এই আফনান,আফনান।
ওঠো না গো।আর কত ঘুমাবে??
আজকে না আমাদের ঘুরতে যাওয়ার কথা??
চোখ খুলে তাকিঁয়ে দেখি আরিবা ডাকছে।
আমি তো পুরাই হতভম্ব।
আমার কথা কলি তো প্রায় ৩বছর হয়ে গেল কথা বলতে পারেনা।
আজকে কি করে এত সুন্দর করে আমাকে ডাকছে??
পরে আরিবার ধাক্কায় বাস্তবে ফিরলাম।
আরে আমি তো ভুলেই গিয়েছিলাম,কাল রাতেই আমার কথাকলিকে হসপিটাল থেকে বাসায় নিয়ে এসেছি।কাল সকালে অপারেশন হয়েছিল ওর।
অতিরিক্ত সুখের কারনেই বোধ হয় রাতের ব্যাপার টা ভুলে গেছি।
কারন প্রায় ৩ টা বছর পর আমার কথা কলি আবার আমার সাথে কথা বলবে,আবার আমার সাথে ঝগড়া করবে,আরো কত কি,ওই সব ভাবতে ভাবতে কখন জানি ঘুমিয়ে পড়েছিলাম মনেই নাই।
রাতে আরিবা কে বলেছিলাম,আল্লাহ সহায় যদি তুমি সম্পূর্ন সুস্থ হয়ে যাও।কাল তোমাকে নিয়ে অনেক দূর ঘুরতে যাব।
সেজন্যই সকাল সকাল আমায় ডেকে তুলল।
-আমি আরিবা কে বললাম, আচছা তুমি রেডি হয়ে নাও।আমি ও ফ্রেশ হয়ে আসছি। আরিবা রেডি হতে চলে গেলো।
–
আরে আপনাদের তো পরিচয়টাই দেওয়া হলোনা।
আমি আফনান।একটা প্রাইভেট কোম্পানিতে জব করি।
আর এতক্ষন যার সাথে কথা হচ্ছিলো উনি হচ্ছেন আমার বউ আরিবা।আমি কথা কলি বলেই ডাকি।
অবশ্য কথা কলি বলার পেছনেও একটা কারণ আছে।
আমাদের বিয়েটা হয়েছিলো পারিবারিক ভাবে।
তবে আমার আগে কারো সাথে কোন সম্পর্ক ছিলোনা, তাই কথাকলি কে খুব সহজেই মেনে নিয়েছিলাম।
খুব পছন্দ করতাম,ভালো ও বাসতাম।
কথা কলি ও আমাকে অনেক ভালোবাসতো।
তবে ওর একটা স্বভাব ছিলো, ও অনেক কথা বলতো।
আমি কিছু বলি আর না বলি,ও এফ এম রেডিও র মতো সারাক্ষন বাজতেই থাকতো।
বাসায় সারাক্ষন এই রেডিও শুনতে শুনতে অফিসে গেলেও মনে হতো বাজছে।
তবে বউটা আমার খুব কেয়ার করতো।
অনতত ফোন করে খবর নিতো আমি খেয়েছি কিনা।
আমি ও রোজ রাতেই ওর জন্য কিছু না কিছু নিয়ে আসতাম।
এতে ও আরো বেশি খুশি হতো।
কখনও আরিবা কে নিয়ে শপিং এ গেলে এক ই তো ঘোরাঘুরি এর মধ্যে ওর কথা দুই-ই মিলে আমায় পুরোই পাগল করে দিতো।
সেজন্যই হয়তো ও কাছে না থাকলে খুব মিস করতাম।
বোরিং ফিল করতাম।
সেজন্যই ওরে কোথাও যেতে দিতাম না।
–
সেদিন কার ঘটনা:…
–
অফিস থেকে বাসায় ফিরলাম বিষন্ন মনে।
কারন বস মিটিং ডেকে সবার বেতন কমিয়ে দিয়েছে।
এত খরচ, এর মধ্যে কথাকলি ও মা হতে যাচ্ছে সেখানে কি না কি হয়।কত টাকা লাগে,তাছাড়া ভবিষ্যৎ -এ বাচ্চার খরচ।কি করে মিটাবো এত খরচ।
ভাবতে ভাবতেই মনটা খারাপ হয়ে গেল।
বাসায় পৌঁছে দরজায় নক করতেই আরিবা দরজা খুলল।আমি বউ কে নিয়ে একা বাসায় থাকি।তাই অন্যকেউ দরজা খোলার চান্স ও নেই।
তাকিঁয়ে দেখি আরিবা খুব সুন্দর করে সেজে গুজে আছে।
আমার দিকে খুব রাগি দৃষ্টিতে তাকিঁয়ে রইলো।
পরক্ষনেই মনে পরে গেল আজকে তো আমাদের বিবাহ বার্ষিকী।
তাই আজকে একটু তাড়াতাড়ি বাসায় এসে,আরিবা কে নিয়ে বাহিরে ঘুরতে যাওয়ার কথা ছিলো।
কি আর করার রুমে ডুকে পড়লাম।
আরিবা ও মুখ ঘুমরা করে শুয়ে রইলো।
আমি ফ্রেশ হয়ে এসে হাত টা ধরে বললাম,আমি রেডি চলো বাহিরে যাই।
হাত টা ছাড়িয়ে খুব চেচিঁয়ে বলল,কোন প্রয়োজন নাই।আমি যাবোনা।আজকের মতো একটা বিশেষ দিনেও তুমি লেট করে আসলে??
প্লিজ আরিবা।একটা বার পুরো ব্যাপারটা শুনো।তারপর বলো।
আরিবা বলল,
ছাড়ো তো।ধরবেনা একদম।যার কাছে ছিলা তার কাছেই যাও।
সে বুজি আমার চেয়ে বেশি ভালোবাসে,তাই আমাকে ভুলেই গিয়েছিলে??
আরিবার মুখ থেকে এই কথাটা একদমই আশা করিনি।
পরক্ষনেই একটা কষে থাপ্পড় বসিয়ে দিলাম ও র গালে।
আর বলতে লাগলাম,সহ্য করি বলে খুব বেশি বেড়ে গেছো তাইনা?আগেই ভাবা উচিত ছিলো মেয়েদের এত মাথায় উঠানো ঠিক না।
আমি কথা গুলো বলে শেষ করতেই,আরিবা আমাকে অনেক গুলো কথা শুনিয়ে দিলো।
আমি নাকি একদমই ওর কেয়ার করিনা।
ওর ভালো লাগা গুলোকে সাপোর্ট দেই না।
আরো কত কি…
আমার ও মেজাজ গেল খারাপ হয়ে।
অবশেষে আমি বলেই ফেললাম,একদম চুপ।
আজকের পর থেকে আমার সাথে কথা বলবা না।
তোমার কথার যন্ত্রনায় আমি অতিষ্ট হয়ে গেছি।
জীবন টাই থামিয়ে দিয়েছো তুমি।
কথা গুলো চোখ বন্ধ করে এক দমে বলে ফেললাম।
চোখ খুলেই দেখি আরিবা আমার সামনে নেই।
সাথে সাথেই হুশ হলো কি বলে ফেললাম আমি??
আমার ই তো দোষ।না হলে আজকের মতো একটা বিশেষ দিন ও ভুলে গেলাম।চাইলেই তো আরেকটু আগে বাসায় আসতে পারতাম।
দূর যা করেছি ভালোই করেছি।
বলেই সোফায় বসে রইলাম।
অনেকক্ষন পরে রুমে গিয়ে দেখি আরিবা ঘুমিয়ে পড়েছে।
ঘুমন্ত অবস্থায় একদম নিষ্পাপ শিশুর মতো লাগছিলো আরিবা কে।
মনে মনে ঠিক করলাম,সকালে আরিবার রাগ ভাঙ্গিয়েই অফিসে যাব।
আর কাল একটু তাড়াতাড়ি বাসায় এসে আরিবা কে নিয়ে একটু ঘুরতে বেরুবো।
–
সকালে ঘুম থেকে উঠতে উঠতেই ১০.টা বেজে গেলো।
ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি ১০ টা.
আমিতো লাফ মেরে উঠে বসে পড়লাম।
এতো লেট,কখন রেডি হবো?কখন অফিস যাবো??
আজকে আরিবা ডেকে দিলো না কেন??
এখন কি করি????
চেচিঁয়ে আরিবা কে ডাকতে লাগলাম।
কিন্তু কোন সাড়া শব্দ নেই।
কি ব্যাপার, কি হলো?
অন্যদিন তো একবার ডাকলেই দৌড়ে আসে।কিন্তু আজকে এত ডাকলাম তা ও আসলো না কেন??
সারা বাড়ি খুঁজলাম।কিন্তু কোথাও পেলাম না।
পরে মনে পড়লো রাতের ঝগড়ার ব্যাপারে।
তবে কি আরিবা রাগ করে কোথাও চলে গেলো??
সাথে সাথে কল করলাম আরিবার ফোনে।
ফোন টা আমার রুমেই বেজে উঠলো।
এখন কি করবো,কিভাবে বুঝবো কোথায় আছে আরিবা??
মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়লাম।
–
সারাদিন অনেক জায়গায় কল করলাম।আরিবার বাবার বাসায় ও কল করলাম,তবে কেউ কোন খবর ই দিতে পারলোনা।
–
মন খারাপ করে ছাদে দাড়িয়ে আছি।আর রাতের রাগের মাথায় বলা কথা গুলো ভাবছি।
সেজন্যই রাগের সময় নিজেকে সংযত রাখতে হয়।
আমি তো অনতত চুপ থাকতে পারতাম।
–
পরে রাতে আমার সালী আমাকে কল করে জানালো আরিবা ওইখানে ই আছে।কিন্তু ওকে বলতে মানা করছিল বলেই ও বলেনি।
আমি যেন হাফ ছেড়ে বাচঁলাম।
আর আমার সালী ব্যাপার টা কি, তা জানতে চাইলো।
তবে আমি কিছুই বললাম না। কারন আমাদের মধ্যকার ব্যাপার টা আমি অন্যদের জানাতে চাইনি।
বললাম, এমনি তোমার বোন তোমাদের বাসায় গেছে।কেন যেতে পারেনা বুঝি??
পারবেনা কেন দুলা ভাই।
আসলে আপু ও কিছুই বলেনি,কিন্তু আপু কে দেখে স্বাভাবিক মনে হলোনা তাই জিঙ্গাসা করলাম।
আমি বললাম তোমার বোনের কাছে একটু দাও তো ফোন টা।
আরিবা কাছ থেকে ওর বোন কে বলল,আমি কথা বলতে চাইনা।
ওকে বলে দে,মরে গেলেও কথা বলবো না আমি।
বুঝলাম পাগলিটার খুব রাগ হয়েছে আমার উপর।
আর হবেই না বা কেন,কতগুলো কথা শুনাইছি আমি।
–
যাই হোক কাল সকালেই গিয়ে পাগলিটাকে আমার কাছে নিয়ে আসবো।
আসতে না চাইলে জোর করে নিয়ে আসবো।
কারন আমি ও যে,আমার কথাকলিকে ছাড়া নিঃস্ব।
আমার ও যে এফ এম রেডিও টা শুনতে শুনতে অভ্যস হয়ে গেছে।
এখন আর না শুনে থাকতে পারিনা।
–
পরের দিন সকাল ১০টায় গিয়ে পৌঁছালাম আরিবার বাড়ি।
ওর বোন কে জিঙ্গাসা করতেই বলল,
আরিবা নাকি ছাদে আছে।
দৌড়ে গেলাম ছাদে।
গিয়ে দেখি বেচারির মুখ টা শুকিয়ে গেছে।
আমাকে দেখেই মুখটা এমন করে রাখছে,যেন পৃথিবীর সব চেয়ে বড় অপরাধী আমি।
আমি পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে বললাম,সরি জানু।
বিশ্বাস করো, মন থেকে কিছুই বলিনি।
সবই ঘোরের মধ্যে হয়ে গেছে।
কিন্তু কে শুনে কার কথা।
মহারানীর মুখের ভার ই কমে না।
তাই নিজে নিজেই শাস্থি নিচ্ছি।
কখনও কান ধরছি।
কখনো ই বা নাক।
পরে কান ধরে উঠ বস করছি।হঠাৎই আমার সালীর আগমন।
প্লিজ আপু,এইবারের জন্য অনতত দুলা ভাইকে মাফ করে দে।
আরিবা বলল,
ওকে তোর কথায় মাফ করে দিলাম।তবে ভবিষ্যৎ-এ এমন ভুলের কোন মাফ নাই।
বলেই আমার সামনে থেকে চলে গেল।
আমি শুধু তাকিঁয়ে রইলাম,তার চলে যাওয়ার পানে।
–
কিছুক্ষন পর সকালের নাস্তা করে বেরিয়ে পড়লাম বাসার উদ্দেশ্যে।
তবে এতক্ষনের মধ্যে আরিবা আমার সাথে একটা কথা ও বলেনি।
কিন্তু আমি নন স্টপ বলেই যাচ্ছি।
সে শুধু শুনছে।
আমি কথা বলছি আর বার বার আরিবার দিকে তাকাচ্ছি।
আজ কেন জানি আরিবার দিক হতে চোখ সরাতেই পারছিনা।
হঠাৎই আরিবা, আফনান সামনে তাকাও,,,,,বলে চিৎকার করে উঠলো।
পরক্ষনেই আমাদের গাড়িটা একটা মালবাহী ট্রাকের সাথে এমন ভাবে ধাক্কা খেল যে,আরিবা ছিটকে বাইরে পড়ে গেল।
আমি ও খুব ব্যথা পেলাম।
পরে আমি প্রায় ৩-৪ ঘন্টা পর নিজেকে হসপিটালের বেডে আবিষ্কার করলাম।
আমার জ্ঞান ফিরতেই আমি আরিবা বলে চিৎকার দিয়ে উঠলাম।
একটা নার্স দৌড়ে এসে বলল,ভাই উওেজিত হবেন না,এইটা আপনার শরীরের জন্য খুবই ক্ষতিকর।
আমি বললাম, নার্স প্লিজ আমার আরিবাকে একটা বারের জন্য ডেকে দিন।
ওরে আমার খুব প্রয়োজন।
সরি মিঃ আফনান,উনি এখন অপারেশন থিয়েটারে আছে।
আমি আতকে উঠে বললাম,মানে???
হুম,উনি অনেক ব্যথা পাইছে।
আল্লাহর দরবারে দোয়া চান,উনি যেন বেচেঁ যায়।
কারন উনার শরীরের কন্ডিশন একদমই ভালো না।
বাইরে আপনাদের পরিবারের সবাই আছে।
আপনি বললে আমি অন্য কাউকে ডেকে দিতে পারি।
আমি আমার মায়ের সাথে কথা বলতে চাইলাম।
মা আমার কাছে এসেই আমাকে জড়ীয়ে ধরে খুব কাদঁলো।
কি করে এত কিছু হলো বাবা??
হসপিটাল থেকে তোর বাবার ফোনে কে জানি কল করে জানালো।তাই আমরা সবার এখানে আসলাম।
না হলে তো জানতেই পারতাম না।
আমি মা কে জড়ীয়ে ধরে কান্না জড়ীত কন্ঠে বললাম , মা আমি কিছুই বুঝে উঠার আগে সব কিছু ঘটে গেছে।
তবে আরিবার কিছু হয়ে গেলে আমি নিজেকে কখনই মাফ করতে পারবোনা।
মা আমার মাথায় হাত রেখে শান্তনা দিয়ে বলল,দেখবি তোর ভালোবাসার জোরে আরিবার কিছুই হবেনা।
তুই শুধু আল্লাহর কাছে তোর ভালোবাসার জীবন ভিক্ষা চা।
সেদিন হয়তো আল্লাহ আমার ডাক শুনছিলো।
তাই প্রায় ৩মাস পর আমার আরিবা সুস্থ হয়ে গিয়েছিল।
কিন্তু আল্লাহ আমার ভুলের চরম শাস্থি দিয়েছেন আমায়।
ওইদিনের পর আর আমার কথাকলি কথা বলতে পারতো না।
বোবা হয়ে গিয়েছিলো।এবং তার পেটের বাচ্চাটাও নষ্ট হয়ে গিয়েছিল।
তবে ওরে দেখলে বুঝাই যেতোনা ও যে বোবা।
চিরকুট লিখে কথা বলতো আমার কথাকলি।
খুব কেয়ার করতাম তার।
কারন সব কিছুর জন্য হয়তো আমিই দায়ী।
–
একদিন আরিবা,একটা চিরকুট আমার হাতে ধরীয়ে দিলো।
তাতে লিখা ছিলো সরি জানু।আমি সবটাই মায়ের কাছ থেকে শুনেছি।
আমারি ভুল হইছে,ওইদিন সবটা শুনা উচিত ছিল।
তবে হয়তো আজকে এমন টা হতো না।
আমি শুধু কথাকলির হাত টা ধরে বললাম,বাবুরে তোর এই নিরব অবস্থাটা আমাকে যে কত টা কষ্ট দেয়,তা তোকে বলে বুঝাতে পারবোনা।
তবে আমি নিজের সর্বস্ব দিয়ে চেষ্টা করবো তোমাকে এই অবস্থা থেকে বের করতে।
–
অনেক প্রচেষ্টা,চিকিৎসা এবং সবার দোয়ায় তিন বছর পর আমার কথা কলি আজকে আবার আমার সাথে কথা বলেছে।
আজকে আমার চেয়ে সুখি হয়তো পৃথিবীতে কেউ নেই।
–
হঠাৎই কথাকলির চিৎকারে আমি বাস্তবে ফিরলাম।
কখন বের হবো আমরা???
আমি বললাম,কিগো কি হলো??
কি হলো মানে,সেই ২০ মিঃ যাবত রেডি হয়ে বসে আছি,আর তুমি কিনা বলছো কি হলো।
সরি সোনা।
আর হবেনা।
বলেই আমার কথাকলি কে নিয়ে বেড়িয়ে পড়লাম অজানার উদ্দেশ্যে।
খুব ঘুরবো আজকে দুজন।
অনেক দিনের এক ঘেয়েমি,ঝরতা দূর করবো আজ।
আর সারাদিন আমার এফ এম রেডিও টা শুনবো।
গল্পের বিষয়:
রোমান্টিক