বৃষ্টি পাগলি

বৃষ্টি পাগলি

—-জানেন আমি আর বেশিদিন বাচব না
ফেইসবুকে আমি কখনোই তেমন একটিভ ছিলাম না। এমনিই লগইন করে দু-একটা গল্প পড়তাম, কিছু লাইক কমেন্ট করতাম। আর মাঝে মধ্যো কিছু গল্প লেখার চেষ্টা করতাম। লেখক না হলেও, কিছু গল্প লেখার চেষ্টা করি। লিখতে ভালো লাগে, তাই লিখি। লেখক হওয়ার জন্য লিখি না। হঠাৎ কি মনে করে সেদিন রাত ১২ টার সময় ফেবুতে লগইন দিলাম। ভালো লাগছিল না, ঘুমও আসছিল না। হঠাৎ একটা মেয়ে আইডি থেকে এরকম মেসেজ পেয়ে কিছুক্ষণ আইডিটির দিকে তাকিয়ে থাকলাম।
না, এর সাথে আগে কখনো মেসেজ হয় নি। তবে আইডির নামটা চেনা চেনা লাগছে। তার আইডিতে গিয়ে চেক করলাম। মেয়েটা আমার লেখা গল্পের নিয়মীত পাঠিকা। অনেকদিন হলই লিস্টে আছে, কিন্তু কখনো মেসেজ করেনি। ততক্ষণে তার আবার আরেকটা মেসেজ……
—-আচ্ছা বলেনতো মানুষ কেন আত্নহত্যা করে? তারা কি জানেনা, কিছু মানুষ বাচার জন্য শত চেষ্টা করেও বাচতে পারেনা। আর তারা জীবনকে এতটাই তুচ্ছ মনে করে……
কি রিপ্লে দেব বা দেয়া উচিত বুঝতে পারছিলাম না। তার প্রশ্নের উত্তর আমার কাছে নেই। তাই আমি তাকে প্রশ্ন করলাম……
—-কেন কি হয়েছে আপনার?
—-জানিনা, মাথায় কি যেন সমস্যা। প্রচন্ড ব্যাথা করে। আজ ৯ মাস হল হাসপাতালের বেডে পড়ে আছি। এমন জীবন ভাললাগে না। কিন্তু আমি বাচতে চাই……
—-হুম বিশ্বাষ রাখেন, বাচবেন। ভবিষ্যতের খবর কেউ জানেনা। ডাক্তারের সব কথাই কখনো সত্য প্রমাণিত হয়না।
—-তা হয়না, তবে কেন ডেন মনে হয় আমি আর বাচব না।
—-ওসব চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলুন। আর এতরাত পর্যন্ত ফেইসবুক না চালিয়ে ঘুমিয়ে পড়ুন……
মেসেজটা সিন হল না। ততক্ষণে সে অফলাইনে চলে গেছে। রাতটাও কিছুটা বেড়ে গেছে, তবুও আমার ঘুম এল না। ততক্ষণে আমার চিন্তাই যোগ হয়েছে……
কি অদ্ভুত খেলা! কেউ বাচতে চেয়েও বাচতে পারে না। আবার কেউ কত সহজে জীবন ত্যাগ করে।

আমি রাজ। অনার্সে পড়াশোনা করছি। ছাত্র হিসেবে খারাপ না। গ্রামের ছেলে হলেও শহরে এসে লেখাপড়া করছি নিতান্ত জেদের বশে। পার্টটাইম জব, সাথে লেখাপড়া জীবন বলতে আমার এতটুকুই। বাড়িতে বাবা-মা আর বড় ভাই। সুখেই আছে তারা। বাড়িতে তেমন যাতায়াত খোজ-খবর নেয়া হয়না। জীবনটা যান্ত্রিক হয়ে গেছে।

গত ৫-৭ দিন খুব ঝামেলা গেছে। একটা গল্প লেখাও তো দূড়ে থাক, ফেবুতেই লগ-ইন করেনি। লগ-ইন করলাম। দু-একটা মেসেজ ছিল,সেগুলোর রিপ্লে দিলাম। নতুন একটা গল্প পড়ছিলাম, পড়া শেষে রিফ্রেশ করে দেখি সেই মেয়েটির মেসেজ……
—-জানেন আমাকে কেউ ভালবাসে না! বাবা-মা ভালবাসে, কিন্তু মানুষ তো এর বাইরেও কারো না কারো ভালবাসা চাই। যার সাথে সে রাগ-অভিমান সব করতে পারবে, তাইনা?
—-হুম,
আন্তরিকতার খাতিরে প্রশ্ন করলাম……
—-কেমন আছেন? (যেহেতু সে অসুস্থ)
—-তেমন ভালো ছিলাম না, তবে এখন একটু ভালো লাগছে……
—-মানে?
—-আচ্ছা, আপনাদের ওখানে কি বৃষ্টি হচ্ছে………
—-কই না তো!
—-এখানে হচ্ছে, জানেন আমার খুব ইচ্ছা বৃষ্টিতে ভেজার। কিন্তু এখন বাইরে বেরুতে পারি না। এই বেডটাই আমার সব হয়ে গেছে…… হা হা হা……
সে বাইরে বৃষ্টির দৃশ্য ছবি তুলে দিল।
—-হুম, সত্যিই ভেজার মত বৃষ্টি!
—-আপনি কি বৃষ্টিতে ভিজতে ভালবাসেন? আমার দারুণ লাগে, আমার খুব ইচ্ছা আমার সেই মানুষটার সাথে একসাথে বৃষ্টিতে ভিজব।
মেয়েটা এমন এমন প্রশ্ন করত, যার কোন উত্তর দেয়া যেত না। ডে সব প্রশ্নের উত্তর দেঢা যায় না বা আমার কাছে ছিল না। অগত্যা ফেইসবুক থেকে লগআউট করে বেরিয়ে আসতাম।

সেই থেকে শুরু, মেয়েটার সাথে রেগুলার চ্যাট হত। ততদিনে অনেক পরিচয় পর্ব শেষ। এখন অনলাইনে আসলেই সে মেসেজ করে। আমিও করি। যে আমি ফেইসবুকে তেমন একটিভ ছিলাম না, সেই আমি সুপার একটিভ হয়ে গেলাম। নিয়মিত গল্প লেখা শুরু করলাম। তার সাথে চ্যাট না করলে নিজেকে অপরাধি মনে হত। কারণ সে বলেছিল, জানেন, আপনিই আমার একমাত্র বন্ধু! আর আপনার সাথে চ্যাট করলে ভাললাগে। অবশ্য ততদিনে ফোনে কথা বলাও শুরু হয়ে গিয়েছিল। কিভাবে যেন তার সাথে জড়িয়ে পড়ছিলাম। অথচ আমি তাকে দেখেনি, কখনো সে তার ছবিও দেয় নি। আমাদের চ্যাটিংয়ের প্রায় ৭-৮ মাস কেটে গেছে।
—-আপনার কি কেন গার্লফ্রেন্ড আছে……?
—-না
—-আমারো কোন প্রেমিক নাই। অবশ্য এই অসুস্থ মেয়েকে কে ভালবাসবে?
তার অনেকগুলা ছবি দিল। সবগুলাই হসপিটালের বেডে শুয়ে বা বসে আছে এরকম ধরনের। মেয়েটা হ্যাংলা পাতলা চিকন। একেবারে চিকন না, দেখতে তেমন অসুস্থও বুঝা যায় না। চেহাড়াটা সুন্দর, চোখদুটো আরো সুন্দর। তাকে দেখে পুরো সুস্থ মানষ মনে হল!
আমি মেসেজে লাইক বাটন টিপে দিয়ে বেরিয়ে পড়লাম।
রাতে তার ফোন……
—-হ্যালো……
—-হুম বলেন……
—-আচ্ছা আপনি কি সবসময়ই কখা কম বলেন……
—-না, তবে চেষ্টা করি। আপনার অসুখের কি অবস্থা?
—-আর খুব বেশিদিন নাই! চলে যেতে হবে দৃষ্টির অগোচরে……
—-আপনার ছবিগুলো দেখে কিন্তু, আপনাকে খুব সুস্থ মনে হল!
—-আসলে আমি দেখতেই ওরকম!
—-ওহ্
—-আচ্ছা আপনি কি আমাকে ভালবাসবেন?
—-সরি, কি বলছেন এসব?
—-কেন, আমাকে পছন্দ হয়না? নাকি অসুস্থ আর মারা যাবে বলে……
—-আসলে তেমনটা না……
—- তাহলে কেমনটা?
—- ভাবতে হবে……
—-ভাবুন, হয়ত একজন মূত্যু পথযাত্রীকে খুশি করতে পারবেন!

আমি ভাবলাম। অনেক ভেবে দেখলাম, তাকে ভালবাসলেই কি বা না বাসলেই কি? সে কিছুদিনের ভিতরে মারাই যাবে!! তাই তাকে খুশি করার জন্য কয়েকদিন না হয় অভিনয় করলাম!……
তাকে হ্যা বলে দিলাম। মাত্র কিছুদিন যেতে না যেতেই একদিন……
—-চলো আমরা বিয়ে করে ফেলি!
—-কি বলছ এসব?
—- ঠিকই তো বলছি। জানো, আমার খুব ইচ্ছা ছিল মূত্যুর আগে তোমার সাথে আমার বিয়ে হবে, বাসর হবে। তোমার বাহুতে মাথা রেখে একটা রাত ঘুমানোর খুব ইচ্ছা আমার। তোমার সাথে এক বৃষ্টিতে ভেজার খুব ইচ্ছা আমার! আমার এই শেষ আশাটুকু পূরণ কর প্লিজ………
আমি কিছু ভেবে পেলাম না। হ্যা করলেও বিপদ, না করলেও বিপদ!!
—-কিন্তু তোমার বাবা-মা?
—-তারা আমার অমত হবে না। আর তোমার বাবা-মাকে আমি মেনেজ করব। তাদের নাম্বারটা দিও……
তারপরে কিভাবে কি হয়ে গেল কিছুই বুঝতে পারলাম না। আমার বাড়িতে বলে রাজি করিয়েছে। মা সুধু একবার ফোন দিয়ে বলল মেয়েটার কথা আগে বলিস নি কেন? আমরা কি না করতাম?
বউকে নিয়ে আসিস!!
তারপরে এখন আমি বাসরঘরে। আমার শুশুরবাড়িতেই আমার বাসর হচ্ছে। বাসর ঘরে বউ আগে গিয়ে থাকে, কিন্তু এখানে আমি তার উল্টো! আমিই আগে গিয়েছিলাম। রুমে গিয়ে তো অবাক, এ তো সেই রুম! যে রুমের বেডে থাকা অবস্থার ছবি সে আমাকে দিয়েছিল।
তার আগমন হল……
—-চল দু-রাকাত নামাজ পড়ে ঘুমিয়ে পড়ি। দুজনাই ক্লান্ত! তুমি তো বেশিদিন বাচবে না……
—-কেন, তুমি কি চাওনা আমি বেশিদিন বাচি?
—-হুম চাই, চাইলেই কি আর সব হয়?
—-আমাকে মাফ করে দিও, আমি তোমার কাছে মিথ্যা বলে অভিনয় করেছি!
—-মানে?
—-আসলে আমার কোন অসুখ নেই। সবই তোমাকে পাওয়ার জন্য অভিনয় করেছি!!
—-অভিনয়!
—-হ্যা, তুমি খেয়াল করনি আমাদের প্রথম সাক্ষাৎটা কলেজে হয়েছিল। তুমি তাড়াহুড়ো করে কি যেন করছিলে। কোথাও যাচ্ছিলে, আর আমি সেদিন ট্রান্সফার ছার্টিফিকেট নিতে গিয়েছিলাম। তোমার সাথে আমার ধাক্কা লাগে, আমার কাগজগুলো পড়ে এলোমেলো হয়ে যায়। কিন্ত তুমি সেদিবে ভ্রুক্ষেপ না করেই চলে যাও!!
এরপরে, সেদিন রাস্তায় যে মেয়েটাকে তুমি হেল্প করতে গিয়ে কতিপয় ছেলের হাতে মার খেলে? সে মেয়েটা আমিই ছিলাম। তুমি অজ্ঞান হয়ে গেলে। আমি হসপিটালে নিয়ে গেলাম। তারপরে তোমাকে ভর্তি করে বাড়িতে যাই, যখন তোমাকে শুভেচ্ছা জানানোর জন্য আসি, ততক্ষণে তুমি চলে গেছ!
তোমার ব্যাপারে খোজ-খবর নেই। জানতে পারি তোমার সম্পর্কে। তোমার ফেইসুক আইডি নেই। পরে দেখি, আমি তোমার ফ্রেন্ড লিস্টে আছিই! এবং তোমার গল্প রোজ পড়ি, ভাললাগে। তোমার গল্পের কাল্পনিক নায়িকা চরিত্রের নামটা কিন্তু আমারই!!
—-কিন্তু এর জন্য এত অভিনয় না করলেও তো হত……
—-হুম, তবে একটু কষ্ট হত। কেননা একে তো তুমি মেয়েদের তেমন দেখতে পারনা! কারো সাথে কথা বল না। ফেবুতেও তেমন রিপ্লে দাও না!! তাই এভাবেই আরকি………
ওকে কি বলব বা কি করা উচিত কিছুই বুঝতে পারলাম না। এতটা ভালবাসা পাওয়ার যোগ্য আমি না। তারপরেও ওর মত একটা মেয়ে!!
তখন বাইরে বৃষ্টি হচ্ছিল। কিছু বুঝে উঠার আগেই ও টানতে টানতে বাইরে নিয়ে গেল। দুজনা ভিষণ ভাবে ভিজলাম। যদিও প্রথমে ভিজতে রাজি হয়নি। তারপরেও কিছু করার ছিল না। ভেজা শেষে দুজনা রুমে এসে ফ্রেশ হলাম। সেদিন রাতটা সত্যিই ও আমার বুকে বাহুতে মাথা রেখে ঘুমালো। আমি ওর চুলের ভিতর দিয়ে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে ভাবছিলাম……
সত্যিই জীবনটা কি অদ্ভুত!

গল্পের বিষয়:
রোমান্টিক
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত