জোনাকিগুলো

জোনাকিগুলো

মীরা। ইউনিভার্সিটির সবচেয়ে হাসিখুশি একটা মেয়ে। মেয়েটাকে কখনো আমি ঘুমড়োমুখো হয়ে থাকতে দেখেনি। সব সময় মুখের কোণে হাসি লেগেই থাকতো। একটা মেয়ে এতটা কিভাবে হাসতে পারে? কিভাবে সকল কিছুতেই আনন্দ খুঁজতে পারে? আমার তা জানা নেই। সে সময়টায় মেয়েটার প্রতি আমি প্রচন্ডভাবে আসক্ত হয়ে পড়ি। খুব ভালোবেসে ফেলি তাকে। মেয়েটা সেটা বুঝতো। যখন ক্লাস চলতো এক ধ্যানে তাকিয়ে থাকতাম আমি। সকল মনোযোগ মেয়েটার মাঝেই সীমাবদ্ধ থাকতো। মাঝে মাঝে চোখাচোখি হয়ে যেত। মীরা কিছু বলতো না। দৃষ্টি ফিরিয়ে নিত। কিন্তু আমি দৃষ্টি ফিরিয়ে নিতাম না। অপলক তাকিয়ে থাকতাম । অনেকটা নির্লজ্জের মতো।মীরার মায়াভরা মুখটা সত্যি খুব প্রিয় হয়ে উঠেছিল। কাজল কালো চোখগুলো যেন আমাকে তার দিকে টানতো। এক অদ্ভুত আকর্ষণ অনুভব করতাম। তার সব কিছুই আমার খুব ভালো লাগতো। হাত নাড়িয়ে কথা বলা, কথার মাঝে ফিক করে হেসে ফেলা। মেয়েটাকে খুব ভালোবেসে ফেলেছিলাম। তাকে অনেকবার আমার অনুভুতি-গুলো ইঙ্গিতে বোঝানোর চেষ্টা করেছি। হয়তো সে তা বুঝে নি কিংবা বুঝতে চায়নি।

আমি ক্যাম্পাসে দাঁড়িয়ে মীরাকে খুঁজছি। আজকে আমার মনের কথা যে তাকে বলতেই হবে। কি নিদারুণ কষ্ট আমি প্রতিরাত অনুভব করি তা যদি সে জানতো তাহলে হয়তো এতটা কষ্ট সে আমাকে দিত না। মীরাকে দেখলাম একদল মেয়ের সাথে হেসে হেসে গল্প কর যাচ্ছে। আমি মীরাকে ডাক দিলাম।

– এই মীরা দাঁড়াও

মীরা থমকে দাঁড়ালো। আমি তার দিকে এগিয়ে গেলাম।

– ডাকছ কেন? কি হয়েছে?
– তোমার সাথে একটু কথা আছে। একটু অই দিকটায় যেতে পারবে?
– কি কথা?
– আগে অই দিকটায় চলো।

আমরা গিয়ে একটা গাছের নিচে বসে পড়লাম। আমি মীরার দিকে তাকিয়ে আছি। আজ আমাদের ইউনিভার্সিটিতে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। মীরা একটা নীল রঙের শাড়ি পড়েছে। মাথার চুলগুলো খুলে রাখা। হাতে নীল রঙের চুড়ি। চোখে হালকা করে কাজল। কানে নীল পাথরের দুল। কি যে অপূর্ব লাগছে মেয়েটাকে! নিজের চোখগুলো কে যেন সড়াতেই পারছিনা আমি।

– কথা বলতে এনে এভাবে তাকিয়ে আছ কেন?। কি বলবে বল?
– কিভাবে বলবো বুঝতে পারছি না
– তাহলে থাক আর বলতে হবে না। আমি গেলাম।
– না দাঁড়াও বলসি।
– আরামে বসে আছি আর তুমি দাঁড়াতে বলছো?
মেয়েটা কথাটা বলে হাসছে। মুখ টিপে না শব্দ করে হাসছে। আমি খানিকটা লজ্জা পেয়ে গেলাম।
– হাসছো কেন?
– যাও আর হাসবো না। বলো কি বলবে।
– তুমি কি জানো? তোমাকে আমার কতটা ভালো লাগে? তোমাকে আমি কতটা ভালোবাসি? তুমি কি জানো তোমাকে আমি প্রতি রাত স্বপ্নে দেখি? তোমাকে যে আমি খুব ভালোবেসে ফেলেছি।

মীরা চুপ করে আছে। কিছুই বলছে না সে। আমি বললাম,
– কিছু বলবে না?
এবারো কিছু বললো না। মীরা কি রাগ করলো? নাকি বিরক্ত হচ্ছে? আমার কাছে তা পরিষ্কার না। আমি আবার জিজ্ঞাসা করলাম,
– তুমি কি তাহলে রাজি না?
এবার মীরা কথা বললো,
– দেখো শান্ত, তুমি যদি আমাকে ভালোবাসো তাহলে অনেক কষ্ট পাবে। এতটা কষ্ট পাবে যা তোমার প্রাপ্য না। আমি চাইনা কেও আমার জন্য কষ্ট পাক।
– এখনো তো কষ্টই পাচ্ছি।
– আমাকে ভালোবাসলে যে কষ্ট পাবে তার কাছে এই কষ্ট কিছুই না।

মীরা উঠে চলে গেল। আমি তখনো সেখানে বসে আছি। কেমন যেন খালি খালি লাগছে। আমি আর সেদিন কলেজে এক মুহুর্তের জন্যও থাকতে পারিনি। চলে আসি বাড়িতে। মীরার কথাগুলোর মানে আমি বুঝতে পারছি না। তার কথাগুলোর কি অন্য কোনো মানে আছে? না আমিই কথাগুলোকে নিয়ে অন্যভাবে ভাবছি। তা আমি জানি না। কিন্তু আমি এত সহজে দমে যাবার পাত্র না। আমি আরো অনেকবার অনেকভাবে চেষ্টা করেছি। তার ভালোবাসা পাবার আকাঙ্ক্ষা আমাকে পাগল করে দিচ্ছিল। নিয়মিত তার পিছনে পিছনে বাড়ি পর্যন্ত যাওয়া। তার বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে থাকা। ক্লাসে তার দিকে অপলক তাকিয়ে থাকা যেন নিত্যদিনের রুটিনে পরিণত হল। একদিন মীরা আমাকে আড়ালে ডেকে নিয়ে বলল,

– কেন এমন করছো?
– তোমাকে ভালোবাসি তাই।
– আমাকে ভালোবাসলে যে শুধুই দুঃখ পাবে।
– আমি তার জন্য প্রস্তুত।
– না তুমি প্রস্তুত না। তুমি প্লিজ আমাকে ভালোবেসো না।
– কেন?
মীরা কিছু বলল না। চুপ করে থাকল। লক্ষ্য করলাম মীরার ঠোঁট গুলি কচি পাতার মতো কাঁপছে। মীরা আমার দিকে বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল।
– কেন আমাকে ভালোবাসা তোমার উচিত না সেটা তুমি কালকেই জানতে পারবে। তুমি কি কাল ডেইলি ক্যাফেতে দেখা করতে পারবে?
– হুম।
– আচ্ছা ঠিক আছে। কাল এসো সেখানে তাহলেই সব বুঝতে পারবে।

আমারো খুব জানার ইচ্ছা কেন মেয়েটা বারবার আমাকে ফাঁকি দিচ্ছে। আমি আগামী দিনটার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতে থাকলাম।

আমি এবং মীরা ডেইলি ক্যাফেতে বসে আছি। বেশ অনেকক্ষণ হলো বসে আছি কিন্তু মীরা কোনো কথা বলছে না। আমি বেশ কয়েকবার কথা বলতে চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছি।

– কফি অর্ডার করবো?
– না কিছু খাবো না?
আমি অবশ্য তার কথা শুনলাম না। দুটা কফি অর্ডার দিয়ে দিলাম।

মীরা হঠাৎ করে ব্যাগ থেকে একটা ফাইলের মত কিছু একটা বের করলো।
– কি এটা?
– আমার মেডিকেল রিপোর্ট।
– মানে? কিসের মেডিকেল রিপোর্ট?
মীরা খানিকটা হাসলো।
আমি বললাম হাসছো কেন?
– মন চেয়েছে তাই। বাঁচবই আর কদিন? তাই যা ইচ্ছে আছে সব পূরণ করার বৃথা চেষ্টা করছি।
– কি বলছো এসব?
– তোমাকে বলেছিলাম না আমাকে ভালোবাসলে অনেক কষ্ট পেতে হবে। জানো অনেক কষ্ট কেন পেতে হবে? কারণ আমি বেশিদিন বাঁচবো না। আমার মাথার একদম পিছন দিকটায় একটা টিউমার হয়েছে। আগে বুঝতে পারি নি। মাঝে মাঝে প্রচন্ড মাথা ব্যথা হত। আবার তা মুহুর্তেই মিলিয়ে যেত। আমি অনেক বই পড়ি তাই ভাবলাম অত্যাধিক স্ট্রেসের জন্য হয়তো এমনটা হয়। তাই কাউকেই কিছু জানাইনি। কিন্তু একদিন প্রচুর ব্যথা শুরু হয় যে ব্যথা অন্য দিনগুলির মত হুট করে যায়নি। আমি অজ্ঞান হয়ে যায়। দুদিন পর আমার জ্ঞান ফিরে হাসপাতালে। জানতে পারি আমার মাথায় টিউমার হয়েছে। বেশ কয়েকটা অপারেশন হয়েছে। কিন্তু ডাক্তাররা বেশি সুবিধা করতে পারেনি। কেননা টিউমার-টা অনেকটা ছড়িয়ে পড়েছে। মস্তিষ্কের ক্ষতি না করে সেটা বের করা অসম্ভব। তাই বেঁচে থাকাও অসম্ভব। জানো এখন আর আমার খারাপ লাগে না। প্রথম প্রথম খুব খারাপ লাগতো এখন আর লাগে না। ডাক্তার বলেছে খুব বেশি হলে ১ বছর আছি আমি এই পৃথিবীতে। খারাপ কি? ১ বছর অনেকটা সময় তাই না?

আমি মীরার কথাগুলো শুনে যেন বাকরুদ্ধ হয়ে গেলাম। অজান্তেই চোখগুলো কেমন ছলছল করতে থাকলো। এত কষ্ট বুকে নিয়ে মেয়েটা দিব্যি হেসে খেলে বেড়াচ্ছে। এটা কি আদৌ সম্ভব? আমি মাথাটা অন্যদিকে ঘুরিয়ে নিলাম যাতে আমার চোখগুলো সে দেখতে না পারে।

– এই তুমি কি কান্না করার আয়োজন করছো নাকি? প্লিজ কেঁদো না। তোমার কান্না দেখে আমি হেসে ফেলতে পারি। ছেলেরা কান্না করলে কেমন যেন হাস্যকর লাগে।
আমি মেয়েটার দিকে ভালো করে তাকালাম। মুখটা হাসি হাসি। খেয়াল করলাম চোখে খুব গাড় করে কাজল দিয়েছে। চোখগুলো কি সে জন্যই এত টানা টানা লাগছে? কে বলবে মেয়েটার আয়ু ফুরিয়ে আসছে। মেয়েটা এত কিছু মনের মাঝে নিয়ে কিভাবে হেসে খেলে বেড়াচ্ছে? আমি তার হাত দুটো নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে আসলাম।
– এই কি করছো?
আমি উত্তর দিলাম না। হাত দুটো আরো জোড়ে জড়িয়ে ধরলাম। তার মায়াভরা চোখগুলোর দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম।
– তুমি কি জানো তোমাকে আমি কতটা ভালোবাসি? জানো না। কিংবা জানার চেষ্টা করনি । তোমার কি হয়েছে সেটা আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ না। তুমি কতদিন বেঁচে আছো সেটা আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ নয়। আমি চাই তোমার সাথে জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত থাকতে। তোমার স্মৃতিগুলো আঁকড়ে ধরে বাকিটা জীবন কাটিয়ে দিতে। তুমি কি আমার জন্য এইটুকু করতে পারবে না?
খেয়াল করলাম মেয়েটার চোখ আস্তে আস্তে ভারী হয়ে আসছে। মীরার চোখ দিয়ে হঠাৎ করেই দু ফোটা জল গড়িয়ে পড়ল
– তুমি তো দেখি আমাকেই কাঁদিয়ে ফেললে। তোমার তো নাটকের ইমোশনাল ডায়ালগ রাইটার হওয়া দরকার। ভালো নাম করবে
আমি খানিকটা হাসলাম। মীরাও হাসছে।
– আমাকে বিয়ে করবে
– না
– কেন?
– কারণ তুমি একটা গাধা
– আমি গাধা?
– হুম তুমি গাধা।
মেয়েটা আবার হাসছে। কি সুন্দর লাগে মেয়েটাকে হাসলে!

আমি আর মীরা সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বসে আছি। সময়টা ছিল শ্রাবণের মাঝামাঝি। চারদিকে অন্ধকার। আকাশে কালো মেঘের আনা-ঘোনা। এই সময়টাতে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে প্রচুর কদম হয়। আমাদের হাতে বেশ কয়েকটা কদম। কিছুক্ষণ আগেই বৃষ্টি হয়েছে তাই উদ্যান-টা একদম ফাঁকা। আমরা দুজন ছাড়া আর কাউকেই লক্ষ্য করলাম না আশেপাশে। বৃষ্টির জন্য ঢাকা শহরে লোডশেডিং। পুরো শহর অন্ধকারে ডুবে আছে। হাজারো জোনাকি পোকা আমাদের ঘিরে আছে। যেন তারা লাফাচ্ছে নিকষ অন্ধকারে। মেয়েটা আমার কাঁধে মাথা রেখে বসে আছে। তার একটা হাত আমার হাত দুটোর আড়ালে। মীরার শরীর খুব দ্রুত খারাপ করছে। মাত্র কয়েক মাসের ব্যবধানে একাধিক বার জ্ঞান হারিয়েছে সে। কিন্তু শেষবারের জ্ঞান হারানোটা ছিল সবচেয়ে ভয়ংকর। ১ সপ্তাহ পরে জ্ঞান ফিরে মেয়েটার। ডাক্তার বলেছে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব মীরাকে হাসপাতালে ভর্তি করিয়ে দিতে। কিন্তু মেয়েটা রাজি হচ্ছে না। সে তার জীবনের শেষ সময়টুকু আমার সাথেই কাটাতে চায়। আমি অনেকবার তাকে বোঝাতে চেষ্টা করে হাল ছেড়ে দিয়েছি। হঠাৎ মনে হলো মীরার শরীরটা কেমন যেন কেঁপে কেঁপে উঠছে। মেয়েটা কি কান্না করছে?
– এই মীরা কি হয়েছে তোমার?
– কিছু না তো
– কাঁদ ছো নাকি?
মেয়েটা জবাব দেয় না। চুপ করে থাকে। আমার কাঁধটা ভিজে যাচ্ছে মেয়েটার চোখের জলে।

– আচ্ছা একটা প্রমিজ করবে শান্ত
– কি প্রমিজ?
– আমি মারা গেলে তুমি উলটাপালটা কিছু করবে না।
– এসব কথা বাদ দেয়া যায় না?
– না বাদ দেয়া যায় না।
মীরা সোজা হয়ে বসে।
– আজ তোমাকে অনেকগুলো প্রমিজ করতে হবে আমাকে। তুমি যদি সত্যি সত্যি আমাকে ভালোবেসে থাকো তাহলে প্রমিজ গুলো রাখবে। কি রাখবে না?
আমার চোখগুলো ছলছল করছে। যেকোনো সময় চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়তে পারে এরকম অবস্থা।
– প্রমিজ কর আমার মৃত্যুর পর খুব মিষ্টি দেখে একটা মেয়েকে তুমি বিয়ে করবে। আমি চাই না আমার জন্য তুমি সারাজীবন কষ্ট পাও। কি পারবে না?
– না। আমি তোমাকে ভালোবেসেছি। সেই ভালোবাসাটার ভাগ আমি কাউকে দেব না। আমার সবগুলো নীল পদ্ম যে তোমার কাছে। অন্য কাউকে দেয়ার মত আর কিছুই বাকি নেই
– আমার জন্য তুমি এতটুকু করতে পারবে না?
– আমি জানি না মীরা।
– আমি জানি তুমি পারবে। আর শুনো মিস্টার আমার মৃত্যুর পর তুমি যদি দেবদাস হয়ে থাক তাহলে একদিন ভূত হয়ে তোমার ঘাড় মটকে দেব আমি। বুঝলে?
আমি কিছুই বললাম না। অবাক চোখে আছি মেয়েটার দিকে।
– আর শুনো আমার মৃত্যু বার্ষিকীতে তুমি এখানটায় আমার জন্য কদম ফুল নিয়ে বসে থাকবে? কি পারবে না?
আমি জবাব দিলাম না। চুপ করে রইলাম। আকাশে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। বেশ ভালো হাওয়া দিচ্ছে। ঝড় আসবে কি না কে জানে?

এর পরের দিনগুলোতে মীরার শারিরীক অবস্থার মারাত্বক ভাবে অবনতি হতে থাকে। ধীরে ধীরে লুটিয়ে পড়ে মীরা। শরীরের সমস্ত শক্তি যেন হারিয়ে যায়। নিজের চোখের সামনে নিজের ভালোবাসাটাকে শেষ হতে দেখছিলাম। কিন্তু কিছুই করতে পারছিলাম না। এর চেয়ে কষ্টের আর কি হতে পারে? মরে যেতে ইচ্ছে করছিলো। কিন্তু পারছিলাম না। মীরার শেষ ইচ্ছেগুলো যেন আমাকে আঁকড়ে আছে। মাঝে মাঝেই খুব কান্না করতাম। বুক ভেঙে কান্না আসতো। নিজেকে থামাতে পারতাম না। মৃত্যুর ২দিন আগে মীরা যেন একদম সুস্থ হয়ে গেল। হেসে হেসে কথা বলে। আমাকে একদিন বললো,
– কি গো তুমি দেখি আমার মরার আগেই দেবদাস হয়ে গেলে। মরে গেলে কি করবে? কথাটা বলেই ঘর কাঁপিয়ে হাসতে লাগলো। আমি তার পাশে বসে ছিলাম। আমি তাকে দু হাতে জড়িয়ে ধরলাম। জড়িয়ে কান্না করতে থাকলাম।
– আরে পাগল কি হয়েছে তোমার? এভাবে বাচ্চাদের মত কেও কাঁদে? দেখো আমি একেবারে সুস্থ হয়ে গেছি। আমার কিছুই হবে না। আরে এখনো কান্না করছো? উঠ বলছি

মীরা আমাকে সোজা করে। দু হাত দিয়ে চোখের পানি মুছে দেয়। আমার চোখ বারবার ভিজে যাচ্ছিল। দুহাতে আবার গালটা ধরে ঠোঁটে একটা ভালোবাসার পরশ এঁকে দিয়ে বললো
– এভাবে কাঁদতে নেই।

পরেরদিন রাতে হঠাৎ করেই মীরার শ্বাস ভারী হয়ে যায়। শ্বাস নিতে তার খুব কষ্ট হচ্ছিল। আমি তার পাশে হাতটা শক্ত করে ধরে বসে ছিলাম। মীরা আমাকে অস্ফুটস্বরে বলল,
– শান্ত খুব কষ্ট হচ্ছে। খুব খুব কষ্ট হচ্ছে। শান্ত আমি নিতে পারছি না।
আমি মীরার হাতগুলো আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরলাম। আমার ভালোবাসা কষ্ট পাচ্ছে আর আমি কিছুই করতে পারছি না! আমার তখন মরে যেতে ইচ্ছে করছিলো। আমি মীরার মাথায় হাত বুলাতে থাকলাম।
– কিছুই হবে না তোমার মীরা। আমি আছি তোমার পাশে। তোমার কিছুই হতে দেব না আমি।
মীরা অই অবস্থাতেই খানিকটা হাসলো। আমি ঠুঁকড়ে কেঁদে উঠলাম। মীরার মাঝে মাঝেই খিঁচুনি উঠছে। একজন ডাক্তার তাড়াতাড়ি করে তার মুখে একটা অক্সিজেন মাস্ক লাগিয়ে দিল। আমি তখনো কাঁদছি। অপলক তাকিয়ে আছি মীরার দিকে। বারবার মীরার শরীর উপরে উঠছে। থেমে আবার নিচে নেমে যাচ্ছে। মীরার এই কষ্টগুলো যেন আমি নিতে পারছিলাম না।

মীরার যখন মৃত্যু হলো তখন দিনের আলো ভালো করে ফুটে নি। আমি চিৎকার করে কান্না করছি। আমাকে কেও টেনে নিতে পারছে না। আমার বাবা- মা, মীরার বাবা – মা সবাই তখন সেখানে দাঁড়িয়ে। আমার মনে হচ্ছিল কেউ যেন আমার বুকটা কেটে হৃদয়টা বুঝি নিয়ে গেল। আশপাশটা যেন হঠাৎ করেই অন্ধকার হয়ে গেল। যেন এক নিকষ অন্ধকার পথে আমি আলোর একজন দিশারি। কিন্তু কোথাও কোনো আলো নেই। বরং চারদিকের অন্ধকার যেন ক্রমেই গাড় থেকে গাড়-তর হচ্ছে।

– বেশ কিছু বছর পর

মীরা মারা যাবার পর আমি খুব একলা হয়ে পড়ি। মনে হচ্ছিল যেন পুরো দুনিয়া টায় বুঝি আমি একাই বেঁচে আছি। এখন অগ্রহায়ণ মাসের মাঝামাঝি। হালকা হালকা শীত। আমি সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে অন্ধকারের মাঝে বসে আছি। কেমন যেন শীত শীত লাগছে। তবে আরামদায়ক শীত। আশেপাশে হালকা কুয়াশা। এক অন্যরকম পরিবেশের সৃষ্টি করেছে। রহস্যময় পরিবেশ। আকাশটা একদম পরিষ্কার। সেখানেই খেলা করছে অর্ধেকটা চাঁদ। চারপাশে জোনাকি পোকাগুলো আমাকে ঘিরে আছে। আমি নিশ্চুপ বসে আছি একটা বেঞ্চিতে।আজ মীরার মৃত্যুবার্ষিকী। যখন মীরা বেঁচে ছিল তখন জায়গাটা আমাদের খুব প্রিয় ছিল। কত সময় যে আমরা কাটিয়েছি তার কোনো ইয়ত্তা নেই। চোখটা কেমন যেন ভিজে উঠছে। আশপাশটা গোলা হতে শুরু করেছে। টপটপ করে পানি পড়ছে। আমি পাঞ্জাবির হাতা দিয়ে তাড়াতাড়ি চোখটা মুছলাম। মনে হচ্ছে মীরা আমার খুব কাছেই আছে। যেন আমি তার উপস্থিতি টের পাচ্ছি। যেন আমার পাশটায় বসে আছে সে। চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। আর বলতে চেষ্টা করছে ছেলেদের যে কাঁদতে নেই। তারা কাঁদলে যে আমার খুব হাসি পায়।

~ জোনাকিগুলো
~ লেখা: সাঈদ আহমেদ শান্ত

(ভুলত্রুটি মার্জনীয়)

#𝙷𝚊𝚙𝚙𝚢_𝚁𝚎𝚊𝚍𝚒𝚗𝚐

গল্পের বিষয়:
রোমান্টিক
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত