হ্যারিকেনের আলোতে দেখা যাচ্ছে চৈতি বিছানার উপর জুবুথুবু হয়ে বসে আছে, আমার ভিতরের পশুটার ইচ্ছে করছে চৈতিকে গিয়ে বস্ত্রহীন করে ফেলে তারপর ঝাপিয়ে পড়তে। আলনার কাছে গিয়ে পাঞ্জাবি খুলতে লাগলাম শরীরে দিয়ে যেন আগুন বের হচ্ছে, পাঞ্জাবিটা অর্ধেক খুলতেই পিছন থেকে অসহায় একটা কণ্ঠস্বর শুনলাম – আমার খুব খিদে পেয়েছে। আসলেই তো সারাদিনে আমি একবারো খোজ নেই নি চৈতি খেয়েছে কিনা। চৈতির দিকে ফিরে তাকাবার সাহস হল না, খুব অপরাধবোধ কাজ করতে লাগল। হেশেলে গিয়ে দেখলাম হাড়ির তলায় কয়েক মুঠো ভাত পড়ে আছে, কপাল বলতে হয় আমার! বিন্তীর মায়ের জ্বর আসতে হল আমার বিয়ের সময়টাতেই! সকালে এসে রেঁধে দিয়ে গিয়েছে আর কোন খোঁজখবর নেই তার। আমার রান্নার হাত মুটামুটি ভালই তা অত সাত পাচ না ভেবে কড়াইয়ে জাল দেয়া পুঁটীমাছ স্টোভে আগুন ধরিয়ে শরষের তেলে ভেজে নিয়ে আসলাম। থালাটা বিছানার উপরে রেখে বললাম – খেয়ে নাও।
এই ফাকে আমি যেয়ে পাজামা পাঞ্জাবি বদলে আসলাম, এসে দেখি যেমন থালা তেমন ই আছে! আস্তে আস্তে কাছে যেয়ে বসলাম, খাচ্ছো না কেন? চৈতি এবার ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্না শুরু করল, মিনিট খানেক কেঁদে নিজেই থেমে গেল আমি কান্না থামাবার কথা একবারো বলিনি আসলে তখন নিজের উপর নিজেই গালি দিচ্ছলাম এই ভেবে- শালা তিনদিন হল বিয়ে করলাম এখনো বউয়ের আদর সোহাগ কিচ্ছুই পেলাম না! চৈতি এবার কান্না থামিয়ে নিজেই বলতে শুরু করল – নিবুদের বরই গাছে উঠেছিলাম সেদিন, বরই পাড়তে গিয়ে কাটার আচড়ে হাতের তালু কেটে গেছে এই বলেই আমার দিকে হাতটা ধরল, এতখানি কাটলো কি করে! হাতের তালুর মাঝ বরাবর লম্বা করে একটা কেটে যাওয়া দাগ! দেখেই বোঝা যাচ্ছে এখনো ব্যথা করছে ওর। এবার আমার কেন জানি ওর উপর খুব মায়া হল, হাতটা ধরলাম তারপর ভাল করে সেখানে মলম লাগিয়ে দিলাম, তারপর আস্তে আস্তে ফু দিতে লাগলাম, চৈতি চুপচাপ বসে বসে আমার কান্ড দেখছে।
আমি হাত ধুয়ে এসে জলপাইয়ের তেল দিয়ে ভাত মেখে আস্ত পুটি মাছ দিয়ে গালে তুলিয়ে ভাত খাইয়ে দিলাম যখন ভাত খাইয়ে দিচ্ছিলাম চৈতির ছোট ছোট দাতগুলো আমার আঙুলের সাথে বেধে যাচ্ছিল.. মনে হচ্ছিল কেউ আমার আঙুলে চুমু খাচ্ছে। চৈতির মুখের দিক চেয়ে দেখলাম একটা তৃপ্তির আভা। চৈতির জীবনের এই তের বছর কাটিয়েছে তার বিধবা মাসির কাছে বিয়ের সময়ে এক টাকাও পণ দাবি করিনি আমি, বাবা মা মারা গিয়েছেন অনেক আগেই তাই বিরাট এই বাড়িতে আমি একাই ছিলাম। দশ পা বাড়ালেই কাকার বাড়ি, তারা থেকেই চৈতিকে আমার বউ করে এনেছেন। চৈতি খুব দুরন্ত ও ডানপিটে স্বভাবের। বয়স কম হবার কারনে ভয়ডর কম এইতো গতকাল কাকীমাকে বলল- আমার স্বামীর ঘর থেকে যখন তখন চাল নারকেল নেয়া চলবেনা! কাকীমা তো একজায়গায় স্থির হয়ে দাড়িয়েছিলেন পরে আমি অনেক বুঝিয়ে শুনিয়ে তাকে শান্ত করেছিলাম, আবার সন্ধ্যাবেলায় দেখি পাড়ার বাচ্চাদের সাথে উঠানে গোল্লাছুট খেলছে! এই বয়সের ছেলে মেয়েরা একসাথে দুটো সত্ত্বা ধারন করে থাকে – প্রথমত তারা নিজদের স্বভাবজাত ব্যবহার নিজের অজান্তেই করে ফেলে, দ্বিতীয়ত তারা সব সময়ই নিজেদেরকে ম্যাচিউরড হিসেবে উপস্থাপন করার চেস্টা চালিয়ে থাকে, চৈতিও তাই এর ব্যতিক্রম নয় সেও। বারান্দায় এসে সেগুন কাঠের চেয়ারটায় বসে চুরুট ধরালাম, হঠাৎ করেই নিজের ভিতর মনুষত্ব জেগে উঠল এবার আমার পাশবিক পুরুষটা পালিয়ে গেল। আসলেই তো আমি কি করতে যাচ্ছিলাম! ছোট্ট একটা মেয়ে সে আর আমি কিনা তার উপর পশুর মত আচরণ করতে যাচ্ছিলাম!
হ্যা অন্য সবাই ই তাই করে তাদের বউও এই বয়সের ই হয় কিন্তু তাদের সাথে আমার যে একটা পার্থক্য রয়েছে সেটা কেন ভুলতে বসেছিলাম আজ আমি! না, চৈতি সময় নিক, সে যেদিন ধরা দেবে নিজ থেকে সেদিনই আমি হাত বাড়াবো তার আগে নয়। ঘরে গিয়ে দেখি চৈতি বালিশ ছাড়াই ঘুমিয়ে পড়েছে, গুটিসুটি হয়ে শুয়ে আছে সে। মাথাটা বালিশের উপর রেখে গায়ে একটা কাথা দিয়ে দিলাম তার পাশে আমিও শুয়ে পড়লাম।মধ্য রাতে ঘুম ভেঙে গেল, কেউ যেন আমার মাথায় হাত দিয়ে আমাকে ডাকছে চোখ মেলে দেখি চৈতি ডাকছে, ঘুম ঘুম চোখে জিজ্ঞেস করলাম কি হয়েছে? সে বলল-আমি টাট্টিতে যাবো, অগত্যা উঠে পড়ে হ্যারিকেনের আলো বাড়িয়ে তাকে নিয়ে বাইরে বের হলাম বাইরে হাল্কা শীত পড়েছে। সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখি চৈতি আমায় জড়িয়ে ঘুমিয়ে আছে, চৈতির মুখের কাটা দাগ আর চুলগুলো সামনে এসে তাকে অনেকটা সুন্দর করে তুলেছে, আহ এই মুখ যেন আমার চিরচেনা! এখন আর উঠতে ইচ্ছে হচ্ছেনা পাছে যদি চৈতির ঘুম ভেঙে যায় তাহলে আমি আজন্মের প্রতীক্ষারত এই দৃশ্য আর হয়ত দেখতে পাবোনা। আচ্ছা চৈতির মুখ কেটেছিল কেন? জিজ্ঞেস করে নেব পরে, একটু পরেই চৈতি উঠে পড়ল, নিজেকে আমার এত কাছে দেখে সে খানিকটা ধাক্কা খেল যেন! দ্রুত নিজেকে গুটিয়ে নিল অন্য পাশে। আমি হাত মুখ ধুয়ে আসলাম, এসে দেখি বিন্তীর মা গমের রুটি আর আলু ঘন্ট করে রেখে গিয়েছে। খেতে বসেছি এই মুহুর্তে মনে হল- চৈতিকে নিয়েই খায় তবে। ঘরে গিয়ে দেখলাম চৈতি জানালা দিয়ে বাইরে খেলা করা দুটো হাসের বাচ্চার দিকে তাকিয়ে আছে আর মিটমিট করে হাসছে, আমি বললাম- চৈতি হাত মুখ ধুয়েছো? চৈতি মাথা নেড়ে বলল – না। আচ্ছা যাও হাত মুখ ধুয়ে আসো, পুকুরঘাটে কয়লা রাখা আছে।
সে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইল, খানিকক্ষণ পরে বলল – ডান হাত কাটা আঙ্গুল পর্যন্ত ব্যথা লাগে যে, আর বা হাত দিয়ে তো টাট্টি করি। পুকুরঘাটে এসে বললাম নাও কয়লা কামড়ে ছোট করে নাও, তারপর আস্তে আস্তে আমি ওর গালের ভিতর আঙুল দিয়ে দাত মেজে দিলাম চৈতির ছোট ধারালো দাতগুলো আমার আঙুলে লাগছিল, এ এক অন্যরকম ভাল লাগা। বিকাল হলেই চৈতি নারকেল তেলের বোতল এনে আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলত – এই নেন আমার মাথায় তেল দিয়ে বিনুনি করে দেন, খবরদার জবজবে করে তেল দিবেন না আমার গা চুলকোয়, আমি মনেমনে হেসে খুব যত্ন নিয়ে তেল লাগিয়ে দিতাম চৈতির চুলে তারপর নানা রঙের ফিতে দিয়ে বউটার চুলে বেনুনি করে দিতাম। বেনুনি করা শেষ হলেই সে উধাও হয়ে যেত, কখনো খুঁজতে গিয়ে দেখতাম বউ আমার কুতকুত খেলছে নয়তো দড়ি লাফ নয়তো গোল্লাছুট বা বরফ পানি। মাঝে মাঝে তো আমাকে বলত- আপনি আর একটু দাড়ান এই দান খেলেই বাড়ি চলে যাব কিন্তু সেই দানের পরও পাগলী বউটা আরো কয় দান খেলত তার হিসেব রাখতে গিয়েই আমি হাপিয়ে উঠতাম। রাতে আমি যখন বসে ধানের হিসেব করতাম তখন সে বেহুঁশ হয়ে ঘুমাতো কত রাত যে তাকে ডেকে তুলে গালে তুলে খাইয়ে তুলে দিয়েছি সে হিসেব নেই, সকালে উঠে সে বলত -আপনি আমাকে না ডেকেই খেয়ে নিয়েছেন!
আমি তখন একগাল হেসে বলতাম – তুমি না খেলে আমার কী? এই কথা বলতে দেরি কিন্তু বউয়ের চোখ দিয়ে পানি পড়তে বেশি দেরি হত না। তারপর যখন তার মনে পড়ত যে রাতে তাকে আমি খাইয়ে দিয়েছিলাম তখন আমাকে এসে বলত- মিথ্যুক কোথাকার..মিথ্যা বললেন কেন। তখন আমি আবার হেসে ফেলতাম সঙ্গে সেও হাসত। একদিন দুপুরে সে এসে বলল সে আবার পড়াশুনা করবে, শুনে খুব খুশি হলাম তার জন্য বই খাতা কিনে আসলাম। কিন্তু ঝামেলা বাধলো তার একা একা পড়তে ইচ্ছে করেনা, তারপর কাকার ছেলে অমিতকে তার সঙ্গী হিসেবে নিয়ে আসলাম। চৈতি এবার খুব খুশি হয়ে পড়াশুনা করতে লাগল। এবার রাতের বেলায় চৈতি উপন্যাস পড়তে শুরু করল প্রায়ই আমাকে এটা ওটার মানে জিজ্ঞেস করত আমি খুব সুন্দর করে তাকে উপন্যাসের অর্থগুলো বুঝিয়ে দিতাম দেখতে দেখতে বিয়ের বয়স বছর দুয়েক পেরিয়ে গেলেও আমি আমার সিদ্ধান্তে অটল থাকলাম চৈতি মাঝে মাঝে ঘুমের ঘোরে আমাকে জড়িয়ে শুয়ে থাকত, এই পর্যন্ত ই ছিল আমাদের কাছে আসা অথচ খুব করে চাইতাম চৈতি আমার কাছে ধরা দিক কিন্তু চৈতি সেটা কখনো করেনি। আসলে সম্পর্কটাতে আমি তখন কোন চাহিদার আভাস চৈতিকে দেয়নি, আর চৈতিও না এর পিছনে কারন ছিল চৈতিকে আমি নিজের হাতে গুছিয়ে রাখতাম আর সেটাকে চৈতি স্নেহের চোখে দেখত সেখানে হয়ত ভালবাসা নামক শব্দটা তার মাথায় আসত না। আমার দেখা চৈতি কৈশোর থেকে যৌবনে পা বাড়ালো, আমি নিজ হাতে গড়ে তুললাম আমার চৈতিকে। এখন চৈতি বেহিসাবি কথা বলেনা কারো সাথে, তার সঙ্গী অমিত আর আমি ছাড়া কাওকে সে একটুও জালাতন করেনা, তেমন কথাও বলেনা আগের মত, সন্ধ্যা পর্যন্ত গোল্লাছুট খেলেনা।
সেদিন বিকেলে হাট থেকে এসে দেখি অমিত চৈতির চুলে তেল মেখে দিচ্ছে চৈতি পাখিটা কি যেন শুনে হেসে গড়াগড়ি খাচ্ছে আমার ভিতরে বাস করা নরম জিনিসটাতে কে যেন খুব যত্ন করে হাতুড়ি দিয়ে আলতো করে একটু আঘাত করল, দেখেও না দেখার ভান করে হেশেলে গিয়ে বাজারের ব্যাগটা রেখে বিন্তীর মাকে ডাকতে গেলাম কিন্তু কে যেন পিছন থেকে বারবার টেনে ধরছিল। রাতে আমি ফাইল গুছিয়ে রাখছিলাম পরের দিনের চাকুরীর ভাইবার জন্য তখন চৈতি বলল- আপনি কখনো কোন ছেলেকে লজ্জায় লাল হয়ে যেতে দেখেছেন? বলেই সে খিলখিল করে হাসতে থাকে – সদ্য যৌবনে পা দেয়া চৈতির হাসিতে এক বিস্তর মাদকতা আছে! মুগ্ধ হয়ে দেখলেই শুধু তৃপ্তি মেটেনা মাঝে মাঝে সেই মাদকতায় মাতাল হতেও ইচ্ছে করে। চৈতির দিকে তৃপ্ত চাহনি দিয়ে জিজ্ঞেস করলাম- কেন কি হয়েছে? আরে আর বলবেন না কোন কিছু বললেই অমিত লজ্জায় লাল হয়ে যায় শুধু থোতলায়.. বলেই আবার হাসি শুরু করল। আচ্ছা কি এমন কথা বলে ওরা যে অমিত লজ্জায় লাল হয়ে যায়! অমিতকে কিছু বললে সেটা অন্যরকম দেখা যাবে আর চৈতিকে জিজ্ঞেস করলে চৈতি ভাববে আমি তাকে অবিশ্বাস করছি পাছে সে কস্ট পাবে। ইদানীং রাতে চৈতি একটা দূরত্ব রেখে শুতে লাগল। আমি বুঝতে পারলাম চৈতি বদলে যাচ্ছে, এখন রাতে আমাকে ডাকেনা সে একা একাই টাট্রিতে যায়, তার হাত ভাল হয়ে গেছে তাই আমাকে আর খাইয়ে দিতে হয়না দাত মেজে দিতে হয়না,আমার কাছে ঘনঘন কোন শব্দের মানে জানতে চায়না সে, ঘুমের ঘোরে আমাকে জড়িয়ে ধরেনা, আর তেল দিতে আমাকেও ডাকেনা এখন সে।
আমি চাইলেই জোর করে কাছে যেতে পারতাম, স্বামীর অধিকার খাটাতে পারতাম কেননা ততদিনে সে অনেক কিছু বুঝে গিয়েছে কিন্তু ঐ যে নিজের ভিতরে থাকা প্রবল জিদ আর চৈতির বদলে যাওয়া স্বভাব তখন খুব জোরে ধাক্কা দিল আমাকে। একদিন সকালে জানতে পারলাম একটা বিদেশী কোম্পানিতে খুব ভাল বেতনে চাকুরী পেলাম কিন্তু কাজের জন্য নেপাল যেতে হবে আমাকে। অনেক ভাল বেতন আর দুজনের ভবিষ্যতের কথা ভেবে যেতে রাজি হলাম, চৈতির মাসিকে রেখে গেলাম চৈতির সাথে, আসার সময় ভেবেছিলাম চৈতি কেঁদে কেঁদে বলবে আমাকেও সঙ্গে নিয়ে যান কিন্তু সে তা করেনি। তার মনটা অনেক খারাপ হয়েছিল মুখটাও মলিন ছিল আমার হাতটা সেদিন ধরে বলেছিল- আমাকে চিঠি পাঠাবেন কিন্তু প্রতি মাসে মাসে আমি সেদিন আড়ালে গিয়ে কেঁদেছিলাম চৈতির ঐ একটা আকুলতা আমাকে কাদিয়ে দিয়েছিল। নেপালে এসেছি এই দুই মাস এর মাঝে তিনিটে চিঠি দিয়েছি চৈতিকে তার জবাবে চৈতির কাছ থেকে একটা চিঠি পেয়েছিলাম :-
প্রিয় রুদ্র
আপনি তিনিটে চিঠি দিয়েছেন কিন্তু তার উত্তর দেয়া হয়ে ওঠেনি, সামনে পরীক্ষা তাই একটু পড়াশুনা করছি। টুকটাক রান্না শিখে গিয়েছি আমি। ভাল একটা কথা শুনুন- অমিতের লজ্জা এখন ভেঙে গিয়েছে, সে ই আমাদের বাজার করে দেয় আমার এটাওটা এনে দেয় এখন। আমি অঙ্ক না বুঝলে সে ই আমার শেষ ভরসা। মাস্টার মশাই বলেছেন আমরা দুজন ই ফার্স্ট ডিভিশন পাব। আপনি আশীর্বাদ করবেন, আচ্ছা বিদেশের মেয়েরা নাকি খুব খারাপ হয়? তারা নাকি বিদেশী ছেলেদের সাথে খোলামেলা চলাফেরা করে? আচ্ছা যাই হোক, সকাল সকাল উঠতে হবে আমাকে এখন অনেক রাত, আপনাকে চিঠি লিখতে লিখতে ঘুম পাচ্ছে খুব। আর হ্যা চিঠির উত্তর দিতে দেরি হলে রাগ করবেন না আবার।
ইতি
চৈতি
আফসোস চিঠির কোথাও জিজ্ঞেস করেনি আমি কেমন আছি! আমার শরীর কেমন! পুরোটা জুড়েই অমিত আর চৈতি, আচ্ছা বিদেশে মেয়েরা খারাপ হয় এসব কথা তাকে কে বলেছে? নিশ্চয় অমিত বলেছে সব কেননা না হলে চৈতি বলত না অমিতের লজ্জা ভেঙে গিয়েছে। খুব কস্ট হল। এই বিদেশে এসেও চৈতির মুখটা ভাসত চোখের সামনে সারাটাদিন। দেড় বছরের ডিল নিয়ে এখানে এসেছি, বাড়ি ফিরতে ফিরতে আরো বছর খানেক এর চেয়েও বেশি সময়। দিন যেতে লাগল, গত নয় মাসে মোট ছয়খানা চিঠির একটারও উত্তর আসেনি। ম্যানেজারকে দিয়ে প্রতি সপ্তাহে পাঠাতাম খোজ নিতে কিন্ত সে প্রতিবার ই এসে ভাঙা ভাঙা ইংরেজিতে বলত :-
“O Babu.. yet not the letter has received…”
এরপরে তো আর তাকে বলার ই সাহস পেতাম না। একদিন রাতে স্বপ্ন দেখলাম অমিতের মুখের সাথে মুখে লাগিয়ে শুয়ে আছে চৈতি ঠিক যত কাছাকাছি চোখাচোখি হলে সব কিছু থমকে যেতে পারে ঠিক ততটা কাছাকাছি, অমিতের বুকের সাথে লেপ্টে আছে আমার চৈতি। স্বপ্নের ভিতর চিৎকার করে কাঁদছিলাম আমি, কতটা কস্ট এই দৃশ্য দেখা সেটা যাদের ভালবাসার মানুষকে অন্য কারো বুকে লেপ্টে থাকতে দেখেছে এভাবে সেটা তারা ছাড়া আর কেউ ই বুঝবেনা। তখন ভাবতাম কোন সমস্যার কারনেই হয়ত চিঠি এসে পৌছায়নি। অনেকগুলো টাকা পেলাম ডিল শেষে, চৈতির জন্য এখান থেকে গয়না কিনলাম দেশের সব কিছুতেই ভেজাল, আরো অনেক কিছুই কিনলাম। বাড়ি ফিরছি প্রায় দেড় বছর পর কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার হল এতদিন পর দেখা হলেও কেউ আগ্রহ দেখিয়ে কথা বলছেনা। বাড়িতে গিয়ে দেখলাম মাসি উঠানে বসে মাছ কাটছে। উনি আমাকে দেখে ভয়ে কুঁচকে গেলেন, ঘোমটাটা নামিয়ে দিলেন। আমি ভালমন্দ জিজ্ঞেস করে বললাম -মাসি চৈতি কোথায়?
তিনি চুপ করে রইলেন। কাকাবাবু আমাকে দেখে এসেই জড়িয়ে ধরলেন এবার উনি কাঁদতে শুরু করলেন। ভাবলাম অনেকদিন পর দেখা তাই কাঁদছেন কিন্তু ভুল ভাঙল তখন যখন কাকীমা বললেন- বাবা তুই আমাদের ক্ষমা করে দে বাবা, নিজের পেটের ছেলে যে এমন করতে পারে সেটা কখনো কল্পনা করিনি। আমি বার বার জিজ্ঞেস করলেও উনি ক্রমাগত কেদেই চলেছিলেন, পাশের বাড়ির বুড়িটা এসে আমার দিকে তাকিয়ে বলল- বউ নেকে বিদেশ যাতি নেই.. এ কতা তোরে কেউ কয়নি আগে? হদচ্ছাড়া এবার বোঝ বউ পরপুরুষ এর হাত ধরি রাতির বেলা ভাইগে গিলি কিরামডা লাগে..বোঝ এবার। আমার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল, পায়ের তলার মাটি সরে গেল.. আমার চোখ দিয়ে ক্রমাগত পানি বের হতে লাগল তখন বার বারর মনে হচ্ছিল ইশ্বর কেন এখনো আমার চোখ অন্ধ করে দিচ্ছেনন না! আমি যে কিছু দেখতে চাচ্ছিনা আমার কোন কিছু দেখার সাহস ও যে হচ্ছেনা। সেদিন বুঝতে পেরেছিলাম –
ভালবাসার লাল দাগে বাতাস স্তব্ধ হয়ে যায়, কলমে কাপুনী ধরে যায়, গোল চাঁদটা ফিকে হয়ে যায়, বাচার ইচ্ছেটা নিমিষেই কর্পূরের মত হাওয়ায় ভেসে যায়।