আজকাল কানে হেডফোন লাগিয়ে রাস্তায় চলাফেরা করা স্বাভাবিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। নীলের ক্ষেত্রেও এর কোনো
ব্যতিক্রম ঘটলো না। নীল কানে হেডফোন লাগিয়ে রাস্তার একপাশ দিয়ে হাটছিলো। তার ঠিক বিপরীত দিক দিয়ে একটি অচেনা
মেয়ে আসছিলো।
.
ওহহ, দাঁড়ান!! দাঁড়ান!!
আপনাদের তো নীলের ব্যাপারে তেমন কিছুই বলা হয়নি।
.
অঢেল সম্পত্তির মালিক নীল কিন্তু তার মা-বাবা নেই। মারা গেছে অনেক বছর হবে। একাকিত্বটাই তার জীবনের সঙ্গী হয়ে আছে বহুবছর। লেখাপড়া শেষ করে এখন একটা আইটি কম্পানীর মেনেজার হিসেবে কাজ করছে।
অনেক তো পরিচিত হলেন চলুন এখন কাজে ফিরে যাই থুক্কু গল্পে ফিরে যাই।
.
নীলের এই চাকরীটা এখন ভালোলাগে না তাই সে আজ বসের সাথে সামান্য কথা কাটাকাটি করে চলে আসছিলো বাসার
উদ্দেশ্যে। বাসা অফিস থেকে বেশি দূরে নয় তাই সে বাসায় হেটেই আসছিলো। হঠাৎ একটা বাস নিয়ন্ত্রণ হাড়িয়ে সজোরে নীলকে
পিছন থেকে ধাক্কা মারলো। নীল ছিটকে অচেনা মেয়েটির সামনে গিয়ে পরলো। রক্তাক্ত অবস্থায় নীল পড়ে আছে অচেনা
মেয়েটির সামনে। নীলের রক্তাক্ত দেহকে ঘিরে প্রচুর ভীড় জমা হয়ে গেলো কিন্তু কেউ নীলকে ধরতে যাচ্ছে না। অচেনা মেয়েটি
নীলের রক্তাক্ত দেহটি দেখে নিজেকে ধরে রাখতে পারলো না। দ্রুত একটি সিএনজিতে করে নীলকে ধরাধরি করে উঠিয়ে ছুটে
চললো কাছের একটি হাসপাতালে।
.
হাসপাতালে গিয়ে,,,
নীলের খুব রক্তক্ষরণ হয়েছে যার কারণে জরুরি অবস্থায় তাকে আইসিইউ তে নেওয়া হয়েছে। আইসিইউর বাহিরে অচেনা
মেয়েটি দাঁড়িয়ে আছে। নীলকে একা রেখে যেতে পারছে না কারণ এখানে নীলের পরিবারের কেউ এখনো আসে নি আর নীলের
পুরো পরিচয়ও সে জানেনা। তাই নীলের জ্ঞান ফেরার আগ পর্যন্ত অচেনা মেয়েটি বাহিরে অপেক্ষা করছে। হঠাৎ নীলের জ্ঞান
ফিরলো আর সে নিজেকে হাসপাতালের বেডে আবিষ্কার করলো, দেখতে পেলো তার পুরো হাতে ব্যান্ডেজ। নার্স গিয়ে অচেনা
মেয়েটিকে বললো যে লোকটির জ্ঞান ফিরেছে। সাথে সাথেই মেয়েটি কেবিনে ঢুকলো,
– আপনার জ্ঞান ফিরেছে তাহলে??
– হুম,!! (উঠতে উঠতে জবাব দিলো নীল)
– থাক থাক। উঠতে হবে না বিশ্রাম নিন।
এর মধ্যে ডাক্তার প্রবেশ করলো রুমে আর বললো,,
– মিঃ নীল আপনার জ্ঞান ফিরেছে তাহলে (ডাক্তার নীলের পূর্ব পরিচিত)। আসলে আপনার হাতে বেশি আঘাত লেগেছে যার কারণে হাতে ফ্র্যাকচার হয়েছে যেটা ঠিক হতে মোটামুটি ২ মাস সময় লাগবে, আর এই ২ মাস এখানেই থাকতে হবে।
– আমি হাসপাতালে আসলাম কিভাবে??(নীল)
তারপরে মেয়েটির দিকে তাক করে ডাক্তার বললো,,
– এই মেয়েটি আপনাকে এখানে এনেছে। উনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ উনি সঠিক সময়ে আপনাকে হাসপাতালে এনেছে আর আমরা আপনার চিকিৎসা করতে পেরেছি। আচ্ছা, আপনি বিশ্রাম করুন, আমি একটু পর আবার এসে চেকআপ করবো হাতের।
এই বলে ডাক্তার চলে গেলো।
মেয়েটি নীলের পাশে এসে বসলো–
– এখন কি সুস্থবোধ করছেন??
– হ্যা আপনি আমার এতো বড় সাহায্য করলেন আমার প্রাণ বাঁচালেন, আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ।
– এটা তো আমার কর্তব্য ছিলো। আচ্ছা আপনার নাম নীল তাহলে!! আপনার পরিবারের কারো নাম্বার দিন আমি ফোন করে বলে দিচ্ছি
– থাক সেটার প্রয়োজন হবে না। কারণ আমার কেউ নেই। আমি একা। মা-বাবা মারা গেছে অনেক বছর হলো আর আত্নীয়-স্বজন আমাকে বোঝা মনে করতো তাই এখন একা থাকি।
– তাহলে এখানে আপনার কে দেখাশুনা করবে??
– কেউ নেই। যতটুকু পারি নিজের খেয়াল নিজেই রাখি। আচ্ছা, আপনার ব্যাপারে তো এখনো কিছুই জানা হলো না??
– আমি লামিয়া জান্নাত নীলা। এবার এমবিএ করছি। আপনার অফিসের পাশের বিল্ডিং এর তৃতীয় তালায় থাকি। আচ্ছা আজ
আসি, ভালো থাকবেন বলেই নীলা চলে যাচ্ছে। আর নীল তার(নীলার) যাওয়ার পথে তাকিয়ে আছে এক দৃষ্টিতে আর ভাবছে
আজও এই দুনিয়াতে এমন মানুষ আছে যে কিনা অচেনা একজনকে এভাবে সাহায্য করলো। আর এদিকে নীলা বাসায় গিয়ে
সারাটাক্ষন শুধু নীলের কথাই ভাবছে। ভাবছে ছেলেটার এই দুনিয়াতে আপন বলতে কেউ নাই, দেখাশুনার মত কেউ নেই।
ভাবতে ভাবতেই রাতের খাবার খেয়ে ঘুমিয়ে গেলো।
.
এভাবেই দিন চলছে নীল আর নীলার। নীলা এর পর গত ১ মাসে পড়াশোনার চাপে একবারো নীলকে দেখতে যেতে পারেনি।
আজ যে আবার নীলকে দেখতে যাবে আর আজ সে নিজের রান্না করা কিছু খাবার নিয়ে নিলো নীলের জন্য।
.
হাসপাতালে পৌঁছে সরাসরি নীলের কেবিনে চলে গেলো আর দেখতে পেলো নীল ঘুমিয়ে আছে। সে গিয়ে নীলের পাশে বসলো
আর নীলের দিকে সুন্দর দৃষ্টি দিয়ে দেখতে লাগলো। নীলের ঘুম ভেংগে গেলো আর চোখ মেলেই সে নীলাকে তার পাশে দেখতে
পেলো।
– আপনি কখন আসলেন?? (বেড থেকে উঠতে উঠতে বললো নীল)
– এইতো মাত্র। কেমন আছেন আপনি??(নীলা)
– এইতো যেমন দেখছেন। আপনি??(নীল)
– ভালো আছি। তো দুপুরের খাবার খেয়েছেন??(নীলা)
– নাহহ একটু পরে খাবো।(নীল)
– আমি আজ আপনার জন্য খাবার নিয়ে এসেছি।(নীলা)
– আপনি আবার কষ্ট করতে গেলেন কেনো??(নীল)
– নাহহ কষ্ট কিসের।(নীলা)
– আচ্ছা একটা চামচ দিন আমাকে!!
– চামচ দিয়ে কি করবেন??
– খাবো!!
– আচ্ছা, আমি যদি আজ আপনাকে খাইয়ে দেই?? খাবেন!!
-……….. (নীল চুপ কিছুই বলছে না)
– আচ্ছা হা করুন আমি খাইয়ে দিচ্ছি।
নীল হা করছে আর নীলা তাকে খাইয়ে দিচ্ছে। নীলের চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি পরতে লাগলো কারণ তাকে যে কখনো কেউ এভাবে খাইয়ে দেয় নি।
– কি হলো?? আপনি কাঁদছেন কেনো??(নীলা)
– নাহহ এমনি। (চোখের পানি মুচ্ছে নীল)
খাওয়া-দাওয়া শেষ করে নীলের কাছ থেকে বিদায় নিল নীলা। এরপর থেকে রোজ একবার দুবার করে হলেও নীলকে দেখতে
আসতো নীলা আর প্রায় সময় নীলের জন্য বাসা থেকে রান্না করা খাবার নিয়ে আসতো। রোজ রাতে নিজের রুমে শুয়ে শুয়ে
নীলের কথা ভাবতো আর নিজের কাছেই প্রশ্ন করতো, কেনো সে নীলের কথা এতো ভাবছে নীল তো তার কেউ না। তবে কি সে
নীলের প্রেমে পড়ে গেলো। প্রতিদিন দুপুরে এসে নীলকে ঘুমন্ত অবস্থায় তার মাথার পাশে গিয়ে বসে এক দৃষ্টিতে নীলের দিকে
তাকিয়ে থাকতো নীলা। কি নিষ্পাপ একটি চেহারা, যেনো তাকিয়েই থাকতে মন চায় নীলার। মনে মনে ভাবে সে আসলেই নীলের
প্রেমে পড়ে গিয়েছে।
.
এভাবেই প্রতিটা দিন নীলা নীলের সেবাযত্ন করতো আর আসতে আসতে যে নীলের প্রতি অনেকটাই দুর্বল হয়ে পরলো। এভাবেই ২টা মাস কেটে গেলো নীলও পুরোপুরি সুস্থ হয়ে উঠেছে।
.
২ মাস পর,,,,,
আজ নীল পুরোপুরি সুস্থ আর আজ সে হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেতে যাচ্ছে। নীলাও আজ উপস্থিত নীলের কেবিনে নীলের পাশেই সে বসে আছে। একে অন্যকে আড়চোখে দেখছে, ২জনেই চুপচাপ।
নীরবতা ভেংগে নীল বলে উঠলো,,,
– আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ এতো কিছুর জন্য। আমার এতোটা সেবাযত্ন করার জন্য। আপনি না থাকলে এই অগোছালো ছেলেটা নিজের দেখাশোনা ঠিকভাবে করতে পারতো না।
– আমি আপনাকে একটা কথা বলবো বলবো ভাবছি, আজ আমি বলে দিতে চাই
– (নীল কিছু না বলে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে নীলার দিকে তার কথা শোনার জন্য)
– আসলে এতোদিন আপনার সাথে অনেক সময় কাটিয়েছি যেগুলো আমাকে আপনার প্রেমে পড়তে বাধ্য করেছে। আমি এখন
আপনাকে ভুলে থাকতে পারবো না। আমি আপনার সারাজীবনের সেবা করার দায়িত্ব নিতে চাই!!! আপনি কি আমাকে সেই
অধিকার টুকু দিবেন??
(করুন দৃষ্টিতে নীলা নীলের দিকে তাকিয়ে আছে)
নীলা খেয়াল করলো নীল মুচকি মুচকি হাসছে তার কথা শুনে। হাসার কারণ হলো নীলও যে এই কয়েকদিনে নীলাকে ভালবেসে ফেলেছে। আজ নীল তার ভালবাসার কথা প্রকাশ করতো কিন্তু নীলাই আগে বলে দিলো।
নীল নীলাকে বেড থেকে নামিয়ে নীলের মুখোমুখি দাড় করালো আর নীলাকে তার দুটো হাত দিয়ে শক্ত করে জরিয়ে নিল। যে হাত
কয়েকদিন আগেও নাড়ানোর সামর্থ্য ছিলোনা নীলের আজ সেই হাত দিয়ে নীল তার ভালোবাসাকে আকড়ে ধরেছে, কখনো আর
ছাড়বে না।
দুজনেই যেনো আজ ভালবাসার মায়া জালে আটকে গেলো। এ যেনো ভালবাসা নয় সৃষ্টার অকৃত্রিম দান। বেচে থাকুক তোমাদের
এই ভালবাসা।
.