ফয়সাল আদ্রিতার ভালোবাসার সম্পর্ক এক বছর পেরিয়ে দুই বছরে পা দিচ্ছিল।দিচ্ছিল বললাম এ জন্যই কারণ তাদের নিষ্পাপ ভালোবাসার হয়ত আজই ইতি ঘটতে যাচ্ছে। আদ্রিতা এসব আনমনে ভাবছে আর এক দৃস্টিতে আয়নার দিকে তাকিয়ে আছে।এরই মধ্যে মোবাইলের ভাইব্রেট বেজে ওঠল,ফয়সালের ফোন।ফোন ধরতেই ওপাশ থেকে বলে উঠল-
-\-\হ্যালো,ময়না পাখি (ফয়সাল ভালোবেসে ওকে ময়না পাখি ডাকে)
-\-\হ্যা কিউটির বাপ (আদ্রিতা ফয়সালকে কিউটির বাবা বলেই ডাকে)
-\-\বিকালে দেখা করতে আসবে তো??
-\-\হ্যা গো কিউটির বাবা,আসবো।
-\-\ভার্সিটির সেই বকুল ফুল গাছটার নিচে থাকবে কিন্তু।
-\-\ঠিক আছে থাকব।তুমি লেট করো না কিন্তু,আমি আবার ১ঘন্টার বেশি থাকতে পারব না।হবু শশুর-শাশুরী দেখতে আসবে আমায়।
-\-\ ……………
-\-\ কি হল কথা বলছ না যে?
-\-\ ওকে ময়না পাখি,আমি ঠিক সময়েই আসবো।এখন তাহলে রাখছি,,হ্যা??
-\-\ শুনো,,,,
-\-\ হ্যা বলো
-\-\ না থাক।এখন তাহলে রাখছি।
বলেই আদৃতা ফোন রেখে দিল।আর এদিকে ফয়সালের বুকের বাম পাশটায় চিনচিনে ব্যাথা অনুভব করতে থাকল।সে জানে ফোন রাখার পর পাগলিটা ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদছে।এসব ভাবতে ভাবতেই এক বছর পূর্বে ফিরে গেল ফয়সাল।সবেমাত্র ভার্সিটি ভর্তি হয়েছে সে।বন্ধুবান্ধব বলতে গিটারটাই।বন্ধুবান্ধব তখনও তেমন হয়নি।রোজ সে ক্লাস শেষ করে বকুল গাছটার নিচে গিয়ে গিটার দিয়ে টুংটাং আওয়াজ তুলতো।ভালোই বাজাতে জানে সে। বাসায় যাওয়ার সময় বেশ কিছুদিন খেয়াল করল আদৃতা।একদিন তো পাশে এসে বসেই পড়ল।সেদিন বেশ খানিকটা হকচকিয়ে গেছিল ফয়সাল।এর আগে যে কখনোই মেয়েদের সংস্পর্শে আসেনি সে,কারণ সে একজন গ্রামের ছেলে।শহরের মত গ্রামে ছেলেমেয়েদের এতটা মেলামেশার সুযোগ নেই।
আর গ্রামের সবাই ফয়সালকে ভদ্র বলেই জানত,তাই সেও নিজেকে সবসময় এ সব থেকে দূরে রেখেছিল।
হঠাত করেই সুরটা বন্ধ করে দেয় ফয়সাল।আদৃতা তখন বেশ মুগ্ধতার সাথে বলে- বাহ সুন্দর বাজাওতো তুমি!! আদৃতা ছিল শহরের মেয়ে,তাই সংকোচবোধ তার কম ছিল।ফয়সাল জবাবে বলে,চেষ্টা করি একটু একটু।বলেই মুচকি হাসি দিল।তারপর তারা একে অপরের সাথে পরিচিত হয়ে চলে গেল।
যদিও তারা একই ডিপার্টমেন্টে ছিল না,তবুও তাদের রোজ দেখা হত।একসাথে হৈহুল্লোড়,রিকশায় করে ঘুরা,আড্ডা এসব তাদের দৈনন্দিন রুটিন ছিল।এরই মধ্যে আদৃতা ফয়সালের প্রতি দুর্বল হয়ে পড়ে,ফয়সালও যে ছিল না তা নয়।কিন্তু তা সে প্রকাশ করত না, কারণ সে জানে আদৃতা কেমন ফ্যামিলির মেয়ে।বিপরীতে সে একজন সামান্য কৃষকের ছেলে।তাই তো তাকে অনেক কিছুই ভাবতে হয়,গরীবের জন্য যে সব চাওয়া পাওয়া নয় তা এই বয়সে শিখে ফেলেছে ফয়সাল।
হঠাত করেই আদ্রিতার ফোন আসে।ফোনটা রিসিভ করে কথা বলছে ফয়সাল।
-\-\হ্যালো ময়না পাখি
-\-\হ্যা কিউটির বাপ,,, আমি বাসা থেকে বের হচ্ছি।তুমি চলে এসো।
-\-\ আমিও বের হচ্ছি।
-\-\ফয়সাল।আমার একটা কথা রাখবে?
-\-\ কি কথা,বলো প্লিজ।
-\-\আসার সময় নীল পাঞ্জাবীটা পড়ে আসবে।কি আসবে না???
-\-\ওকে আসব,বায়
-\-\বায়।বলে রেখে দিল আদৃতা।
নীল রঙ ওদের দুজনেরই খুব প্রিয়।তাই যেকোনো স্পেশাল দিন গুলোতে ওরা নীল রঙ পরত।যদিও আজ স্পেশালের কোনো ছোয়াই নাই তবুও শেষবারের মত আদ্রিতা পুরনো সেই স্মৃতিকে খুজার চেষ্টা করে যাচ্ছে।বড্ড বেশিই করে ফেলেছি ওর সাথে।কিন্তু তাই বলে কি আমি ক্ষমার যোগ্য না।হয়ত বা না,তা নাহলে কেন সে ক্ষমা করল না আমায়??বার বার একই প্রশ্ন করে যাচ্ছে নিজেকে,আর গাড়ী ড্রাইভ করছে।সবকিছুর অবসান ঘটিয়ে গাড়ী এসে থামল বকুল গাছটার নিচে।ফয়সাল এখনো আসেনি।তাই আদ্রিতা গাছটার নিচে বসে অপেক্ষা করতে থাকে।গাছটা আজও আগের মতই আছে,সাদা ফুলে ভরে আছে গাছটার প্রতিটা ডাল।আরও যুগ যুগ হয়তো দাঁড়িয়ে থাকবে গাছটা,ফুলে ফুলে ভরে উঠবে ডালপালা।শুধু থাকবে না ডানা মেলা একজোড়া দুরন্ত পাখি।এইসব ভাবতে ভাবতে কিছুটা আনমনে হয়ে গিয়েছিল আদৃতা।কখন পাশে এসে বসে আছে ফয়সাল,আদৃতা বিন্দুমাত্র টেরও পায়নি।ফয়সালই সর্বপ্রথম কথা বলে,এতে ভাবনার জগৎ থেকে ফিরে আসে আদৃতা।
-\-\ কখন আসলে তুমি???
-\-\ এইতো সবেমাত্র।আমি দুঃখিত লেট হওয়ার জন্য।
একদৃস্টিতে তাকিয়ে আছে আদ্রিতা,ফয়সালের মুখের দিকে।ফয়সাল মাথা নিচু করে বসে আছে।সে জানে আজ অনেক প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হবে তাকে।দুজনেই নিরব,নিস্তব্ধ।সকল নিরবতার অবসান ঘটিয়ে আদ্রিতা বলে উঠে
-\-\ তোমার ইচ্ছেতেই বিয়েটা করতে যাচ্ছি।এবার নিশ্চয়ই তুমি খুব হ্যাপি??
-\-\ বুকে শত চাপা কষ্ট রেখেও ফয়সাল একটা সুখের হাসি হেসে বলেছিল”হ্যা আজ আমি অনেক হ্যাপি।” আর একটা ধন্যবাদ জানাতেও ভুল করেনি সে।
-\-\ জানতে চাইব না কি আমার ভুল ছিল,কিন্তু আমি কি ক্ষমার যোগ্য ছিলাম না??(ফয়সালের কলারটা অনেকটা শক্ত করে ধরে)
-\-\ ফয়সাল তখন নিজেকে সামলে নিয়ে নিজের পুরোটা অপরাগতা স্বীকার করে ছিল।
এই প্রশ্নের জবাব ছিল ফয়সালের কাছে,কিন্তু ইচ্ছে করেই দিতে রাজি না সে।
কী লাভ তাতে,কথাগুলো বলে নিজের কষ্টের পাল্লাটাকে ভারী করতে চায় না সে।হাজারো কষ্টের মাঝে ফয়সাল বলে উঠে
-\-\ তোমার সকল প্রশ্নের জবাব আমার কাছে আছে কিন্তু আমি তার জবাব দিতে চাচ্ছি না।তবে যেদিন থেকে তোমাকে ভালোবেসেছিলাম সেদিন থেকে আজ অবধি তোমার মঙ্গল ছাড়া অন্য কিছু আশা করিনি,আজও তার ব্যতিক্রম কিছু আশা করছি না।তুমি তোমার নতুন সংসার নিয়ে সুখি হও,আমি শুধু এটিই চাই।
-\-\ কোন কথা বলছে না আদৃতা।হয়ত অতি শোকে পাথর হয়ে গেছে সে।
দেখতে দেখতে কখন যে একঘন্টা পার হয়ে গেছে তা দুজনের একজনেও টের পায় নাই।
সবশেষে আদ্রিতা শুধু বলেছিল আমাকে একটু শক্ত করে জড়িয়ে ধরবে??
ফয়সাল ধরতে গিয়েও কেন জানি ধরতে সাহস পেল না।আদ্রিতা শুধু বলেছিল ওহহ বুঝতে পেরেছি সেই অধিকারটুকুও যে আমার নেই।এই বলেই কাদতে কাদতে গিয়ে গাড়িতে ওঠে গেল।
ফয়সাল মূর্তির ন্যায় দাঁড়িয়ে ছিল আর পাথর দৃস্টিতে আদ্রিতার চলে যাওয়া দেখছিল।সময়ের স্রোতে গাড়ীটাও অদৃশ্য হয়ে যেতে থাকল।
এখন ফয়সাল চিৎকার করে কাদবে,আর বকুল গাছটা সেই বুকফাটা কান্নার বাস্তব সাক্ষী হয়ে থাকবে।এই কান্না কী আদ্রিতার কানে গিয়ে পৌছাবে??
বিঃদ্রঃ ফয়সাল তার বাবামার একমাত্র সন্তান।ফয়সালের জন্মের সময় তার মা মারা যায়।ফয়সালের বাবা আর কোন বিয়ে না করে নিজেই ছেলেকে মা এবং বাবার ভালোবাসা দিয়ে বড় করে তুলেন।তার বাবার তেমন কোন জমিজমা ছিল না।সে অন্যের জমিতে কাজ করে তার ছেলেকে মানুষ করতে থাকে।ঝড় বৃস্টি অসুস্থতাকে উপেক্ষা করে তার ছেলের মুখে খাবার তুলে দিত,লেখাপড়ার জন্য খাতা কলম কিনে দিত।তবুও ফয়সালকে দিয়ে কোনদিন কাজ করাত না।আদ্রিতার সাথে ভালোবাসার সম্পর্কে জড়ানোর পর থেকেই তার খরচ ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পেতে থাকে।আর তার জন্য সে তার অসহায় দরিদ্র বাবাকে চাপ দিতে থাকে।আজ এই ফি,কাল অই ফি,পরশু সেই ফি এসব ফি এর নামে তার হতদরিদ্র বাবার উপর সে শোষণ চালাতে থাকে।সে একটি বারের জন্যও ভাবেনি সারাজীবন হাড়ভাংগা পরিশ্রম করা এই লোকটি কত্থেকে তাকে টাকা দেবে।তবুও তার বাবা হাসি মুখে সব টাকা ঠিকি জোগাড় করে দিত।আর এই কস্টের টাকা নিমিষেই ভালোবাসার মানুষটিকে সুখি করতে খরচ করে ফেলত।
একটি বারের জন্যও তার বাবার ঘামে ভেজা মুখটি তার চোখের সামনে ভেসে উঠত না।সর্বশেষ যখন আদ্রিতা তার জন্মদিনে ফয়সালের কাছে আইফোন চেয়ে বসে,তখন ফয়সাল তার বাবাকে টাকার জন্য চাপ দিতে থাকে।তার বাবা গ্রামের মাতাব্বরের কাছে গিয়ে তার ভিটাবাড়ি বন্ধক রেখে টাকা জোগাড় করতে যায়।কিন্তু মাতাব্বর তাকে টাকা দিতে অসম্মতি জানায় কারণ পাওনার খাতা বিশাল বড় হয়ে গেছে।তাই মাতাব্বর তাকে সাফ জানিয়ে দেয় সে আর কোন টাকা পয়সা দিতে পারবে না।মাতাব্বরের অনেক হাতে পায়ে ধরেও কাজ হলনা।কিন্তু সে নাছোড়বান্দা। একসময় মাতাব্বর রাগান্বিত হয়ে লাথি মারে,আর তাতে ছিটকে গিয়ে কাঠের চেয়ারের সাথে মাথায় আঘাত লাগে এবং তিনি কুমায় যান।এই ঘটনার পর ফয়সালের বিবেক জাগ্রত হয়,নিজেকে নিজে প্রশ্ন করতে থাকে,তার গরীব বাবা তাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখেছিল সেটা কি তার অপরাধ ছিল??সে কি তার বাবার নিরবে হু হু করে কেদে ওঠা মুখটা কখনো বুঝার চেষ্টা করেছিল??
তাহলে কি ফয়সাল তার বাবার স্বপ্নের সুমানুষ হতে পেরেছিল???
ফয়সাল আর কিছু ভাবতে পারে না।
আসল ভালোবাসা তো তার বাবা তাকে বেসেছিল,সেই ভালোবাসা তো সে দেখতে পারেনি,তাহলে দুইদিনের পরিচয়ে একটা মেয়েকে সে কি করে ভালো রাখবে,ভালোবাসবে।
আর এই সব অপরাধবোধ তাকে প্রতি নিয়ত খুড়েখুড়ে খাচ্ছে।কারোর ভালোবাসা পাবার কিংবা কাওকে ভালোবাসার কোন অধিকারি যে আজ তার নাই।আর তাই আজ সে পাগল প্রায়।
গল্পের বিষয়:
রোমান্টিক