সুপ্তির বিয়ে

সুপ্তির বিয়ে

এক
—-

বিয়ে যে করতে হবে, এই ভাবনাটা অনেক দিন আমার মাথায় আসেই নি । এর পেছনে অবশ্য যুক্তি যুক্ত কারণও ছিল । এখনও জেরিনের কথা গুলো আমার কানে খুব পরিস্কার ভাবেই বাজে । মনে না করতে চাইলেও মাঝে মাঝে সেগুলো সুচালো তীরের মতই বুকের ভেতরে বিঁধে । অবশ্য আমি জেরিনকে দোষ দিতে পারি না । মেয়েটার কোন কিছু করারও ছিল না । চুপচাপ দেখা ছাড়া আর কিছু করারও ছিল না ।

শান্ত কন্ঠেই জেরিন আমর দিকে তাকিয়ে ছিল কিছুটা সময় । ওর এই চেহারাটা আমি খুব ভাল করেই চিনতাম । কঠিন কিছু বলার আগে ও এমন করে তাকিয়ে থাকে । মনে মনে ঠিক করে নেয় কি বলবে । আরও কিছু সমু চুপ থাকার পরে জেরিন বলল
-বাবা রাজি হচ্ছেন না !
আমি জানতাম জেরিনের বাবা কোন দিনও রাজি হবে না । জেরিন আবার বলল
-তুমি নিশ্চয়ই বুঝতে পারছো কেন রাজি হচ্ছে না । কোন মেয়ের বাবাই চাইবে না তার মেয়ে একটা শূন্য ঘরে যাক । তার উপর তোমার অবস্থা এমন ভাল না যে আমি সাহস করে চলে আসবো ।

আমার অবস্থা বলতে জেরিন আমার আর্থিক অবস্থাকে বোঝাচ্ছে । সবে মাত্র একটা চাকরিতে ঢুকেছি তখন । বেতন খুব একটা ভাল না । নিজের চলে যায় ভাল ভাবে কিন্তু বউ নিয়ে চলার মত নয় ।
জেরিন বলল
-আগামী সপ্তাহে ওরা আমাকে দেখতে আসবে ! আজকেই …..

লাইনটা শেষ করলো না জেরিন । আমি জানতাম ও কি বলতে এসেছিলো । সেদিনই আমাদের শেষ দেখা ছিল । এরপর আর ওর সাথে আমার দেখা হয় নি । শুনেছিলাম বিয়ে হয়েছে খুব ভাল জায়গায় । তারপর থেকেই আমি একা একা সামনের দিকে যাচ্ছি । সপ্তাহে ৫ দিন কাজ করি । দুইদিন ঘুমাই আর বই পড়ি । অন্য কিছু মাথার ভেতরে আনি না । বেশ ভালই ছিলাম কিন্তু মাঝখান দিয়ে রফিক মামা আমাকে ঝামেলায় ফেলে দিলেন ।

আসলে আমার আত্মীয়ের ভেতরে কেবল এই মামাকেই আমি চিনি কিংবা কেবল ইনার সাথেই আমার যোগাযোগ আছে । ঢাকাতে আমার অভিভাবকও এই মামাই । মায়ের যদিও আপন ভাই নয় তবুও এক মাত্র জীবিত আত্মীয় বলতে এই রফিক মামাই আমার আছে । বাবা মা তো মারা গেছে সেই কবে । দাদা কিংবা নানার দিক থেকেও কেউ আর বেঁচে নেই । কিংবা থাকলেও আমি চিনি না তাদের তারাও আমাকে চেনার দরকার মনে করে না । বেশি চিনলেই ঝামেলা । এই রফিক মামাই আমাকে ঝামেলা মনে করেও একটু একটু চেনে । যদিও আমি তাকে খুব একটা ঝামেলাতে কোন দিন ফেলি নাই ।

মামা আমার দিকে তাকিয়ে বলল
-বিয়ে করতে হবে না ?
আমি টেবিলে বসে ভাত মাখাচ্ছিলাম । মাঝে মাঝে মামার বাসায় আমার দাওয়াত থাকে । মাসের ভেতরে দু এক দিন । অথবা বিশেষ কোন দরকার পড়লে মামা কিংবা মামি আমাকে ডেকে পাঠায় । আজকের বিশেষ দরকার তাহলে আমার বিয়ে । মামাকে বললাম
-যা বেতন পাই এই টাকা দিয়ে বউ পালা যাবে না ।

টেবিলে মামী নেই । আমি আর মামা একা খেতে বসেছি । মামা বলল
-সেটা নিয়ে তোকে চিন্তা করতে হবে না । মেয়ের বেশ টাকা পয়সা আছে । ঢাকায় ফ্ল্যাট আসে একটা । সেই ফ্ল্যাটে থাকবি দুজন আর তোর চাকরির বেতন দিয়ে সংসার চলবে । ব্যস !

আমার মাথায় ঠিক ঢুকলো না যে মেয়ের ঢাকায় ফ্ল্যাট আছে সেই মেয়ে আমাকে কেন বিয়ে করবে । কোন দুঃখে ?
মামা বলল
-আসলে মেয়েরও তোর মত কেউ নেই । বাবা মা মারা গেছে বেশ কয়েক বছর আগে । মেয়েটা একাই থাকে । মেয়ের বাবার এক বন্ধু বলল আমাকে । আমাদের অফিসের এক কলিগের মাধ্যমে জানতে পারলাম । তুইও একা জেনে সেই আগ্রহ দেখালো । বলল যে দুজনের যখন কেউ নেই তাহলে একে অন্যের দুঃখটা বুঝতে পারবে ।

আমি কি বলবো বুঝতে পারলাম না । কিন্তু তবুও কেমন জানি লাগছিলো । আমার কাছে কেবল মনে হল মামা যেন কিছু যেন এখনও বলে নি আমাকে । মামার চেহারা দেখেই বুঝতে পারলাম । আমি মামার দিকে তাকিয়ে রইলাম কিছুটা সময় । মামা খানিকটা ইতস্তত করে বলল
-মেয়ের আগে একবার বিয়ে হয়েছিল । স্বামীটা ভাল ছিল না । একদিনও সংসার করতা পারে নি । আসলে মেয়ের ফ্ল্যাটের পেছনে পড়েছিল স্বামীটা । মেয়েটা প্রথমেই দিতে রাজি হয় নি ।

হুম । এইবার বুঝতে পারলাম আমাকে কেন এতো পছন্দ হল তাদের । পাত্র হিসাবে আমি কোন কালেই কারো প্রথম চয়েজ হতে পারি না । না আমার পরিবার আছে, না আমি অনেক টাকার মালিক ! এমন ছেলেদের জন্য মানুষের কেবল মায়া কিংবা করুনাই জন্মে, ভালবাসা নয় । জীবন সঙ্গী হিসাবে কোন মেয়েই এমন ছেলেদের কে আশা করে না ।

একবার মনে হল মামাকে বলি যে আমি ঝামেলায় যাবো না তারপর কি যেন মনে বললাম
-আচ্ছা আপনি যা ভাল মনে করেন ।

আমার উত্তর শুনে মামা খুশি হলেন । মেয়ের মোবাইল নাম্বার আমাকে দিয়ে বললেন
-আমি জানতাম তুই রাজি হবি । আমি কথা বলেই রেখেছি । কাল মেয়ের সাথে দেখা করে আয় । কি বলিশ !
-আচ্ছা !

—-
দুই
—–

বসুন্ধরার আট তলায় দাড়িয়ে আছি । আমার থেকে একটু দুরে মেয়েটা বসে আছে । বুঝতেই পারছি আমার জন্য অপেক্ষা করছে কিন্তু আমার কেন জানি সামনে যেতে ইচ্ছে করছে না । তার প্রধান কারন হচ্ছে মেয়েটা দেখতে অন্য রকম সুন্দর । কি রকম সুন্দর আমি বলতে পারবো না তবে একম কাউকে আমি বহুদিন দেখি নি । আমি চোখ ফেরাতে পারছি না । আসে পাশের অনেকেই দেখি মেয়েটার দিকে আড় চোখে তাকাচ্ছে । মেয়েটার ভাব দেখেই মনে হচ্ছে আসে পাশের মানুষের এমন আচরনে মেয়েটা অভ্যস্ত । তাই তার কোন ভ্রুক্ষেপ নেই । আমার তবুও মনের ভেতর থেকে সন্দেহ যাচ্ছে না । ছবিতে মেয়েটাকে কম সুন্দরী লাগছিলো । বাস্তবে আরও বেশি সুন্দর মনে হচ্ছে । এই মেয়ে আমাকে বিয়ে করতে রাজি হবে বলে মনে হয় না ।

আমি আরেকটু সামনে গিয়ে ফোন বের করে ফোন দিলাম আরও ভাল করে নিশ্চিত হওয়ার জন্য । দেখলাম মেয়েটার ফোন বেজে উঠলো । আমার নাম্বার আগেই ছিল মেয়েটার কাছে । স্ক্রিনের দিকে তাকিয়েই এদিক ওদিক তাকাতে লাগলো আর আমার দেখতে পেল । দুজনের চোখাচোখী হল ।

আমি অনুভব করলাম যে আমার পা খানিকটা কাঁপছে । কেন কাঁপছে আমি ঠিক জানি না । না ঠিক পা নয়, আমার বুকের ভেতরটা কাঁপছে । কিছু একটা হচ্ছে সেটা আমি বুঝতে পারছি । আমি আস্তে আস্তে মেয়েটার দিকে এগিয়ে গেলাম ।

বাসা থেকেই ঠিক করে এসেছিলাম যে এই মেয়ে এখন বিয়ে করবো না । দেখা করবো । মামাকে খুশি করার তারপর মেয়েটার সাথে কথা বলে তাকে বলবো সে বিয়ে করার আমার কোন ইচ্ছে নেই । আমি এই ঝামেলার ভেতরে যেতে চাই না । কিন্তু মেয়েটাকে দেখার পরে আমার মনে আর কিছুই রইলো না । আমার কেবলই মনে হল জেরিন আমাকে বিয়ে করে নি ভালই করেছে তাহলে হয়তো এই মেয়েটার সাথে আমার দেখাই হত না ।

আমি মেয়েটার সামনে গিয়ে একটু হাসার চেষ্টা করলাম ।
বললাম
-দেরি হয়ে গেল ?
-না । সমস্যা নেই । আমি মাত্রই এলাম !
আমি বসতে বসতে বললাম
-আমার নাম তো আপনি জানেনই তাই না ?
মেয়েটা বলল
-আমি আপনার ব্যাপারে সব কিছুই জানি । আপনি জানেন তো ?
-হ্যা ! মামা বলেছে ।
-কি কি বলেছে ?

আমি বলতে লাগলাম কি কি বলেছে । কথা বলার মাঝ খানে একটা সময়ে মনে হল আমি যেন একটু দ্রুত কথা বলছি । আসলে নিজের কাছেই একটু একটু বেশি উত্তেজিত মনে হল । মেয়েটা একটু হাসি মুখে আমার দিকে তাকিয়ে রইলো । তারপর মেয়েটা বলল
-একটু আস্তে বলেন । আমি তো কলেজের টিচার না । আপনার কথা শুনে মনে হচ্ছে আপনি স্যারের কাছে পড়া দিচ্ছে ।
-আসলে ……।

আসলে কি ?
সত্যিই তো ! কেবল চেহারা দেখেই আমি কাত হয়ে গেলাম । এটা ঠিক হচ্ছে না । নিজেকে বোঝানোর চেষ্টা করলাম কিন্তু কেন জানি মনে শুনলো না কথাটা ।

প্রায় ঘন্টা দুয়েক ছিলাম সুপ্তির সাথে । সুপ্তি মানে যার সাথে আমি কথা বলছি । মামা অবশ্য ফারজানা আহমেদ বলেছিলো । ওটা ফরনাম নেইম । ডাকনাম সুপ্তি ।
আহ কি চমৎকার নাম !
যাই হোক দুই ঘন্টা কোন দিয়ে চলে গেল টেরই পেলাম না । সন্ধ্যা বেলা ওকে একদম ওর বাসা পর্যন্তই এগিয়ে এলাম । আসলে আমি ওর সাথে রিক্সায় চড়ার সুযোগটা হাত ছাড়া করতে চাচ্ছিলাম তাছাড়া সুপ্তির বাসাটাও চিনে আসা দরকার ।

রিক্সা থেকে নামতে নামতে বললাম
-আবার কবে দেখা হবে ?
-কবে আপনি চান ? এখনও তো সিদ্ধান্তই জানালেন না । বাসায় গিয়ে চিন্তা ভাবনা করুন । এতো বড় সিদ্ধান্ত একটু ভেবে চিন্তে নেওয়া ভাল ।

আমি রিক্সা নিয়ে ফেরৎ আসার সময় যত কয়েকবার ফিরে তাকালাম দেখলাম সুপ্তি গেটের কাছেই দাড়িয়ে আছে । চোখের আড়াল হতেই আমার কি হল আমি ফোন বের করে সুপ্তিকে ফোন দিলাম ।
-হ্যালো !

আমি কোন ভূমিকা না করে বললাম
-আমাকে কি আপনার পছন্দ হয়েছে ?
সুপ্তি আমার প্রশ্নের জবাব না দিয়ে বলল
-আপনার কি আমাকে পছন্দ হয়েছে ?
-কি মনে হচ্ছে ?
-এতো জলদি এতো বড় সিদ্ধান্ত নেওয়া ঠিক না । আপনি কিন্তু আমার ব্যাপারে কিছুই জানেন না ।
-যা জেনেছি ওটুকুই ঠিক আছে ।
ওপাশ থেকে দীর্ঘ নিরবতা । তারপর সুপ্তি বলল
-এমন কিছু বিষয় আছে যা জানলে হয়তো আপনি আমাকে বিয়ে করতে চাইবেন না । একটু সময় নিন ।

আমি কি বলবো বুঝতে পারলাম না । এমন কি বিষয় থাকতে পারে ! ওর যেমন কেউ নেই আমার কেউ নেই । আর ওর যে ডিভোর্স হয়েছে এটা তো ও আমার কাছ থেকে লুকায় নি । এর থেকে বড় আর কি পারে !
থাকুক ! আমার কিছু যায় আসে না । আমি মনে মনে সিদ্ধান্ত নিয়েই নিলাম । এই সিদ্ধান্ত নিয়েই নিলাম ।

—–
তিন
—–

আমি মামার দিকে তাকিয়ে রইলাম বোকার মত । মনে হচ্ছিলো যেন মামা অন্য কোন ভাষায় কথা বলছে । আমি কেবল তার মুখ নাড়ানো দেখছি কিন্তু কিছু বুঝতে পারছি না । মামা আমার দিকে তাকিয়ে বলল
-ঐ মেয়েকে বিয়ে করার দরকার নেই । মেয়ের এতো সমস্যা থাকলে তো সেটা মেনে নেওয়া যায় না, তাই না ? আমি ওদের কে ফোন করে মানা করে দিচ্ছি ! ঐ মেয়ের সাথে আর যোগাযোগ করার দরকার নেই ।

আমি মামার বাসা থেকে বের হয়ে কোন দিকে যাবো ঠিক বুঝতে পারলাম না । আমার বাসার দিকে যাওয়া যায় আবার সুপ্তির বাসার দিকেও । কিন্তু ওর বাসায় গিয়ে কি বলবো ? বলবো যে আমি তোমাকে বিয়ে করতে পারবো না । তুমি আমাকে এসব কেন বল নি ! এসব তো আমাকে বলা উচিৎ ছিল । ও তো আমাকে বলেই ছিল যে এমন কিছু আছে যা জানলে আমি ওকে বিয়ে করতে চাইবো না । আগে অনেকেই চায় নি হয়তো ।

আমি যাবো কি না ওদিকে এই কথা ভাবতে না ভাবতেই সুপ্তির ফোন এসে হাজির হল আমার ফোনে । একবার মনে হল সম্পূর্ণ ভাবে এড়িয়ে চলে যাই । একবার এড়িয়ে চললেই মেয়েটা বুঝে যাবে সব কিন্তু কেন জানি মন সায় দিলো না । ফোন রিসিভ করলাম ।

ওপাশ থেকে হ্যালোর শব্দ এল না । কিছু সময় নিরবতা । আমিও চুপ করে রইলাম । আরও কিছু সময় কেটে যাওয়ার পরে সুপ্তি বলল
-কথা বলবা না ?
-তুমি তো কিছু বলছো না !
আরও কিছু সময় নিরবতা । তারপর সুপ্তি বলল
-তোমার মামা একটু আগে ফোন দিয়েছিলো । বিয়ে টা হচ্ছে না বলে দিয়েছে ।
-হুম ! আমি জানি ।
তারপর আবারও দুজন কথা হারিয়ে ফেললাম । আমার কেন জানি নিজের কাছে খুব ছোট মনে হল । কেবল মনে হল আমি সুপ্তিকে এমন একটা কাজের জন্য দোষারোপ করছি যেটা ও করেই নি । ঠিক ওর আগের স্বামী সব জানার পরেই ওর সাথে থাকতে চায় নি ঠিক তেমনি টাই আমি আচরন করছি ।

সুপ্তির বিয়ের দিন ওর স্বামী সব কিছু জানতে পারে । বাসররাতে ওর সাথে একটা কথাও বলে নি । মেয়েটা অনেক কান্না কাটি করেছে কিন্তু ওর স্বামী সেটা শোনে নি । সকাল বেলা বাসা থেকে চলে যেতে বলেছে । সুপ্তি আমাকে সম্পর্ণ টুকু বলেনি । অর্ধেক কথা বলেছিলো । আরও একটা ঘটনা যে ছিল সেটা আমি আজকে মামার কাছ থেকে শুনলাম । এবং মনে হচ্ছিলো মেয়েটা আমাকে কেন বলল না আগে ! অবশ্যই বলা উচিৎ ছিল ।

ফোনের ওপাশ থেকে সুপ্তি বলল
-আমি তোমাকে বলতে চেয়েছিলাম । বিশ্বাস কর চেয়েছিলাম । কিন্তু পারি নি । কেন যেন কোথায় একটা বাঁধা ছিল । তুমি যখন ঐদিন আমার বাসায় এসে হাজির হলে কি পরিমান যে ভাল লেগেছিল তোমাকে, আমি আশা করেছিলাম তারপর তুমি যখন এলে…. অনেক দিন … অনেক দিন পর নিজেকে একটু মানুষ মনে হচ্ছিলো । মনে হচ্ছিলো যে আমাকে …..

লাইণটা শেষ না করে আবারও চুপ করে রইলো সুপ্তি । আমি কি বলবো খুজে পেলাম না । সত্যি সত্যি প্রথম দেখার পরে সুপ্তির কথা আমি মন থেকে বেরই করতে পারছিলাম না । ঘুরে ফিরে কেবল ওর কথাই মনে হচ্ছিলো । আমি পরদিন অফিস ছুটির পরেই ওর বাসায় গিয়ে হাজির হই । কোন ফোন না দিয়েই । দরজা খুলে আমাকে দেখে সুপ্তি বেশ খুশি হল মনে হল । চেহারায় একটা সপ্রতিভ ভাব দেখতে পাচ্ছিলাম । আমি লজ্জা মিশ্রিত হাসি দিয়ে বললাম
-এদিক দিয়ে যাচ্ছিলাম, ভাবলাম যে আপনার সাথে আরেকবার দেখা করে যাই ।
সুপ্তি একটু সেহে বলল
-আপনার অফিস এদিকে ?
-হ্যা ! এদিকেই তো । এই তো কাওরানবাজার !

আমার কথা শুনে সুপ্তি হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়লো । কাওরান বাজার এই বাসা থেকে অনেক দুরে । আমার বাসার ঠিক উল্টো দিকে । অবশ্য মামার বাসা একটু কাছেই ।
আমি তখনও দরজাতেই দাড়িয়ে । একটু অস্বস্থি যে লাগছিলো না বলবো না তবে ভাল লাগছি বেশ । সুপ্তি হাসি থামিয়ে বলল
-আসুন । ভেতরে আসুন । বাধরুম ডান দিকে । আপনি ফ্রেস হয়ে আসুন আমি খাবার দিচ্ছি !
আমি ঘরের ঢুকতে ঢুকতে বললাম
-না না । আমি কিছু খাবো না । কেবল কিছু সময় থেকেই চলে যাবো ।
-বুঝতে পারছি আপনি এখানে খেতে আসেন নি । কিন্তু আমি আমার বাসায় আসা সবাইকেই আপ্যায়ন করতে ভালবাসি । আপনি ফ্রেস হয়ে আসুন, প্লিজ !

হাত মুখ ধুয়ে টেবিলের দিকে তাকাতেই বেশ অবাক হয়ে গেলাম । অনেক আয়োজন । এবং সব থেকে বড় কথা সেগুলো একটাও ঠান্ডা নয় । মনে হচ্ছে একটু আগেই রান্না করা হয়েছে । আমি একটু অবাক না হয়ে পারলাম না । আমাকে তরকারির দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে সুপ্তি বলল
-আসলে …..
-আসলে কি ?
-আসলে আমার সকাল থেকেই কেন জানি মনে হচ্ছিলো আপনি আসবেন । তাই নিজ থেকে কিছু রান্না করেছি । রান্না এখনও শেষ হয় নি । এখনও ডাল রান্না হচ্ছে । আপনি খেতে খেতে হয়ে যাবে !

আমি কি বলবো খুজে পেলাম না । মনে হল মেয়েটাকে তক্ষুনি কাজী অফিসে নিয়ে যাই । আর পর তিন কবুল বলে ফেলি ! আমি আপাতট কাজী অফিসের দিকে না গিয়ে টেবিলে বসে পরলাম । খাওয়ার সময় সুপ্তি আমার পাশেই বসে ছিল । কি পরিমান ভাল লাগছিল আমি বলে বোঝাতে পারবো না । বারবাই কেবল মনে হতে লাগলো এবার থেকে আমাকে আর একা একা হোটেলে হোটেলে ভাত খেতে হবে না । অন্তত খাওয়ার সময়ে আমার আপন কেউ বসে থাকবে আমার কাছে ।
-জানেন আমি যখন হোটেলে খাওয়া দাওয়া করি তখন কেন জানি বাসার কথা মনে হয় খুব । একা একা খেতে কেমন একটা কষ্ট হয় । আমার যে এই দুনিয়াতে কেউ নেই সেটা পরিস্কার ভাবে বুঝতে পারি এই খাওয়ার সময় !

সুপ্তির দিকে তাকিয়ে দেখি মেয়েটা আমার দিকে এক ভাবে তাকিয়ে আছে । আমার কষ্ট টা মেয়েটা ঠিক ঠিক বুঝতে পারছে । সুপ্তি বলল
-এবার থেকে প্রতিদিন অফিস থেকে ফেরার পথে এদিক দিয়ে যাবেন । কেমন ! দুজন মিলে এক সাথে রাতের খাবার খাওয়া যাবে । আমিও খানিকটা ক্লান্ত হয়ে গেছি একা একা খেতে ।
-আচ্ছা !

তারপর থেকে প্রত্যেকটা দিন আমি সুপ্তির বাসায় গিয়েছি । ওর সাথে অফিসের পর ঘন্টার পর ঘন্টা গল্প করেছি। বেড়াতে গেছি । কত কথা বলেছি । আর আজকে ওকে ছেড়ে চলে যাচ্ছি !

ফোনের ওপাশে তখনও সুপ্তির কান্নার আওয়াজ শুনতে পাচ্ছি আমি ।
সুপ্তি কান্না থামিয়ে বলল
-এটাই কি আমাদের শেষ কথা ?
-কি বললে ?
-বললাম এর পরে আর কথা হবে না আমাদের ?
-তুমি কি চাও ?
-আমি কি চাই তুমি জানো না ? আমি তোমার কাছে লুকিয়েছি তোমাকে হারানোর ভয়ে । কিন্তু জানতাম একদিন তুমি ঠিক ঠিক জানতে পারবে । সেদিন হয়তো তোমাকে হারাতে হবে । সেদিন ….।
আমি বললাম
-তুমি কি বাসায় ?

কিছু সময় কোন কথা বলল না ও । তারপর বলল
-হ্যা ! কেন ?
-দরজা খোল । মামার বাসা থেকে না খেয়ে বের হয়েছি ।
-মানে ……
-দরজা খোল !

সুপ্তির সাথে কথা বলতে বলতে আমি কখন যে ওর বাসার সামনে চলে এসেছি আমি নিজেই জানি না । দরজার সামনে দাড়িয়ে বেল চাপতে গেলাম তার আগেই দরজা খুলে গেল । কান্না ভেজা চোখ নিয়ে সুপ্তি দাড়িয়ে । কানে ফোন লাগানো । আমার দিকে অবিশ্বাসের চোখে তাকিয়ে আছে । চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়ছে ।

আমি ভেতরে ঢুকবো কি ও নিজে বাইরে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরলো । তারপর হুহু করে কেঁদে উঠলো । ছোট বাচ্চাদের কোন জিনিস হারিয়ে যাওয়ার পরে যখন ফিরে পায় তখন যেমন করে সুপ্তির আচরনও আমার কাছে তেমন মনে হল । আমি বললাম
-আজকে কি রান্না হয়েছে ?

আমার বুক থেকে মানা না উঠিয়েই সুপ্তি বলল
-এখনও কিছু রান্না করি নি ।
-রান্না হবে না ?
-হবে ।
-আজকে আমি কি ঠিক করেছি জানো ?
-কি ?
-ঠিক করেছি যে আজকে আমি আমার বউয়ের হাতে রান্না খাবো ! বুঝেছো । এেকবারে রেজিস্ট্রি করা বউয়ের হাতে রান্না !

সুপ্তি আমার ছেড়ে দিয়ে আমার চোখের দিকে তাকালো তারপর আমার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়েই রইলো । ওর চোখ দিয়ে তখনও পানি বের হচ্ছে । ঠিক যেন বিশ্বাসই করতে পাচ্ছে না যে আমি ওকে আজকেই বিয়ে করতে যাচ্ছি ! কান্না ভেজা কন্ঠে বলল
-কিন্তু তোমার মামা যে ….
-আরে মামাকে গুল্লি মারো ! মামা তো আর বিয়ে করবে না । আমি করবো ।
তারপর হাত দিয়ে ওর চোখের পানি মুছে দিতে দিতে বললাম
-তোমাকেই বিয়ে করবো । রাজি তো ?

(সমাপ্ত)

(কারনটা অজানাই থাক কেন সুপ্তির বিয়ে ভেঙ্গে যাচ্ছিলো)

গল্পের বিষয়:
রোমান্টিক
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত