অফিসের গাড়িটা জেমস লং বড় রাস্তায়, পাড়ায় ঢোকার গলির সামনে এসে দাড়ালো। আমি গাড়ির মধ্যে বাকি সহকর্মীদের বিদায় জানিয়ে গলির মধ্যে ঢুকে বাড়ির দিকে এগোতে শুরু করলাম। আরো চার মিনিট মতো সোজা পথ হাটতে হবে বাড়ি পৌঁছাতে। খুব দেরি হয়ে গেছে আজকে, এখন সময় রাত বারোটা কুড়ি। এমনিতে আমি এগারোটার মধ্যে বাড়ি ফিরে আসি অন্য দিনে, তবে আজ ফিরতে এতো দেরি হলো কারন সকালে অফিস যেতেও এক ঘণ্টার ওপর দেরি হয়ে গেছিলো। তাই কিছুক্ষন বাড়তি সময় কাজ করতে হলো। যেই না তিন চার পা এগিয়েছি, অমনি সামনে থেকে রাস্তার চেনা তিনটি কুকুরগুলো দৌড়ে চলে এলো আমার কাছে, ল্যাজ দোলাতে দোলাতে। আনন্দ পেয়েছে আমাকে দেখে, জানে কিছু একটা খেতে দেবো। ব্যাগের মধ্যে থেকে বিস্কিট এর প্যাকেট টা বার করে, খেতে দিলাম জীবগুলোদের। খেয়ে ওরা আরো খুশি হলো আর সেটা দেখে আমারও ভালো লাগে। আমি আবার বাড়ির দিকে সোজা এগোতে লাগলাম।
শীতকালের সময়, সবাই কম্বল চাপা দিয়ে এতক্ষনে হয়তো ঘুমিয়ে পড়েছে। ফাঁকা রাস্তা, মানুষ বলতে একমাত্র আমি। এই পাড়াতে জন্ম থেকে রয়েছি, রাতে এখানকার গলিতে আড্ডাও মারি বন্ধুদের সাথে, তবে এখন এই নিঝুম শীতের রাতে একলা চলতে গিয়ে চারদিকটা একটু ছমছমে লাগছে বটে। সোজা পথটায় কিছুটা এগোনোর পর, সামনেই ডান দিকে যাওয়ার জন্য একটা গলি পরে। সেই গলির মুখটায় একটা ফ্ল্যাটে থাকে আমার বন্ধু টুবাই। গলির মুখ অবধি এসে সবে ভাবছিলাম একবার ওকে ডাকবো নাকি কিছুক্ষন আড্ডার জন্য, হঠাৎ করে পেছন থেকে ওই কুকুরগুলো তারস্বরে ডাকতে ডাকতে আমার দিকে দ্রুত গতিতে ছুটে আসতে লাগলো। আমার পাশে এসে থেমে গিয়ে, ওরা এবার ডানদিকে যাওয়ার গলিটার দিকে চেয়ে সেই একই ভাবে জোড় গলায় ডেকে চলেছে। দেখে মনে হলো যেনো আমাকে সুরক্ষা করছে কোনো একটা ঝামেলা থেকে। এই প্রাণীগুলো এরকমই বিশ্বস্ত হয়। আমিও তাকালাম গলিটার দিকে। কাউকে তো দেখতে পাচ্ছি না! কোনো বেড়াল ও দেখছি না।
তাহলে চোর নাকি? টুবাইয়ের বাড়ির পাইপ বেয়ে উঠছে হয়ত। তদন্ত করতে গলির মধ্যে ঢুকলাম। বাড়ির চারিদিকে রাস্তার আলোতে যতটা দেখা যায়, ভালো করে দেখে নিলাম। কেউ নজরে পরলো না। তাও কুকুরগুলো ডেকে চলেছে। কে জানে কেনো। যাইহোক, আমি আবার গলি থেকে বেরিয়ে বাড়ির দিকে অগ্রসর হতে শুরু করলাম, এমন সময়ে রাস্তার সবকটা আলো নিভে গেলো। এক নিমেষে আমাকে চারপাশ থেকে একটা প্রকান্ড কালো ছায়া ঘিরে ধরলো। কুকুরগুলোর চিৎকার এই জনহীন কালো রাতের নিস্থবদতায় আমার কান দুটো কাঁপিয়ে দিচ্ছে। তবে এরকম অন্ধকারে ওই অবলা জীবগুলোর ডাক টাই আমাকে মোবাইলের ফ্ল্যাশলাইট চালু করে এগিয়ে যাওয়ার সাহস দিলো। লোডশেডিং আগেও হয়েছে পাড়াতে, আর রাস্তায় আলো না থাকতেও আমি বহুবার চলাফেরা করেছি। কিন্তু আজকের মতো একটা অস্বস্তি ভাব আগে কখনো হয়নি। আকাশের চাঁদ কেও এখুনি লুকাতে হতো? ওখান থেকে ও তো সামান্য আলো আসে। এখনও পাঁচ টা বাড়ি পেরিয়ে আমার বাড়ি। আমি আমার স্ত্রী কে ফোন লাগালাম, ‘ বলছি বাড়িতেও কি লোডশেডিং?’ উত্তর এলো, ‘ কই না তো।’ কথাটা শেষ হতেই ফোন লাইন কেটে গেলো। ফোন এর ব্যাটারি শেষ। বুঝলাম, শুধু রাস্তার আলোগুলো নিভেছে। নতুন কিছু নয় এটা।
টুবাইয়ে’ র ফ্ল্যাট টা পেরোতেই, আমার বাঁ সাইড থেকে আওয়াজ এলো – ‘ খস খসখস…খসখস ‘ – সঙ্গে সঙ্গে বাঁ দিকে ঘুরে দাড়ালাম। জ্বলজ্বল করা দুটো চোখ তিক্ষ্ণ দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে রয়েছে, আর আওয়াজটা ও থেমে গেছে – ‘ মিয়াও ও!’ খস খস আওয়াজটা আবার শুরু হলো। শুনে যা বুঝলাম, একটা হুলো বেড়াল কাগজের ঠোঙ্গা ‘ র ওপর নিজের থাবা দুটো নিয়ে কাগজটার পুরো দফারফা করে দিতে চাইছে। বেড়ালটা র কাগজ ছিড়ে খেলা করার হালকা শব্দ – শুনে মনে হলো যেনো কোনো অচেনা লোক নিজের পা ঘষতে ঘষতে আমার পাশেই হাঁটছে। ঠান্ডা আরো বাড়ছে কারন সামনে থেকে বাতাসের তেজ সামান্য বেড়ে উঠেছে হঠাৎ করে। আমি আমার হাত দুটো জ্যাকেটের পকেটে ঢুকিয়ে এগিয়ে চলেছি, এমন সময় আমার ডান দিক থেকে একটা হালকা হাওয়ার দমকা আমাকে ঠান্ডার কাঁপুনি দিয়ে, ছুয়ে পালিয়ে গেলো। দুই তিন সেকেন্ডের জন্য আমি ঠান্ডায় কেঁপে উঠলাম। কোনো বাড়িতেও আলো জ্বলছে না। সবাই গভীর নিদ্রায় মগ্ন। কে আর এই শীতে জেগে থাকবে? ঠিক এই সময়ে কে একজন পেছন থেকে চেঁচিয়ে উঠলো,’ কোথায় চললে? ‘ আমি চমকে কাঠ হয়ে গেলাম। দাড়িয়ে পরে তাকালাম পেছনে – কেউ নেই। এই অন্ধকারে কাউকে দেখবই বা কি করে? তারপর দেখি একটা ফ্ল্যাটের ঘরে আলো জ্বলে উঠেছে, এবং সেই পরিবারের গৃহিণী আবার বলে উঠলেন ,’ কোথায় যাচ্ছো এখন? ‘ সম্ভবত মিনু কাকিমা তার স্বামী দেবু কাকুকে প্রশ্নটা করলেন। দেবু কাকু কোথায় চললেন আমার জানা নেই, তবে আমি চলতে লাগলাম বাড়ির দিকে। চার মিনিটের পথ চল্লিশ মিনিটের বোধ হচ্ছে। কুকুরগুলো আবার ডেকে উঠলো – ‘ ঘেউ উ উউ ! ‘ পিলে চমকে গেলো ডাকে। খেয়াল ছিল না যে ওরা ডাকা বন্ধ করে গিয়েছিল। আবার কিছু দেখতে পেলো নাকি? ডান সাইডে দাস কাকুর বাড়ির পরেই আমার বাড়ি। আর বাঁ সাইডে একটা নতুন ফ্ল্যাট এখন under construction অবস্থায়। স্পষ্ট শুনতে পেলাম কেউ নতুন ফ্ল্যাটের এক তলা ‘ র ছাদে চলাফেরা করছে। কোনো মিস্তিরি এই সময়ে থাকে না এখানে, কোনোদিন ও। নিশ্চই চোর, তাই কুকুরগুলো চেঁচিয়ে উঠলো।
আমি সাহসী গলায় জিজ্ঞেস করলাম, ‘ কে ওখানে ? ‘ – কোনো উত্তর নেই, না কোনো সাড়া শব্দ। আবার জিজ্ঞেস করলাম, ‘ কে ওখানে ?’
হালকা স্বরে, আমার কানের একদম কাছে এসে – ‘ কেউ না!’, জবাব এলো আমার প্রশ্নের। ছিটকে এক পা পিছিয়ে গেলাম, ‘ কে ? কে বললো ?’ মুখের একদম সামনে থেকে আবার সেই জবাব, ‘ কেউ না !’ ধাক্কা মেরে সামনে থেকে অচেনা শত্রু কে সরাতে চাইলাম। কিন্তু ধাক্কা মারবো কাকে? সামনে তো কেউ নেই। আতঙ্কে দৌড়াতে শুরু করলাম, সামনেই বাড়ি। চাঁদ একটু উকি মেরেছে, হালকা আলোতে নিজের বাড়ি দেখতে পাচ্ছি। দৌড়াতে দৌড়াতে ই পেছনে তাকালাম কেউ আমাকে তাড়া করেছে কিনা দেখতে, হঠাৎ সামনে থেকে কে বলে উঠলো, ‘ কেউ না! ‘ আমি গতি বাড়িয়ে বাড়ির মেন গেটে পৌঁছে, পাগলের মত কলিং বেল বাজাতে লাগলাম। এক প্রকারের বাতাস আমার পিছু নিয়েছে, আমাকে যেনো গেট থেকে সরিয়ে দিতে চাইছে। আমি বেল বাজিয়েই চলেছি। ভেতর থেকে ছিটকিনি খোলার শব্দ পেলাম। দরজা খুললো আমার স্ত্রী, আর সাথে রাস্তার আলো ও জলে উঠলো। বাতাসের তেজ কমে এসেছে, আর কুকুরগুলো ও আর ডাকছে না। আমার আতঙ্কিত আর সম্পূর্ণ ঘেমে যাওয়া মুখ দেখে আমার স্ত্রী জিজ্ঞেস করলো, ‘ কি হলো তোমার? একি অবস্থা? ‘ আমি জানি কি অবস্থা আমার, বাড়ির ভেতরে ঢুকলাম হাঁপাতে হাঁপাতে, ‘ এখন না, কাল সকালে কথা হবে ।’