বিবাহ নিমন্ত্রণ

মা বিয়ের জন্য সাজগোছ করছেন। না মানে বিয়ের দাওয়াত -এ যেতে হবে সেজন্য! আমার জন্য শুক্রবার হলো “বিয়ের দাওয়াত” দিবস। প্রায় প্রতি শুক্রবার মায়ের কোনো না কোনো আত্মীয়ের বিয়ে থাকবেই! এই হলো প্রকৃতির এক অদ্ভুদ নিয়ম। এবং সেই সব বিয়েতে আম্মা আমাকে অনেকটা জোরপূর্বক নিয়ে যান।

যাইহোক, এবারের বিয়েটা ছিল আমার ছোট খালার। কমিউনিটি সেন্টারে যাওয়ার পর প্রথম যে ভয়ংকর সংবাদটা শুনলাম, তা হলো খাবার পরিবেশন করার জন্য যাদের ঠিক করা হয়েছিল তাদের কয়েকজন আসবে না। মা আমার দিকে দরদি দৃষ্টিতে তাকালেন! আমি অসহায়ের মতো বললাম, আম্মা, দয়া করে খাবার পরিবেশনের দায়িত্ব আমার ঘাড়ে দিও না! আমার একটা মান-সম্মানের ব্যাপার আছে।

মা পূর্বের চাইতে দ্বিগুন দরদি কণ্ঠে বললেন, তোর খালার বিয়ে বলে কথা, আমার মান-সম্মানের ব্যাপারটা একটু দেখ। খাবার পরিবেশনে সমস্যা হলে বিশাল দুর্নাম হয়ে যাবে।

হিসাব বুঝলাম। আজ কপালে ওয়েটারগিরি-ই লেখা। খাবার রুমে ঢুকতেই এক চাচা অতি ভদ্রভাবে বললেন, নেন স্যার এই শার্টটা পরেন!

শার্টের দিকে তাকালাম, কটকটে গোলাপী রং। তার উপরে লেখা, মোঃ শামসু মিয়া। আমি রেগে গিয়ে বললাম, শামসু মিয়ার শার্ট আমি পরবো কেন?

চাচা মুচকি হেসে বললেন, শার্ট পরতে হবে, এটাই নিয়ম। তাছাড়া শামসু মিয়া আজকে কাজে আসে নাই, তার পরিবর্তেই তো আপনি কাজ করবেন।

মনে মনে বললাম, ওরে শামসু রে! তোরে খালি পাই একবার। কোপামু!

শার্ট পরে রুম থেকে বের হতেই আমার ছাত্রী বিথীর সাথে দেখা। লজ্জায় মাথা কাটা যায় অবস্থা। বিথী আমাকে দেখেই অনেকটা চিৎকার করে বললো, সে কি স্যার! আপনি কমিউনিটি সেন্টারেও কাজ করেন না-কি?

– না মানে আসলে!
– হোয়াটএভার ইউ আর লুকিং গ্রেট স্যার। গোলাপী তে আপনাকে ভীষণ মানিয়েছে।
– ব্যাপারটা হচ্ছে কী বিথী..
– ব্যাপার সে যাই হোক, কোন কাজই কিন্তু ছোট না, বুঝলেন স্যার! কিন্তু আপনার ডাকনাম যে ‘শামসু’ সেটা জানতাম না।

কথাটা বলার সাথে সাথেই বিথী চলে গেল। আমার এই অসহায়ত্বের ঘটনা তাকে বুঝানোর সুযোগ পেলাম না।

তার পরপর-ই দেখা হলো আমার হাইস্কুল টিচার সাইফুল স্যারের সাথে। আমার দিকে রাজ্যের অবাক দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে বললেন, কি রে তুই কী আজকাল কমিউনিটি সেন্টারে কাজ করা শুরু করেছিস নাকি?

যতটা লজ্জিত হওয়া যায়, তারচেয়ে দ্বিগুণ লজ্জিত হয়ে বললাম, না মানে স্যার মূল ব্যাপারটা হলো।

পুরো কথা শেষ করার আগেই স্যার বললেন, চুপ বেয়াদব, একদম চুপ। আমি আগে থেকেই জানতাম যে তোর অধঃপতন হবে, কিন্তু এতোটা হবে সেটা জানা ছিল না। কত করে বলতাম ঠিকমতো পড়াশোনা কর, তখন তো শুনতি না।

– স্যার আপনি যা ভাবছেন, ঘটনা আসলে..
– চুপ শয়তানের ওস্তাদ! আমাকে আর ঘটনা শোনাতে হবে না। আগামী শুক্রবারে আমার মেয়ের বিয়ে, সেখানে চলে আসিস। দাওয়াত খেতে নয়, খাবার পরিবেশন করতে!

লজ্জায়, অপমানে, এবং রাগে ইচ্ছে করছে মাটি খুঁড়ে পাতালে চলে যাই। সৃষ্টিকর্তার নিকট প্রার্থনাও করলাম। দুর্ভাগ্যবশত আমার প্রার্থনা সফল হলো না। খানিকবাদে মায়ের সাথে দেখা। মা আমার দিকে উৎসুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন, বাহ্ তোরে তো আজ অত্যাধিক সুন্দর লাগতেছে! ঘটনা কী রে?

আমি রেগে বললাম, আম্মা, তুমি আমার সাথে আগামী দশ দিন কথা বলবা না। তোমার জন্যেই আজ আমার এই দশা। আসলে আমি তোমার ছেলেই না!

মা অবাক চোখে বললেন, ছেলে না মানে! আরে কী বলিস, তুই মেয়ে হয়ে গেছিস নাকি? এই অভাবনীয় ঘটনা কবে ঘটলো? যাক একটা মেয়ের বড় শখ ছিলো..

বুঝলাম মা আরও রাগাতে চাচ্ছেন,উনাকে সেই সুযোগ না দিয়ে আমি খাবার টেবিলের দিকে চলে গেলাম। যথাসময়ে মেহমান সবাই না আসার কারণে দুটো চেয়ার ফাঁকা রেখেই আমাদের টেবিলে খাবার পরিবেশন শুরু হলো। এবং তারপর থেকেই মূল খেলা শুরু!

গোরু গর্ভবতী হলে যেমন দেখায়, আমার সামনে যে আঙ্কেল বসে খাচ্ছেন, উনার পেটের অবস্থা তার কাছাকাছি বলা চলে। আরো সমস্যা হলো উনি প্রায় প্রতি মিনিটে তিন বার করে আমায় শামসু ভাই ডাকছেন। কী যে এক ঝামেলায় পড়লাম!

প্রায় এক বাটি ঝাল মাংস পাতে ঢালতে ঢালতে উনি বললেন, বুঝলেন শামসু ভাই, বয়স হয়েছে তাই আগের মতো অতো খেতে পারি না।

বিরক্ত হয়ে মনে মনে বললাম, আল্লাহ্ রহম করেছেন, নইলে সব মাংস আপনিই সাবাড় করতেন।

এরই মধ্যে এক ইয়ো ইয়ো টাইপের ছেলে এসে বললো, হেই ব্রো মে আই সিট হেয়া’র?

খেয়াল করে দেখলাম, ছেলেটার গলায় মোটা মোটা চেইন ঝুলানো, ঢিলে ঢালা কাপড়। ওর চুলের অবস্থা অনেকটা ঘোড়ার লেজের মতো। চুলের বিভিন্ন স্থানে সাদা এবং লাল রং করা হয়েছে। মাথার চারপাশে চুল নেই, তালুর দিকে গোল করে চুল রাখা। কোন সুস্থ স্বাভাবিক মানুষকে এই হেয়ার কাটিং করাতে চাইলে তাকে টানা এক মাস, তিন বেলা করে পশ্চাতদেশে বেত্রাঘাত করতে হবে। তবে যদি সে রাজি হয়।

আমি উত্তরে বললাম, জ্বি ভাই অবশ্যই বসতে পারেন। বান্দা বসতে গিয়ে, পাশে বসে থাকা আন্টিকে ইংরেজী উচ্চারণে বললো, হেই ব্রো, আপনি কী একটু সরে বসবেন?

ইয়ো ইয়োর কথা শুনে আন্টি গেলেন রেগে। বললেন, চুপ ফাজিলের ফাজিল। এই আমারে কী তোর ছেলে মনে হয়? আমি তোর কোন জনমের ‘ব্রো’ ছিলাম। চড়াইতে চড়াইতে মাথার চুল যেগুলো বাকি আছে সেগুলোও ফেলে দিবো!

চড় খেয়ে গাল লাল হওয়ার ব্যাপারে শুনেছি, কিন্তু চুল পড়ে যাওয়ার ব্যাপারে শুনি নি। ব্যাপারটা এখানে ঘটলে মন্দ হতো না, পৃথিবীর নতুন এক ইতিহাসের প্রত্যক্ষ সাক্ষী হতে পারতাম!

আমি মিন মিন করে আন্টিকে বললাম, দুই-একটা দিবেন নাকি? চড় দিলে কীভাবে চুলের পতন ঘটে, ব্যাপারটা বড্ড দেখতে ইচ্ছে করছে।

আন্টি ধমকের স্বরে বললেন, শোন শামসু মিয়া, ফাজলামি করবা না। খাবারের সময় ফাজলামি আমার একদম পছন্দ না।

আন্টির ধমকে আমি একদম চুপ হয়ে গেলাম। এবং অবশ্যই ইয়ো ইয়ো ছেলেটাও চুপচাপ তার সিটে বসলো। কেউ কোন কথা বলছে না। টেবিলে একটা থমথমে পরিবেশ।

ঠিক তখন-ই সব নিরবতা ভেঙ্গে একটা মেয়ে হাসি মুখে বললো, আমি কী এখানে বসতে পারি?

মেয়েটার দিকে তাকাতেই বুকে ছোটখাটো একটা কাল-বৈশাখী বইলো। মেয়েটার হাসি অতিরিক্ত সুন্দর। এক কথায় বলা যেতে পারে ‘সুস্মিতা’।
বয়স অনুমান করতে পারছি না। সবচেয়ে বেশি দুর্বল হলাম তার আধ-খোলা চুল দেখে। এত দীঘল কালো কেশ গত এক দশকে দেখছি বলে মনে পড়ছে না!

উত্তরে বলতে ইচ্ছে হলো, বসতে পারেন মানে! কোথায় বসতে চান তাই বলুন। আপনার জন্য হৃদয়ের মসজিদ, মন্দির, গির্জা সব খোলা আছে। প্রয়োজনে কমিউনিটি সেন্টারের সবাইকে উঠিয়ে আপনাকে বসাবো। প্রয়োজনে ঢাকা শহরের সমস্ত কমিউনিটি সেন্টার আজ খালি করা হবে!

মেয়েটা আবার বললো, এই যে আমি কী বসতে পারি?

আমার ঘোর কাটলো। বললাম, হ্যাঁ হ্যাঁ অবশ্যই।

এতক্ষণ খাবার তদারকি করছিলাম।
এবার নিজেই মেয়েকে খাবার পরিবেশন করা শুরু করলাম। এতক্ষণ অবধি যা অসহ্য লাগছিল সব কেমন যেন ভালো লাগতে শুরু করলো। আহারে মেয়েটা যদি সারাজীবন আমায় ‘শামসু’ বলেও ডাকে তবুও কিছু মনে করবো না। হঠাৎ করে মনে দমকা হাওয়া লাগলে যা হয় আর কি!

এর মধ্যে খেয়াল করলাম পেটমোটা আঙ্কেল একটা হাড়ের টুকরো থেকে মাংস ছাড়াবার জন্য প্রাণপণে চেষ্টা করছেন। কিন্তু সফল হবেন বলে মনে হচ্ছে না। এক পর্যায়ে হাত ফসকে সেই টুকরো ছুটে গিয়ে পড়লো ইয়ো ইয়ো ছেলেটার সাদা টি-শার্টে। তরকারীর ঝোল তার সাদা টি-শার্টে শৈল্পিক ভাবে ছড়িয়ে গেল। দৃশ্যটা খারাপ হলেও, ডিজাইন অতোটা খারাপ হয় নি!

টেবিলের সবাই খাওয়া থামিয়ে ছেলেটার দিকে হা করে তাকিয়ে রইলো।
কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার হলো, আঙ্কেলের খাওয়া তখনও থামে নি। উনি আরো একটা মাংসের টুকরো মুখে পুরে দিয়ে ইয়ো ইয়ো ছেলেটাকে বললেন, কিছু মনে কইরো না বাবা, খাইতে গেলে টুকটাক এমন হয় ই, এই হইলো খাওনের নিয়ম!

ছেলেটা থতমত খেয়ে বললো, হেই ইয়ো, হোয়াট হ্যাভ ইউ ডান ম্যান। হোয়াট দ্যা….

পুরো কথা শেষ করার আগেই সে দ্রুত ওয়াশরুমে চলে গেল। সবাই মুখ টিপে হাসাহাসি শুরু করলো। মেয়েটাও মাথা নিচু করে সরল নিয়মে হাসছে। আমি তার দিকে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে আছি। আহারে ও যদি একবার শামসু বলেও ডাক দিত! আমার জীবন হতো স্বার্থক। হুট করেই মেয়েটার চোখে আমার চোখ পড়লো, সে সাথে সাথে লজ্জায় তার চোখ সরিয়ে নিল।

আমার এই রোমান্টিক সীনের অবসান ঘটলো। ইয়ো ইয়ো ছেলেটার এক ভয়ংকর কাণ্ডের মাধ্যমে! সেই রাগী আন্টি সেলফি তুলছিল, ছেলেটা ফিরে এসে তার চেয়ার টেনে বসতে গিয়ে, আন্টির গায়ে খানিকটা ধাক্কা খেল। হাত ফসকে আন্টির ফোন পড়লো ডালের বাটিতে। ডালে এবং ফোনে একদম মাখামাখি অবস্থা।

ছেলেটা ভয়ে ভয়ে বললো, হেই সরি ব্রো, আই ডোন্ট ডু দেট ইনটেনশনালী।

আন্টি রেগে অগ্নিমূর্তি হয়ে গেলেন। ইয়ো ইয়ো- কে এলোপাথাড়ি কিল-ঘুষি মারতে মারতে বললেন, তোর ব্রো গিরি আমি ছুটাইতেছি, হারামী এখন এই মূহুর্তে আমার ফোন ঠিক করে দিবি।

ছেলেটা কী করবে বুঝতে পারলো না। অতি দ্রুতই সে গাধার মতো একটা কাজ করে বসলো। আন্টির ফোন যত্নসহকারে পানি দিয়ে ধুয়ে আনলো। সমস্যা বাড়লো। প্রথমে যাও ফোন চলছিল এখন পানি ঢুকে একেবারেই ফোন বন্ধ হয়ে গেল।

আন্টির রাগ আগের চাইতে ও বাড়লো। তিনি আবারও ইয়ো ইয়ো ছেলের দিকে তেড়ে গেলেন। হুলস্থুল কান্ড। আমাদের সব আত্মীয়-স্বজন টেবিলের দিকে এগিয়ে আসলেন। বুঝতে পারলাম অবস্থা নিয়ন্ত্রণের বাইরে। টেবিলের বাকি সদস্যরা যে যার মতো উঠে চলে যাওয়া শুরু করলো।

কিন্তু তার চাইতেও ভয়ংকর ব্যাপার হলো ঐ পেটমোটা আঙ্কেল তখনও খেয়ে যাচ্ছেন। উনার কথা হলো, ভূমিকম্প, সিডর, আয়েলা যাই হোক না কেন, খাওয়া থামানো যাবে না। কোন প্রকারেই না!

খেয়াল করলাম মেয়েটাও চলে যাচ্ছে। ঝগড়া থামাবো নাকি মেয়েটার পিছু নেব বুঝতে পারছিলাম না। হঠাৎ-ই আমার মস্তিষ্কে শুদ্ধ ও মূল্যবান একখানা চিন্তার উদয় হইলো। ভাবলাম জীবন ঝগড়া থামানোর সুযোগ বহু আসবে, কিন্তু মেয়েটাকে হারিয়ে ফেললে আর কখনোই খুঁজে পাবো না।

মেয়েটার পিছু নিলাম। কিছুদূর যেতেই সাহস করে বললাম, এই যে শুনছেন?

মেয়েটা নরম কন্ঠে বললো, হ্যাঁ বলো!

ঠিক তখন মাথার মধ্যে কেমন যেন একটা ‘হ য ব র ল’ অবস্থা কাজ করল।
আমি হাসির প্রশংসা করতে গিয়ে করলাম চুলের প্রশংসা। গড়গড় করে বললাম, আপনার চুল বয়স্ক রাতের অন্ধকারের মতো কালো, আমাজনের অজগরের মতো লম্বা। এমন চুল যাদের থাকে তাদের বলা হয় ‘তিমিরকুন্তলা’। এই চুলের সাগরে যে কোন প্রণয় নাবিক হুট করে ডুবে যেতে পারে। সাবধানে থাকবেন!

কথাটা বলেই বোকার মতো তাকিয়ে থাকলাম। উত্তরে মেয়েটা দেড় মিনিটের মতো কিছুই বললো না। শুধু আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলো। আহা হাসি! আমার ভেতরে ভেতরে খানিকটা ভয়ও লাগলো, বেশি উল্টাপাল্টা কিছু বলে ফেললাম নাকি!

সবশেষে মেয়েটা যা বললো তা হলো,
ইয়ে মানে ‘অন্তু’ তুমি আমায় চিনো না হয়তো, তোমার মা আমার দুঃসম্পর্কের বোন হন! আর আমি তোমার খালা! তবে তোমার প্রশংসায় আমি মুগ্ধ হয়েছি। অনেক ধন্যবাদ। ভালো থেকো।

গল্পের বিষয়:
রোমান্টিক
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত