এক আকাশ নদী

এক আকাশ নদী

(১)

“এই দিন থেকে দিন
প্রতিদিন সরে যায়
এই ভোর যেন তোর
কোন সখ না মোছায় …”

রূপঙ্করের গাওয়া অসাধারণ গানটা বেজে ওঠে গাড়ীর মিউজিক প্লেয়ারে। আমার খুব পছন্দের গান। মৌরীর পছন্দ অবশ্য অন্যরকম, ও কোন সময় জার্নিতে স্লো ধরনের গান শোনেনা। যথারীতি সে হাত বাড়ালো রিমোট কন্ট্রোলটার দিকে। আমি মানা করি –

: মৌরী, প্লিজ … থাক না গানটা
: না, থাকবে না, এই গান শুনলে আমি কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘুমিয়ে যাব
: ঘুমিয়ে যাও, মানা করেছি?
: বল কি? তাহলে তোমাকে গাইড করবে কে?
: আমি চিনে নিতে পারবো, এই রাস্তা আমার চেনা
: তোমাকে মাঝে মাঝে যে মনে করিয়ে দিতে হবে – স্যার, দয়া করে আস্তে ড্রাইভ করুন – সেটা কে করবে?
: মনে করিয়ে দিতে হবে না, আমি সাবধানেই চালাবো
: তোমার সাথে কথায় পারিনা কখনও, থাক … চলুক গানটা

গান ততক্ষণে শেষ প্রায়। আমি একটু হেসে রাস্তার দিকে মনোযোগ দেই।

এই মেয়েটার মাথায় সমস্যা আছে। বড় ধরনের সমস্যা। এত বড় একটা মেয়ে, ইন্টার্নিশিপ করছে মেডিকেলে, অথচ বৃষ্টি দেখলে পাগল হয়ে যায়, তীব্র রোদে চারিদিক পুড়ে গেলে তন্ময় হয়ে তাকিয়ে থাকে, মেঘলা দিনে মন খারাপ করে আমার হাত ধরে বসে থাকে, ঝড়ের রাতে ভয়ার্ত গলায় আমাকে ফোন দেয় “আমার খুব ভয় করছে, একটু আসবে জানালার কাছে, প্লিজ”। রেইন কোট পড়ে আমাকে যেতে হয় ওর হোস্টেলের পেছনের পাঁচিল ঘেরা নির্দিষ্ট জায়গাটায়, যেখান থেকে ও জানালা দিয়ে আমাকে দেখতে পায়। এসব নিয়ে আমার বন্ধুরা হাসাহাসি করে। আমি গা করি না। জীবনটা আমার, ভাল লাগা মন্দ লাগাটা আমার, কষ্টটা আমার, আনন্দটাও। আমার পৃথিবীটা ওকে ঘিরেই, যে যাই বলুক, আমি ওকে খুশী করতে যে কোন কিছু করতে পারি। কাজেই … মাঝে মাঝে পাগলামী করতেও মন্দ লাগে না।

এখনও বেশ মনে আছে ওকে প্রথম দেখার দিনটা।

আমি তখন সবে থার্ড ইয়ারে পড়ি। ইউনিভার্সিটিতে সন্ধানীর ওরা এসেছে রক্ত নিতে। বেশ সাহস করে লাইনে দাঁড়িয়ে গেলাম। হোস্টেলের জলের মত পাতলা ডাল আর ফ্রি ভাত খেয়ে খেয়ে প্রচুর রক্ত বানিয়েছি শরীরে। কিছুটা অন্তত মানুষের কাজে লাগুক। টেন্টের বাইরে রেজিস্ট্রেশন করে ভেতরে ঢুকলাম। দুটি বিছানা পাতা, দুজন রক্ত দিচ্ছে। সাদা এপ্রোন পড়া কয়েকটা ছেলেমেয়ে তদারক করছে তাদের। এদের মাঝ থেকে তালপাতার সেপাই ধরণের একটা মেয়ে এগিয়ে এসে আমাকে চেয়ার দেখিয়ে বসতে বললো। ভেতর ভেতর ঘামছি আমি, রক্ত দেবার দৃশ্য দেখা খুব সুখকর না, বিশেষ করে প্রথমবার রক্ত দিতে আসা কারও জন্যে। মেয়েটা এসে আমার শার্টের হাতা গুটিয়ে ব্লাড প্রেশার মাপার যন্ত্র লাগাচ্ছে। ভয় পেয়ে গেলাম, বসে বসেই রক্ত দিতে হবে না কি আমাকে! বোকার মত এদিক ওদিক তাকাচ্ছি।

: ভয় পাচ্ছেন কেন আপনি? ভয়ের কিছু নেই? এই প্রথমবার রক্ত দিতে এলেন?

চমৎকার রিনরিনে কণ্ঠস্বর। কোন মেয়ের এত সুন্দর ভয়েজ আগে শুনিনি আমি। মুগ্ধ হয়ে গেলাম রীতিমত। মেয়েটার মুখের দিকে চেয়ে যেন বিশ্বাস হচ্ছিলনা যে এক মুহূর্ত আগে বলা কথাগুলো এই মেয়েটিই বলেছে। তালপাতার সেপাই টাইপের একটা বাচ্চা মেয়ের গলার স্বর এত পরিণত, এত মায়াবী? মেয়েটা ব্লাড প্রেশার মাপার ঘড়ির মত ডায়ালটা থেকে চোখ তুলে আমার চোখের দিকে চাইলো। আমি চোখ নামিয়ে নিলাম।

রক্ত দিয়ে একটু দুর্বল লাগছিল। ঘরে এসে শুয়ে পড়লাম আধা ময়লা বিছানায়। কোন এক অদ্ভুত উপায়ে আমার কানে তখনও মেয়েটার রিনরিনে গলার স্বর বাজছে। প্রেশার মেপে মেয়েটা চলে গিয়েছিল অন্য একজনের কাছে, আর আমি কেমন যেন খুব শান্ত হয়ে শুয়ে পড়েছিলাম রক্ত দিতে। মোটা কাঁচের চশমা পড়া একটা ছেলে এসে বা হাতে মস্ত এক সুঁই ফুটিয়ে দিলো। আমি কিছুই অনুভব করলাম না। কিছুক্ষণ পর ছেলেটা বললো রক্ত নেয়া শেষ, আমার মনে হলো – কেন আমি অনন্তকাল ধরে রক্ত দিতে পারলাম না।

নিজের জীবনে ব্যস্ত হয়ে গেছি আবারও। ক্লাস, ল্যাব আর টিউটোরিয়ালের মাঝে এক মুহূর্ত সময় পেলে দৌড়ে গিয়ে কোন আড্ডায় বসা, দ্রুত চুমুক দিয়ে আগুন গরম চা শেষ করে আবার দে ছুট ক্লাসে। আমার সময়গুলো এভাবেই কাটতো, ছোটবেলা থেকে এভাবেই কেটেছে। নিয়ন্ত্রিত, রূটিনবদ্ধ, নিরানন্দ জীবন আমার। জন্মের পর বাবা মা’র ভালবাসা তো দূরের কথা, তাদের চেহারা দেখবার সৌভাগ্যটাও হয়নি আমার। এতিমখানার আয়া আর বদরাগী সুপারের বকা খেতে খেতে বড় হয়ে উঠছিলাম। যে বয়সে বাচ্চারা আধো আধো বোলে অ অ ক খ শেখে, আমি সেই বয়সেই বুঝতে শিখেছিলাম যে পৃথিবীতে আমি একা। আমাকে একাই বড় হতে হবে, কিছু একটা করতে হবে, পালাতে হবে এই বন্দিশালা থেকে।

সৃষ্টিকর্তার আশির্বাদ, আমাকে বেশীদিন এতিমখানায় থাকতে হয়নি। শান্তশিষ্ট বলেই হয়তো এক নিঃসন্তান দম্পতি আমাকে দত্তক নিয়ে নিলেন। প্রথম কিছুদিন ভালই ছিলাম, মা পেলাম, বাবা পেলাম, আদর যত্ন পেলাম। কিন্তু সেই সুখ আমার কপালে লেখা ছিলনা। আমার মা’র কোল আলো করে এলো নতুন শিশু। আমি পরম মমতায় জড়িয়ে নিলাম আমার ছোট্ট ভাইটাকে। কিন্তু যতই বড় হতে লাগলো সে, আমি ক্রমেই যেন অপাংক্তেয় হয়ে উঠলাম। মা বাবার চোখে আর সেই ভালবাসা দেখতে পাই না। প্রথম প্রথম ভাবতাম আমার বোঝার ভুল। কিন্তু বাচ্চারা আর কিছু বুঝুক না বুঝুক, আদরটা ঠিকই বুঝতে পারে। একসময় বাইরের কারও সামনে যাওয়া বারণ হয়ে গেল আমার জন্যে। খুব কষ্ট পেলাম সেদিন, রাতে বালিশ ভেজালাম কেঁদে কেঁদে। একদিন বাবা আমাকে নিয়ে গেলেন অনেক দূরের এক স্কুলে। আমি জানতেও পারিনি, এ জনমে আমার আর আমার পালক মা বাবার সাথে, আমার ছোট্ট ভাইটার সাথে দেখা হবে না।

আমার সমান আরও চার পাঁচটা ছেলের সাথে একটা রুমে শুরু হলো আমার নতুন জীবন। প্রথম রাতেই মোটা মত ছেলেটা এসে আমার বালিশ টেনে নিয়ে চলে গেল। ওর না কি একটা বালিশ পায়ের নীচে না দিলে ঘুম আসে না। আর আমি বালিশ ছাড়া অস্বস্তিতে ঘুমিয়ে পড়লাম ক্লান্ত হয়ে। সকালে ঘুম ভাঙ্গল গায়ের উপর কেউ পানি ঢেলে দেয়াতে। ধরমর করে উঠে বসতেই দেখি বাকি ছেলেগুলো দাঁত বের করে হাসছে। একটু পরেই বেশ মোটা মত এক মহিলা এসে ঢুকলেন ঘরে, ছেলেগুলো চুপ করে গেল সাথে সাথেই। মহিলা জ্বলন্ত চোখে চাইলেন ওদের দিকে, তারপর এগিয়ে এলেন আমার দিকে। আমাকে চূড়ান্ত রকম অবাক করে দিয়ে কষে এক চড় লাগালেন আমার গালে। চোখে মুখে অন্ধকার দেখলাম আমি। তারপর ধমকে উঠলেন – “এত বড় পুলা বিছানায় মুতে? জীবনেও শুনি নাই। যা, এই চাদর আর খেতা তুই ধুইবি এখন”। চিৎকার করে কেঁদে উঠতে গিয়েও সামলে নিলাম কান্নাটা। বুঝে গেছি আমি, এই পৃথিবীতে আমার কান্না শুনবার জন্য কেউ বসে নেই।

দিন গড়িয়ে মাস, মাস গড়িয়ে বছর – আমি বেড়ে উঠলাম এভাবেই, একা একাই, অনাদরে। সময়ের সাথে সাথে বদলে গেল স্কুল, বদলে গেল হোস্টেল। নতুন নতুন ছেলেমেয়ের সাথে পরিচয় হলো, আবার হারিয়ে গেল। এক সময় আমাকে দত্তক নেয়া বাবা আমার খরচ দেয়া বন্ধ করে দিলেন। হোস্টেল থেকে বারবার যোগাযোগ করে এক সময় জানা গেল তারা ঠিকানা বদল করেছেন, হারিয়ে গেছেন আমার জীবন থেকে। শুরু হলো আমার আরেক জীবন। হোস্টেল সুপার নিতান্ত দয়ার বশে আমাকে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দিলেন না। হোস্টেলে থাকার বদলে আমি পেলাম কাজের লোকের কাজ। টিচারদের ফুট ফরমাস খাটা, বাজার সদাই করে দেয়া, পা টিপে দেয়া, জুতো কালি করে দেয়া, কাপড় ধুয়ে দেয়া, ঘর মোছা – এসব কাজ আমাকে দিয়ে করিয়ে নিতেন সবাই। বয়স তখন কত হবে? ক্লাস ফাইভে পড়ি মনে হয়। আস্তে আস্তে বড় হয়ে উঠলাম এভাবেই। বুঝে গেছিলাম আমার নিজেকে দেখে রাখতে হবে আমাকেই। পড়াশুনাটা করতাম নিয়মিত। স্কুল কলেজের খরচ ওঠানোর জন্য কখনও ছাত্র পড়িয়েছি, কখনও বা একে তাকে ধরে খুব অল্প টাকার বিনিময়ে না না ধরনের কাজ করে দিয়েছি। পৃথিবীটা বড় কঠিন, সময় কারও জন্য অপেক্ষা করেনা, সবাই যে যার মত করে জীবন কাটায়। কারও জীবন কাটে হাসি আর আনন্দে, কারও বা কাটে সীমাহীন চিন্তায় আর কষ্টে।

(২)

রক্তটা দেবার মাস চারেক পর একদিন সকাল বেলা আমি গিয়ে হাজির হলাম মেডিকেল কলেজে। খুঁজে খুঁজে বের করলাম সন্ধানীর ছোট্ট অফিসটা। রক্তদাতার কার্ডটা বের করে দেখালাম, বললাম আমার রক্ত দিতে চাই আমি। টেবিলের অপর প্রান্তে বসা ছেলেটা বেশ উৎসাহের সাথেই আমার রক্ত নিতে শুরু করলো, এ নেগেটিভ রক্ত দুষ্প্রাপ্য আমি জানি, সেটাই ওর আগ্রহের কারণ। কিছুক্ষণ পর শুনতে পেলাম সেই কণ্ঠস্বর, যা পরীক্ষার দিন কয়েক আগেও আবার আমাকে টেনে এনেছে সন্ধানীতে। আরও দুটো মেয়ের সাথে কথা বলতে বলতে রুমে এসে ঢুকলো সেই মেয়েটা। চেয়ারে বসে থাকা ছেলেটাকে বলতে শুনলাম – “মৌরী, এদিকে দেখ একটু, আমি ক্লাসে যাই”। জানলাম – সেই মেয়েটার নাম মৌরী। মেয়েটা এগিয়ে এসে ব্লাড ব্যাগ চেক করলো। তারপর গিয়ে ড্রয়ার থেকে একটা ফাইল বের করে খুলে বসলো। ক্লাস করে এসেছে মনে হয়, ক্লান্ত লাগছে ওকে। আমাকে অতি অবশ্যই ভুলে গেছে। শত শত মানুষের রক্ত নিতে হয় ওদের, আলাদা ভাবে কারও কথা মনে রাখবার সময় কই? কিছুক্ষণ পর মৌরী এসে আমার বাহু থেকে সুঁইটা খুলে নিলো। রক্তটা ফ্রিজে রেখে কি খুঁজলো, তারপর বললো –

: স্যরি, ড্রিংকস শেষ হয়ে গেছে, চা খাবেন?

আমি মাথা নেড়ে সায় দিলাম, একটু পর গিয়ে বসলাম ওদের ক্যান্টিনে। এই প্রথম কাউকে দেখলাম ব্যাগে করে চায়ের কাপ সাথে নিয়ে ঘুরতে। সে একটা খালি কাপ এগিয়ে দিলো ক্যান্টিন বয়টাকে। নিজের কাপ ছাড়া এই মেয়ে চা খায় না।

: ভাইয়া, আপনার তো রেয়ার ব্লাড গ্রুপ, আপনি একটা কন্টাক্ট নম্বর দিয়ে যান, এর পর রক্ত লাগলে আমরা আপনার সাথে যোগাযোগ করবো।

চা খেতে খেতে আমার ঠিকানা লিখে দিলাম একটা কাগজে।

মাস তিনেক পেড়িয়ে গেছে, আমি মনে মনে দিন গুনছি, আবার কবে যাব সন্ধানীতে। নিজেকে অনেক বুঝিয়েছি, এসব আমার জন্যে না, আমি কোন ভাবেই ওকে পাবো না, হয়তো ওর বয় ফ্রেন্ড আছে, না থাকলেও আমার ইতিহাস শুনলে কোন মেয়েই আমার ব্যাপারে আগ্রহী হবে না। তবুও মন মানে না কিছুতেই। আমার কানে বাজে সেই রিনরিনে কণ্ঠ। আমি চোখ বুজে মুগ্ধ হয়ে শুনি।

একদিন দ্রুত পায়ে ক্লাস শেষ করে হোস্টেলে ফিরছি, ক্ষুধায় পেট চোঁ চোঁ করছে। এমন সময় দেখি মাঠের মাঝে আবার তাঁবু গেড়েছে সন্ধানী। তাঁবুর পাশ দিয়ে যেতে যেতে একটু থেমে উঁকি দিলাম তাবুর ভেতর। দেখলাম মৌরী আসেনি, আগে দেখা দুটো ছেলে আর কয়েকজন নতুন ছেলেমেয়ে এসেছে। ক্ষুধাটা মরে গেল হটাতই, হাঁটার গতি কমে গেল আমার, মন খারাপ হয়ে গেল খুব। চলে যাচ্ছিলাম, পেছন থেকে ডাক শুনে ঘুরে দাঁড়ালাম। দেখি সেদিনের রক্ত নেয়া ডাক্তার ছেলেটা ছুটতে ছুটতে আসছে –

: ভাইয়া, আপনি এ নেগেটিভ না?

একটু হেসে মাথা ঝাঁকালাম।

: আপনি প্লিজ এখুনি মেডিকেলে চলে যান, আপনার গ্রুপের ব্লাডটা খুব দরকার। আমাদের অফিসে গিয়ে খুব সম্ভব মৌরীকে পাবেন, ওকে বললেই ও রক্ত নিয়ে নেবে।

সন্ধানী অফিসে মৌরীকে পেলাম না। আরেকটা মেয়ে বসে ছিল, সে আমাকে সাথে নিয়ে ওয়ার্ডে চলে গেল। ওয়ার্ডের ভেতর ডাক্তারদের রুমে বেডের উপর বসে আছি, মৌরী এসে ইশারায় শুয়ে পরতে বললো, তারপর নিপুণ হাতে সুঁই ঢুকিয়ে দিল বাহুতে। খুব ব্যস্ত মনে হলো ওকে। রক্তটা নিয়েই আবার ছুট লাগালো ওয়ার্ডের ভেতর। যেতে যেতে আমাকে বললো –

: আপনি প্লিজ ওয়ার্ডের বাইরে গিয়ে একটু দাঁড়ান, আমি আসছি এখনই

আমি ওয়ার্ডের বাইরে দাঁড়িয়ে আছি।

আমি জানি আমি অনন্তকাল ধরে ওয়ার্ডের গ্রিল ধরে ওর জন্য অপেক্ষা করতে পারবো।

(৩)

ফাইনাল ইয়ারে উঠে পড়ার চাপ কমে গেল। কারণে অকারণে মেডিকেলে যেতে লাগলাম আমি। ভাবটা এমন, যেন কোন কাজে এদিকে এসেছিলাম, খোঁজ নিয়ে যাচ্ছি কারও রক্ত লাগবে কি না। কখনও দেখা হতো মৌরীর সাথে, কখনও হতো না। যেদিন দেখা হতো, পরবর্তী বেশ কয়েকটা দিন আমি আকাশে উড়তাম। এরপর আবার শুরু হতো অস্থির লাগা। যে বার ওর সাথে দেখা হতো না, আমি ঘরে এসে চুপচাপ শুয়ে থাকতাম, কিছুই ভাল লাগতো না।

এভাবে যেতে যেতে সন্ধানীর মোটামুটি সবার সাথে বেশ ভাল সম্পর্ক হয়ে গেল আমার। ওদের ছোট রুমটায় বসে এক সাথে আড্ডা দিতাম সবাই। এ কথা সে কথায় একদিন সবাই জেনে গেল আমি অনাথ আশ্রমে বড় হওয়া একটা ছেলে। আমার কোন জন্ম পরিচয় নেই। কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার, ওদের কারও চোখে আমি করুণা দেখিনি একদিনও, যা অন্য অনেক ছেলেমেয়ের চোখে দেখেছি। স্পষ্ট গৃণাও দেখেছি অনেকের চোখে আর ব্যাবহারে। সে কারণে নিজেকে গুটিয়ে রাখা আমি এখানে এসে যেন নিজেকে মেলে ধরতে পারতাম। এতদিনের একটা ছাই চাপা প্রতিভা, আমার আবৃত্তি করাটা ওরা খুব পছন্দ করতো। আমারও খুব ভাল লাগতো ওদের সাথে সময় কাটাতে।

একদিন আড্ডা শেষে সবাই ক্যান্টিনে বসে চা খাচ্ছিলাম। মৌরী যথারীতি ওর নিজের কাপে চা খায়, এটা নিয়ে ওকে খেপাচ্ছিল সবাই। আমিও যোগ দিলাম ওদের সাথে। হটাত দেখলাম মৌরীর চোখে স্পষ্ট শাসন। ছোট বেলা থেকে পরিস্থিতি সামাল দিতে শিখেছি আমি, বুঝতে পারলাম, হটাত করে থেমে গেলে সবার চোখে পড়বে ব্যাপারটা। তাই খুব কৌশলে আড্ডার টপিক বদলে দিলাম। একসময় কয়েকজন উঠে গেল ক্লাস করবে বলে, আড্ডাটা ভেঙে গেল, শুধু রয়ে গেলাম আমি আর মৌরী। ওরা চলে গেলে আরেক কাপ চায়ের অর্ডার দিলো মৌরী, তারপর বললো –

: থ্যাংকস মিস্টার এ নেগেটিভ
: কেন? আমি আবার কি করলাম?
অবাক হবার ভান করি
: ন্যাকামো করবেন না, ন্যাকামো অসহ্য আমার
বোকা বোকা একটা হাসি দিলাম আমি
: আপনি যে আমার চোখের ভাষা বুঝেছিলেন, এতেই আমি প্লিজড
শব্দ করে হেসে উঠলাম আমি
: আচ্ছা শোনেন, আপনি সব সময় এত সিরিয়াস হয়ে থাকেন কেন?
: কই? না তো। এই তো কি সুন্দর আড্ডা দিলাম আপনাদের সাথে
: আজিব তো! আমি বলেছি আপনি সিরিয়াস হয়ে থাকেন, কাজেই সেটাই মেনে নিন।
: আচ্ছা নিলাম মেনে
আবার হাসি আমি
: আর শোনেন, চিঠিপত্র পাওয়া বা লেখা, কোনটাই আমার ভাল লাগেনা। আপনি যদিও মিস্টার নেগেটিভ, দয়া করে পজিটিভ হোন
: মানে কি? আমি কি সব সময় নেগেটিভ কথা বলি না কি?
: ইয়া খোদা, এই লোকের মাথায় ঘিলু এত কম কেন?
আবার বোকা মার্কা হাসি দেই
: শোনেন, আপনি কেন কারণে অকারণে সন্ধানীতে আসেন, সেটা সবাই জানে, বুঝলেন?
দপ করে নিভে গেলাম আমি। হায় হায়, সবাই বুঝে গেল কিভাবে? লজ্জায় পড়লাম দেখি।
: তাহলে কি আর আসবো না?
: আমি কি সেটা বলেছি?
: না …
: এক ঘুষি দিয়ে নাক ফাটিয়ে ব্যান্ডেজ করে দেবো
হাসতে হাসতে শেষ আমি।
: এই শুক্রবার সকালে আমার হলের গেটে আসতে পারবেন? যদি কোন কাজ না থাকে আপনার।
: না, কোন কাজ নেই। কেন? কোথাও যাবেন?
: আমার জন্মদিন সেদিন।

আমি একুশটা টকটকে লাল গোলাপ নিয়ে গিয়েছিলাম সেদিন।

ভালবাসার একটা নিজস্ব উত্তাপ আছে। ভালবাসার মানুষটা সে উত্তাপটা অনুভব করতে পারে, মুখে বলতে হয়না তাকে। মৌরীকেও বলতে হয়নি আমার। অনাথ এই ছেলেটাকে দ্রুতই সঙ্গী করে নিয়েছিল সে।

(৪)

মৌরী চোখ বন্ধ করে আছে, ঘুমিয়ে গেল না কি সত্যি সত্যি?

সেদিনের পর থেকে পেরিয়ে গেছে কতগুলো মাস, বছর। মৌরী এখন ইন্টার্নিশিপ করছে মেডিকেলে। সামনেই আমাদের বিয়ে। ভার্সিটি থেকে বেশ ভাল রেজাল্ট করে বেড়িয়ে আমি ঢুকেছি একটা মাল্টি ন্যাশনাল কোম্পানিতে। ওর পরিবার আমাদের সম্পর্কটা মেনে নিয়েছে ভাল ভাবেই। আমার অন্ধকার অতীতের ছায়াটা সরে গেছে আমাদের আকাশ থেকে। পৃথিবীতে এখনও অনেক ভাল মানুষ রয়ে গেছে, যারা মানুষকে মানুষ হিসেবেই দেখে, তার বর্তমান দিয়ে, তার প্রাপ্তি দিয়ে বিচার করে।

আমি আস্তে করে মিউজিক প্লেয়ারের গানটা বদলে দেই। অসম্ভব দরদ দিয়ে রূপঙ্কর গেয়ে ওঠেন –

“সেই কথা বলো
এই ছায়া আলো
কার বুকেতে খোঁজে নীল
এক আকাশ নদী
কান্না ছোঁয় যদি
সেও কি হবে কোন মিল
এই দিন থেকে দিন
প্রতিদিন সরে যায়
এই ভোর যেন তোর
কোন সখ না মোছায় …”

গল্পের বিষয়:
রোমান্টিক
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত