অফিস থেকে ফিরে আজ একটু বেশি ক্লান্ত লাগছে। আর লাগবেই না কেন গত রাতে এক কিউট পাগলির মিষ্টি কথোপকথনে প্রায় সাড়ে চারটা বেজে গিয়েছিল। ভেবেছিলাম আজ দশটায় অফিসে যাবো। কিন্তু তা আর হয়নি। সকাল আটটা না বাজতেই স্যারের ফোন। রিসিভ করতেই, অনয় সাহেব আজ সাড়ে আটটার মধ্যে অফিসে থাকবেন। একটা গুরুত্বপূর্ণ অডিটে যেতে হব। আর আমি নিরুপায় হয়ে সম্মতি জানাতেই ফোনটা কেটে দিলেন।
আমিও ভদ্র ছেলের মতো যথাসময়ে অফিসে উপস্থিত হয়ে গুরুত্বপূর্ণ অডিট শেষ করে একটু আগেবাগেই বাসায় চলে এসেছি। ফ্রেস হয়ে ক্লান্ত শরীরটাকে বেলকনির ইজি চেয়ারে এলিয়ে দিয়েছি আর ভাবছি রাতের সেই কিউট মিষ্টি পাগলিটার সাথে কথা বলব। কিন্তু বেলকনির গ্রিলের ফাক গলিয়ে চোখের দৃষ্টি একটু বাইরে যেতেই কিছু একটা দেখে থমকে দাড়াল।
একটু স্থির দৃষ্টি দিতেই দেখতে পেলাম কাটা ঘুড়ির সুতো। মুহুর্তের মধ্যেই সাপলুড়ুর সাপের মুখে পা দিয়ে সোজা লেজে নেমে এলাম। সেই ফেলে আসা স্মৃতি বিজোড়িত শৈশবের খেলাগুলোর কথা মনে হতেই যেন এক আনন্দশ্রোত বয়ে গেল মনের গহীন অরন্যে। ঘুড়ি উড়ানো, ডাংগুলি, মার্বেল, সাতচাড়া, দাড়িয়াবান্ধা, হাডুডু, গোল্লাছোট ছিল উল্লেখযোগ্য খেলা। বল না পেয়ে কাগজ আর ছেড়া কাপড় দিয়ে বানানো বলে বোমফাইট খেলাটাও নেহাত মন্দ ছিল না। বউছি খেলায় নেয়নি বলে খালাতো বোনকে যে বেদড়ক পিটিয়েছিলাম তা মনে হলে আজও হাসি পায়।
আমার খেলোয়াড়ি জীবন ছিল ব্যর্থতার ইতিকথা। বিজয়ে অট্টহাসিতে মাততে পেরেছি খুবই কম। তবুও নেশা তো নেশাই। প্রতিনিয়ত হারও আমাকে নেশা হতে আটকাতে পারে নি। তবে ঘুড়ি ওড়ানোর নেশাটা একটু বেশিই ছিল। প্রতিদিন বিকালে আকাশে রংবেরংয়ের ঘুড়ি গুলো আমাকে বাড়ির বাহির হতে বাধ্য করতো। নানা কথা বলে মার কাছ থেকে টাকা নিয়ে নাটাই, সুতো আর ঘুড়ি কিনেছি। সুতা মাঞ্জা দেয়ায় কাচা ছিলাম বলে কখনো সুতো কাটার রেসে অংশ নিতাম না। চাইতাম সবার থেকে উচুতে উড়িয়ে নীল আকাশ ছুতে। তবে আমি অংশ না নিলেও আমার ঘুড়ি প্রায় সময় নামিয়ে আনতে সক্ষম হতাম না। কোন এক রাক্ষুসে ঘুড়ি এসে আমার ঘুড়ির সুতা কেটে দিয়ে চলে যেত। আর আমার ঘুড়ি হারিয়ে যেত দুর অজানায়। পিছু নিলেও কখনো খোজে পেতাম না কারন আগে থেকেই উতপেতে থাকতো দুষ্টু ছেলের দল কাটা ঘুড়ি ধরবে বলে। আর যে প্রথম ধরতে পারবে ঘুড়িটা তারই। প্রায়ই সময়ই ঘুড়ি হারাতাম বলে চুরি বিদ্যাটাও রপ্ত করেছিলাম।
মার কাছ থেকে চুরি করে টাকা নিতাম। যখন পারতাম না আমিও যোগ দিতাম দুষ্ট ছেলেদের দলে আর অপেক্ষায় থাকতাম কাটা ঘুড়ির। আকাশে লাল, নীল, হলুদ, বেগুনীসহ আরও নানা বর্ণের ঘুড়ি। সুতা কেটে উড়েও আসতো। কিন্তু আমার ভাগ্য কখনই সুপ্রসন্ন ছিল না। তাই আমার ভাগ্যের শিকে ছিড়েনি কখনো। একদিন স্কুল থেকে খালাদের বাড়ি হয়ে বাড়ি ফিরছি।
হঠাৎ আমার পায়ে সুতোর টান। নিচে তাকাতেই দেখি সত্যি তো কাটা ঘুড়ির সুতো। চারদিক ভালভাবে দেখে নিলাম কেউ আছে কিনা। সেদিন আমার ভাগ্য সুপ্রসন্ন ছিল তাই হয়তো কাউকে দেখতে পেলাম না। আমি আনন্দে আপ্লোত হয়ে ব্যাগ থেকে খালি পানির বোতল বের করে তাতে সুতা পেচাতে পেচাতে ঘুড়ির সন্ধানে এগিয়ে যাচ্ছি। কিছুদুর যাওয়ার পরই কাঙ্খিত ঘুড়ির দেখা পেলাম। একটা লাল ঘুড়ি আম গাছের ডালে আটকে আছে।নিচে বিশাল পুকুর। আমি আমার কাধের ব্যাগ, জুতা আর সুতা পেচানো বোতল পুকুরের পাড়ে রেখে একটা লম্বা কঞ্চি নিয়ে আম গাছে উঠেছি। নাগাল পাচ্ছি না দেখে আরোও একটু উপরে উঠে চেষ্টা করছি।
প্রায় নাগালের মধ্যে এসেছে এমন সময় একটা শব্দ। কিছু বোঝে ওঠার আগেই আমি ঘুড়ি সমেত পুকুরের পানিতে। ভাগ্যিস গাছের নিচে পুকুর ছিল তাই আমি বেচে না হলে ঘুড়ির সাথে সাথে আমারও প্রাণ ভোমরা বেরিয়ে যেত। গাছের ডাল ভাঙ্গার শব্দে পাশের বাড়ি থেকে মানুষ বেরিয়ে এসেছে। আমি ততক্ষনে পাড়ে ওঠে এসেছি। মানুষ বের হতে দেখে আমি ব্যাগ, বোতল আর জুতা হাতে নিয়ে দিয়েছি ভো দৌড়। কার সাধ্য আর আমায় খোঁজে পায়।
সাপলুডুর মই বেয়ে উপরে উঠে এলাম। বেলকনির গ্রিলের ফাক দিয়ে কাটা ঘুড়ির সুতাটাকে হাতের নাগালে আনার চেষ্টা করলাম। ব্যর্থ হয়ে চার্যারের লম্বা তারের সহায়তা নিলাম। সুতা হাতে পেয়ে টেনে আনার চেষ্টা করলাম। কিন্তু আনতে ব্যর্থ হলাম। দুই পাশেই আটকে আছে। ছোট সময়ে হলে হয়তো ঘুড়ি উদ্ধারের অপারেশনে বেরিয়ে পড়তাম। এখন পারব না তাতে কি অন্য কেউ যেন সহজে নিতে না পারে তাই টেনে এনে সুতাকে গ্রিলে বেধে রাখলাম। আর আমার ভাঙ্গা টোনে গুনগুনিয়ে সুর দেয়ার চেষ্টায়,
“যে দিন গুলি আমি ফেলে এসেছি… এ জীবনে কভু আর ফিরে পাবো কি…”