সমীর প্রত্যাখ্যাত হয়নি মোটেও । তবু ফিরে আসতে হল তাকে । তন্দ্রা আপত্তি তো করেনি বটেই , দৃশ্যত বরং সম্মতিই জানিয়েছিল । অতটা ভাবতেই পারেনি সমীর , আশা করা তো দূরের কথা । হবে নাই বা কেন , অনেকেরই আগ্রহ তাকে নিয়ে । উজ্জ্বলতায় তারা কেউ কম নয় সমীরের থেকে । অন্যদিকে নিজে সে লাজুক প্রকৃতির , ভিড় ঠেলে এগিয়ে গিয়ে সামনে দাঁড়াবার শক্তি বা সাহস কোনোটাই তার ছিল না । তাছাড়া ইউনিভার্সিটিতে তন্দ্রার সিনিয়র ছিল সে । সহপাঠীদের ভিড়ের মধ্যেই সারাদিন আটকা পড়ে থাকত যে , তার দিকে সে এগোবে কেমন করে ? খুব কাছে গিয়ে কথা বলবার সুযোগ একমাত্র লাইব্রেরিতে । কিন্তু লাইব্রেরিতেই বা আর নিভৃতি কোথায় ! সেখানেও ভিড় । সে ভিড় মনোযোগী পাঠকের , সেখানে নৈকট্যের সূচনা করার সামান্যতম প্রয়াসও অত্যন্ত দৃষ্টিকটু । বইপত্র আশ্রয় করে যেটুকু কথা বলার সম্ভাব্য সুযোগ , তা বড় সামান্য সময়ের । নইলে শুধু দূরের থেকে দেখা । প্রস্তাব যেদিন জানাল সেদিন সে একলা ছিল । কপালে না থাকলে এমনটা হয় না । ইউনিভার্সিটি থেকে ফেরার পথে দেখা হয়ে গিয়েছিল হঠাৎ । ইউনিভার্সিটির পাট তারও চুকে গেছে সমীরের মতন । তবু হয়তো দরকার পডেছিল কোনো , যেমন হঠাৎ সমীরের পড়েছে ।
–
সেদিন গ্রীষ্মের ভরদুপুরের খরতাপে কেমন করে যেন হঠাৎ সাহস জেগে উঠেছিল সমীরের । হয়তো কারণ ছিল তার , যে কারণে আপাত প্রতিকূলতার মাঝে অনুকূল এক আবহাওয়া দেখা দিয়েছিল । দেখা হওয়া মাত্র হাসির সাথে সাথে যেভাবে চোখমুখ উদ্ভাসিত হয়ে উঠল তন্দ্রার , তা বানান করে পড়লে অভ্যর্থনার নীরব উচ্চারণ শোনা যায় । বিনা রিহার্সালেই সমীর তখন জিজ্ঞেস করতে পারল , চললে কোথায় ? বাড়ি ? নাকি কোনো দরকারি কাজে ?
–
— দরকারি কাজের ডাক পাইনি এখনো । অগত্যা তাই বাড়ির দিকেই । তুমি?
— তথৈবচ । কিন্তু আমার কোনো আফসোস নেই তার জন্য । এমন আড্ডা মেরে সময় কাটানোর সুযোগ পরে আর কখনো পাওয়া যাবে কিনা সন্দেহ আছে । তাই আফসোস করে সময়টা নষ্ট করতে সায় পাই না মনের । তোমায় কি এখনই ফিরতে হবে বাড়িতে ?
— না , না , মোটেই না । এমন আশা জাগানো কথা শোনার পর আর কখনো হতাশায় ছটফট করার জন্য বাড়ি যাওয়ার কথা ভাবি ? কক্ষনো না । তা , তোমার আড্ডা দেওয়ার পরিকল্পনা এখন কোথায় ? অন্য কারো সাথে ?
— একদম নয় । যাকে পাব তার সাথেই ।
— ওহ্ , ফাইন , তাহলে আমাকে তো পেলেই ।
— অবশ্যই , এর চেয়ে ভালো আর কী হতে পারে ?
— ওহ্ , তাই! আমি ভাবতেও পারিনি এত বড় একটা কমপ্লিমেন্ট পাব তোমার কাছ থেকে ।
— থ্যাংকস , চলো কোথায় যাবে ?
–
সমীর তখন অনুকূল আবহাওয়ায় প্রাণপূর্ণ । বলল , আগে তো চলা শুরু হোক , তারপর না হয় ভাবা যাবে গন্তব্যের কথা । যেতে যেতে সমীরের মনে হল মাত্র ক’হাত দূরেই তো কফি হাউস , আড্ডা মারার পক্ষে সেটাই তো প্রকৃষ্ট জায়গা। সে কথা কি অজানা থাকতে পারে তন্দ্রার । তবু কেন গন্তব্যের কথা জানতে চাইল সে । সে কি তবে চাইছে না কফি হাউসের ওই ভিড়-কোলাহলের মধ্যে তাদের আড্ডার উদযাপন হারিয়ে যাক । সে কি তবে তেমনই নিভৃতি চাইছে যার জন্য তার নিজের আকাঙ্ক্ষা প্রবল !
–
হাটতে হাটতে হঠাৎ তার মনে হল এই মহার্ঘ সময় মৌনতায় নষ্ট করবার নয় । ঠিক তখনই এক প্রগলভ সমীর ফিরে এল তার মধ্যে । সে বলল , জানো তন্দ্রা , অনেক দিন ধরে একটা কথা তোমায় বলবার কথা ভাবছি , কিন্তু কোনোদিন সুযোগ পেলাম না । তন্দ্রা ঘাড় ঘুরিয়ে একবার মুখের দিকে তাকাল । সমীর বলল , আজ এইভাবে হঠাৎ দেখা না হয়ে গেলে কোনোদিনও সে কথা বলা হত কিনা কে জানে । তন্দ্রা আর একবার মুখ ঘুরিয়ে তাকাল । সমীরও তাকাল । তন্দ্রার ভ্রূ কি একটু কোঁচকানো ? চোখে কি সন্দেহ ? নাকি নিজের অনুমান অব্যর্থ বুঝতে পেরে কৌতুক প্রকাশ করেছে সন্দেহের ভঙ্গিতে ? । না , তা তো নয় , দৃষ্টি যেন কেমন মেদুর হয়ে আসছে মেঘে ঢাকা আকাশের মতন ! যেন বলছে , সে কথা শোনার জন্য আমিও তো কান পেতে আছি কবে থেকে , তবে আর দেরি কেন ? । সমীরের মনে হল দ্বিতীয় অনুমানটাই বোধহয় সত্য । তাই সে বলল , বলব বলব , আছি তো আমরা কিছুক্ষণ !
–
এগিয়ে গেল অনেক দূর , নিভৃতির খোঁজে । পাওয়া গেল শেষে তেমন একটা জায়গা , ভর দুপুরেও যেখানে ভিড় হয় না । সমীর এগিয়ে গেল কেবিনের দিকে । তন্দ্রা আপত্তি করল না । সেও গেল পিছু পিছু । প্রায় ঘেমে নেয়ে ওঠা শরীরটা ফ্যানের হাওয়া পাওয়া মাত্রই আরামে মুখ থেকে বেরিয়ে এল , ” আহ্ ” । আরামে তন্দ্রারও প্রায় একই রকম প্রতিক্রিয়া , কিন্তু কোনো রকম উচ্চারণে তা প্রকাশ পেল না । তন্দ্রা বলল , এবার বলো কী বলতে চেয়েছিলে । সমীর বলল , বলব বলব , কোন ব্যস্ততা নেই । আগে বল , কী খাবে । তন্দ্রা বলল , শুধু চা , এই গরমে আবার কিছু খেতে আছে নাকি ?
–
— গরমের কথা যদি বল, তাহলে কিন্তু চা-ও চলে না ।
তন্দ্রা চোখ তুলে তাকাল সমীরের চোখের দিকে । ঐ ভাবেই থাকল কিছুক্ষণ দৃষ্টি দুজনের আলিঙ্গনাবদ্ধ হয়ে । ছাড়াছাড়ি হয়ে যাওয়ার পর কৌতুক খেলে গেল তন্দ্রার চোখে । সে বলল, অনেকক্ষণ থাকতে হলে কেবল চা-ই খেতে হয় বারবার সেটা আজও বুঝতে পারনি সমীরদা ? কোনো খাবার অতক্ষণ সময় ধরে খাওয়া যায় না ।
— তা জানি , কিন্তু খাবার অর্ডার দেওয়ার যে আর একটা লাভ আছে , সেটা তুমি জান না ।
— জানি না হয়তো , কিন্তু অনুমান করতে পারি , ঠিক যেমন অনুমান করতে পারি তুমি কী বলবে , মানে কোন কথা বলবার জন্য সময় নিচ্ছ ।
— কী কথা বলো তো ? দেখি তোমার অনুমান কতটা ঠিক হয় ।
— অনুমান করা মোটেই কঠিন নয় , সমীরদা । অনেক আগেই তুমি যে তা বলে দিয়েছ , তুমি তা জান না । আমার শুধু একটাই সন্দেহ ছিল যে ঠিক শুনেছি কিনা । তো আজ যখন তুমি এত আয়োজন করছ সে কথা বলবার জন্য , তখন আর বুঝতে বাকি থাকে নাকি যে কথাটা আমি ঠিকই শুনেছিলাম ।
–
সমীর আবার জিজ্ঞেস করল , বেশ তো , শুনিই না কী অনুমান করলে ? । ঠিক সেই সময়ই বেয়ারা এসে হাজির হল মেনু কার্ড নিয়ে , তন্দ্রা উত্তর দেওয়ার আগেই । সমীর কার্ডটা এগিয়ে দিল তন্দ্রার দিকে । বলল , দেখ । দেখে বলো কোনটা চলবে । তন্দ্রা হাসল , বলল , তোমায় তো বললাম সমীরদা , আমার শুধু চা । সমীর বলল , হ্যাঁ তা শুনেছি তখন । দাও এদিকে , আমিই দেখি । তারপর নিজে দেখে অর্ডার দিল সমীর । ফিশ কবিরাজি আর হার্ড টোস্ট , দুই জায়গায় । তারপর মেনু কার্ড ফিরিয়ে দিতে দিতে বলল , দুটোই একসাথে দেবেন । একটু ভাল করে করবেন কিন্তু । বেয়ারা ঘাড় নাড়িয়ে সম্মতি জানাল । তারপর কেবিনের পর্দা টেনে দিতে দিতে বলল , একটু দেরি হবে কিন্তু । সমীর বলল , তা হোক । বেয়ারা চলে গেল । যাওয়ার সময় আরো টান টান করে দিয়ে গেল পর্দাটা ।
–
সমীরের চোখ যখন সেখান থেকে সরে এসে তন্দ্রার মুখের উপর , তখন দেখল তন্দ্রা হাসছে । হালকা একটা হাসির ছোপ পড়ল সমীরের ঠোঁটে । ভ্রূ কুঁচকে জিজ্ঞেস করল , হাসছ যে ? । তন্দ্রা বলল , আমার অনুমান খুব একটা ভুল হয় না দেখলাম । দেখলে তো আমি ঠিকই ধরেছিলাম , পর্দা টেনে কেমন ঢেকে দিয়ে গেল । কি , তাইতো ?
–
লজ্জা পাওয়া মুখে সমীর বলল ,বাদ দাওতো , বলো কী বলছিলে তখন ? । তন্দ্রা বলল , আমি কেন ? বলবে তো তুমি । তখন বললে না কী একটা কথা তুমি অনেক দিন ধরে বলব বলব করছ । এখন বলে ফেল , এইতো প্রকৃষ্ট সময় । অলমোস্ট নির্জন রেস্টুরেন্ট , কেবিন পর্দায় ঢাকা । কি সমীরদা , আমার অনুমান ঠিক আছে তো ? তোমার এতদিনের অপেক্ষা এবার শেষ করে ফেলো ।
লজ্জায় লাল হয়ে গেল সমীরের চোখমুখ । দিশাহারা মনে হতে থাকল তার নিজেকে , সিলেবাসের বাইরে থেকে প্রশ্ন এলে যেমন হয় । না ঠিক তাও নয় , সম্ভাব্য যে প্রশ্নের উত্তর মনের মধ্যে তৈরি আছে , সে প্রশ্নের সমস্ত উত্তর বলে দিয়েও যদি আবার সেই প্রশ্নই করা হয় , তাহলে যেমন ভেবে পাওয়া যায় না আর কী বলার থাকতে পারে , অনেকটা সেই রকম ।
–
তার এই বিপর্যস্ত অবস্থা দেখে তন্দ্রা জিজ্ঞেস করল , তোমার যে কেন এত দ্বিধা বুঝতে পারি না । কত কেউ তো বলে গেল এ যাবৎ , কম শুনলাম নাকি সে কথা । কান ঝালাপালা হয়ে গেছে শুনতে শুনতে । বুঝতে পারি না ওই কণ্ঠস্বরের ভিড়ে সেই চেনা কণ্ঠস্বরটা আছে কিনা যার জন্যে কান পেতে আছি । খুঁজে পাই না কিছুতেই । অথচ নিয়ত সবাই বলে চলেছে , ভালবাসি , ভালবাসি , ভালবাসি । দুদিন আলাপ হতে না হতেই , কথাবার্তায় একটু সহজ হতে না হতেই ওই এক কথা , ভালবাসি । গলাটা তখন এমন গম্ভীর হয়ে যায় আর কথায় তখন এমন বিষাদের সুর থাকে যে মনে হয় যেন মা বাবার মৃত্যুর খবর শোনাচ্ছে । শুনলে নিজের মনটাও যেন কেমন নরম হয়ে যায় , কোলে টেনে নিয়ে আদর করতে ইচ্ছে করে । জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে করে , আহা বাছা রে এত দুঃখ কীসের তোর ? ভালবাসতে ইচ্ছে করেছে ? তা বাসবি, কে বাধা দিচ্ছে তোকে ! শুধু হঠাৎ করে কোনোদিন বলতে আসিস না যেন যে মা তোর হাতের বালা আর ব্লাউজের মাপ জানতে চাইছে । কখনো কখনো রাগের মাথায় জিজ্ঞেস করে বসেছি , খোকা জীবনে আর কাকে কাকে ভালবেসেছ এর আগে । কেউ কেউ হতভম্ব হয়ে মুখের দিকে তাকিয়ে থেকেছ । তখন জিজ্ঞেস করেছি , ওহ্ , আমাকে দেখেই ইচ্ছেটা প্রথম জাগলো নাকি? কথার কোনো জবাব নেই দেখে যখন হো হো করে হেসে উঠলাম , তখন বোধহয় খোকার মেল ইগোতে লাগল । বলল , আমি কিন্তু কোনো অশিষ্ট আচরণ করিনি তোমার সাথে , তুমি অকারণে হেক্ল করছ আমাকে । তোমার আপত্তি থাকতেই পারে , কেউ তো আর জবরদস্তি করতে যাচ্ছে না । আমি বললাম , ওহ্ , রাগ হল বুঝি ? আমাকে যে হেক্ল হতে হচ্ছে , সেটা খেয়াল করেছ ? ।
–
ছেলেটা যেন আকাশ থেকে পড়ল । হেক্ল করলাম তোমাকে ? আমি ? । আশ্চর্য তো ! কী বললাম তোমাকে ?
— ভালবাসার প্রস্তাব করলে তো? করোনি ?
— হ্যাঁ, তা করেছি । তোমাকে ভাল লেগেছিল , তাই জানিয়েছি সে কথা । এতে অন্যায় কোথায় ? তোমার সাথে পরিচয় আছে , বন্ধুত্ব আছে , অনেক রকম গল্প , আলোচনা হয়েছে এ যাবৎ । একটা সহজ সম্পর্ক আছে বলে এত স্পষ্ট করে বলতে পেরেছি । এতে অন্যায় কোথায় ? এতে তোমায় হেক্ল করা হল কেমন করে ?
— নয় হেক্ল করা? এতটা সহজ সম্পর্ক নিশ্চয় আরো অনেকের সাথে তৈরি হয়েছে, অনেক ছেলে বন্ধুদের সাথে ? তাদের কাউকে কি এমন কায়দা করে কখনো বলতে গিয়েছ , ” ভালবাসি ” । জানি , বলোনি কখনো। কারণ তারা ছেলে , তাদের নিয়ে কোনো বিশেষ সম্পর্কের কথা ভাবা যায় না । আমায় শুনতে হল কারণ আমি মেয়ে । আমি মেয়ে বলে একের পর এক ছেলেরা এসে ইনডাইরেক্টলি তাদের সেই বিশেষ ইচ্ছের কথা শুনিয়ে যাবে আর আমাকে কিনা বিনা রাগে হাসিমুখে শুনতে হবে সেগুলো ? সেটা হেক্লড হওয়া নয় ? । তখন থামল ছেলেটা । তারপর “ঠিক আছে , আসছি ” বলে যখন চলে যাচ্ছে , তখন পিছন ডেকে বললাম , শোনো , কাল থেকে কথা বন্ধ করে দেবে এমন যেন না হয় । দেখা হলে মুখ ঘুরিয়ে চলে গেলে না-চেনার ভান করে , এমন দেখলে কিন্তু সব ফাঁস করে দেব , বুঝলে । এতক্ষণ পর প্রথম হাসল ছেলেটা । বলল , না , না , তা হবে না কখনো ।
একমনে শুনছিল সমীর । এতক্ষণে তার লজ্জা পাওয়ার ভাব কেটে গেছে অনেকটাই । জিজ্ঞেস করল ” তোমাদের ইয়ারের ?
— কে ? ছেলেটা ?
— হ্যাঁ , তা না হলে আর কার কথা বলব ?
— বুঝেছি , কিন্তু তা যে বলতে পারব না সমীরদা । অলিখিত চুক্তি আছে যে , কাউকে জানাব না ।
— ওহ্ ।
–
ঠিক এই সময় কেবিনের পর্দা সরে গেল । চোখ সরে গেল দুজনেরই সেই দিকে । বেয়ারার হাতে ট্রে । তার উপর কয়েকখানা প্লেট । ধোঁয়া উঠছে প্লেট থেকে । প্লেটগুলো এক এক করে নামিয়ে দেওয়া হল টেবিলের উপর । সমীর আর তন্দ্রার আলাপচারিতায় সামান্য বিরতি তখন । বেয়ারা তখনো কেবিনের মধ্যে প্লেট সাজাচ্ছে , তারই সামনে স্যালাডের প্লেটটা টেনে নিয়ে কচ কচ করে পেঁয়াজ চিবোতে লাগল তন্দ্রা । সমীর ব্যস্ত হয়ে জিজ্ঞেস করল , আরে , খাবার ফেলে স্যালাড চিবোচ্ছে যে ! স্যালাড এত ভালবাসো ?
— স্যালাড না, পেঁয়াজ ।
বলেই বেয়ারাকে বলল, ভাই একটু রসুন এনে দিতে পারবে? এক কোয়া হলেই হবে । আর একটা কাচালঙ্কা । বেয়ারা বলল , ” রসুন কোথায় পাব ? স্যালাডে রসুন থাকে না । লঙ্কা চাইলে আরো এনে দিচ্ছি “। কিন্তু তন্দ্রার নাছোড় আবদার । বলল , দাও না ভাই এনে , রসুন না হলে আমি খেতে পারি না । কিচেনে গেলে পাবে । এত কিছু প্রিপারেশন হচ্ছে , রসুন না থেকে পারে ? । বেয়ারা বলল , ঠিক আছে দেখছি , রান্নার জন্যে আনা রসুন ওরা দেয় কিনা । তন্দ্রা বলল , ঠিক আছে আমি এক্সট্রা পেমেন্ট করছি তার জন্য । অন্য রেস্টুরেন্টে তো চাইলে দেয় ।
–
অবাক হয়ে দেখছিল সমীর । বেয়ারা চলে যাওয়ার পর হাসতে হাসতে বলল , এমন তো দেখিনি কখনো , রসুনের জন্য কাউকে এমন বায়না ধরতে ! রসুন আবার কেউ শখ করে খায় নাকি ? মুখে গন্ধ হয় , আশেপাশে কেউ বসতে পারে না ।
তন্দ্রাও হাসল। বলল , ঠিক বলেছ সমীরদা , বিশ্রী গন্ধ হয় মুখে , অনেকক্ষণ পর্যন্ত যায় না । নিরুপায় হয়ে খাওয়া , এখন অভ্যাস হয়ে গিয়েছে ।
— নিরুপায় হয়ে কেন ? ডাক্তার বলেছে ?
‘– না , না , একটা বিদেশি ম্যাগাজিনে পড়েছি । সেই থেকে খাচ্ছি ।
— রসুনের তো উপকারিতা আছেই । সে তো আমরা এমনিই জানি , তার জন্য বিদেশি ম্যাগাজিন পড়তে হবে কেন ? সেখানে কি আর কোনো উপকারিতার কথা লিখেছে ?
— হ্যাঁ , লিখেছে । কিন্তু তা তেমন বলবার মত নয় ।
— তবু শুনিই না কী লিখেছে ।
— লিখেছে ওর গন্ধের কথা আর সেই গন্ধ কেমন কাজ দেয় ।
— যেমন ?
— লিখেছে হলিউডের কিছু নাক উঁচু হিরোইনরা নাকি অভিনয়ের সময় সেটে ঢুকবার আগে খুব করে পেঁয়াজ আর রসুন চিবিয়ে নেয় , যাতে চুম্বন দৃশ্যে হিরোরা অকারণে বেশি সময় ঠোঁটের উপর ঠোঁট ঠেকিয়ে রাখতে না পারে , যাতে ছিটকে সরে যায় । ভেবে দেখলাম প্রোটেকশন মেজার হিসাবে ব্যাপারটা খারাপ নয়। সাধারণ মেয়েরাও তা করতে পারে যদি কখনো বোঝে তেমন আশঙ্কা আছে ।
–
শেষের কথাটা শোনা মাত্রই মুখটা কালো হয়ে গেল সমীরের । উঠে দাঁড়িয়ে পড়ল সে । একটু এগিয়ে গিয়ে এক টানে পর্দাটা সরিয়ে দিল । অমনি যেন বাইরের আলোর সাথে বাইরের সব কিছু কেবিনের মধ্যে ঢুকে পড়ল । খদ্দের কেউ নেই , কেবল একজন দূরে এক কোনে মাথা নিচু করে বসে চা খাচ্ছে । চা , শুধুই চা । সমীর বলল , কাউকে তো দেখছি না বাইরে । সে ছেলেটা রসুন খুঁজতে দেশান্তরী হল নাকি ? খেয়ে নাও , খেয়ে নাও , কতক্ষণ আর বসে থাকবে ? রসুন নিয়ে সে আর আসবে না ।
হাতে তখন ছুরি আর কাঁটা চামচ ধরল তন্দ্রা । তারপর মুখ তুলে সমীরের চোখের উপর চোখ রেখে বলল , কী যেন বলবে বলছিলে ? কই , সেই কথাটাই তো বললে না এখনও ।
–
— আর কী বলব , তোমার কি আর কোনো কথা জানতে বাকি আছে নাকি ? অনুমানে তো তুমি সব কথাই ঠিক ঠিক জেনে যাও। তখন তো বললেই যে আমার কথাই নাকি আমি আগেই সব বলে দিয়েছি , তুমি শুনতে পেয়েছ । শুধু সন্দেহ নিরসনের বাকি ছিল যে ঠিক শুনেছ কিনা । এখন মনে হয় সে সন্দেহ নিরসন হতে বাকি নেই ।
— বাকি থাকবে না কেন ? তোমার মুখ থেকে না-শোনা পর্যন্ত বাকি তো থাকবেই ।
শুনে কেবল হাসল সমীর , ধনুকের মতন বাঁকা সেই হাসি । তন্দ্রা বলল , হাসছ যে ? সমীর বলল , হাসছি তোমার অনুমানের আলস্য দেখে । মাথা খাটাও , দেখবে যে বলার আর বাকি নেই । যা বলার সব বলে দিয়েছি । এই প্রথম তন্দ্রাকে গম্ভীর দেখাল । সমীর বলল , একটু বসো তো , বাইরে গিয়ে দেখে আসি ছেলেটা গেল কোথায় , এক কোয়া রসুন এখনও জোটাতে পারল না । তন্দ্রা বলল , থাক , লাগবে না ।
— না না , তা হয় নাকি ? বড় মুখ করে বললে , আর আমি কিনা এক কোয়া রসুনের ব্যবস্থা করতে পারব না তোমার জন্য ? এখানে না পাই , বাইরে কোনো দোকানে তো পাব ।
গল্পের বিষয়:
রোমান্টিক