লুকোচুরি গল্প

লুকোচুরি গল্প

বিয়ের রাতেও মেয়েটিকে অসম্ভব সুন্দর লাগছিল।মেয়েদের সাজলে আসলেই সুন্দর লাগে।তার কাজলের ন্যায় চোখ দুটি দেখে আমি মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলাম।পাঁপড়ির মত ঠোঁটযুগল মনে একটা আকাঙ্ক্ষা জাগিয়ে তুলেছিল।সব সময় ভালবাসা কে বন্দি করে রেখেছিলাম নিজের খাঁচায়।আজ বিয়ে হয়ে গেল।তাই সব ভালবাসা এখন সেই মেয়েটির জন্য। এতদিন যা জমা ছিল তা একটু একটু করে মেয়েটির কপাল ছুঁইয়ে দিব। . বিয়ের দিন মেয়েরা যে এত কাঁদে তা ওকে না দেখলে বুঝা যেত না।বলা যেতে পারে অকেই আমি প্রথম দেখলাম কনে সাজে কাঁদতে।কারন এর আগে কন্যা বিদায় আমার দেখার সৌভাগ্য হয়নি।শুধু গল্পই যা শুনেছিলাম।আজ নিজ বউয়ের কন্যা বিদায় দেখছি। হয়ত আমার মেয়ের বিদায়ের আগে আর কন্যা বিদায় দেখা হবে না।কারন আমি এসব দেখতে পারি না। সম্পর্ক গুলো কাঁদুক এই বিষয় টা বরাবরের ন্যায় একদম বাজে এক অনুভূতি আমার কাছে।তাই সচরাচর এসব থেকে নিজেকে দূরেই রাখতে ভালবাসি। নেহাত নিজের বউ আর মেয়ে বলে কথা তাই দেখতে হচ্ছে আর মেয়ের বেলাই তো দেখতে হবেই। . রাতের ড্রিম লাইটে পুরো ঘর আধো আধো আলোতে জ্বলছে।খাটের চারপাশ ফুল দিয়ে সাজানো হয়েছে।সেই ফুলের সুবাস পুরো ঘর জুড়ে ছড়িয়ে পড়ছে। মেয়েটি ঘোমাটা দিয়ে এক ভাবে বসে আছে। আমি প্রথমে কিছুটা অস্বস্তি বোধ করি।কি বলব না বলব।নিজের বউ হলে কি হবে এখনও যেহেতু পরিচিত হইনি আমরা সুতরাং অপরিচিতই দুজন। . চুপচাপ দুজনেই কিছুক্ষণ বসে থাকলাম।তারপর ভাবলাম মেয়েরা লাজুক স্বভাবের হয়।হয়ত তাই সে নিজে থেকে আমার সাথে অবশ্যই আগে কথা বলবে না। তাই লজ্জা, ভয় সরিয়ে মেয়েটির ঘোমটা তুলেই ফেললাম অনেক টা সাহস জুগিয়ে। . মনে হচ্ছিল এক অপ্সরী বসে আছে আমার সামনে।দুচোখ ভরে দেখছি তাকে। এ দেখা যেন শেষ হয় না। এইবার প্রথমে মেয়েটিই আমার সাথে কথা বলল। আমি অবাক হয়ে গেলাম।যতটা লাজুক ভেবেছিলাম ততটা হয়ত লাজুক না সে। ব্যাস,ধীরে ধীরে আলাপ আলোচনা চলতেই থাকলো আমাদের। এক মুহূর্তে সেই অচেনা মেয়েটি আমার কাছে পরিচিত হয়ে উঠলো।সে এখন আমার জীবন সঙ্গিনী। . একদিন,দুদিন করতে করতে পুরো দুইটা বছর চলে গেল আমাদের। সংসারের খুঁনসুটি রাগ অভিমান, আর মিষ্টি ভালবাসা সবকিছু নিয়েই চলল আমাদের এই সংসার। . একদিন দুপুরবেলা সে হঠাৎ মাথা ঘুরে পড়ে গেল। প্রাইভেট ডাক্তারকে সাথে সাথে তলপ করা হলো।। ডাক্তার এসে আমাকে সেদিন জীবনের সবচেয়ে বড় খুশির সংবাদ টি দিয়েছিলেন। হ্যাঁ আমি বাবা হব। ওর পেটে ছোট্ট একটা অস্তিত্ব বেড়ে উঠছে। আমি সব সময় ওর খেয়াল রাখতাম।যে আসছে তার কোনো অযত্ন হতে দিতাম না। সময় মত ওষুধ, গোসল,খাওয়া দাওয়া সবদিকে খেয়াল রাখতাম আমার বউটির।কারন তার অযত্ন হলে সেই অতিথিও যে অযত্নে থাকবে। . ধীরে ধীরে সময় চলে যাচ্ছে। অবশেষে আমার জীবনের অন্যতম আনন্দের দিনটি চলে আসল।একটি কন্যা সন্তানের আমি বাবা হলাম। ওকে যখন দেখলাম হাসপাতালের দোলনায় চোখ বুজে শুয়ে আছে।ওর ছোট্ট হাত,পা, ছোট্ট মাথা আর কিছু ঘন কালো চুল তখন নিজের আনন্দ টাকে আর ধরে রাখতে পারলাম না। ভাবলাম আমার বউ আজ আমাকে জীবনের সেরা উপহার দিয়েছে। জড়িয়ে ধরলাম বউকে। আলতো আদরে ভরিয়ে দিলাম তার কপাল। . সময়ের কাঁটা এগিয়ে চলল। দেখতে দেখতে পঁচিশ বছর পার হয়ে গেল। আমার সেই ছোট্ট মেয়েটি অনেক বড় হয়ে গিয়েছে।পেশায় সে এ্যাএডভোকেট। আজ আমার সেই ছোট্ট সোনামনির বিয়ে। মেয়ে আমার বড় হয়ে গেলেও আমার কাছে ঠিক যেদিন হাসপাতালের দোলনায় দেখেছিলাম ছোট্ট মেয়েকে সে রকমই রয়ে গেছে। সন্তান রা যে বাবা মায়ের কাছে আজীবন ছোটই থাকে।নইলে যে সন্তানরা ভুল করলে আমরা আর তাদের কে ক্ষমা করতে পারতাম না। . অনেক জাঁকজমক ভাবেই আমার মেয়ের বিয়ে দিচ্ছি।ছেলে পেশায় ইঞ্জিনিয়ার। আশা করি মেয়ে আমার সুখেই থাকবে।ওর সব আবদার মেনে নিয়েছি।তাই শেষ আবদার টুকুও মেনে নিলাম। ওর নিজের পছন্দ অনুযায়ী বিয়ে দিচ্ছি আজ। . বিয়ে সম্পন্ন। এখন কনে বিদায়ের পালা। চারিদিকে বিয়ের করুন বাদ্যযন্ত্র গুলো বেজে উঠলো। মেয়েটির কনে বিদায় তো দেখতেই হবে।তাই হাজার কষ্ট বুকে পাথর জমা রেখে আমার সেই মেয়েকে বিদায় দিলাম। কাঁন্নাকে চেপে ধরে রাখলাম।আজ বুঝলাম কনে বিদায় বেলায় মেয়েরা এত কাঁদে কেনো? আসলে পুরুষ মানুষরা এই কাঁন্না বুঝবে না যতদিন না সে তার মেয়েকে বিদায় দিচ্ছে। সত্যিই সেই সময় টুকু ভয়াবহ আকারের দুর্বিষহ একটা সময়।যা সকল কন্যার বাবাকেই মুখোমুখি হতে হয়। . ভাবছেন তো আমার সহধর্মিণী কই গেলো? মেয়ের বিদায় হয়ে গেল তবুও তার একটি কথাও বললাম না? আসলে মেয়ে কে বিদায় দিয়ে আমি আজ বড্ড বেশি একা হয়ে গিয়েছি। আমার সেই মিষ্টি বউটি আমাকে ছেড়ে চলে গেছে আরো ১৩ বছর আগে। আমার জীবনের প্রথম কষ্টের আঘাত সেইদিনটিই ছিল যেদিন তার মৃত্যু হয়। একটা কঠিন অসুখে ধরেছিল ওকে।বাঁচাতে পারিনি । ধরে রাখতে চেয়েও ধরে রাখতে পারি নি তাকে। একা করে দিয়ে চলে যায় সে ওপারের দুনিয়ায়। আসলে যে যাবার সে চলেই যাবে।ধরে রাখার ক্ষমতা গুলো মানুষের নাই।যদি থাকত তবে দুঃখ বলে পৃথিবী তে হয়ত কিছু থাকত না। আর আজ আমার দ্বিতীয় কষ্টের দিন। মেয়ের বিদায়ের দিন। মেয়ের বিদায়ের দিনের সাথে প্রথম কষ্টের আজ একটা টান অনুভব করছি। কারন ২৭ বছর আগে এমনি এক মেয়ের বিয়ের বিদায় বেলার কাঁন্না দেখেছিলাম। সেদিন ছিল প্রথম।আর আজ শেষ। বউ চলে গেল।মেয়েকেও বিদায় দিলাম। এখন পুরো ঘর জুড়ে শুন্যতা। এইভাবেই হয়ত সবাই লুকোচুরি খেলা খেলে চলে যাবে জীবন নামক সংসার থেকে। আমিও একা একা চেয়ে রব সেই অজানা পৃথিবীর দিকে। শুধু সময়ের অপেক্ষা। হয়ত আজ নয়ত কাল। আমাকেও যে যেতে হবে সেখানে। কেউ হয়ত আমাকেও সেদিন জোর করে ধরে রাখতে চাইবে কিন্তু পারবে না ধরে রাখতে। এ যে প্রাকৃতিক খেলা। কারো সাধ্য নেই এ খেলায় জয়ী হবার। . .

গল্পের বিষয়:
রোমান্টিক
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত