ষন জোরে জোরে নিশ্বাস নিলাম। তারপর উঠে সোফায় গিয়ে শুয়ে পড়লাম।
..
সে আমাকে জিজ্ঞেস করছে বারবার আমি ওখানে গেলাম কি করে! আমি নিশ্চুপ রইলাম আর ঘুমিয়ে যাওয়ার ভান ধরলাম। সে মনে করেছে আমার শরীর খারাপ আমাকে আর বিরক্ত করা ঠিক হবে না তাই আর ডাকে নি।
..
কিন্তু আমি ঘুমাতে পারিনি। চোখের দু-পাতা এক করতে পারিনি। ওর প্রতিটা কথাগুলো কানে বাজছে। নিজেকে অনেক বড় অপরাধী মনে হচ্ছে। আমি কিভাবে মেয়েটাকে এত কষ্ট দিতে পারলাম! ও তো আমার স্ত্রী! আমি কিভাবে ওর মনের কথা বুঝতে পারলাম না! এতদিন যে আমায় ভালোবেসে এসেছে আমি কেন তার ভালোবাসা বুঝতে পারিনি! আমি কি সাদা-কালোর মধ্যে এতটাই অন্ধ হয়ে গিয়েছি যে একটা মানুষকে চিনতে পারলাম না!!
..
নিজেকে অনেক ভাবে স্বান্ত্বনা দিচ্ছি কিন্তু চোখের জল আটকাতে পারছিলাম না। হয়ত আজ এখনই সব জল শুকিয়ে যাবে। হয়ে যাক সব মরুভুমি তবুও ওকে আর দূরে রাখা যাবে না। যাকে দু-মাস আগে বিয়ে করেছি , তাকে যে স্ত্রীর মর্যাদা থেকে বঞ্চিত করেছি কাল সব ফিরিয়ে দিব। হ্যা কাল-ই। কাল তাকে নতুন জীবন দিব। কালো বলে আর অবহেলা করবো না। এতদিন যা ছিল সব ভুলে-ভরা ছিল। এখন সবকিছু শুদ্ধ করে নতুন সকালের সূচনা করবো। এখন শুধু সকালের অপেক্ষায়।
..
চোখটা বন্ধ করে শুয়েছিলাম যেন হাল্কা বিশ্রাম নিয়ে উঠে যাই। কিন্তু কখন যে ঘুম লাগল টের-ই পেলাম না। চোখ খুলে দেখি ১১টা বাজে। উঠে দেখি সে বিছানায় নেই। আমি ওকে খুজতে রুম থেকে বের হলাম। আম্মুকে জিজ্ঞেস করতেই যাচ্ছিলাম ও কোথায় তখন ওকে দেখতে পাই। কাপড়ের বালতি নিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকেছে। ইচ্ছে করছিল এখনই ওর কাছে যেতে কিন্তু না, এভাবে যাবো না। আজকে অন্যরকম হয়ে যাবো। তাক লাগিয়ে দেয়ার মত যাবো।
..
ঝটপট ফ্রেশ হয়ে বাইরে থেকে এক গুচ্ছ গোলাপফুল কিনে আনলাম। কাপড় মেলতে এখন সে ছাদেই থাকবে। তাই আর রুমে না গিয়ে ছাদে যেতে লাগলাম। ফুলগুলোর দিকে তাকিয়ে ভাবছি কিভাবে শুরু করবো। ওর সামনে হঠাৎ করে এভাবে দাড়ালে তার কি রিয়েকশন হবে! সে চমকে যাবে তো! হ্যা, ওকে চমকানোর জন্যই তো যাচ্ছি। ভাবতেই আমার মুখের এককোণে হাসি ফুটলো।
..
তখন হঠাৎ-ই কিছু একটা নিচে পড়ার শব্দ হল। মনে হচ্ছিল কিছু সিঁড়ি থেকে পড়ছে। আমি মাথাটা একটু তুলতেই প্রিমার পড়ে যাওয়াটা দেখতে পেলাম। আমি এক পা বাড়াবার আগেই সে আমার পায়ের কাছে এসে পড়লো। ওর নাকে-মুখে রক্ত। মাথা অনেকটা ফেটে গেছে। আমি ওর অবস্থা দেখে প্রায় জ্ঞান হারিয়ে ফেলি তবুও ফেললাম না। হাত থেকে ফুলগুলো পড়ে গেল। আব্বু আম্মু তারা দৌড়ে আসলেন। আমি মুর্তির মত দাড়িয়ে থাকলাম। আব্বু ড্রাইবারকে কল দিয়ে বের হতে বললেন। আমি প্রিমাকে কোলে নিয়ে গাড়িতে যাই। এই প্রথম আমি তাকে স্পর্শ করেছি। আলাদা একটা শিহরণ আমায় ছুঁয়ে গেল। তাও ভুল সময়ে।
..
গাড়ি যত দ্রুত যাচ্ছিল ওর রক্তে আমি তত লাল হচ্ছি। ওকে বাহুতে বসিয়ে হাত দিয়ে চেপে রক্ত বন্ধের চেষ্টা করছি কিন্তু পারছিনা। রক্ত ওর ঝড়ছে কিন্তু কষ্ট পাচ্ছি আমি। বুঝতে পারছিনা এ কেমন কষ্ট।
..
প্রিমার রক্তে গাড়ি যখন পুরোটা লাল হয়ে যায় আমরা তখন হাসপাতালে পৌছলাম। ততক্ষনাৎ তাকে ইমার্জেন্সি রুমে তাকে নেয়া হয়। আমি ছানা-মাখা রক্তে ভিজে দেয়ালে হেলান দিয়ে বসি। ভাবতেই পারছিলাম না এরকম কিছু হবে।
..
কিছুক্ষন পর ডাক্তার এসে বললো অনেক রক্তক্ষরণ হয়েছে ইমিডিয়েটলি ৫ ব্যাগ রক্ত লাগবে। আব্বু ডাক্তারকে জিজ্ঞেস করলেন রক্তের গ্রুপ কি। ডাক্তার বললো বি পজেটিভ। আমি তখন বললাম আমার রক্তের গ্রুপও বি পজেটিভ। আমি আব্বু আর আমার ছোট ভাই কেবিনে গেলাম। ডাক্তার বললো আমি একা এত রক্ত দিতে পারবো না। তাই আব্বু আর ছোটভাইয়ের গ্রুপ একি থাকায় রক্ত দিলাম।
..
প্রায় ৪ ঘন্টার অপারেশনের পর ডাক্তার বের হল। আমরা সবাই ডাক্তারের কাছে এগিয়ে গেলাম। ডাক্তারের মুখ নিচু করা। কিছুই বলছেন না। আব্বু ডাক্তারকে বললেন আমার বউমা কেমন আছে! কি করছে! আম্মু জিজ্ঞেস করলেন আপনি চুপ করে আছেন কেন কিছু বলুন! ডাক্তার তখন আব্বুর কাধে হাত রেখে মাথা নাড়িয়ে নাসূচক ইশারা দেখালেন।
..
আমি ইশারা দেখে দাড়ানো অবস্থায় পড়ে যাই। ভাই এসে আমাকে সামলালো। আব্বু ডাক্তারকে বলছেন আবার বউমাকে দেখতে! ওর কিছু হয়নি, ওকে ভালো করে চেক করুন!! আব্বু নিস্তেজ হয়ে মাটিতে ঢলে পড়লেন। আম্মু উনাকে চেয়ারে নিয়ে বসালেন। আমি নির্বাক হয়ে যাই। ডাক্তারের কথা আমার বিশ্বাস হচ্ছিল না।
..
তাই আমি অটি-র ভিতর ঢুকে যাই। ওর থেতলানো মাথায় সেলাই, নাকে ব্যান্ডেজ দেখে আমি আঁতকে যাই। পা যেমন আমার চলতেই চাচ্ছিল না। তবুও একটু একটু করে এগুলাম। আমি কোনদিন ওকে ওর নাম ধরে ডাকিনি। আজ ডাকছি।
..
“প্রিমা, ও প্রিমা!”
..
সে কোম রিসপন্স করছে না। আমি ঢোক একটা গিলে ওর হাত ধরি। হাত বুলাতে থাকি আর ডাকতে থাকি। কিন্তু সে কোন উত্তর দিচ্ছে না। আমার চোখ জলে ভরে যায়। কিছুই দেখতে পাচ্ছিলাম না। মনে হচ্ছে চোখের পানিতেই ডুবে গিয়েছি। শেষে আমি জ্ঞান হারিয়ে ফেললাম।
..
আমার যখন জ্ঞান ফিরে আমি নিজেকে একটা রুমে আবিষ্কার করি। জ্ঞান ফিরতেই আমি প্রিমাকে খুজতে থাকি। আর নার্স আব্বুকে খুজছে যেন বলতে পারে আমার জ্ঞান ফিরেছে। নিজেকে অনেক দুর্বল মনে হচ্ছিল তবুও ওকে খুজতে বের হয়েছি। কয়েকটা নার্স আমাকে প্রায় অচেতন অবস্থায় ধরে রাখে। মেডিসিন একটা আর তার সাথে ইঞ্জেকশন দিল। কয়েকমিনিট দুর্বল ছিলাম তারপর শরীরে আস্তে আস্তে একটু এনার্জি পেলাম।
..
প্রিমার লাশ নিয়ে সবাই বাসায় ফিরছিল। চারিদিকে কান্নার আওয়াজ। হয়ত কেউ হারানোর ব্যথায় কাঁদছে, নয়ত সে আর বেঁচে নেই তাই কাঁদছে। কিন্তু আমি কাঁদছি কষ্টে, নিজের কষ্টে কাঁদছি। তাকে আমি যত কষ্ট দিয়েছি সব যেন উল্টো ঘুরে আমার বুকেই বিধছে। নিজেই নিজেকে আজ মেরে ফেললাম।
..
কফিনে করে ওকে কবরে নিয়ে যাচ্ছি। কয়েকমাস আগে আমি তাকে বিয়ে করে গাড়ি করে আমার বাসায় এনেছিলাম। আর আজকে……..। সারাটা রাস্তা আমার চোখের জলে ভিজছিল। সাথে সাথে আবার শুকিয়েও যাচ্ছে। কিন্তু চোখ থেকে ঝড়া বন্ধ হচ্ছে না। এ কেমন শাস্তিভোগ করছি আন্দাজা-ই নেই।
..
সাড়ে তিন ফুট মাটির নিচে যখন ওকে রাখা হল আমার কান্নার বেগ বেড়ে গেল। আমার ইচ্ছে করছিল যেন ওর পাশে যাই। কিন্তু মানুষেরা আটকে রাখলো। বড় বড় বাশের ওপর যখন সবাই মাটি ছিটিয়ে দিচ্ছিল আমার কলিজা ফেটে যাচ্ছিল। ও দূরে চলে গিয়েছে তবুও মনে হচ্ছে কেউ যেন আমার পাশ থেকে ওকে দূরে সরিয়ে দিচ্ছে। এগুলো আমি সহ্য করতে পারছিনা, একটুও না।
..
প্রিমা যখন প্রথমবার আমার সামনে কাঁদছিল তখন বিচ্ছিরি লাগছিল শুনতে। এখন ইচ্ছে করছে ওর কান্না শুনেই সারাজীবন কাটিয়ে দিতে। কিন্তু ভাগ্যটা সাথে নেই। শুনেছিলাম দাঁত থাকতে দাঁতের মর্ম দিতে হয়। আজ সেটার মানে বুঝতে পেরেছি।
..
ওকে দাফন করে যখন বাসায় ফিরছিলাম তখন রাস্তায় পুলিশ আটকালো। কিছু বুঝার আগেই ওরা আমাকে তাদের গাড়িতে তুলে নেয়।
..
যেতে যেতে বুঝতে পারলাম কেউ একজন আমার ওপর কেস দিয়েছে। নিজের স্ত্রীকে হত্যার কেস। এটা শুনার আগে যদি আমার কান ফেটে যেত তাহলে দুঃখ পেতাম না।
..
গ্লাস যেভাবে পড়ে ভেঙে চুরমার হয়ে যায় সেভাবে আমার ভরসাও আমাকে ছেড়ে দিল। নিজের ওপর আর কোন নির্ভরতার আশা দেখতে পাচ্ছি না। এরই মধ্যে আমাকে নিজের স্ত্রীর হত্যার দায়ে যাবজ্জীবন কারাদন্ড দেয়া হল।
..
..
আজ প্রায় ৪ বছর পেরিয়ে গেল। আমি কারাগারে। পুরনো দিনের কথাগুলো মনে করছিলাম। মনে করছি আমার প্রিমার কথা যাকে একবিন্দু ভালোবাসা দিতে না পেরেও আজও পাগলের মত ভালোবেসে যাচ্ছি। ও চলে যাওয়ার পর আমার যখন নতুন কারাবাস শুরু হয়েছে তখন আমি আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছিলাম। কিন্তু পিছু নামতে হল। সে দুয়া করেছিল আমি যেন আমি সুখে থাকি, ভালো থাকি। তাই আজও ওকে ছাড়া ভালো থাকার চেষ্টা করছি। মুখে তো বলছি ভালো আছি কিন্তু ভেতর থেকে জ্বলে-পুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছি মিথ্যে কথা বলতে বলতে।
..
যে কালো মেয়েকে বলেছিলাম লাইটের নিচে বসলেও দেখা যাবে না আজ সেই মেয়েকে চার দেয়ালের অন্ধকার রুমের মধ্যে চেহারা দেখি। চোখ বন্ধ করলে দু-চোখের আধারেই তার মুখ ভাসে। সব অন্ধকার জায়গায় ওরই ছবি ফুটে উঠে। এক রুমের মধ্যে শত বোল্টেজের আলোকসজ্জ্বায় কোন এক অন্ধকার জায়গা যেমন বেমানান ঠিক একিভাবে প্রিমা বেঁচে থাকতে আমার জীবন ছিল। আর ওর মৃত্যুর পর পুরো রুম অন্ধকার শুধু ওই কোন এক জায়গায় একটু আলো যেমন আবছা আশা দেখায় সেরকম জীবন চলছে। হয়ত এরকমই চলতে থাকবে যতদিন না পর্যন্ত সে আলো দিচ্ছে বা নিজে অন্ধকারে না যাচ্ছি।

গল্পের বিষয়:
দু:খদায়ক
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত