দুষ্টু ছেলের ভালবাসার গল্প

দুষ্টু ছেলের ভালবাসার গল্প

প্রতিদিনের মত মোড়ের এই টং দোকানটার কাছে এসেই আমার মেজাজ গরম হয়ে যায়। বদমাইশ
ছেলেগুলো রোজ একই টাইমে এখানে বসে থাকবে। ফেল ফেল করে তাকিয়ে থাকবে আর মিট-মিট করে হাসবে। দেখে মনে হয় জীবনে কোন মেয়ে মানুষ দেখে নাই। যেন ভিনগ্রহের কোন প্রাণী রাস্তা দিয়ে হেটে যাচ্ছে। ইচ্ছে করে প্রত্যেকটার দুই গালে দুটি করে থাপ্পড় দিয়ে জিজ্ঞেস করি. তোদের খেয়ে-দেয়ে কাজ নাই? প্রতিদিন এক-ই টাইমে এখানে বসে থাকিস কেন? আমাকে কি এলিয়েন মনে হয়? কিন্তু পারছিনা। প্রতিদিনের মতো আজও দেখেও না দেখার মতো চলে যাচ্ছি।
আজ এমনিতেই মেজাজ গরম। দশ মিনিট দরে দাড়িয়ে থেকেও কোন রিক্সা না পেয়ে হেটে কলেজে যাচ্ছি। রিক্সা ওয়ালারা মনে হচ্ছে আজ কাল প্রাইভেট কার ওয়ালা হয়ে গেছে। এখন তারা রিক্সা চালায় না প্রাইভেট কার চালায়।
—এক্সকিউজ মি আপু।
আমি পিছন ফিরে তাকালাম। টং দোকানের ঐ বদমাইশ গুলোর একটি পিছনে দাড়িয়ে।
—আপু আপনার সাথে আমার একটু কথা ছিলো।
মাথায় এলোমেলো চুল। দেখে মনে হচ্ছে গত দুই সপ্তাহ ধরে মুখের দাড়ি কাটে না।
—কি কথা?
মুখ থেকে একটু আগে খেয়ে আসা সিগারেটের ধোঁয়া বেড়িয়ে আসছে। কপালে ফুটা ফুটা ঘাম। মনে হচ্ছে এই মাত্র দুই মন ওজনের বস্তা নামিয়ে এসেছে মালিকের কাছ থেকে টাকা নেয়ার জন্য।
—আসলে আপু কিভাবে কথাটা বলবো বুঝতে পারছিনা।
—বুঝতে পারছেন না তাহলে কথা বলতে আসছেন কেন? মেয়েদের রাস্তায় একা পেলেই কথা বলতে ইচ্ছে করে? পিছন থেকে ডাকতে ইচ্ছে করে?
রাগে আমার শরীর ঘিনঘিন করছে। এই বখাটে ক্ষ্যাতগুলোর যন্ত্রণায় রাস্তায় বেড় হওয়া যায় না। মেয়ে দেখলেই হারামিগুলো ঝাপিয়ে পরতে চায়। টেনে হেছড়ে খেতে চায়।
—আসলে আপু আপনে যা ভাবছেন আমি ঐ রকম নই। আমার নাম সানি।
—আপনার নাম সানি! এটা বলতে এসেছেন? আর আপু আপু করছেন কেন? আমি আপনার কোন জম্মের আপু? শুনুন আপনার মত ছেলেদের আমার খুব ভালো করে চেনা আছে।
—আসলে. . . . না মানে. . . আপু আপনাকে একটা চিরকুট দিতে এসেছি।
—আমাকে চিরকুট দিতে এসেছেন? কিসের চিরকুট?
ছেলেটি আমার সামনে দাড়ানো। মূখ থেকে সিগারেটের দুর্গন্ধ বেড়িয়ে আসছে। এতো বাজে জিনিস মানুষ কিভাবে খায় আমি বুজতে পারি না।সানি আবার আমতা আমতা করে বলছে–
—সরি, কিছু মনে করবেন না। দোকানে যারা বসে আছে তারা আমার ফ্রেন্ড। ওদের সাথে আমি বাজি ধরেছি। যদি আপনাকে আমি এই চিরকুটটি দিতে পারি তাহলে তারা আমাকে কে এফ সি তে খাওয়াবে। প্লিজ আপু অন্য কিছু মনে করবেন না।
ছেলের সাহস দেখে আমি অবাক হচ্ছি! চিরকুটের দিকে তাকাতেই লিখাটি চোখে পরলো। ওখানে লিখা “I LOVE YOU”। রাগে আমার মাথা ব্যাথা শুরু হয়ে গেছে। ঠাস করে গালে একটা থাপ্পড় দিয়ে বললাম–
—বদমায়েশি করার আর জায়গা পাননা? মেয়ে দেখলেই চিরকুট দিতে ইচ্ছে করে? বাজি ধরতে ইচ্ছে করে? মেয়েদের আপনারা কি মনে করেন? বাজারের পণ্য না জুয়ার দান?
সানি কোন কথা বলছে না। গালে হাত দিয়ে নিচের দিকে মুখ করে তাকিয়ে রয়েছে। প্রচন্ড অপমানিত হলে মানুষকে যেমন দেখায় ঠিক তেমন লাগছে।
—আপনাদের বংশ পরিচয় নিয়ে আমার সন্দেহ হচ্ছে। ভালো বংশের ছেলেরা তো রাস্তায় দাড়িয়ে মেয়েদের ট্রিকস্ করে না! লজ্জা থাকলে ফের যেন এখানে না দেখি। আর বাজি ধরতে চাইলে আপনার ফ্যামিলির কাউকে নিয়ে ধরুন। রাস্তায় এসে নিজের বংশ পরিচয় দেখাবেন না।
এই ক্ষ্যাতটার সামনে আমার আর দাড়িয়ে থাকতে ইচ্ছে করছে না। কথা বলতেও ঘৃণা করছে।
আমি আর দাড়ালাম না। পাশেই একটা খালি রিক্সা পেয়ে উঠে পরলাম।
* * * * * * * * * * * * * * * * * * * *

মাঝে মাঝে আমি আয়নায় নিজেকে দেখে নিজেই অবাক হই। মনে মনে বলি কিরে প্রতিভা তোকে এতো সুন্দর লাগছে কেন? আজ আমার সেরকম কিছু একটা বলতে ইচ্ছে করছে। ইচ্ছে করছে অনেক্ষন ধরে ড্রেসিংটেবিলের সামনে দাড়িয়ে নিজেকে দেখি। হাসলে কেমন লাগে দেখি, কাঁদলে কেমন লাগে কিংবা অভিমান করলে কেমন লাগে দেখি। কিন্তু বেশিক্ষন নিজেকে দেখতে পারছি না। সময় নেই। কলেজের ফাউন্ডেশন ডে উপলক্ষে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হবে। দুপুর দুটার মধ্যে যাওয়ার কথা। এখন বাজে তিনটা। অনেক দেরি করে ফেলেছি। তবু নিজেকে ড্রেসিংটেবিলের সামনে রেখে কয়েকবার দেখে নিয়েছি।
আজ শাড়ি পরেছি। নীল শাড়ি। কপালে লাল টিপ। দেখতে অনেক সুন্দর লাগছে। যেদিন বেশি সুন্দর লাগে সেদিন বেশি বেশি করে দেখতে ইচ্ছে করে।
— আপু তুমি এখনো যাওনি? আর কতো সাজো? এমনিতেই তোমাকে অনেক সুন্দর লাগে। এতো সাজতে হবে না।
আমাকে ড্রেসিংটেবিলের সামনে দেখলেই পূর্ণতার মেজাজ গরম হয়। ছোট বোনটি কেন আমার সাজা দেখতে পারে না বুঝিনা।
—এইতো যাচ্ছি। তুই যাবি আমার সাথে?
—না।আমার যাওয়া লাগবে না। তুমিই যাও। তোমার সাথে গেলে আমাকে কুৎসিত লাগে।
পূর্ণতা দেখতে অনেক সুন্দর। তবু কেন আমাকে এতো হিংসা করে বুঝি না।
—তুই সবসময় আমাকে এতো হিংসে করিস কেন বলতো? আমি কি তোকে কখনো সাজতে নিষেধ করছি?
—ওমা! আমি তোমাকে কখন হিংসে করলাম? তোমাকে সুন্দর লাগছে বলছি বলে হিংসে করা হয়? ঠিক আছে তুমি সাজো। সাজতে সাজতে পেত্নী হও। আমি গেলাম।
পূর্ণতা রাগ দেখিয়ে রুম থেকে বেড়িয়ে গেছে। মেয়েটাকে একটা কথা বলা যায় না। অমনি রাগ করে। রাগ যেন সবসময় ঠোঁটের কিনারায় এসে থাকে।
বাসা থেকে বেড়িয়ে রিক্সা পেয়ে গেছি। রিক্সার জন্য দাড়িয়ে থাকা অসহ্য লাগে। আজ তেমন লাগছে না। অবশ্য একা একা যেতে ভালো লাগছে না। পূর্ণতা সাথে থাকলে ভালো হতো। দুজনে গল্প করে যেতে পারতাম।
রিক্সা ছুটে চলেছে। বিকেলের স্নিগ্ধ আলো হালকা বাতাসে মিশ্রিত হয়ে গায়ে জড়িয়ে যাচ্ছে। মোড়ের টং দোকানটার কাছে এসে আগের মতো এখন আর মেজাজ গরম হয়না। বদমাইশ ছেলেগুলোকে গত এক সপ্তাহ দরে কলেজ যাবার সময় দেখিনা। একদিনেই জন্মের মতো শিক্ষা হয়ে গেছে। কেউ প্রতিবাদ করে না বলে ওরা মাথায় উঠে। দূর্বলতার সুযোগ নিয়ে নিজেদের নোংরামি প্রতিষ্ঠা করতে চায়।
আজ কলেজ অনেক সুন্দর করে সাজিয়েছে। মেইন গেইট থেকে শুরু করে পুরো ক্যাম্পাসে লাল নীল তারা বাতি লাগিয়েছে। চারদিকে নতুন নতুন ফুলের টব বসানো। অনেক ছেলেমেয়ে পারফর্ম করবে বলে বাহারি রংয়ের ও ডিজাইনের পোশাক পরে এসেছে। মুখে কড়া মেকাপ। দেখতে অদ্ভুত মনে হচ্ছে।
মাঠের একপাশে বিশাল মঞ্চ তৈরী করা হয়েছে। যেখানে এইমাত্র একটি ছেলে ও একটি মেয়ে চমৎকার নিত্য উপহার দিয়েছে। দেখতে খুব মজা লাগছে। এখন একটি ছেলে এসেছে গান গাইতে। বাড়ি মিষ্টি গলা।
সন্ধ্যা হয়ে গেছে। বাসায় ফিরতে হবে। সন্ধ্যার পরে বাহিরে থাকলে আম্মু ভিশন টেনশন করে। কখনো সন্ধ্যার পরে একা বাহিরে থাকতে পারি না। রাত করে বাসার ফিরলে অনেক বকা খেতে হয়। আমার সাথে আমার দুই ক্লাসমেট। নীলা ও শিখা। মাঝে মাঝে ওদেরকে দেখে আমার প্রচন্ড হিংসে হয়। ওরা যেখানে খুশি সেখানেই যেতে পারে। যা ইচ্ছে তাই করতে পারে। রাত দশটার পর বাসায় ফিরলেও কেউ কিছু বলে না।
মাঝে মাঝে ইচ্ছে হয় ওদের মতো হই। মুক্ত বিহঙ্গের মতো উড়ে বেড়াই। কিন্তু পারিনা। আমার মেন্টালিটি আমাকে বাধা দেয়। আমার সোসাইটি আমাকে বাধা দেয়।
বিকেল থেকে বসে আছি। অনুষ্ঠান ছেড়ে একটুও উঠতে ইচ্ছে করছে না। প্রত্যেকের প্রেজেন্টেশনই অনেক ভালো লাগছে। কিন্তু আর থাকতে পারছি না। সন্ধ্যা পেরিয়েছে অনেক্ষন আগে।
—নীলা-শিখা আমি যাইরে। আর থাকতে পারছি না।
—এখনই চলে যাবি? আর একটু থাক।
—নারে আম্মু অনেক টেনশন করবে।
ইচ্ছে থাকা সত্যেও আমি প্রগ্রামে থাকতে পারছি না। নীলা-শিখার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বেড়িয়ে এলাম। বাহিরে আধো আলো আধো ছায়া। আকাশে মধ্য বয়সি চাঁদ জোছনা ছড়িয়ে যাচ্ছে। শেষ কবে একা একা জোছনা রাতে রিক্সা করে বাসায় ফিরেছি মনে নেই। ভাবতেই ভালো লাগছে।
রাস্তা মনে হচ্ছে জনমানব শুন্য। কোথাও কেউ নেই অবস্থা। ইদানিং কি যে হলো সন্ধ্যার পরে কেউ ঘর থেকে বের হয়না। সবার মাঝে আতংক বিরাজ করে। কি হয় কি হয় অবস্থা। কখন কোথায় আগুন দিচ্ছে বোমা মারছে বলা যায়না। আমাদের এই মানুষ মারার রাজনীতি কবে যে বন্ধ হবে আল্লাহ জানে। হঠাৎ হঠাৎ অবশ্য রাস্তায় দুই-এক জনকে দেখা যাচ্ছে। দেখে মনে হয় খুব জরুরী কাজে বের হয়েছে।
মোড়ের টং দোকানটার বেতরে দোকানি ছেলেটা বসে আছে। আশপাশে কেউ নেই। দেখে মনে হচ্ছে নিঃসঙ্গ কোন একটি গ্রহে একটি প্রাণীর বাস।

গল্পের বিষয়:
রোমান্টিক
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত