বিশ্বাসঘাতকতার প্রতিদান

বিশ্বাসঘাতকতার প্রতিদান

অনেক দিন পর দেশে ফিরছে ফিরোজ। গত দুই বছরে একবারও দেশে আসেনি সে। এবার মা এর জোরাজুরিতে দেশে আসতে হচ্ছে। বড় আপার ছেলে হয়েছে একবছর আগে। এবার তাহলে একসাথে ভাগ্নেকেও দেখে আসা যাবে। ভাবতেই অনেক আনন্দ হচ্ছে তার। তবে এ আনন্দের মাঝেও কোনো একটু কষ্ট লুকিয়ে আছে তার মনে।
.
ফিরোজ ৩০ বছর বয়সী একজন প্রবাসী। প্রায় ৯ বছর ধরে দুবাই থাকে সে। তার এ বয়স জীবনের আয়তনের তুলনায় নিতান্তই ক্ষুদ্র। তবুও এ ছোট্ট জীবনের মাঝেও আছে গভীর একটা ক্ষত।
.
৩ বছর আগে একবার দেশে এসে মা-বাবার পছন্দের মেয়ে মুক্তাকে বিয়ে করে ফিরোজ। মুক্তা দেখতে শুনতে ভালোই ছিলো। বিয়ের পর বউয়ের সাথে খুব ভালোই কেটেছিলো দিনগুলো। বিয়ের তিন মাসের সময় দুবাই চলে যায় ফিরোজ। নিয়মিত মা-বাবার জন্যে টাকা পাঠানোর সাথে সাথে মুক্তার জন্যেও আলাদা হাত খরচের টাকা পাঠাতো। সব দিকদিয়ে মুক্তার খোজ-খবর নেয়ার পরেও মুক্তা যেনো কেমন করে কথা বলতো ওর সাথে। মুক্তা কখনোই ওর সাথে ঠিক করে কথা বলতো না। ফোন করলে কথা বলতো এমন ভাবে যেনো তার অসহ্য লাগছে। তারপরেও ফিরোজ আর মুক্তার কথা হতো।
.
৮-৯ মাস পর ফিরোজের মা ফিরোজকে জরুরী ভাবে দেশে আসতে বলে। ফিরোজও মায়ের কথামত দেশে ফিরে আসে।
.
ফিরে এসে মায়ের কথা শুনে ফিরোজের মাথায় যেনো বাজ ভেঙে পড়ে। মুক্তা নাকি তার এলাকার এক ছেলের সাথে পালিয়ে গেছে আর তাকেই বিয়ে করেছে। ফিরোজের মা-বাবা কাদঁছে একারণে যে নিজের হাতে ছেলের সর্বনাশ করেছে তারা। ফিরোজ কিন্তু নিজে ভেঙে পড়েনি। মা-বাবাকে বুঝতে দেয়নি তার কষ্ট। তবুও তার মা তার চেহারার দিকে তাকিয়ে কষ্ট পেতো। যা ফিরোজ বুঝতে পারতো। তাই গত দু-বছরে একবারও দেশে ফেরেনি সে। তবে এবার মায়ের জোরাজুরিতে ফিরতে হচ্ছে তাকে।
.
বাড়িতে আসার পরই সবাই তাকে নিয়ে মাতামাতি করছে। কার জন্য কি এনেছে সবাই তাই খোজ করছে। কিন্তু তার মা দরজার কোণে দাড়িয়ে ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। ফিরোজ বুঝতে পারে তার মা কি ভাবছে। মায়ের কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করছে
“মা, তুমি কি এখনো আমাকে নিয়ে চিন্তা করো? মা বিশ্বাস করো আমি ভালো আছি।”
“বাবা, আমি জানি তুই কেমন আছিস। তুই আমার একটা কথা রাখবি??”
:- কি কথা মা??
” বাবা তুই আবার বিয়ে কর। তুই আমার কথা ফেলিস না বাবা। তোর আব্বাজানও এটা চান। তোর কথা চিন্তা করে তোর বাবার অসুখটাও বেড়ে চলেছে।”
বাবার কথা চিন্তা করে ফিরোজ মাকে বললো ” মা আমি কথা দিচ্ছি আমি এবার বিয়ে করবো।”
.
ছেলের রাজি হওয়াতে ফিরোজের মা যেনো অনেক খুশি। অনেক বড় একটা টেনশন যেনো তার মাথা থেকে দূর হয়েছে। তার মা-বাবা,ভাই-বোন সবাই তার জন্য মেয়ে দেখা শুরু করে দিয়েছে। ফিরোজের মনে কি চলছে সেটা একমাত্র ফিরোজই জানে। একবার হোচট খাওয়ার পর তার মনোবলটা হারিয়ে গেছে। প্রত্যেকবারই ভাবতে হয় আবার যদি হোচট খায়। তবুও মা-বাবার কথা ভেবে সে রাজি আছে।
.
দেশে মা-বাবার সাথে খুব ভালোই কাটছে দিন গুলো। ১ বছর বয়সী ভাগ্নেকে নিয়ে প্রতিদিন ঘুরাঘুরি আর এটা সেটা কিনে দিতো সে। হঠাৎ বোনের ফোন আসে। ওর ভাগ্নেটা নাকি অসুস্থ। গত দু দিন ধরে কিছুই খাচ্ছেনা। হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে। সেদিনই ফিরোজ ভাগ্নেকে নিয়ে হাসপাতালে যায় ডাক্তার দেখানোর জন্য।
.
হাসপাতালের সিরিয়ালে বসে থাকতে থাকতে কোমরে ব্যাথা হয়ে গেছে তার। তাই ছোট ভাগ্নেকে কোলে নিয়ে এদিক সেদিক হাটা-হাটি করছে। হঠাৎ করেই সে খেয়াল করলো জেনারেল ওয়ার্ডের ফ্লোরে একটা মেয়ে শুয়ে ছটফট করছে। ফ্লোরে শুয়ে থাকা মেয়েটার চেহারা দেখেই চমকে যায় ফিরোজ। এই মেয়েটা তারই প্রাক্তন স্ত্রী মুক্তা। মুক্তাকে দেখে তার মুখে-চোখে একটা তীব্র ঘৃনা ফুটে উঠছে।
.
ফিরোজের মনে হচ্ছে যেনো মুক্তাকে দেখলে ফিরোজের পাপ হবে। মুহুর্তেই চোখের কোন হতে একফোটা অশ্রু বেয়ে পড়ছে। নিজেকে সামলে নিয়ে একজন নার্সকে ডেকে ওর অসুস্থতা আর বেড খালি থাকতেও ফ্লোরে শুইয়ে রাখার কারণটা জানতে চায়। নার্স জানায় ” মেয়েটার অন্তঃসত্ত্বা থাকা অবস্থায় বাচ্চা মারা যায়। আর এখনো ও খুব অসুস্থ। ওর স্বামী হাসপাতালের খরচ না দিতে পারায় স্ত্রীকে রেখে পালিয়েছে। আর হাসপাতালের কতৃপক্ষও ওকে বাধ্য হয়ে বিনা চিকিৎসায় ফ্লোরে রেখে দিয়েছে।
.
কথা গুলো শুনেই ফিরোজ মনে মনে ভাবে মুক্তা নিজের পায়ে নিজেই কুড়াল মারলো। এটাই হয়তো আল্লাহ ওর বিশ্বাসঘাতকতার জন্যে শাস্তি দিয়েছেন। কথাগুলো ভাবতে ভাবতে ফিরোজ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। কিছুক্ষন চুপ করে কি যেনো ভাবার পর নার্সকে জিজ্ঞেস করলো “কতটাকা বকেয়া আছে?”
নার্সটা একটা ফাইলঘেটে বললো “উনত্রিশ হাজার আটশ নব্বই টাকা”
.
ফিরোজ সাথে সাথেই ওর ছোট ভাই রেজাকে ফোন করে পঞ্চাশ হাজার টাকা নিয়ে আসতে বলে। রেজা এতো পরিমান টাকার কথা শুনে কিছুটা অবাকই হলো। কারণটা জিজ্ঞেস করার আগেই ফিরোজ লাইনটা কেটে দেয়।
.
টাকা সহ হাসপাতালে পৌছে রেজা নিজের ভাইকে কাউন্টারের সামনে দেখতে পায়। রেজাকে ফিরোজ দেখতে পেয়ে টাকাটা নিয়ে তড়িঘড়ি করে মুক্তার হাসপাতালের বিলটা পরিশোধ করলো। রেজা শুধু অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। আর বারবার জিজ্ঞেস করছে ” ভাই কিসের টাকা দিচ্ছিস তুই??। ফিরোজ কোনো কথা বলে না। হাসপাতালের পাশে থেকে কিছু ফলমূল কিনে আনলো। রেজা আবার জিজ্ঞেস করছে “ভাই কিসের টাকা দিচ্ছিস তুই? এতো পরিমান টাকা? ফলগুলোই বা কার জন্যে? বাবুর কিছু হয়নি তো??”
ফিরোজ কাউন্টার থেকে রিসিটটা নিয়ে রেজাকে দেখায়। রিসিটে মুক্তার নাম দেখতে পেয়ে রেজা ভাইয়ের দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে থাকলো। ফিরোজ সাথে সাথে রেজার হাত ধরে জেনারেল ওয়ার্ডের সামনে নিয়ে গেলো।
.
ফ্লোরে শুয়ে থাকা মুক্তাকে দেখে রেজা প্রচন্ড অবাক হলো। একদৃষ্টিতে ভাইয়ের চোখের দিকে তাকিয়ে থাকলো। সে জানে তার ভাইয়ের মনে কি হচ্ছে। জিজ্ঞেস করলো ” ভাই তুই ওর জন্যে এতো কিছু করছিস কেন? ও তো তোর সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। তবুও তুই ওর জন্য এতো কিছু করছিস। কেন ভাই?”
.
ফিরোজ চোখের কোণে থাকা পানিটুকু মুছে বললো ” রেজা আমি ওকে ওর বিশ্বাসঘাতকতার প্রতিদান দিয়েছি। এরপর থেকে যখনই ওর আমার কথা মনে পড়বে ওর কষ্ট হবে। নিজেকে বারবার ঘৃনা করবে। কিন্তু তখন আর কোনো লাভ হবেনা।”
.
ভাইয়ের কথা শুনে রেজা আর কোনো কথা বললো না। ভাগ্নেকে ডাক্তার দেখানোর পর চলে আসার সময় আরো হাজার খানেক টাকা ফিরোজ নার্সের হাতে দিয়ে আসে পরবর্তী খরচের জন্যে। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বাড়ির দিকে রহনা দেয় ফিরোজ। মনে মনে ভাবে মুক্তার জন্য কষ্ট পেলে হবে না। মা-বাবাকে খুশি রাখতে ও সব করতে রাজি।
.
কয়েক মাস পর….

ফিরোজের ফোনে একটা অপরিচিত একটা নাম্বার থেকে কল আসে। রিসিভ করতে সেই চিরপরিচিত কন্ঠ। বলছে ” ফিরোজ আমি ভূল করেছি আমাকে ক্ষমা করে দাও। হাসপাতাল থেকে খোজ নিয়ে তোমার কথা জানতে পারি। আমি জানি আমি ক্ষমার অযোগ্য, আমি তোমার কাছে ফিরে যেতে চাইনা। শুধু যদি পারো আমাকে ক্ষমা করে দিও।”
.
উত্তরে ফিরোজ একটা কথাই বললো ” আমার মা-বাবার চোখ থেকে ঝরে পড়া পানির ফোটা গুলো যদি তুমি পরিশোধ করতে পারো তাহলেই তোমাকে ক্ষমা করবো। জানি তুমি পারবে না।”
কথা গুলো বলেই ফিরোজ ফোনটা রেখে দেয়। এরপর মুক্তা কোনোদিন ফোন দেয়নি অথবা যোগাযোগের চেষ্টাও করেনি।
.
অন্যদিকে ফিরোজ এখন তার মা-বাবার কথায় আবার বিয়ে করে খুব সুখেই আছে। মুক্তার কথা কল্পনায়ও আসেনা তার।
কারন অমানুষের স্থান কখনো মানুষের মনে হতে পারে না।
.

গল্পের বিষয়:
দু:খদায়ক
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত