মাতৃত্বের দাম

মাতৃত্বের দাম

মাতৃত্বের দাম:-

এই ভরদুপুরে কে আবার কড়া নাড়ছে,দরজা খুলেই মুখ ঝামটা দেবে,কিন্তু না…. দেখে বিরেন বাবু মুখ নিচু করে দাঁড়িয়ে।বুকের ভেতরটা ছ্যেঁৎ করে ওঠে সুলতার,”তুমি…..!” ইনি সুলতার পুর্বপরিচিত ।বিরেন্দ্র নাথ মজুমদার ওরফে বিরেন বাবু,”ভেতরে ডাকবে না?””হুমমমমম…. এসো”। চৌকি তে বসতে দিয়ে সুলতা জল বাতাসা আনতে গেল।
সব কিছু আগের মতই আছে,একটা সময় ছিল যখন এই পুরনো -সেঁতসেঁতে -ঘুপচি -ছোট ঘরটিই ছিল বিরেন বাবুর পরম তৃপ্তির ঠিকানা অথচ আজ বড্ডো অস্বস্তি হচ্ছে উনার। সুলতার হাত থেকে জলের গ্লাসটা নিতে-নিতে দেখলেন ওর শরীরের খাঁজে মেদ জমেছে.. আগের সেই ডাগর পানা চেহারা আর নেই,চোখের কোলেও কালি, কমলা লেবুর মত গাল দুটো ঝুলে গেছে কেনইবা হবেনা ওরও তো বয়েসটা থেমে নেই ।ঘরের এক কোনে দাড়িয়ে সুলতা,মনের ভেতরটা তোলপাড় করছে ওর..”কেমন আছো লতা?” হ্যাঁ এই নামেই উনি ডাকতেন সুলতাকে।ঘার নেড়ে ও জানায় যে ও ভালো আছে। “রোজগার পাতি কেমন চলছে… শুনলাম তুমি নাকি ধান্দা ছেড়ে দিয়েছ! একটা বাঁকা হাসি হেসে..কেন দাম পাচ্ছিলে না বুঝি?”
সুলতাও তেমন একটু মুচকি হেসে..”হুম..যেমন তুমি দাম দেওয়ার ভয়ে এ পথ ছাড়লে সেই রকমই। তা আজ এত বছর পরে কি মনে করে শুনি…?” বিরেন বাবু..”আমি জানি তোমার অভিমান হয়েছে… কিন্তু কি করতাম বলো….. তোমাকে যে আমার পরিবার ,আমার সমাজ মেনে নেবে না..তাই তো….।”বিরেন বাবু কে মাঝ পথেই থামিয়ে…”কেন এসেছ সেটা বলো।”বিরেন বাবু..”ছেলে কে নিয়ে যেতে এসেছি।”
মাথার উপর যেন আকাশ ভেঙ্গে পড়ল সুলতার,সূর্যই তো ওর জীবনের একমাত্র অবলম্বন,যাকে আঁকড়ে ধরে ও বেঁচে আছে। ছেলে কে হারানোর আশঙ্কায় ওর বুক কেঁপে উঠলো চারপাশ অন্ধকার হয়ে গেল,কাঁপাকাঁপা গলায় ও বললো..” এ তোমাদের কেমন সমাজ গো,যে সমাজ একজন পতিতাকে মানতে পারবে না অথচ আবার সেই পতিতার সন্তানকেই সমাজ স্বীকার করছে?” বিরেন বাবু..”ও কি তোমার একার ছেলে নাকি …ওর শরীরে আমার রক্ত বইছে,ও আমার পরিচয়ে স্বীকৃতি পাবে এবং আমার বংশ রক্ষা করার দায়িত্ব ওর কারণ সূর্য আমার ছেলে।” সুলতা লজ্জায়-ঘৃনায়-ভয়ে নিরুত্তর স্তম্ভের মতো দাঁড়িয়ে রইল।
দরজার আড়াল থেকে সবটাই শুনেছিল সূর্য, সশব্দে দরজা খুলে ঘরের মধ্যে ঢুকে পড়াতে সুলতা ও বিরেন বাবু দুজনেই চমকে ওঠেন । প্রাণবন্ত ফুটফুটে এই কিশোরই যে সূর্য সেটা বুঝতে বিরেন বাবুর খুব একটা সময় লাগেনি।বুকে জড়িয়ে ধরে চুমু খেতে খেতে বলেন..”চল বাবা চল… আমি তোকে নিয়ে যেতে এসেছি,আমি তোর বাবা..তোর খুব কষ্ট হয় এই ঘরে থাকতে তাই না… ভালো করে বুঝি খেতেও পাস না…চল তোর জন্য আমার অট্টালিকা পথ চেয়ে আছে..কত ঝি চাকর তোর আগে পিছে ঘুরবে.. মন্ডা-মিঠাই রোজ জুটবে।” বিরেন বাবুর হাত দুটো আলগা করে ছুট্টে গিয়ে সুলতাকে জড়িয়ে ধরে বলে..”মা এটাই আমার বাবা?” সুলতার দু-চোখে জল উপচে পড়ছে।”হ্যাঁ সোনা..তোর বাবা তোকে নিয়ে যেতে এসেছে..যা,ওখানে তুই সব পাবি।যা চলে যা…”।
কিন্তু মা এখানে তো তোমাকে পাবো না.. তোমার গায়ের এই মা-মা মিষ্টি গন্ধ টা সেটা পাব না.. তোমার ভালবাসা- তোমার আদর -তোমার শাসন কিছুই কি পাব সেখানে? তাহলে আমি উনার সাথে যাব কেন? উনি আজ আমায় নিতে এসেছেন কিন্তু এই পনেরো বছরে একবার কি এসেছেন আমরা বেঁচে আছি কিনা তা দখতে,আমিও তো দিনের পর দিন বসে থেকেছি বাবাকে পাওয়ার আশায়,আমার একটাই পরিচয় আমি তোমার ছেলে।তুমি বেশ্যাবৃত্তি করে আমায় বড়ো করেছ আমার অনেক সখ মিটিয়েছ।আমি তোমার পেশাকে লজ্জা বা ঘৃণা নয় মা আমি সম্মান করি ।আমার রোজ রোজ মন্ডা-মিঠাই চাই না মা, তোমার হাতের ওই ঝাল তরকারিটাই আমার প্রিয়। মা উনার ওই অট্টালিকা তে নয়,ওই নীল আকাশের মতো তোমার যে বিশাল হৃদয় আছে সেখানেই তোমার সূর্য থাকতে চাই মা…. তুমি উনাকে চলে যেতে বলো ।” ছেলেকে বুকে জড়িয়ে ধরে অঝোরে কেঁদে চলছে সুলতা…দরজা বন্ধ হওয়ার শব্দে ওরা দুজনেই চোখ মেলে দেখে বিরেন বাবু ঘরে নেই চলে গিয়েছেন ,উনি হয়তো এবার বুঝবেন যে এই দুনিয়ায় সবকিছু দাম দিয়ে কেনা যায় না।

ঋতুপর্ণা দাস নস্কর

গল্পের বিষয়:
দু:খদায়ক
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত