ভালোবাসার ক্যানভাস

ভালোবাসার ক্যানভাস

দিনটা ১৩ই ফেব্রুয়ারি,
হোটেলের বাইরে লনটার কাছে বসে গরম চা তে চুমুক দিতে দিতে অনিশা ঘন হয়ে এলো ঋকের বুকে, সকাল সকাল চায়ের উষ্ণতার সঙ্গে স্ন্যাকস হিসাবে বরের বুকের উষ্ণতাটা হানিমুনটাকে আরো জমিয়ে দিলো।
হোটেলে ফিরে স্নান সেরে বেরিয়ে ব্রেকফাস্ট টেবিলে পৌঁছে দেখে ঋক অর্ডার দিয়ে দিয়ে দিয়েছে অলরেডি।
ও বসতেই ঋক বলে উঠলো,
-বল তো ওরা কি বলছে?
অনিশা অবাক হয়ে বলল,
-কারা?
-আরে কেবলি ঐ যে কোণায় বসা ফ্যামিলিটা, দেখ আমাদের দিকে তাকিয়ে তাকিয়েই বলছে।
-তো আমি কি করে জানবো? অদ্ভুত তো।
-আরে অনুমান তো করতেই পারিস না কি?ছাড় তুই.. আমি বলবো?
-বল
-বৌ টা বরটাকে বলছে,
“দেখো কাপলটাকে!এত ফূর্তি,সবে সবে তো বিয়ে হয়েছে, কাটুক দশ-পনেরো বছর, সংসারের যাঁতাকলে সব ফূর্তি উবে যাবে।”
আর বরটা বলছে,
“আরে বাওয়া সে আর বলতে? আমি হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি,সে আর বলতে???”
-যা তা তুই, বলতে বলতে অনিশা হাসিতে ফেটে পরে।
-জানি তো,তবে ওরা তো আর জানে না অলরেডি আট বছর সহ‍্য করেছি এই পাগলীটাকে,আরো পঞ্চাশ বছর আরামসে কাটিয়ে দিতে পারবো।
অনিশা হেসে একটা ফ্লাইং কিস ছুঁড়ে দেয় ঋকের দিকে। হোটেলের বয়টা এসে ব্রেকফাস্ট রেখে যায়, সঙ্গে একটা গোলাপ ফুলের সাথে লাল রাংতায় মোড়া একটা বইয়ের মতো কিছু। সেদিকে তাকিয়ে ঋক বলে,
-ম্যাডাম গিফট আর ফুলটা নিয়ে ধন্য করুন আমায়।আনন্দে চোখ চিক চিক করে ওঠে অনিশার, জোরে চিৎকার করে বলে,
-কিরে এটা ঋক? নিশ্চই সেই পিসি চন্দ্রেরটা?
-খোল না আগে, আমার খুব প্রিয় কিছু,আজ তোকে দিলাম,যত্ন করে রাখিস।
খুলে দেখে একটা কবিতার বই , জয় গোস্বামীর।
পাতা উল্টে দেখে ঋকের হাতে লেখা,
‘ছিলো একলা ঘর, একলা মন আর একলা একটা আমি,
ভালোবেসে কাছে টানলি, হলাম অনেক দামী,
রূপকথারা আকার নিলো তোর ছদ্দবেশে,
পাগলী থাকিস কিন্তুএইভাবে আমার শেষ নিঃশ্বাসে।’
গিফট টা মাটিতে ফেলে ঠাস করে চড় মারে অনিশা ঋক কে, হাউ হাউ করে কাঁদতে কাঁদতে বলে,
-চাই না তোর কিছু, আজই মার কাছে চলে যাবো।
মাথায় একটা চুমু খেয়ে বুকে টেনে ঋক বলে,
-পাগলী বউ আমার, যেতে দিলে তো।

দশ বছর পর:-

-আমি আর পারছি না ঋক, প্রতিদিন এইভাবে দেয়ালের সাথে কথা বলে বলে আমি ক্লান্ত। জানিস , রোজ বোঝাই নিজেকে না আমরা নিজেরা তো আমাদের জন্যই লড়ছি, কিন্তু এই লড়াই এ আমরা কোথায়?
-প্লিজ অনি, তুই চলে যাস না।
-প্লিজ ঋক,হলো তো অনেক। কেন এই নাটকটা কন্টিনিউ করবো বলতে পারিস? আমাদের মধ্যে কথা ফুরিয়ে গেছে জানিস? আজ আমরা পাশাপাশি বসে থাকলে তোর মোবাইল আর আমার মোবাইল কথা বলে জানিস? ওরাও ক্লান্ত হয়ে দেখ চার্জ ফুরিয়ে শুয়ে পড়েছে, পাশাপাশি শুই ঠিকই, কিন্তু আমাদের নিজেদের কথাগুলো ঘুমিয়ে পড়ে…
-সাট্ আপ অনি, প্লিজ আমি তোকে ছাড়া পারবো না থাকতে।
-কাম অন ঋক,এই ন্যাকা ন্যাকা কথাগুলো ভালো লাগছে না আর শুনতে।তুই জানিস অন্য কোনো কারণ নেই, শুধু এই বোরিং লাইফটা আমি আর নিতে পারছিনা, অনেকটা ভাঙলাম নিজেকে তোর জন্য।
-অনি সারাদিনের শেষে তোকে দেখতে না পেলে আমি পাগল হয়ে যাবো,চল না প্লিজ নতুন করে শুরু করি আবার।
-সেটা আর হয় না।দেখ এভাবে আমরা জীবনটা কাটিয়ে দিতেই পারি, তবে আমার মনে হয় এভাবে একসাথে থাকার চেয়ে দুজন আলাদাভাবে ভালো থাকাটা অনেক বেশি ভালো।
কথাটা শেষ করেই ঋকের হাতে সাইন করা ডিভোর্স পেপারটা ধরিয়ে ট্রলি নিয়ে বেরিয়ে যায় অনিশা।
চুপচাপ কাঠের পুতুলের মত খাটের একপাশে বসে ঋকের মনে হয় চারিদিকটা হঠাৎ শূন্য হয়ে যাচ্ছে।অনিশা ফ্ল্যাট থেকে নেমে একটা ট্যাক্সি ধরলো, চোখে সানগ্লাস ।আকাশটা দেখলো ঋক, আজ মনে হয় বৃষ্টি আসবে।

দু সপ্তাহ পর সন্ধ্যেবেলা:-

উফ্ শান্তি। আজ ঋক ডিভোর্স পেপারটা সাইন করে পাঠিয়ে দিয়েছে,এবার নিজের মতো করে শান্তিতে থাকা যাবে, ভাবতে ভাবতে কফির কাপটা হাতে নিয়ে টিভি খুলে বসে অনিশা।আনমনা হয়ে মাকে বলে,
-মা খেয়ে নাও এখন, কখন খাবে?
ভেতরে শুয়ে থাকা মহিলা বলে ওঠেন,
-দাড়া তোর বাবাকে খাবারটা দিয়ে নিই।
তারপর উঠে একটা ছোট্ট থালায় সাজিয়ে একটা ফটোর সামনে রেখে খেতে এলেন। ফটোর ভদ্রলোক অনিশার বাবা, আজ প্রায় ১৪ বছর উনি নেই । অনিশার মা আজও বাঁচিয়ে রেখেছেন ওনাকে। হটাৎ কেঁদে ফেলে অনি, মা মাথা নিচু করে বলতে থাকেন,
“ঋক কিছু খেলো কিনা কে জানে,যা ছেলেমানুষ ,মন খারাপ থাকলে কিছু বানাবেও না খাবেও না। এই কথা গুলো ফুটছে নাকি মনা এখন তোর গায়ে???”
খায় না আর অনি।মনটা খুঁতখুঁত করতে থাকে ।রাতের জন্য কিছু বানাতে ও ইচ্ছা করে না,ঋকের পছন্দমতো খাবার বানাতে সবসময় ভালো লাগতো,কি তৃপ্তি করে খেতো। নিজের জন্য খাবার বানাতে ইচ্ছা করে না। কিছু না খেয়েই শুয়ে পড়ে।
হঠাৎ বুক ঠেলে একরাশ অভিমান বুদবুদের মত ভেসে উঠতে থাকে। হঠাৎ চোখের সামনে ভেসে ওঠে সেই প্রথম প্রেমের দিনগুলো,ঋকের হাত ধরে কলকাতার অলিগলিতে ঘুরে বেড়ানো থেকে আরম্ভ করে হানিমুনের দিনগুলো এক-এক করে চোখের সামনে ভেসে উঠছিল।চোখ ভেসে যাচ্ছিল অবাধ জলের ধারায়।
কোথায় ছিল এত ভালোবাসা?কই বিগত কয়েক বছরে তো এই ভালোবাসার আঁচও পায়নি।ও তো ভেবেছিলো সম্পর্কটা মরে গেছে, যেটার শ্রাদ্ধ ও আজ হয়ে গেলো কিন্তু আজ বুঝতে পারছে সম্পর্কটা চাপা পড়ে গেছিল সংসারের যাতাকলে।ও যদি ঋকের থেকে দূরে না আসতো,তাহলে আজ ও বুঝতে পারতো না।
মোবাইল হাতে নিয়ে ঋকের নম্বরে ফোন করলো। প্রথমবার ফোনটা বেজে কেটে গেল। দ্বিতীয়বার রিং হতে ধরলো ফোনটা ঋক।
-হ্যাঁ,বল
-তুই আমার ফ্ল্যাটে আয় এখনই।
কান্নার আওয়াজে ঘাবড়ে গেল ঋক
-তোর শরীর ঠিক আছে তো?ঐ কি হয়েছে?আরে কিছু তো বল।
-তুই আয়
-ওকে আমি আসছি।
উদ্বিগ্ন গলায় ঋক বলে উঠলো।

ঠিক আধঘন্টা পর অনিশার ফ্ল্যাটের বেলটা বেজে ওঠে।
খোলার সাথে সাথে অনিশা ঝাপিয়ে পড়ে ঋকের বুকে।
-তুই কেন ডিভোর্স পেপারটা সাইন করলি?
কাঁদতে কাঁদতে বলতে থাকে অনিশা
-তুই তো চাইলি।
-আমি চাইলেই তোকে দিতে হবে, আমি চাঁদ চাইলে এনে দিবি তো?
-হ্যাঁ দেবো।
-মিথ্যুক
-আচ্ছা বাবা এবার চোখটা মোছ।

তখন হঠাৎ ই ঋকের বুকের পুরুষালি গন্ধ পাগল করতে থাকে অনিশাকে।ওর ঠোঁটে নেমে আসে উষ্ণতা।
ওর গলায় ঋকের দাড়ির উদগ্রতা, কোলে তুলে নেয় ঋক ঠিক যেমন ভাবে নিতো। ঠোঁট নেমে আসে ঠোঁটে,ভারী হয়ে আসে নিঃশ্বাস।
ঋক, অনিকে জড়িয়েই বলতে থাকে,
-সন্ধ্যেবেলা ঝগড়া হবে, হবে দুই
বিছানা আলাদা
হপ্তা হপ্তা কথা বন্ধ
মধ্যরাতে আচমকা মিলন
পাগলী,তোমার
সঙ্গে ব্রক্ষ্মচারী জীবন কাটাব
পাগলী ,তোমার সঙ্গে আদম ইভ কাটাব জীবন।

গল্পের বিষয়:
রোমান্টিক
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত