একটু পরেই ঘন্টা বাজবে। ঘন্টা বাজলেই টিফিন। ক্ষণিকেই পূর্ণ হয়ে উঠবে পুরো ক্যাম্পাস। ক্যান্টিনেও হবে প্রচুর ভিড়। টিফিন মাত্র ১৫ মিনিটের। ভিড় ঠেলে পছন্দের খাবার কেনা যেনো প্রায় দুঃসাধ্য। আর এই দুঃসাধ্য জয়ের সাহশ নেই আমাদের।
.
আর তাই টিফিন দেওয়ার আগেই আমরা ক্যান্টিন প্রাঙ্গণ দখল করে বসে আছি। গরম গরম সিঙ্গারা আমাদের খুব পছন্দ। এদিন আমরা পেলাম পছন্দের সিঙ্গারা। যা আমরা তিন বন্ধু মজার সুখে বসে বসে খাচ্ছি।
.
এমন সময় হঠাৎ একটি মেয়ের আগমন ঘটলো। মেয়েটি ক্যান্টিনের দরজায় কড়া নাড়লো। কিন্তু ক্যান্টিনের কাক্কুর দরজা খোলার নামগন্ধ নেই। অনেক্ষন পর কাক্কু দরজা খুললো। মেয়েটি চিপস কিনতে চাইলো। কিন্তু কাক্কু দিলো না। এখন নয়, কাক্কু মেয়েটিকে টিফিনে আসতে বললো।
.
বলা বাহুল্য, আমাদের কলেজ অনেক কড়া। নানান নিয়মকানুনে ঠাশা। শুধু টিফিন পিরিয়ডে ক্যান্টিন থাকে খোলা। বাদবাকি সময় ক্যান্টিন খোলা রাখার নিয়ম নেই।
.
মেয়েটি কাক্কুকে অনেক অনুনয় বিনয় করলো। কিন্তু কাক্কু কিছুই শুনলো না। উল্টো মুখের উপর দরজা বন্ধ করে দিলো। এবার মেয়েটি আমাদের দিক তাকিয়ে। আমাদের সিঙ্গারা পার্টি তখনো চলছে।
.
মেয়েটির চেহারায় আক্ষেপের ছাপ। চোখ জোরা দেখে বুঝা যাচ্ছে সে ভীষণ রাগান্বিত। আর তা হয়তো আমাদেরকে দেখেই। আমি মেয়েটির দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি। মেয়েটি ভীষণ সুন্দর। যতোই রাগছিলো, ততোই যেনো সৌন্দর্য মেয়েটিকে রাঙ্গিয়ে দিচ্ছিলো।
.
কথায় যেনো শুনেছিলাম মেয়েদের রাগলে নাকি দেখতে সুন্দর লাগে। যদি এ কথা সত্যি হয়। তাহলে আমার একটা রাগিণী বউ চাই। যে কারণে অকারণে আমায় বকবে। সময় অসময় রাগ করবে। আমি তার পানে শুধু মুগ্ধ দৃষ্টিতে চেয়ে থাকবো, আর মন উজাড় করে ভালোবাসবো।
.
হঠাৎ আমার দুই বন্ধ হো হো করে হেসে ফেললো। মেয়েটি আরো রেগে গেলো। আর রাগবারই কথা। আমার দুই বন্ধু যে মেয়েটির অসহায়ত্ব দেখে হেসেছে, তা আর সেই রাগিণীর বুঝতে বাকি নেই। রাগিণী এবার জোরের সাথে দরজায় কড়া নাড়লো। কাক্কু সঙ্গে সঙ্গে দরজা খুললো। কাক্কুর চেহারায় বিরক্তির ছাপ।
>>কিরে আবার কি হলো? (কাক্কু)
>কাক্কু আপনি আমায় পরে আসতে বললেন। আর ওদের এখানে বসিয়ে আপ্যায়ন করে খাওয়াচ্ছেন। (রাগিণী)
>>ও হো ওদের কথা বলছিস। আরে পাগলি ওরা স্পেশাল। ওদের জন্য ক্যান্টিন সবসময় খোলা। (কাক্কু)
>ও এই ব্যাপার। ভালো খুব ভালো। (রাগিণী)
.
কাক্কুর সাথে আমাদের সম্পর্ক বেশ ভালো। যে কারনে একটুআধটু এডভান্টেজ আমরা পেয়েই থাকি। আমি কাক্কুর চোখে চোখ রাখলাম। ইশারায় কিছু একটা বুঝিয়ে দিলাম। ভিতর থেকে কাক্কু দুইটি চিপসের প্যাকেট বের করে রাগিণীকে দিতে ধরলো। একবাক্যে “লাগবে না” বলেই রাগিণী হাটা শুরু করলো।
.
যাওয়ার সময় আমাদের দিকে একবার তাকালো। রাগিনীর ভয়ঙ্কর দৃষ্টি, ছোবল মারলো আমার দুই বন্ধুকে। তারা এবার আর হাসলো না। অজানা আতঙ্কে তারা যেনো কুপোকাত। আর আমি অপলকে চেয়ে আছি। রাগিনীর সৌন্দর্যের রহস্য খোজার চেষ্টা করছি।
.
আচমকায় রাগিণীকে উপলদ্ধি করলাম এক বিশাল নদীতে। রাগিণী সেই নদীতে রূপের জাহাজ, আর আমি সেই জাহাজের মাঝি। আমরা মাঝ নদীতে। হঠাৎ কানে ভেসে আসলো এক বিকট শব্দ। মনে হয় আকাশ যেনো নেমে এসেছে। আর আমি রাগিণীর থেকে বোধহয় আলাদা হতে ধরেছি।
.
– না, এসবের কিছুই হয়নি। শুধু বাজলো টিফিনের ঘন্টা। সেই শব্দেই ভাঙ্গলো আমার ঘোর। মুহূর্তেই পুরো প্রাঙ্গণ পেলো পূর্ণতা। আর রাগিণী হলো চোখের আড়াল। এতো খুজলাম, পরে আর কোথাও পেলামনা দেখা।
.
কলেজে প্রতিদিনই খুঁজতাম রাগিণীকে। এতো খুজলেও, কখনওই পেতাম না রাগিণীকে। টিফিনের আগে ও পরে প্রতিটি সময় ক্যান্টিনে বসে থাকতাম।চাওয়া শুধু আরেকবারের মতো রাগিণীর দেখা। কিন্তু কলেজ লাইফ শেষ হলেও কখনো আর হয়নি রাগিণীর সাথে দেখা।
.
.
পাঁচবছর পর আবারো একদিন এসেছি কলেজে। কলেজের পূর্নমিলনী অনুষ্ঠান। এ উপলক্ষে পুরো কলেজ সেজেছে রঙ্গিন সাজে। পুরনো বন্ধুরা সব একত্রিত হয়েছি। আবারো সবাই আগের মতো আড্ডায় মগ্ন থেকেছি। মাঠে জমকালো অনুষ্ঠান চলছে। সবাই সেখানে ব্যস্ত। যে যেভাবে পাচ্ছে সময়টা উপভোগ করছে।
.
এসব ছাপিয়ে মন আমার পড়ে আছে অন্যদিকে। আনমনা হয়ে ভিড়ের মধ্যে একা একা হাটছি। আর ভাবছি হারিয়ে যাওয়া সেই রাগিনীর কথা। প্রথম দর্শনেই জানিনা মেয়েটা কি জাদু করেছে। এতোবছর কেটে গেলেও কোনভাবে ভুলতে পারিনি তাকে।
.
প্রতিটা মুহুর্তেই নাম না জানা সেই রাগিণী আড়াল থেকে এ আমায় ডেকে যায়। আর চুপিচুপি বলে যায় “তুমি যে আমার”। কাছে গেলেই কেনো জানি হারিয়ে যায়। জানিনা এভাবে আর কতদিন চলবে, এই রাগিণী আমায় কুড়ে কুড়ে নিঃশেষ করে দিচ্ছে।
.
হঠাৎ মোবাইল বেজে উঠলো। কল রিসিভ করতে হবে। পকেট থেকে ফোন বের করবো। এমন সময় সামনে একটা মেয়েকে দেখলাম। মেয়েটাকে আমার খুব চেনা মনে হলো। বিশেষ করে তার চোখ দুটো। এ চোখ তো রাগিণীর। কিন্তু রাগিণীর মুখে এতো হাসি কেনো। রাগিণী কি তাহলে হাসতেও পারে !
.
আমি তো কখনো রাগিণীকে হাসতে দেখিনি। তাই হয়তো জানা ছিলো না। তবে দেখতে মোটেও মন্দ লাগছে না। বরঞ্চ রাগিণীকে আরো সুন্দর দেখাচ্ছে।পাশ থেকে কে যেনো রাগিণীকে বললো, চল তানিয়া ওদিকটায় যাই। ওদিকে কি আছে দেখে আসি। তাহলে আমার রাগিণীর নাম তানিয়া। নামটা শুনতে বেশ। তবে আমার কাছে রাগিণী নামটাই সেরা।
.
রাগিণীরা হাটা শুরু করলো। আমি পিছন পিছন অনুসরণ করলাম। ধীরেধীরে রাগিণীর সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম।
>>এই যে রাগিণী! (আমি)
> কাকে বলছেন, আমাকে? (তানিয়া)
>>হ্যা, তোমাকেই। (আমি)
>>আজব ! (তানিয়া)
> কই হারিয়েছিলে এতদিন? (আমি)
>> মানে? (তানিয়া)
> কলেজ ছেরে হঠাৎ কই গেছিলা? তুমি জানো আমি তোমায় কতো খুঁজেছি ! (আমি)
>> আব্বু বদলী হইছিলো। তাই কলেজ চেঞ্জ করতে হইছে। আচ্ছা আপনি কে? আমাকে কেনো খুঁজছিলেন? (তানিয়া)
> আমাকে চিনো নি? ওই যে কলেজ ক্যান্টিনে বসে ছিলাম। তুমি আমাদের দেখে রেগে গেছিলা। মনে নেই? (আমি)
>> আজব ! কিসব বলছেন, কবেকার কথা। আমার কিছু মনে নেই। পথ থেকে সরেন। (তানিয়া)
.
রাগিণী বন্ধুদের নিয়ে এগোতে শুরু করলো। আমি অপলকে চেয়ে আছি। রাগিণীকে দেখতে বেশ সুন্দর লাগছে। রাগিণী আমায় চিনেনি , এতে আমার কোন আফসোস নেই। অনেক বছর পর রাগিণীর দেখা পেয়েছি এটাই বা কম কিসের।
.
এটা ছিলো রাগিণীর সাথে আমার দ্বিতীয় দেখা। তবে শেষ দেখা নয়। পরবর্তীতে রাগিণীর সাথে আমার আরো অনেকবার দেখা হয়।
↓↓
আরো পাঁচবছর পেরিয়ে আজ আমার বিয়ে। বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান বলে কথা। বিয়েটা বেশ ঘটা করেই হচ্ছে। দিনভোর নানান পর্ব সেরে এখন আমি বাসরঘরে। আর লাল টুকটুক বউ সেজে বসে আছে রাগিণী, ও থুক্কু তানিয়া।
.
>>তোমাকে একটা কথা বলার ছিলো। আমার মনে হয় কথাটা তোমায় বলা অনেক জরুরী? (আমি)
> কি কথা? বলেন? (রাগিণী)
>>কথাটা হলো যে, আমি তোমাকে…. তোমাকে। (আমি)
> কি তোমাকে তোমাকে করছেন? কি বলবেন বলেন? (রাগিণী)
>>ভালোবাসি না (আমি)
> কি বললেন? সাহশ থাকলে আরেকবার বলেন? (রাগিণী)
>>বললাম যে, আমি তোমায় ভালোবাসি না। (আমি)
> কি????? (রাগিণী)
.
রাগিণীর চোখমুখ কেনো জানি ফুলে উঠেছে। নাক দিয়ে জোরের সাথে শ্বাস নিচ্ছে। চোখ জোরা কেমন যেনো স্থির হয়ে গেছে, আর রাগিণী আমার দিকে ভয়ঙ্কর দৃষ্টিতে তাকিয়ে। মনে হচ্ছে এবার আমাকে খেয়েই নিবে।
>> আরে আমি তোমাকে না, আমি তো রাগিণীকে ভালোবাসি। আর আমার বউটা তো রাগিনীই। (আমি)
> ধ্যাত তেরি, ভাল্লাগেনা। শুধু শুধু রাগালো। (রাগিণী)
>> হে হে হে। এই না হলে আমার রাগিণী বউ। (আমি)
…………………………………………………সমাপ্ত…………………………………………………………