কিছুটা রাগ চোখে সুরাইয়ার দিকে তাকালাম। সে তার মত মুচকি হাসছে। ভেবেছিলাম তাকে কড়া চোখে শাষন করব। কঠিন কিছু কথা বলব। কিন্তু এই হাসি দেখে কঠিন হয়ে থাকার উপায় নেই। মন ভোলানো কোন হাসি বললে, ওর হাসি তার মধ্যে সেরা। চোখে উচ্ছাস নিয়ে এমন করে তাকালে রাগ করে থাকা যায়! হাতটা টেনে ধরে বললাম
-এই তুমি এমন কেন! হু!
-আমি কেমন!
-কোন বিষয়ে সিরিয়াস হবে না!
-সিরিয়াস কেন হব! সিরিয়াস মানে তো মারাত্মক! আমি মারাত্মক কেন হব!
এই মেয়ের সাথে কথা বলে পারা যাবেনা। কথা যোগানোই থাকে! কিভাবে কি বলব সেটাই মাঝে মাঝে ভুলে যাই!
.
-তুমি ঔষধ ফেলে দিলে কেন!
সরাসরি ঔষধের কথা বলায় সে কিছুটা লজ্জা পেল। মাথা নিচ করে বলল
-ফেলে দেইনি তো। হাত থেকে পরে গিয়েছে।
-হাত থেকে পরে যায়! আমি তো বসে আছি। আমি তো পরে গেলাম না!
-ধাক্কা দিলে তুমিও পরবে।
শেষের কথাগুলো আস্তে করে বলল। শুনেও পাত্তা দিলাম না। একটু আগে ঔষধের দোকান থেকে কয়েকটা ঔষধ কিনলাম। দোকানদার প্যাকেট করার সময় বলেছিল
-এগুলো তেঁতো ঔষধ। নাক বন্ধ করে খেলেই চলবে।
দোকানদারের এটা বলাই বড় ভুল! তেঁতো বলে সে ঔষধ ফেলে দিল!
.
ছোটবেলায় আমার এমন অভ্যাস ছিল! অসুস্থ হলে ডাক্তার সবসময় তেঁতো ঔষধ লিখত। বুঝতাম না, তার সাথে আমার কি এমন শত্রুতা ছিল! ভুলেও কোনদিন মিষ্টি লিখেন নি উনি। উনার তেঁতো ঔষধ দেখলেই সুস্থ হয়ে যেতাম । তারপরে বাবা কিনে এনে রাখত। মাঝেমাঝে চিপায় পরে তেঁতো ঔষধ খেত। কখনো সুযোগ পেলে ওগুলো ইঁদুরের গর্তে চালান করে দিতাম। মনে মনে একটাই কথা বলতাম
-তুই খা। তেঁতো খেয়ে মর। দেখ কেমন লাগে!
.
বড় হওয়ার সাথে সাথে সেই অভ্যাসগুলো ত্যাগ করেছি। কিন্তু সুরাইয়ার বাচ্চামি এখনো আছে। অসুস্থ থাকলেও সে ঔষধ খাবেনা। চোখ রাঙিয়ে ওর দিকে তাকালাম। আমার তাকানো দেখে সে হেসেই উড়িয়ে দিল। রিক্সা চলতে চলতে ওর বাসার সামনে চলে এল। রিক্সা থামানর পরে সে নেমে গেল। ওকে ডেকে বললাম
-ঠিকমত ঔষধ খাবে। নাহলে খবর আছে।
আমার কথা শেষ হতেই সে চলে গেল।
.
মেয়েটিকে মাঝে মাঝে অচেনা লাগে। হুট করর এসে চমকে দেয়। ওর সাথে পরিচয়টাও এমন একদিন হুট করেই। সেদিন আমাদের সংগঠনের একটা পোগ্রাম ছিল। আমাদের সেদিনের পোগ্রাম ঢাকার বাইরে ছিল। শিশুদের নিয়েই আমাদের সংগঠন। আমরা সুবিধা বঞ্চিত শিশুদের নিয়ে কাজ করি । আমি আগেই চলে গেলাম সেখানে। অন্যরা পরে যাওয়ার কথা আছে!
.
-এইযে আপনি এখানে কি করছেন!
একটা বাচ্চার সাথে কথা বলছিলাম। পিছনে ঘুরে তাকালাম। একটা মেয়ে গম্ভীর হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমাদের কলেজে এমন একটা ম্যডাম ছিল। সবসময় গম্ভীর হয়ে থাকত। যখন তখন ক্লাসে এসে পড়া ধরতে শুরু করত। কেউ না পারলে ঝারি দিতে শুরু করত। ভাবখানা যেন, কত বড় অপরাধ করে ফেলেছে! আরে ভাই সবাই কি বিদ্যাসাগর নাকি! বইয়ের যে কোন জায়গা থেকে বলা যায়!
.
-কথা বলছেন না কেন!
এখনো সে গম্ভীর হয়ে আছে। আমার পরিচয় জানতে এত আগ্রহ কেন তার! তিনি মহিলা সি আই ডি নাকি!
-আমি জুবায়ের হাসান রাব্বি।
-ও! এটাই পরিচয়! আর কোন পরিচয় নেই!
আমি পকেট থেকে কার্ড বের করে দিলাম। কার্ডটা হাতে নিয়ে কিছুক্ষণ দেখল। রাস্তার পাশে সরে গিয়ে বলল
-এটা কি আসল কার্ড!
-মানে!
-মানে ভুয়া কার্ড হতে পারে এটা। আপনি শিশু পাচারকারী হতে পারেন!
এবারে রেগে গেলাম! এই মেয়ে বলে কি! রেগে বললাম
-আপনি কে বলুন তো! আমাকে দেখে পাচারকারী মনেহয়!
-হতেই পারে। নাহলে এখানে বাচ্চাদের সাথে এমন ছলাকলা করছেন কেন!
-ছলাকলা! আপনি তো আমার কার্ড দেখেছেন। আমি একটি সংগঠনের সাথে জড়িত।
-এইরকম ভুয়া কার্ড অনেক পাওয়া যায়। আপনার মতলব বলুন তো।
মেজাজ পুরোপুরি গরম হয়ে গিয়েছে। ইচ্ছা করছে মেয়েটাকে ধরে থাপড়াই। সে দেখতে যেমন সুন্দরি, তেমনি ত্যাড়াও বটে! কেউ এইরকম ত্যাড়ামি করলে মেজাজ খুব খারাপ হয়ে যায়।
.
-কিরে কি হয়েছে?
রাকিব ভাই এসে আমাকে থামিয়ে দিল। মেয়েটার সাথে তর্ক শুরু হয়ে গিয়েছিল। আমি জোরে কথা বলেছি। ঝগড়াটে মেয়ে কোথাকার! সেধে ঝগড়া করতে আসে! ওর সাথে কথা বলা থামিয়ে রাকিব ভাইয়ের দিকে চলে এলাম। সব ঘটনা বলতেই তিনি হাসতে শুরু করল। তার হাসি দেখে ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেলাম! হাসতে হাসতে বললেন
-আরে ও সুরাইয়া। আমাদের সাথেই কাজ করে। নতুন এসেছে; তোর সাথে পরিচয় করানো হয়নি।
সুরাইয়া নামের মেয়েটি আমার বোকা চেহারার দিকে তাকিয়ে হাসতে শুরু করল। এতক্ষণ সে আমার সাথে মজা নিচ্ছিল! আমি ঠিক বোকা হয়ে গিয়েছিলাম।
.
পোগ্রাম শেষ করে সবাই এক সাথে ঢাকায় ফিরলাম। একদিনে সুরাইয়ার সাথে ভাল সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। সবাই মিলে একসাথে কাজ করেছি। কাজ করতে করতে ওর সাথে অনেক কথা হয়েছে। যতদুর জেনেছি, মেয়েটা বেশ মিশুক। সহজেই মানুষের মাঝে মিশে যেতে পারে।
.
-আরে তুমি!
পিছন থেকে কেউ একজন পিঠ চাপড়ে দিল! ঘুরে তাকিয়ে মুচকি হাসি দিলাম। সুরাইয়া! এভাবে কেউ পিঠ চাপড়ে দেয়! ভেবেছিলাম কোন ছেলে বন্ধু! আমি বললাম
-আরে তুমি এখানে!
-এখানে আসা নিষেধ আছে নাকি!
-সেটা না। তোমার সাথে এভাবে দেখা হবে সেটা আশা করিনি।
-আমি ওইদিকে থাকি।
-আরে আমিও তো…
-জানি সব জানি।
-তাহলে আগে যোগাযোগ না করে এভাবে চমকে দিলে কেন!
সুরাইয়া আমার কথা থামিয়ে দিল। সে আমার সবকিছু জানে! এতদিনে সব জেনে ফেলেছে।
.
-মামা। আর কতদুর যাব?
রিক্সাওয়ালার কথা শুনে ভাবনার ছেদন ঘটল। বাসার কাছাকাছি চলে এসেছি প্রায়। পকেটের ফোন কাঁপছে সেটাও খেয়াল করিনি। সুরাইয়া ফোন করেছে! ফোন বের করে বললাম
-হুম। বলো।
-আমার ওষুধ কেনা লাগবে।
-আবার ফেলে দিবে বলে!
-আরে নাহ। এবারে খাব। তুমি এসে কিনে দিয়ে যাও।
রিক্সাওয়ালাকে ঘুরাতে বললাম। উনি আবার সুরাইয়ার বাসার দিকে যেতে থাকল।
.
সুরাইয়া বাসার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। ওর হাত থেকে প্রেসক্রিপশন নিলাম। সামনেই একটা ওষুধের দোকান। হাটতে হাটতে ওষুধ কিনে আনলাম। নিজের টাকা দিয়েই ওষুধ কিনলাম। আমার টাকার কেনা ওষুধ সে ফেলে দিবেনা। এর আগে একবার এইরকম হয়েছিল। তাই ওষুধ কিনে ওর হাতে দিয়ে আবার বাসায় রওনা দিলাম।
.
রাতের বেলায় বারান্দায় এসে বসলাম। ইজি চেয়ারটায় বসে পা দুলাতে বেশ মজা লাগে। নিজেকে মাঝে মাঝে রাজা ভাবতে শুরু করি। আমার রাজ্যে আমিই রাজা। নেই শুধু সাম্রাজ্য! ভেবে ঠোটের কোনে এক চিলতে হাসি ফুটে ওঠে। কিছু কিছু কাজের কারনে মুখে হাসি ফুটলে একটু পাগলামি মনেহয়। কখনো অন্যরকম পাগলামি করতে ইচ্ছা করে! সুরাইয়ার সাথে প্রেম করতে ইচ্ছা করে। নিয়মিত দেখা হবে আমাদের।
.
কখনো দেখা করতে দেরি হলে, সে গাল ফুলিয়ে থাকবে। কথা বলতে চাইবেনা। একটু পরে নিজে থেকেই কথা বলবে। বেশি ভালবাসবে বলে রাগ করে থাকতে পারবে না! কাধে মাথা রেখে হাতটা বাড়িয়ে দিবে! আমি ওর হাতের আঙ্গুলের ভেতর আমার আঙ্গুল দিয়ে বসে থাকব। চকলেট ওর খুব প্রিয়। নিয়মিত ওকে চকলেট কিনে দিব। চকলেট পেয়ে সে খুব খুশি হবে!
.
পাগলামিটা কল্পনায় থেকে যায়। ইজি চেয়ার আর বারান্দার মধ্যেই সিমাবদ্ধ থাকে! কোন এক বাধা থাকার কারনে বাস্তবায়ন করতে পারিনা! সুরাইয়া প্রেমে বিশ্বাসী না! সে নিজেই আমাকে বলেছে। একটা ছেলের সাথে ওর দুই মাসের সম্পর্ক ছিল। তার বিশ্বাসঘাতকতার কারনে অন্য কাউকে বিশ্বাস করতে পারেনা!
.
আমার স্বপ্নগুলো বড়ই বেয়ারা। বাস্তবায়ন হওয়ার চেষ্টা করে শুধু। বারবার মনের বাইরে বেড়িয়ে আসতে চায়! কিন্তু এক বাধার কারনে সেগুলো দমিয়ে রাখি। মনের কথগুলো আমায় কুড়েকুড়ে খায় কখনো! ছোটবেলায় একটা রুপকথার গল্প পড়েছিলাম। একজন লোক মনের কথা চেপে রাখতে রাখতে পেট ফুলে যায়।
আমার তেমন পেট ফুলে যাওয়ার দশা হয়েছে!
.
আজ কয়েকদিন পরে সুরাইয়ার সাথে দেখা হল। অসুস্থতার কারনে সে বাসা থেকে বের হতে পারেনি। অসুস্থ হয়ে ওর মুখটা শুকিয়ে গিয়েছে। দেখে আমার খারাপ লাগছে। জ্বরকে যদি কিছু বলে ঝারি দিতে পারতাম! তাহলে বেশ ভাল হত।
.
-কি দেখ এভাবে!
সুরাইয়া আমার পাশে বসে চকলেট খাচ্ছে। বাচ্চাদের মত ওর চকলেট খাওয়া দেখতে ভাল লাগে। মুখের সাথে লেগে গেলে আমার থেকে টিস্যু নিয়ে মুখ মুছে। ওর এসব বাচ্চামি মন দিয়ে দেখি! এখন ওর মুখ মুছতে টিস্যুর দরকার। একটা টিস্যু এগিয়ে দিয়ে বললাম
-মুছে নাও।
.
-আচ্ছা আমি তোমার কে হই?
আমার কথা শুনে সুরাইয়া চুপ হয়ে গেল। কিছুক্ষণ ভেবে বলল
-কেউ না তো!
ওর কথায় মন খারাপ হয়ে গেল। আমি ওর কেউ না! সিরিয়াস ভাবে বললাম
-আমি জানতে চাই আমি তোমার কে হই?
-বন্ধু।
-বন্ধু! এরচেয়ে বেশি কিছু নয়!
-না তো!
-যদি আমি বেশি কিছু হতে চাই!
-কি হবে!
-তোমার প্রেমিক হতে চাই।
.
কিছুক্ষণ নীরবতার মাঝে কেটে গেল। দুজনেই চুপ করে আছি। কারো মুখে কোন কথা নেই। হঠাৎ সুরাইয়া রেগে গিয়ে বলল
-তোমাকে এক থাপ্পড় দিব! তোমার সাহস হয় কিভাবে আমাকে প্রোপোস করার!
হঠাৎ করে সুরাইয়ার এমন ব্যবহারে চমকে গেলাম! ওকে হঠাৎ করে অচেনা লাগছে! এমন ব্যবহার কেন করছে! সুরাইয়া উঠে চলে গেল!
.
রাতের বেলা ইজি চেয়ারটায় বসে আছি। আজ কল্পনাগুলো মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে না। মনের কথাগুলো বাইরে বের হয়ে এসেছে। তবে নতুন এক অস্থিরতা কাজ করছে নিজের মাঝে। দুপুরবেলা সুইরাইয়ার ওইরকম ব্যবহার! তারপরে আমার সাথে যোগাযোগ করেনি! ইজি চেয়ারে পা দুলিয়ে নিজেকে রাজ্যহারা রাজা মনেহচ্ছে! কি যেন একটা নেই!
.
ফোনের মেসেজ টোন শুনে, ফোনটা হাতে নিলাম। জিপি কোম্পানির লোকগুলো যখন তখন মেসেজ দেয়! নতুন নতুন অফার তারা বানিয়েই রাখে!
মেসেজ ভিউ করে চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ালাম! সুইরাইয়া মেসেজ দিয়েছে! মেসেজে লেখা “এমনি এমনি কেউ প্রোপোস করলে রাজি হব না। তবে কদমফুল দিয়ে প্রোপোস করলে রাজি হব”
.
মেসেজটা পড়ে কিছুক্ষণ ভাবছি। দুপুরে আমাকে চমকে দেওয়ার জন্য এমন ব্যাবহার করেছে! এখন তো আমাকে কদমফুল জোগার করতে হবে! কিন্তু কোথায় পাব! মুখে ভালবাসি না বললেও কখনো ভালবাসা হয়ে যায়! মেয়েটা আমাকে চমকে দেয় হুট করে! না জানি আর কত চমকাতে হবে!
গল্পের বিষয়:
রোমান্টিক