চলতে চলতে পথের মধ্যে

চলতে চলতে পথের মধ্যে

“নীলা! তুমি কেন আমায় বিশ্বাস করতে পারো না? একবার, শুধু একবার আমায় বিশ্বাস করে দেখো। একটি বারের জন্য আমার চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বল।

তবে বুঝতে পারবে তোমার জন্য এই হ্নদয়ে কতটা ভালবাসা রয়েছে।”
আনমনে হাঁটছি আর এই কথা গুলো ভাবছি।কখনো কি এই কথাগুলি নীলাকে বলতে পারব?
আমার যখন খুব মন খারাপ হয় তখন একা একা ঘুরে বেড়াই।আজ আমার খুব মন খারাপ তাই ঘুরতে চলে আসি।
হঠাত মনে হল একটি মেয়ে আমায় ফলো করছে।
এতক্ষণ আনমনে হাঁটছিলাম তাই খেয়াল করিনি। মেয়েটি আমার থেকে কয়েক হাত দূরে আছে। তার চোখের দৃষ্টি মনে হচ্ছে আমার দিকে।

নিশ্চিত হওয়ার জন্য আমি থেমে যাই,আর নিচু হয়ে আমার জুতার ফিতা খুলে নতুন করে লাগাই। লক্ষ্য করলাম মেয়েটি ও দাঁড়িয়ে পড়েছে। তারমানে আমায় ফলো করছে!!
মনের ভিতর একটা অজানা ভয় ঢুকে গেল। মহিলা হাইজ্যাকার নয়তো? কখন থেকে ফলো করছে সেটাও বুঝতে পারিনি।
আরো কিছু পথ যাওয়ার পর যখন দেখলাম মেয়েটি পিছু ছাড়ছে না তখন সিদ্ধান্ত নিলাম দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করব। হাইজ্যাকার হলে হউক।

কি আর আছে নেয়ার মতো! একটা মোবাইল আর ২-৩ শ টাকা হবে।
“এই যে মিস আপনি আমায় ফলো কেন করছেন?”
মেয়েটির চোখে মুখে ভীতিভাব ফোঁটে উঠল।তারমানে হাইজ্যাকার নয়, নাকি এটা তার ওভার স্মার্টনেস।
“ইয়ে…. মানে…. আমি,,,, আমি হারিয়ে গেছি।”
বলে কি মেয়ে!!! এত বড় মেয়ে আবার হারায় কি করে।
“হারালে কি করে?”
“আসলে আমি ফ্যামিলির সাথে এখানে বেড়াতে এসেছি। হঠাত খেয়াল হল তাদের কাছ থেকে আমি সরে গেছি।আমি একা একা হাঁটলে অনেক ছেলেই আমার সাথে খারাপ আচরন করবে,

তাই আপনার পিছু পিছু হাঁটছি যাতে অন্যরা মনে করে যে আমি আপনার সঙ্গী।”
“আমি যদি তেমনি কোনো বাজে ছেলে হই সেই ভয় নেই?”
“না, আপনাকে দেখে মনে হল আপনার সাথে চললে আমার কোনো ক্ষতি হবে না।”
“আপনি কি মানুষ কে দেখেই বুঝে যান সে কেমন হবে?”
“সবাইকে না,তবে আপনাকে দেখে মনে হল যে আপনি মেয়েদের সাথে কোনো খারাপ আচরণ করতে পারেন না।”
“আপনারা কোথা থেকে বেড়াতে এসেছেন?”
“সিলেট থেকে।”
“সিলেটের মানুষ হয়ে এই জায়গায় এসে হারিয়ে গেলেন? আগে কখনো এখানে ঘুরতে আসেন নি?”
“আসলে আমাদের বাসা সিলেট তবে আমরা আমেরিকা থাকি।দেশে এসেছি কিছুদিন হল।এখানে এই প্রথম আসলাম।”
“কিন্তু তাদের কে হারিয়ে ফেলেছেন যখন ফোন করে খুঁজে নেন।মোবাইল নেই? নাকি হাইজ্যাক হয়েছে?”
“না না। আসলে আমার ছোট ভাই ছবি তোলার জন্য মোবাইল নিয়েছিল, তার কাছেই রয়ে গেছে।”
“ওহ তাহলে আমার মোবাইল দিয়ে ফোন দেন।”
আমি মোবাইল বাড়িয়ে দিলাম।
মেয়েটি অসহায় চাহনি দিয়ে বলল,
“আমার তো আব্বু আম্মুর দেশের নাম্বার জানা নেই।মোবাইলে সেইভ করা আছে।”
“আজব মেয়েতো! নাম কি?”
“তানহা, আপনার?
“ইশান।”
আমি আর কিছু বললাম না।আবার হাঁটতে শুরু করলাম।
মেয়েটি ও আমার পিছনে আসছে। মেয়েটি পিছন থেকে বলল,”কি হল আপনি কিছু বললেন না যে?”
এবারো কিছু বললাম না। নিজের মতো হেঁটে চলছি।এবার মেয়েটি আমার পাশাপাশি এসে হাঁটছে।
“প্লিজ কিছু বলেন, আমার খুব ভয় করছে। আপনার সাথে চললে আমার ভয় করবে না।”
আমি বাংলা ছবির খলনায়ক হয়ে ওঠলাম।আশেপাশে আর কোনো মানুষের চিহ্ন নেই।জায়গাটা খুব নির্জন।

ভয়ংকর দৃষ্টি দিয়ে মেয়েটির দিকে এগিয়ে যাচ্ছি।মনে হল সে কিছুটা ভিতু হয়ে ওঠেছে।পিছু হটতে লাগল।
আমি বললাম,”অপরিচিত কাউকে এতটা বিশ্বাস করা ঠিক নয়, আজ সেটা বুঝিয়ে দেব। হা… হা… হা…”
ডাকাতের মত করে হাসার চেষ্টা করলাম।
“দে… দেখুন, আমি জানি আপনি এমন না।প্লিজ আমার সাথে এমন করবেন না।”
ভয় পেয়ে তুঁতলাচ্ছে মেয়েটা। পিছু হটতে হটতে সে একটি গাছের সাথে ধাক্কা খায়।আর পিছনে যেতে পারে না।আমি ঠোঁটে দুষ্টু হাসি দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছি।

মেয়েটি অনুরোধ করে যাচ্ছে।
“না,,, প্লিজ এমন,,,, এমন করবেন না,,, না…..”
আমি একেবারে কাছে চলে গেলাম। মুখটি তার মুখ লক্ষ্য করে এগিয়ে নিচ্ছি। ভয়ে মেয়েটি চোখ বন্ধ করে নেয়।
আমার আর তার মাঝে তখন নূন্যতম দূরত্ব, হঠাত সে বলে ওঠে,” আই লাভ ইউ ইশান।”
আমি বিষণভাবে চমকে গেলাম।কিছুটা দূরে সরে এলাম।এবার সে চোখ খুলে তাকালো আমার চোখের দিকে।চোখে চোখ রেখে আবার বলল,”আমি তোমায় ভালবাসি।”
“এই মেয়ে পাগল নাকি তুমি? চেনা নেই জানা নেই একজনকে এভাবে ভালবাসি বলে দিলে?”
তানহা বোকার মত আমার দিকে তাকাচ্ছে।
“আমি কি করব আপনি যেভাবে এগিয়ে আসছিলেন ভয়ে বলে ফেলেছি।ভাবলাম যদি কিছু করেন তবে প্রেমিক হিসেবে করলেন।”
তার কথায় উচ্চ স্বরে হেসে ওঠলাম।অনেক কষ্টে হাসি থামিয়ে বললাম,”এটা কে কি ভালবাসা বলে নাকি?”

তারপর গম্ভীর হয়ে বললাম,” ভালবাসা সেটাই, কাউকে একপলক দেখার জন্য হাজার বাঁধা পেরিয়ে আসা।ভালবাসা সেটাই,

যখন ভীরের মধ্যে ভালবাসার মানুষটি হারিয়ে যায় তখন পাগলের মতো তাকে খোঁজে বেড়ানো।
ভালবাসা সেটাই, সে কখনো ভালবাসবে না জেনেও প্রতিদানহীন ভাবে তাকে ভালবেসে যাওয়া।”
কথাগুলো বলতে গিয়ে অন্যমনস্ক হয়ে যাই। তাকালাম তানহা’র দিকে, তার চোখে মুগ্ধতা প্রকাশ পাচ্ছে।
আবার বললাম,”সরি,আপনার সাথে খুব খারাপ ব্যবহার করে ফেলেছি।আসলেই আমি এমন ছেলে না।

আজ আমার মন খারাপ,আর মন খারাপ হলে আমি একা একা হেঁটে বেড়াই।

তাই চাচ্ছিলাম আপনাকে ভয় দেখিয়ে তাড়িয়ে দিতে।”
“আমরা কি আপনি থেকে তুমি তে আসতে পারি না?”
মনে হল তানহা এখনো ঘোরের মধ্যে কথা বলছে।
“মানে!”
তার ঘোর কাটল,স্বাভাবিক হয়ে বলল,”ইয়ে,,, মানে আমরা বন্ধু হতে পারি?”
“হুম।”
“আচ্ছা তোমার মন খারাপ কেন?”
আমি অবাক হয়ে তাকালাম তানহা’র দিকে।একটি মেয়ে হারিয়ে গিয়েছে অথচ কত স্বাভাবিক ভাবে কথা বলছে।

খুব সহজেই আমার সাথে বন্ধুত্ব করে ফেলল।এখন আবার আমার মন খারাপের কারনও জানতে চায়।
“কিছু বিষয় আছে শুধু নিজের।কাউকে বলে বুঝানো সম্ভব নয়।”
“আমি তো এখন তোমার বন্ধু, আমায় বলা যাবে না?”
“না।”
আমি খুব সহজভাবে বললাম। যদিও সুন্দরী মেয়েদের কথার উপর এইভাবে না বলাটা অভদ্রতা।
“না বললেও আমি জানি, তোমার গার্লফ্রেন্ডের জন্য মন খারাপ।মনে হয় আজ দেখা হয়নি তাই। কি ঠিক বলছি তো?”
আমি ৪২০+৪২০=৮৪০ ভোল্টেজের শকড খেলাম।এই মেয়ে জানল কি করে? মাহিলা হিমু নাকি???
তানহা আবার বলল,” হুম, তোমার চোখ মুখ দেখেই বুঝতে পারছি আমার কথা ঠিক।”
“কিন্তু তুমি বুঝলে কিভাবে?”
“খুব সিম্পল, তুমি যেভাবে ভালবাসা নিয়ে বলছিলে প্রেমে না পড়লে কেউ এভাবে বলতে পারে না। আর এই বয়সে ছেলেদের মন খারাপের কারন হল প্রেমিকা।”
“খুব বুদ্ধিমতী মেয়ে তো তুমি।”
“এবার বলো কি হয়েছে,ঝগড়া?”
আমি হাসলাম, মলিন হাসি,এই হাসির মধ্যে রয়েছে বিষণ্ণতা।
“আমি তো প্রেম করছি না, আবার ঝগড়া? তবে হাঁ, আমি একটি মেয়েকে ভালবাসি। খুব বেশি ভালবাসি।

আমার HSC পরিক্ষা দিয়ে শেষ, তারপরও মাঝেমধ্যে কলেজের দিকে যাই শুধু তাকে একটিবার দেখার আশায়।আজ খুব ইচ্ছে হচ্ছিল তাকে দেখতে।

তাই গিয়েছিলাম, কিন্তু সে আজ আসে নি।”
“নাম কি মেয়েটির?”
“নীলা আরশি।”
“তাকে বলেছ কখনো?”
“পারবে না বলে দিয়েছে।আসলে সে আমায় বিশ্বাস করতে পারেনি।”
“কেন?”
“আসলে নীলা একটি ছেলেকে ভালবেসেছিল কিন্তু কিছুদিন পর জানতে পারে ছেলেটি একসাথে অনেক মেয়ের সঙ্গে প্রেম করে (প্রেমের অভিনয়)।

অল্প বয়স ছিল তো তাই মানুষ চিনতে ভুল করেছিল।একবার বিশ্বাস ভেঙেছে তাই এখন আর কাউকে (ছেলেদের) বিশ্বাস করতে সাহস পায় না।”
“কিন্তু সবাই তো আর এক নয়!”
“এই কথাটিই সে বুঝতে পারে না।বাদ দাও এসব কথা, এখন তুমি কি করবে সেটা ভাবো।তুমি কি বাসার ঠিকানা জানো তাহলে তোমায় পৌঁছে দিতে পারব।”
“পৌঁছে তো দিতেই হবে, তবে ঠিকানা টা আমি নই অন্য কারো কাছ থেকে শুনে নিও।”
আমি কিছুই বুঝতে না পেরে বললাম,” মানে কি?”
কথা টি বলে আমি পিছনে ফিরে তাকাই কেননা তানহা থেমে পড়েছে। কিন্তু পিছনে তাকিয়ে আমার দৃষ্টি তানহার দিকে নয় তার পিছনে এগিয়ে আসা একটি মেয়ের দিকে চলে যায়।
নীলা!!!!! এখানে কার সাথে?
কিছু বুঝতে পারলাম না।অবাক হওয়া ছাড়া যেন আমার আর কিছু করার নেই।সে একা আসছে সাথে কেউ নেই।ঘটনা কি?
আমার বিস্ময়ের ঘোর কাটার আগেই নীলা আমাদের সামনে এসে দাঁড়ায়। সরাসরি তানহাকে
বলে,”কিরে সব ঠিক তো?”
আমি বড়সড় ধাক্কা খেলাম।তারমানে ওরা পরিচিত? কিন্তু নীলার তো তানহা নামের কোনো বান্ধবী নেই।
আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে আছি, কি হচ্ছে সেটা বুঝার চেষ্টা করছি।
তানহা বলল,”নীলা তুই এত গাধা জানা ছিল না।এইরকম একটা ছেলেকে তুই এতদিনে বিশ্বাস করতে পারছিস না?

এই অল্প সময়ে আমি যতটুকু দেখছি তাতে করে ইশানকে চোখ বন্ধ করে বিশ্বাস করা যায়।”
আমার স্নায়ুচাপ বেড়ে যাচ্ছে,আমি আর চুপ তাকতে পারলাম না।
“ওয়েট,,, ওয়েট,,,,, তোমরা একে অন্যকে চিনো?”
নীলা বলল,”তানহা আমার কাজিন, আমেরিকা থাকে।”
“তাহলে হারিয়ে যাওয়াটা…..”
তানহা আর নীলা হেসে ওঠে।
তানহা বলে,”আমাদের পরিকল্পনা ছিল।”
“কেন?”
“তুমি দেখছি নীলার চেয়ে বড় গাধা।বুঝ না কেন?”
সত্যিই আমি বোকার মতো প্রশ্ন করেছি বুঝতে পেরে তাকালাম নীলার দিকে চোখে চোখ রেখে
বললাম,”আমি আর এভাবে মন খারাপ করে একা একা ঘুরতে আসতে চাই না।যদিও কখনো ঘুরতে আসি তবে কি আমার পাশে পাশে হাতটি ধরে হাঁটার জন্য তোমাকে পাবো?”
নীলা কিছু না বলে আমার ডান হাতটি ধরে হাঁটা ধরল….।

গল্পের বিষয়:
রোমান্টিক
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত