বাজান, ও বাজান! (মরিয়ম)
কি হয়ছে রে মা? (কমর মিয়া)
বাজান, এবার আমারে ঈদে কিন্তু নতুন জামা দেওন লাগবো।।
আইচ্ছা মা, এবার ফসল গুলা ঠিক মতন গোলাই তুলতে
পারলে সব হইবো।
আমার লক্ষি বাজান, সোনা বাজান।।
যা যা , অনেক হইছে। পুটু ( ছাগলের বাচ্চা) টারে একটু কাঁঠাল পাতা আইনা দে মা, খাওনের লাইগ্যা কখন থাইক্যা ডাকতাছে।।
আচ্ছা, বাজান। দিতাছি!
.
কথা হচ্ছিল কমর মিয়া আর তার মা মরা মেয়ে মরিয়ম এর মাঝে।
রাজশাহী জেলার বাঘমারা উপজেলার প্রত্যন্ত একটি গ্রামের বাসিন্দা তারা।
কমর মিয়া সামান্য কৃষি কাজ করেন, আর তার একমাত্র মেয়েটাই তার সংসারের চালক।
মরিয়ম এর মা মারা যাবার পর থেকে মরিয়ম সেই ৬ বছর থেকে আজ পর্যন্ত সংসার টাকে আগলে রেখেছে।
কমর মিয়াকে অনেকেই বলেছে আরেকটা বিয়ে করে নতুন বিবি ঘরে আনার জন্য।
কিন্তু, কমর মিয়া তার মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে সেটা আর করেননি।
.
সকাল বেলা ঘরে রাখা পান্তা ভাত খেয়ে আর মেয়ের আশা পূরন এর কথা ভেবে মাঠে চলে গেলেন।
ভাবলেই যে ভাবেই হোক এই ঈদে মেয়েকে একটা নতুন জামা দিবেন ই।
তারপর……
.
কি কমর ভাই?( সালেহ মুন্সি, পাশের জমির মালিক)।
আইজকা দেরি হইলো যে?
আর বইলোনা ভাই, মাইয়াডা আজইকা নতুন জামার লাইগ্যা খুব কইরা ধরলো, তাই দেরি হইয়া গেছে। (কমর মিয়া)
ও, তাই কও।
বড় ভালা মাইয়া তোমার ভাই, তোমার খুব দেখভাল করে।
হ ভাই, ওর মা ডা মারা যাওণের পর থেয়ক্যা ঐ সংসার ডারে আগলাইয়া রাখছে।
হ, হাচা কথা কইছো।
কমর ভাই, এক্ষান কথা হুনচোনি? (শুনেছেন)
কি ভাই?
হুনলাম,(শুনলাম) এইবার নাকি বড় রকমের বান(বন্যা) আসতাছে.।
কমর মিয়ার মুখ অনেকটাই বিবর্ন হয়ে যায়।
মনের ভিতর এর পাখিটা যেন আবার ডেকে উঠে।
কথা হাচানি?( সত্য নাকি)
হয় ভাই, পানসিপাড়া, নোলকপুর আর দিঘল গাও নাকি পানি উঠতাছে।
তয় আমাগোর চিন্তা নাই, আমাগোর বাধডা ঠিকিইআছে।
তাও ভালা, কিন্তু বাধডা তো অনেক দিন হইলো।
ইন্দুরে( ইঁদুর) অনেক ফুডা করছে দেখলাম।
হ, তয় চিন্তা নিও না।
আল্লাহ ভরসা।
মুন্সির কথায় ভরসা হয় না কমর মিয়ার।
.
দুপুরে বাসায় যেয়ে দেখে মেয়েটা রেধে নিয়ে বসে
আছে।
বাজান, ও বাজান।
তারা তারি গোসল দিয়া আহ (আসো)।
যাইতাছিরে মা।
কমর মিয়া গোসল করে এসে খেতে বসেন।
একবার মুখে দিয়েই বলেন, তুই খাইছোস মা?
তুমি খাইয়া লও বাজান,তোমার পর আমি খামুনে।।
কমর মিয়া ছোট বাচ্চাদের মত বসে থাকেন।,
কি বাজান, বইয়া রইলা কেন।?
খাও!
খামু না।
কেন বাজান।?
রান্ধন (রাধা) ভালা হইনাই?
না, আমার ইচ্ছা নাই।।
আর খামু না।
অরে মা রে, আমার বাজানের রাগ কতো?
নেও, আমিও ভাত নিতাছি।
কমর মিয়া প্লেটে আরো একটু ভাত নিয়ে নেন।।
বলেন, নে মা।
আমি তোরে খাওয়া দেই.।
আইচ্ছা বাজান।
দুপুরের খাবার শেষে কমর মিয়া আবার বাইরে যান।
কালকে আবার তাকে গঞ্জের হাটে যেতে হবে, পাইকার (যিনি পাইকারি দরে জমির শস্যাদি কিনে থাকেন) খুজতে।
.
পরের দিন ————
.
মা,মারে?
কও বাজান, আমি গঞ্জে যাইতাছি।
কাইলকা আসুম, তুই তোর সাবিনা ভাবির কাছে আজ রাইত টা থাকবি।
কাইল বিকালের মধ্যেই আমি চইলা আসুম।
আর হুন, সাবধানে থাকবি।
তোর লাইগ্যা এবার পাইকার গো কাছ থাইক্যা অগ্রিম টাকা লমু।
আর ওইডা দিয়া তোর নতুন ——–
কি নতুন বাজান? কিছু্না।
কাইলকা দেখিস।
আইচ্চা বাজান।
সাবধানে যাইও।
আইচ্চা মা জননী।
.
কমর মিয়া যাওয়ার পর রাতে মরিয়ম তার পুটুকে ঘরে বেধে, ওর চাচাতো ভাবিদের বাসায় চলে যায়।
কিছুক্ষন হাসি তামাসার পর রাতে ওরা ঘুমিয়ে পড়ে।
——————————————
মরিয়ম, ওই মরিয়ম।
হু…….
মরিয়ম রে?
হু…..
কি হইছে ভাবি?
তাড়াতাড়ি উঠ।
কেন?
আরে বানের পানি নাকি অনেক বাইড়া গেছে।
লোকে সবাই চইলা যাইতাছে।
আমাগোও যাইতে হইবো।
এখনি?
হ, কি কয়তাছি তোরে?
আইচ্ছা, তুমি থাইমো ভাবি। আমি পুটুরে আর ঘরের জিনিস কিছু লইয়া আহি (আসি)।
যা, তয় তাড়াতাড়ি।
বানের পানিতে নাকি বাধ ভাইংগা যাওয়ার যোগার।
.
মরিয়ম এক দৌড় দিয়ে বাসায় আসে, রাস্তা যেন ফুরাই না।
বাসায় এসে কিছু কাপড়, ঘরে থাকা শুকনা মুড়ি, গুড় আর চিড়া নিয়ে আর প্রয়োজনীয় জিনিস আর মায়ের থাকা
সেই সাদাকালো ছবি টা নিয়ে সে চলে আসতে থাকে।
মাঝ রাস্তাতে, মরিয়মের মনে হয়।
আরে?
আমি পুটু টারে নিলাম না।?
বানের পানিতে তো ভাইস্যা যাইবো!
.
মরিয়ম তাড়াতাড়ি সাবিনা ভাবিদের বাসায় যেয়ে অগুলো রেখে, বলে…..
ভাবি আমি পূটু টারে লইয়া আহি।
ভুলো রাইখ্যা আইছি।
সাবিনা ভাবি পিছন থেকে ডাকতেই, মরিময় চলে আসে।
ঘরে তালা খুলে, পুটুর ঘরের চাবি খুজতে থাকে।
চাবিটা সবসময় ওর বালিশের নিচে থাক্অতো।আজকে কি হল?
খুজেই পাচ্ছে না সে। দেখতে পেল, চৌকির ( শোবার জন্য কাঠ দিয়ে বানানো ; খাট বা পালংকের মত) নিচে পড়ে আছে সেটা।
দরজা খুলেই, পুটুর দড়ি খুলে দেয় মরিয়ম।
পুটু ভ্যা…. ভ্যা…..ভ্যা….. করতে করতে চলে যাচ্ছিল।
মরিয়ম বাড়ির পিছন থেকে খানিকটা ঘাস আনতে গেল,
পিছনে গিয়েই তার হাতের চেরাগ ( কুপি, বাতি) টা নিভে যায়।
হটাৎ, ওর মনে হতে থাকে কিছু যেন শব্দ করতে করতে তার
দিকে এগিয়ে আসছে।
ও দৌড়ে আসতে লাগে, কিছুর সাথে ধাক্কা খেয়ে পড়ে যায় সে।
তারপর সব যেন ঠান্ডা হয়ে যায়……
তারপর সব কিছুই থেমে যায়।
মরিয়ম এর মনে হতে থাকে কেউ যেন তাকে ডাকছে, ওর কষ্ট হয়।
আর্তনাদ করে কিন্তু মনে হয় এই গুলো শোনার মানুষ নেই।
আস্তে আস্তে সে হারিয়ে যায়, চলে যায় সেই না ফেরার দেশে।
.
.
অন্য দিকে সাবিনা ভাবি ও তার পরিবার বুঝতে পেরে
আগেই চলে যায় অন্য স্থানে।।
প্রাইমারি স্কুলের ২য় তলায় যেয়ে ওঠে অরা।
পুটু অনেক আগেই সাবিনাদের বাসার কাছে চলে
গিয়েছিল।
সাবিনার স্বামী সালেহ তাকে আগেই নিয়ে চলে যায়।
কিন্তু তারা কোন ভাবেই মরিয়ম কে পেল না।
—————————————
পরের দিন বিকেল বেলা,
মরিয়ম এর বাবা কমর মিয়ে নৌকাই করে গ্রামে ফিরে আসেন।পুরো গ্রাম ডুবে গেছে ।
প্রাইমারি স্কুলের নিচতলা গোটাটাই পানির নিচে।।
সবার মাঝে হাহা কার, আশ্রয়কেন্দ্র কমর মিয়া সাবিনাদের খুজে বের করলো।
সাবিনাও সালেহ কে মরিয়ম এর কথা জিজ্ঞাসা করতেই তারা বলে ঘটনা।
কমর মিয়া চিৎকার দিয়ে ঊঠেন।
.
সাবিনা সালেহ অ অন্যারা বলে মরিয়ম নিশ্চয় অন্য কোন যায়গাতে আছে।
কিন্তু কমর মিয়ার মন মানে না।
তিনি বুঝতে পারেন তার কলিজার টুকরা ভালো নেই।
.
—————–ছয় দিন পর —————–
.
বন্যার পানি নেমে যাচ্ছে।
কমর মিয়া বাসার দিকে যাচ্ছেন। যদিও প্রায় হাটু পরিমান পানি আছেই বলা যায় তবুও তিনি তার মিয়ের খোজে চলে এসেছেন।
বাড়ির কাছের বাশ ঝাড় টার দিকে চোখ পড়তেই তার বুক ধক করে উঠে।
কে যেন ভেসে আছে।
সালেহ, মুন্সি, জয়নাল সবাই এগিয়ে যায়।
কমর মিয়া কাছে যান, যেয়ে বঝতে আর তার বাকি থাকে না।
চিৎকার দিয়ে উঠেন তিনি।
মারে!!!
ওরে মারে, আমারে ছাইরা চইলা গেলি রে মা।
আমি কি নিয়া বাচুম রে মা…।
আমার যে কেউ নাই রে।
আল্লাহ, আমারে তুইলা নাও গো।
আমার মাইয়ডা কই গেলো গো।
সবাই তাকে সান্তনা দিতে থাকে, নিষ্পাপ চেহারার অই মেয়েটা হারিয়ে গেল ঐ নীল আকাশে।
নতুন ঈদের জামাটা গড়াগড়ি খাচ্ছে কাদার মাঝে।
আর বুক ফাটা আর্তনাদ ভেংগে গুড়িয়ে দিচ্ছে সবার হৃদয় কে।
…
অন্যদিকে,
এক প্রকৌশলীর ঘরে তখন জ্বলছে মোমবাতি।
বিশাল বড় কেক আর পার্টির আয়োজন হয়েছে তার ঘরে।
হ্যা, আজ তার মেয়ের জন্মদিন।।
মেয়েটা ফূ দিয়ে মোমবাতি গুলো নিভাচ্ছে।
আর, মরিয়ম এর মত মেয়েদের জীবন প্রদীপ নিভে যাচ্ছে তার
শখের মোমবাতি টির মত।
কারন, তারা মোমবাতি নিভিয়েই শান্তি পায়।
অন্যর ঘরের প্রদীপে কি আসে যায় তাতে, প্রদীপ তো কমরের মত পা ফাটা মানুষের।
কোর্ট, প্যান্ট জুতা, মোজা পরা এক প্রকৌশলীর তো নয়।
—————————————–